#রজনীগন্ধা
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
#পর্ব_৩
‘আপনি আমাকে এত ভয় পান কেন? আমি কী ভূত? একটু ইজি হওয়ার চেষ্টা করুন। নইলে দেখা যাবে, কোনদিন আবার হার্ট অ্যাটাক করে বসে থাকবেন।’ বলতে বলতে ঠোঁটের কোণায় হাসি ফুঁটে উঠে আদ্র’র। রজনী লজ্জা পেয়ে গেল। সে মাথা নিচু করে নিজেও অল্প একটু হাসে। বলল, ‘এভাবে নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ালে যে কেউই ভয় পাবে তো।’
–‘আপনার মতো এত ভয় কেউ পাবে না। বি ইজি..’
রজনী জবাব দেয় না। আদ্র একনজর ঘুমন্ত অর্থির মুখপানে তাকায়। তারপর বলল, ‘এদিকে আসুন।’
আদ্র রুম ছেড়ে বের হয়। পাশেই অন্য আর একটি রুম, এটা সোফাঘর। আদ্র সোফায় গিয়ে বসল। রজনী তার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
–‘বসুন।’
রজনী মিনমিনিয়ে বলার চেষ্টা করল, ‘আমি দাঁড়িয়েই থাকি।’ কিন্তু কোনো এক কারণ বশত বলতে পারল না। তার গলা দিয়ে জড়ানো কিছু শব্দ বের হয় কথার পরিবর্তে। আদ্র বলল, ‘কিছু বললেন?’
–‘জি না।’ চট করে মিথ্যে জবাব দিয়ে একটা সোফায় বসে পড়ল রজনী। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল। আদ্র’র সাথে এই জড়তা তার কাটাতেই হবে। যেহেতু এই বাসায়ই থাকবে সে।
আদ্র বলল, ‘আপনি বলেছিলেন, আমার বাসার চাকর হতেও রাজী। তাই না?’
–‘জি।’
–‘আপনাকে আমি চাকর হিসেবে রাখিনি। আমার মেয়ের বন্ধু হিসেবে রেখেছি। বর্তমান যে ন্যানি আছে, তাকে আমার মেয়ে বিশেষ পছন্দ করে না। জানি না কেন। বাচ্চাদের তো সবাইকে ভালো লাগে না তাই না? ওর আপনাকে ভালো লেগেছে। তাই আজকে থেকে আপনার দায়িত্ব, চব্বিশ ঘণ্টা অর্থির সঙ্গে থাকা। ওর সঙ্গে খেলা, ওকে হাসিখুশি রাখা। ওর সব আবদারগুলো পূরণ করা। এক কথায়, ওকে একটু মায়ের ভালোবাসা দেওয়া। শিশুকালে একটি সন্তানের মায়ের ভালোবাসা প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে আমার মেয়ে এই আদর, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত। আমি যতই ভালোবাসি না কেন, মায়ের স্নেহ তো মায়ের স্নেহই। সেটা কখনোই আমি দিতে পারব না। তার উপর থাকি সারাদিনই ব্যস্ত। এখন আমার হলিডে, তাও আজকে হলিডের লাস্ট দিন। আবার কালকে থেকে ব্যস্ত ঘোড়ার মতো ছুঁটতে শুরু করব। অর্থি একা থেকেই বড় হয়েছে। চারপাশের এত মানুষও ওর একাকীত্বের দেয়াল ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনি। আমি চাই, সেই দেয়াল আপনি ভাঙার চেষ্টা করুন। পারবেন, আমার মেয়েকে ভালোবাসতে? ওর বন্ধু মা হতে?’
কথাগুলো বলার সময় রজনী খেয়াল করল,এক অন্য রকম বিষাদের ছায়া আদ্র’র চোখেমুখে খেলা করছে। আদ্র মানুষটাকে মিডিয়ার সবাই সুখী মানুষ নিক নেইমে ডাকে। কারণ চব্বিশ ঘণ্টা এই মানুষের ঠোঁটে ঝলমলে হাসি। বোঝার উপায়ই নেই, এই লোকের হাসির আড়ালে কতবড় দুঃখের পাহাড় লুকিয়ে! রজনীর খারাপ লাগে আদ্র’র জন্য। আবার ভালোও লাগে.. অর্থির বন্ধু মা হওয়ার প্রস্তাবের জন্য। সে পারবে, খুব পারবে.. একজন নিঃসন্তান নারীই পারে যেকোনো সন্তানকে নিজের ভেবে ভেতরের ভালোবাসার সবটুকু নিংড়ে নিংড়ে দিতে। রজনীও পারবে।
রজনী হাসিমুখে মাথা নাড়িয়ে জবাব দিল, ‘আমি পারব। আপনি কোনো চিন্তাই করবেন না।’
–‘থ্যাংকস। অর্থির বন্ধু মা হওয়ার জন্য আপনি এখানে থাকা খাওয়া বাবদ মাসে…’
আদ্র’র কথা শেষ হয় না, অর্থি বলে উঠল, ‘না, না। আমাকে এসব বলে ছোটো করবেন না। আপনি জানেন না, আমি কতটা বিপদের মধ্যে ছিলাম। মাথায় এত পরিমাণে প্রেশার ছিল যে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি লোড না নিতে পেরে। সেই প্রেশার থেকে, বিপদ থেকে আপনি আমায় মুক্ত করেছেন। মাথার উপর ছাদ দিয়েছেন, পেটে ভাত দিয়েছেন। আর কোনো চিন্তা নেই আমার। যেই জাহান্নামে ছিলাম, সেখান থেকেও মুক্তি পেয়েছি আমি- আলহামদুলিল্লাহ। আমি এমনিতেই আপনার উপর ঋণী। সেই ঋণ টুকু যদি অর্থি মামনীর বন্ধু মা হয়ে শোধ করা যায়, তাহলে আমি তা অবশ্যই করব। খুব ভালো করে করব। আমাকে থাকতে আর খেতে দিলেই চলবে। আলাদা কোনো টাকাপয়সার প্রয়োজন নেই স্যার।’
আদ্র অবাক হলো। কিন্তু সেটা প্রকাশ করল না। ভাবল, এই মেয়েকে সরাসরি টাকা দিলে হয়তো সে নিতে মানা করে দিবে। একে অন্য উপায়ে টাকাগুলো দিতে হবে।
আদ্র ভাবনার গতিপথ থামিয়ে বলল, ‘আপনার গল্পটা জানতে চাই। সমস্যা আছে?’
রজনী দুই সেকেন্ড ভেবে বলল, ‘না স্যার।’
–‘শুনুন, কিচেনে চলে যান। অন্তরাকে বলবেন, দুই কাপ কফি দিতে এক্ষুনি। কফি নিয়ে ছাদে চলে আসুন। ছাদের খোলা বাতাসে বসে আপনার গল্পটা শুনবো। পারবেন তো?’
–‘পারব।’ রজনী হাসে। মানুষটা রসিকও বটে।
অন্তরাকে বলামাত্র সে দুই কাপ কফি তৈরি করে দিল। হয়তো আগে থেকেই সব রেডি করা ছিল। রজনী একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এই মেয়েটা তাকে তেমন একটা পছন্দ করছে না। কেমন যেন আচরণ… রজনী কিছু বললে জবাব দেয় না। দ্রুত রজনীকে বিদায় করতে চায়। রজনীকে দেখলেই কপালের চামড়া কুঁচকে ফেলে, চোখমুখ দেখলে মনে হয় অমাবস্যার অন্ধকার নেমে এসেছে! রজনী পাত্তা দিল না। হয়তো সে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে দেখেই তাকে কেউ পছন্দ করছে না। নাহ, ভুল বললাম। সবাই-ই তাকে পছন্দ করেছে, অন্তরা বাদে।
রজনী ধীর পায়ে ছাদের দিকে পা বাড়াল। যাওয়ার এক ফাঁকে অর্থির ঘরেও উঁকি মারল, অর্থি ঘুমাচ্ছে। রজনী দরজাটা ভেজিয়ে দিল। তারপর ছাদে গেল।
ছাদটা বেশ পছন্দ হলো রজনীর। ভীষণ সুন্দর, খোলামেলা আর বড়। চারপাশে স্টিলের ডিজাইনার রেলিং দেওয়া। রেলিং এর সঙ্গে ঘেঁষে আছে সারি সারি টব। সব টবে ফুলের গাছ। ফুলে ফুলে ছেয়ে আছে পুরো ছাদ। দেখলে ছোট খাটো বাগানের মতো লাগে। একপাশে ঘাস কার্পেট লাগানো, দোলনাও আছে। নিশ্চয়ই অর্থির জন্য। একটা কাঠের বেঞ্চ আছে। মধ্যিখানে সিমেন্টের বড় ছাতা, ছাতার নিচে গোল টেবিল, বেতের চেয়ার। একটা চেয়ারে বসে রয়েছে আদ্র সাহেব।
রজনীর চোখ তার চোখের সঙ্গে এক হয়। সে রজনীর দিকেই চেয়ে ছিল। রজনী দ্রুত চোখ সরিয়ে লজ্জায় নতজানু হয়ে পড়ল। আদ্র বলল, ‘ছাদ দেখা হলে একটু জলদি আসুন ম্যাডাম। আমার হাতে বেশি সময় নেই।’
রজনী ঠোঁট টিপে হাসি আঁটকালো। আদ্র সাহেবকে যত দেখছে, ততই ভালো লাগছে। অসাধারণ একজন মানুষ। ভেতরে এক বিন্দু অহংকার নেই! কোথাকার কোন মেয়ে রজনী, তার সঙ্গে একসাথে বসে কফি খাবে আবার গল্প শুনবেন। আজব না হলে এমনটা কেউ করে? এই লোকের মাথা ঠিক আছে তো?
রজনী গিয়ে একটা চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসল। একটা মগ আদ্র’র দিকে বাড়িয়ে দিয়ে, অন্য মগে নিজে এক চুমুক দিল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘আমার বিয়েটা হয় বেশ নাটকীয় ভাবে। অবশ্য পালানোর বিয়ে যে নাটকীয় হবে,এতে সন্দেহ নেই। তবে আমারটা বোধহয় একটু বেশিই নাটকীয়। নাটকীয় কেন বললাম শুনুন, অভি আর আমার সম্পর্কের মাত্র এক সপ্তাহ চলছিল, ও আমাকে হুট করে বলে বসল, আমাকে এক্ষুনি বিয়ে করবে। আমি তো অবাক, এভাবে বললে বিয়ে হয় নাকি? একটা প্ল্যানিং আছে না? আর তখন চলছে মাত্র এক সপ্তাহ। তাকে কতটুকুই বা চিনি আমি? অভিকে কোনো ভাবেই বোঝাতে পারলাম না। তার এক কথা, সে আমাকে এক্ষুনি বিয়ে করবে, নইলে তার লাশ দেখব আমি। হেন তেন.. আমি ভয় পেয়ে গেলাম। বললাম, আচ্ছা করব। চলো। সে আমাকে তৎক্ষনাৎ একটা মসজিদে নিয়ে গেল। বলে রাখি, মসজিদটা তার পরিচিত ছিল। আমি জানতাম না। সেই মসজিদে আল্লাহর কালাম মতো আমাদের বিয়ে হলো। তখন বাজে সকাল দশটা। আমি সেদিন কলেজের নাম করে বেরিয়েছিলাম। দুইটা পর্যন্ত বাইরে থাকতে পারব। ও আমাকে বিয়ের পরপরই এক বন্ধুর বাসায় নিয়ে গেল, আর সেখানে আমাদের প্রথম বাসর হলো।’
–‘বাহ! একদম সিনেমার মতো।’ মাঝদিয়ে বলল আদ্র।
রজনী বলল, ‘হুঁ.. এইজন্যেই তো বললাম, নাটকীয় বিয়ে। যাইহোক, এরপর এভাবে চারমাস পার করি আমরা। ও প্রায় প্রতি সপ্তাহে আমার উপর স্বামীর অধিকার প্রতিষ্ঠিত করত। চারমাস পরের ঘটনা, কীভাবে যেন ওর বাসায় জানতে পারছে, আমার সঙ্গে ওর সম্পর্ক। ওর মা তো কোনোভাবেই আমার মতো মেয়েকে মানবে।না। তাই ওর জন্য ভালো পাত্রী দেখতে শুরু করল।’
–‘আপনাকে না মানার কারণ কী? আপনি তো বেশ সুন্দর।’
রজনী থমকে গেল আদ্র’র এই কথায়। তার কেমন যেন করে উঠল মনের ভেতরে, লজ্জাও পেল খানিক। এই লোকের জন্য কতশত মেয়ে পাগল! আর ইনি কীনা ওকে সুন্দর বলছে? রজনী মনে মনে ভাবে, যদি এই খবর আদ্র’র ক্রাশখোর মেয়েরা জানতে পারে,তাহলে ওকে ক্রসফায়ারেই মেরে ফেলবে বোধহয়। রজনী আনমনে হেসে উঠল।
–‘হাসছেন যে! সত্যি বলছি আপনি সুন্দর। হ্যাঁ, এখন বলবেন যে নায়িকারা কত সুন্দর, আর আমি আপনাকে সুন্দর বলে আপনার ইনসাল্ট করছি! আরে শুনেন, নায়িকাদের পেছনে যত টাকা খরচা করা হয়, যত রূপচর্চা করে ওরা, ওরকম আপনি করলে আপনিও ওদের মতো হতে পারতেন। ওদের সৌন্দর্য আর্টিফিশিয়াল। আপনার সৌন্দর্য ন্যাচারাল। আমি বুঝলেন, একদিন এক নায়িকার বাসায় গেছি, বিনা এপোয়েন্টমেন্টে। গিয়ে যা দেখলাম!! ওই নায়িকা যখন শুটিংয়ে আসে, আমি তো ভেবেই পাই না এত ফর্সা চামড়া তার হলো কীভাবে? আর বাসায় গিয়ে দেখি, শ্যামলা রঙের সাধারণ এক মেয়ে। আমাকে বসিয়ে রেখে মেকাপ করতে গেল। তাহলে বুঝেন একবার। এখন তো পারমানেন্ট বডি ফর্সা করার কত লেজার ট্রিটমেন্টও বের হইছে। যাইহোক, আমি যে মিথ্যে বলছি না, আপনি মানছেন তো?’
–‘মানছি।’
–‘থ্যাংকস। এরপর বলুন, কেন মানলো না আপনাকে?’
–‘কারণ আমার বাবা-মা কেউ নেই। ক্লাস টেনে থাকতে বাবা মারা যায়। তার দুই মাস পর মা-ও বাবার শোকে পাড়ি জমায়। আমি থাকতাম আমার দুই ভাইয়ের কাছে। তাদের অবস্থা ততটা ভালো না। তাদের ঘরে আমি চাকরই ছিলাম একপ্রকার। দুই ভাবির কেউই আমাকে সহ্য করতে পারত না। জানি না কেন। কলেজটা সরকারি ছিল দেখে যাও একটু পড়তে পারছি। নইলে তাও পারতাম না। যাইহোক, অভিকে বললাম টেনশন নিও না। তোমার মা তেমন সুবিধা করতে পারবে না। যেহেতু আমরা ম্যারিড। অভি বলল, আমাদের বিয়েটা কালাম মতো হলেও কাগজপত্র নেই।আর কাগজ ছাড়া নাকি বর্তমানে বিয়ের দাম নেই! এইবার আমিও ভয় পেয়ে গেলাম। আসলেই তো.. কী করব? কাগজ করতে না হলেও হাজার তিন টাকা দরকার। পাব কোথায়? এদিকে অভির মা পাগল প্রায়। ছেলেকে আমার বন্ধন থেকে মুক্ত করবেই। বাসায় পারে না আঁটকে রাখে। আমি তখন ভালোবাসায় অন্ধ। অভিকে চাই-ই চাই.. করলাম কী, মা আমার জন্য যেই সোনা টুকু রেখে গেছিল, সেগুলো নিলাম। সঙ্গে দুই ভাবির সব গয়নাগাটিও নিলাম। তারপর আমি আর অভি পালিয়ে যাই। বিয়ে করি। যা টাকা ছিল তা দিয়ে কোনোরকমে থাকা শুরু করি। বিশদিন পর অভির মা আমাদের ঠিকানা খুঁজে বের করে আমাকে সহ নিতে আসলো। ছেলে ছাড়া উনি থাকতে পারবে না। আমি খুশি মনে গাট্টিবোস্তা সব নিয়ে রওনা হই শ্বশুর বাড়ি।’
–‘এরপর নিশ্চয়ই আপনাকে অনেক মেন্টাল টর্চার করছে, রাইট?’
রজনী অবাক গলায় বলল, ‘আপনি বুঝলেন কী করে?’
–‘বাংলাদেশে এগুলো তো কমন!প্রথমে ভালোবাসা দেখিয়ে ঘরে তুলবে। তারপর শুরু হবে আসল অত্যাচার।’
রজনী মলিন ঠোঁটে হাসল, ‘হুম। আমার অবস্থাও সেম। শুধু মেন্টাল টর্চার না, শারীরিক নির্যাতনেরও শিকার হয়েছি।’
–‘বলেন কী!’
–‘হুম। ভাইয়েরাও মুখ ফিরিয়ে নিল। একে তো অভিকে তারা পছন্দ করেনি। তার উপর আমি গয়নাগাটি নিয়ে ভাগছি, তাই রাগ। তারা বাসাবাড়ি ছেড়ে কোথায় যে চলে গেল, আমি জানলাম না। আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। পুরোপুরি বন্দি হয়ে গেলাম ওদের হাতে। যত যাই হতো, আমি কোথাও যেতে পারতাম না বলে ঠোঁট বুজে সব সহ্য করতাম। অভিও আস্তে আস্তে পর হয়ে গেল। পাল্টে গেল।’
–‘হোয়াট এ এসহোল! তারপর?’
–‘কপাল খারাপ থাকলে যা হয় আর কী! অভির সঙ্গে যখন এত ঝামেলা আমার তখন জানতে পারলাম, আমি কনসিভ করতে পারছি না। এতে আগুনে যেন ঘি পড়ল। আমাকে বের করে দেওয়া হলো ওই বাসা থেকে।’
পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে রজনীর চোখের কোণায় অল্প অল্প জল জমে। আদ্র চুপ, নিঃশব্দে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে।
রজনী নিজেকে সামলে নিল দ্রুতই। বাস্তবতা মানুষকে শক্ত হতে শেখায়,আর সেই বাস্তবতা যদি কঠিন বাস্তবতা হয়, তাহলে তো কথাই নেই! রজনী আদ্রকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল, ‘আপনার খাওয়া শেষ?’
আদ্র’র ধ্যান ভাঙে। নড়েচড়ে বসে সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘ছেড়ে দেওয়া অনেক সহজ। আমরা বোকারা শুধু বয়েই বেড়াই।’
–‘আমি কখনো তাকে ছাড়তে চাইনি জানেন। এখনো..’ রজনী থামে, দম নেয়, বলল, ‘এখনো তাকে খুব মনে পড়ে আমার।’
আদ্র হাসল, ‘ বললাম না, বোকারা শুধু বয়েই বেড়ায়। সে চাইলে পারত আপনাকে ভাল রাখতে। শত ঝামেলা থাক, তাও… আমরা চাইলেই কিন্তু অনেককিছু স্যাক্রিফাইস করতে পারি অন্যের জন্য। আপনি যেই মগে কফি খাচ্ছেন, ওটা আমার পার্মানেন্ট মগ। আমি ওটাতে সবসময় কফি খাই। হয়ত অন্তরা আপনাকে বলে দেয়নি, তাই জানেন না বিধায় আমাকে এই মগটা এগিয়ে দিলেন। আমি পারতাম, চাইতে। কিন্তু চাইনি। ভাবলাম, ওই মগটা আপনার বেশি ভালো লেগেছে তাই রেখেছেন। এই যে একটু স্যাক্রিফাইস করলাম, এরকম ছোট ছোট স্যাক্রিফাইস সবাই করতে জানলে জীবনটা অন্যরকম হতো!’
রজনী স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে রইল। একবার মগের দিকে তাকাল, একবার আদ্র’র দিকে। তারপর দ্রুত মগটাকে দূরে ঠেলে রাখলো। নিচু স্বরে বলল, ‘স..স..রি।’
আদ্র দুই গাল ফুলিয়ে হেসে ফেলল, ‘এত ভীতু! আল্লাহ… আপনি না আসলে একটা, কী বলব! আপনাকে দেখলে আমার শুধু হাসি পায়!’
রজনীর ভয় কেটে গেল এক নিমিষে। সে মুগ্ধ চোখে তাকাল। আদ্র হাসছে। তার চোখও হাসছে। এক গালে টোল জেগেছে, কী অপূর্ব!
___________
মাগরিবের অনেক পর অর্থির ঘুম ভাঙলো। সে চোখ মেলতেই দেখল, একজোড়া উৎসুক চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থিকে জাগতে দেখেই রজনী বলে উঠল, ‘অবশেষে উঠলে! কতবার এসে ঘুরে গেলাম।’
অর্থি তার ছোট্ট পাতলা ঠোঁট দুটি মেলে হাসল। তারপর উঠে বসল। রজনী অর্থির পিঠের পেছনে বালিশ রেখে দিল, অর্থি হেলান দিয়ে বসে।
রজনী বলল, ‘আটটা প্রায় বাজতে চললো। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও অর্থি। আমি তোমার জন্য নাশতা আনছি।’
–‘আচ্ছা।’ জবাব দেয় অর্থি। তারপর রজনীর হাত ধরে নেমে পড়ে। রজনী অর্থির ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে দিয়ে অর্থির হাতে ধরিয়ে দিল। অর্থিকে ব্রাশ করে দ্রুত মুখ ধুঁয়ে ফেলতে বলে নিজে চলে গেল কিচেনে, নাশতা আনার জন্য।
অর্থি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখল, রজনী আর অন্তরা দু’জনে কথা কাটাকাটি করছে। অর্থি অবাক চোখ মেলে তাকিয়ে রইল দু’জনের দিকে।
অন্তরা রাগী গলায় বলল, ‘এগুলো মামনী খায় না। মামনীকে সবসময় লাইট টাইপ জিনিস খাওয়ানোর অর্ডার দিয়েছেন স্যার। আপনি এই টাইমে এসব এনেছেন কেন?’
রজনী কাটাকাটা গলায় উত্তর দেয়, ‘এটা লাইট জিনিসই, আর এমন কোনো বিষ না যে মামনীর খেলে ক্ষতি হবে। আর ওর দায়িত্ব স্যার আমাকে দিয়েছেন, সো আমাকেই বুঝতে দিবেন। মামনী এখনো পাঁচ মাসের শিশু না যে তাকে সুজি, ঝাউ এসব খেতে হবে!! এখন থেকে যদি খাওয়ার অভ্যাস না গড়া হয়, তাহলে খাওয়া শিখবে কী করে?’
–‘একদিনে এসে খুব বুঝে গেছেন, আপনি? তাই না?’
–‘হ্যাঁ, বুঝে গেছি। বাচ্চা একটা মেয়ে। ও কী নাটক সিনেমা করে নাকি যে ওকে মেপে মেপে চার্ট মেনে খেতে হবে? এখন ধুমিয়ে খাওয়া দাওয়া করবে। এটাই তো বয়স। হেহ! আসছে… অন্তরা যান তো আপনি। আপনার সাথে আমি ঝগড়া করতে চাই না। আমি আসার পর থেকেই দেখছি, আপনি কোনো কারণবশত আমাকে সহ্য করতে পারেন না।’
–‘হ্যাঁ, পারি না। এই যে ওভার বুঝতেছেন, এই জন্যে আরও পারি না। এই বাসার সবাই কী খাবে না খাবে, কোন খাবার কার জন্য হেলদি, কখন কোন মেন্যু ফলো করতে হবে,এগুলোর সব দায়িত্ব কিন্তু আমার! আমি বাইরের দেশ থেকে এসবের উপর স্টাডি করেছি। আর আপনি কোথাকার কে আসছেন আমাকে শেখাতে?? মামনীর ন্যানিও তো এত বাড়াবাড়ি করেনি কখনো। আপনার এত সাহস হচ্ছে কী করে?’
কথাটা গায়ে লাগে রজনীর।মাথা বিগড়ে যায়। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে দুইটা লাগাতে অন্তরা নামক আপদটার গালে…
সে রাগে ফুঁসে উঠে জবাব দেয়, ‘আমি ওর ন্যানি না। আমি..আমি ওর মা.. ওর বন্ধু মা..’
আদ্র সন্ধ্যার পরে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিল। শরীর ম্যাজ ম্যাজ করছিল তার। কিছুক্ষণ আগেই বাড়িতে আসে। নিচ থেকেই চিল্লাচিল্লির ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, তাই সে উপরে উঠে। আর তখনি রজনীর শেষ কথাটা কানে আসে। আদ্র মনে মনে ভাবে, অর্থির জন্য বন্ধু নির্বাচনে আমি কোনো ভুল করিনি…
চলবে