#রুপকথার_খোঁজে
#২য়_পর্ব

রুহামা কথাগুলো বলেই ঘুরে দাঁড়ালো। আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তখনই নজরে পড়লো আকরাম তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। আকরামের চোখজোড়া রক্তিম হয়ে আছে। চোখজোড়ায় চোখ রাখতে ভেতরটা কেঁপে উঠলো রুহামার। কিছু বলবে তার আগেই আকরাম হনহন করে এগিয়ে এলো তার এবং সাঈদের দিকে। আকরাম উপর থেকে কখন ফিরে এসেছে জানা নেই তার, কথা বলার সময় পারিপ্বার্শিক জ্ঞান ছিলো না রুহামার। এই কথোপকথনের ঠিক কতটুকু আকরাম শুনেছে তার জানা নেই, তবে আকরামের মুখভাবে ভালো কিছুর আভাস পেলো না রুহামা। বরং ঈষৎ ভয় তাকে নাড়া দিচ্ছে। ভয় পাবার কোনো কারণ অবশ্য নেই, সাঈদের সাথে তার কথোপকথন অমার্জিত বা সন্দেহজনক ছিলো না। কিন্তু ওই যে, একটা তিক্ত শব্দ ‘প্রাক্তন’ জড়িয়ে আছে সাঈদের সাথে। সুতরাং আকরাম ক্রোধিত হলেও অনুচিত হবে না। রুহামা একবার সাঈদের মুখের দিকে তাকালো, সে ঘেমে নেয়ে একসার হয়ে আছে। মাঘের প্রচন্ড শীতেও তার কপালে ঘামের পরদ। রুহামা মনে মনে আকাশকুসুম চিন্তা করতে ব্যাস্ত, ঠিক তখনই তাকে অবাক করে আকরাম একটা ফোন সাঈদের দিকে এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
“এই যে তোমার জিনিস, সামলে রাখো। বলা যায় না কখন হাতছাড়া হয়ে যায়”

আকরামের ছন্নছাড়া কথার কি মানে বুঝলো সাঈদ জানা নেই, তবে সে একরকম সালাম দিয়েই ছুটে পালালো। সাঈদ চলে যাবার পর আকরাম এক মূহুর্ত সেখানে দাঁড়ালো না, হনহন করে লিফটে উঠে পড়লো। রুহামাও পিছু নিলো। আড়ষ্টতায় জবুথুবু হয়ে রয়েছে সে। আকরামের থমথমে মুখখানা আরো বেশি অস্বস্তিতে ফেলছে তাকে। তার মুখে একটা কথাও নেই, সে শুধু লিফটের নাম্বারপ্লেটের দিকে চেয়ে আছে, পূর্বের ন্যায় ই তার চোয়াল শক্ত। কিভাবে কথাটা পাড়া যায় বুঝে উঠতে পারছে না রুহামা। হুট করেই তো বলা যায় না ‘আপনি কি সব শুনে ফেলেছেন?’। তাহলে প্রমাণিত হবে চোরের মন পুলিশ পুলিশ। কিন্তু রুহামা তো চোর নয়, সে চুরি করতে চাও না। লিফট থামলো গন্তব্যে। দরজা খুললো, রুহামা বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলেই আকরাম চাপা স্বরে বললো,
“স্ত্রীদের কিছু জিনিস মস্তিষ্কে রাখা উচিত, যতই হোক তাদের স্বামীর সম্মান জড়িত থাকে তাদের কাজের সাথে”

আকরামের শীতল রোষাগ্নিতে মেশানো কথাটা শুনে রুহামা থমকে গেলো। সে অবাক নয়নে তাকালো আকরামের মুখশ্রীর দিকে। আকরাম কি তবে তার এবং সাঈদের কথোপকথন শুনে তাকে ভুল বুঝলো! রুহামা কিছু বলার আগেই আকরাম লিফট থেকে বেড়িয়ে গেলো। হনহন করে বাসায় প্রবেশ করলো সে। রুহামা একটা ছোট নিঃশ্বাস গোপন করে নিলো, মনে মনে স্থির করলো আকরামের সাথে আর লুকোচুরি নয় এবার সরাসরি ই কথাগুলো বলবে সে।

রাতের খাওয়া দাওয়ার পালা শেষ। আদিবা বারবার তার বা হাতের অনামিকার দিকে তাকিয়ে আছে। মনের মাঝে হাজারো প্রজাপ্রতি ডানা মেলেছে তার। সাঈদ নামক ব্যাক্তিটিকে বেশ মনে ধরে এই বাইশ বছরের মেয়েটির। রুহামা ননদের এরুপ কাজ দেখে কেবল ই হাসে। মেয়েটার প্রসন্ন মুখখানায় এক শীতল শান্তি আছে। বিয়ের পর থেকে এই মেয়েটির সাথেই বেশ ভালো বোঝাপড়া হয়েছে তার। সমবয়সী হবার দরুন তাদের চিন্তাধারাগুলোর বড্ড মিল। মন খুলে মেয়েটির সাথে কথা বলা যায়, হাসা যায়, আবার মন খারাপ হলে তার কাছে কাঁদাও যায়। আদিবা অজান্তেই রুহামা সখীতে পরিণত হয়েছে। নিজের ছোট বোনের ন্যায় তাকে সোহাগ করে রুহামা। সেইজন্য ভয়টা বেশি। যদিও এই বিয়েটা পারিবারিক সম্মতিতে, এখানে অনেক মানুষের পছন্দ, অপছন্দ জড়িত। তবুও ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়। রুহামা মনে মনে ঠিক করলো সে আকরামের সাথে কথা বলবে। বিয়ে তো হাজার বার হবে না, একবার ই হবে তাই ভেবেচিন্তে আগানো বুদ্ধিমানের। আকরাম আদিবার অভিভাবক। তাই তাকে জানিয়ে রাখলে সে উচিত সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

নিজ ঘরে আকরাম ফাইলপত্র নিয়ে বসেছে। মিরপুর তফসিল অফিসের রেজিস্টার সে। তার বন্ধুর একটা জমির কিছু কাগজে ঘাপলা হয়েছে। বন্ধু হিসেবে তাকে সাহায্য করা আকরামের দায়িত্ব কিন্তু তাকেও অনেককিছু মেপে কাজ করতে হয়। একটা ভুল সই জীবন দূর্বিষহ। এর মাঝেই রুহামা দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে। শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বিছানায় বসলো সে। আকরাম আড় চোখে এক নজর তার পানে চাইলো। তারপর আবার ফাইলের কাজ করতে লাগলো। রুহামা একটু রয়ে সয়ে বললো,
“ঘুমোবে না?”
“ঘুম আসলে ঘুমাবো”

আকরাম পুনরাম ঈষৎ ঝাঁঝ মিশিয়ে উত্তর দিলো। রুহামা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো, শব্দগুলো কিভাবে উপস্থাপন করবে সাজিয়ে নিলো। তারপর বললো,
“সাঈদ নামক ছেলেটিকে তুমি কবে থেকে চেনো?”

রুহামার প্রশ্নে ফাইল থেকে মাথা তুলে চাইলো আকরাম। তার ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে এক বিন্দুতে মিলিত হয়েছে, সন্দিহান দৃষ্টি তাক করে আছে। অন্য সময় হলে রুহামা কথা এগোতো না, কিন্তু আজ না আগিয়ে পারছে না। আদিবার ভবিষ্যতের কথা। রুহামা থেমে থেমে বললো,
“আসলে বিয়ে সাদীর ব্যাপার, একটু খতিয়ে না দেখলে পরে আফসোসের সীমা থাকে না। তাই জিজ্ঞেস করছিলাম”
“আদিবার কথা তুমি ভাবো?”
“এ কেমন অবান্তর প্রশ্ন, না ভাবার কি রয়েছে? সে আমার ননদ। আমি ছোট বোনের মতো তাকে স্নেহ করি”

রুহামা খানিকটা অধৈর্য্য হয়েই উত্তর দিলো। আকরাম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। তারপর ফাইল গুলো নামিয়ে বিদ্রুপের স্বরে বলল,
“এতোই যখন ভালোবাসো তবে আমাদের কাছে ব্যাপারটা লুকালে কেনো?”
“কি লুকোলাম?”
“এই যে তুমি সাঈদকে চেনো, শুধু চেনো তাই নয় বেশ গভীরভাবে চেনো। কি জানে বলছিলে, অতীতের ভুল না কি যেনো। শোনো রুহামা, আমি অবুঝ নই। আমি ব্যাপারগুলো বুঝি। তবে তুমি এখনো অতীত নিয়েই হা হুতাশ করবে জানা ছিলো না। বসার ঘরে আংটি পড়াবার সময়ও তুমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলে। আমার এই কানের কাছের চুল এমনেই রোদে পাকে নি। আমি তোমাদের মতো ধুর্ত মানুষদের চড়িয়েই আয় করি। মানুষ কতোটা ধুরন্দর আমি জানি। তাই তোমাকে আবারো বলছি, আমার স্ত্রী হিসেবে আমার সাথে তোমার নামটা জড়িয়ে আছে। যা করবে ভেবে করবে। অবশ্য তোমার মতো বাচ্চা মেয়ের কাছে কি বা আশা করা যায়।”

আকরামের গম্ভীর কন্ঠের কথাগুলো কেনো যেনো অপমানের চেয়ে দুঃখ বেশি দিলো। বুকে বিষাদের জোয়ার বয়ে আনলো এই ক’টা কথা। আকাশ পাতাল ভেঙ্গে কান্না চোখের কাছে এসে ভিড় জমালো। অবশেষ কি না মানুষটা তাকে ভুল বুঝলো। রুহামার কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কন্ঠে দলা পাকানো কষ্ট এসে জানান দিচ্ছে। কিন্তু ছেলেমানুষের মতো কাঁদবে না সে। আকরামের ভুল ভাঙ্গানো বেশি জরুরী এখন। বেশ কষ্টে কান্না রোধ করে বললো,
“আপনি আমায় ভুল বুঝছেন, আমি এমন কোনো কাজ করি নি যা আপনার সম্মানে আঘাত হানে। হ্যা, সাঈদের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো। কিন্তু তা বছর পেরিয়েছে। তার প্রতি আমার কোনো অনুভূতি নেই। যা আছে তা শুধু কিছু ক্ষত, কিছু আক্ষেপ, কিছু প্রিয় অপ্রিয় ঝাপসা স্মৃতি। যতই হোক অবুঝ মনটা ভালোবেসেছিলো একটা সময়। তবে এতোটা দূর্বল নই যে মরীচিকার পেছনে ছুটবো। আপনার সাথে আমার বিয়ের সত্যতাটাকে অস্বীকার করবো। আমি চিন্তিত আদিবাকে নিয়ে। মেয়েটি সাঈদকে পছন্দ করে। মানুষ একবার যা করে পুনরায় সেই কাজটা করার প্রবৃত্তি থাকে। সাঈদ আমাকে হুট করেই তার জীবন থেকে বিলীন করে দিয়েছিলো। তাই সে যে আদিবার সাথে এমন কিছু করবে না, সেই চিন্তাটাই আমার ভেতরে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে। জানি আপনার পছন্দের উপর আংগুল তুলছি। কিন্তু এটা সারাটা জীবনের ব্যাপার। এখন বাকিটুকু আপনার ইচ্ছে।”

অনেকগুলো কথা বললো রুহামা। তার ভেতরটা তীব্র যন্ত্রণায় ছেয়ে গেছে। আকরাম নামক গম্ভীর মানুষটার চোখে নিজের প্রতি অবিশ্বাস সহ্য হলো না তার। সে তড়িৎ গতিতে বাথরুমের দিকে চলে গেলো। আকরামের সামনে কাঁদতে বড্ড লজ্জা লাগছে। আকরাম কিছু বললো না। শুধু একরাশ চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে রইলো সে।

মুখ হাত ভালো করে ধুয়ে আকরামের পাশেই শুয়ে পড়লো রুহামা। আকরাম তার ফাইল দেখার কাজ চালিয়ে গেলো। রুহামা দ্বিতীয়বার তাকালো না আকরামের দিকে, মাথা ব্যাথা করছে। কান্না করলেই তার মাথা ব্যাথা করে। তখন বড্ড ঘুম পায়। তাই মিনিট বিশেকের মাঝেই তলিয়ে পড়লো সে ঘুমে। গভীর রাতে অনুভব করলো একজোড়া পুরুষালী হাত তাকে শক্ত করে বেষ্টনীবদ্ধ করে রেখেছে। রুহামা চোখ খুললো না, এই হাতজোড়া কার সেটা যে তার জানা__________

তিনদিন পর,
বিকালে,
আদিবার মাথা আছড়ে দিচ্ছিলো রুহামা। মেয়েটা বড্ড আলসে, কিছুতেই চুল বাধতে চায় না। দু দিন পর বিয়ে হবে এখন এতো গা ছাড়া দিলে হয়। এই তো রুহামা দিব্বি একা হাতে সংসার সামলাচ্ছে, হ্যা সে নিপুন নয় তবে একেবারে আকাম্মা নয়। প্রতিদিন ভুল করে আবার শিখে। এভাবেই এই দু মাস কেটেছে তার। এর মাঝেই কলিংবেল বাজে। আদিবাকে বসতে বলে নিজেই উঠে যায় রুহামা। দরজা খুলতেই হনহন করে ঘরে ঢুকে আকরাম। আকরাম এতো তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে না। ফিরতে ফিরতে সাতটা বাজে। কিন্তু আজ ব্যাতিক্রম। উপরন্তু তার মুখ লাল হয়ে আছে। যেনো একদলা অগ্নিলাভা সে নিজের ভেতর আটকে রেখেছে। সুমাইয়া বেগম ছেলেকে দেখে রুহামাকে বললো,
“বউ মা, ওকে পানি দাও। কেমন হাপাচ্ছে দেখো”

রুহামা বিলম্ব করলো না, পানি নিয়ে আসলো তখনি। আকরাম এবার মুখ খুললো, কিন্তু যা বললো তার জন্য সুমাইয়া বেগম প্রস্তুত ছিলেন না,
“সাঈদের মাকে ফোন করে জানিয়ে দাও মা, এই বিয়ে হবে না…………………

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here