#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[৩১]

ধীরপায়ে হেঁটে লাল শাড়ি পরিহিত মেয়েটি জায়িদের মুখোমুখি আসল। বলল
‘ আপনি এখানে?
জায়িদ পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করল। বলল,
‘ চিনতে পেরেছ?
কপালের পাশে হাত দিল আনহা। থেমে থেমে বলল,
‘ চিনতে না পারার কি আছে? আপনি পুলিশ!
জায়িদ বলল,
‘ পুলিশ হিসেবেই চিনেছ। গুড জব। যাইহোক, এখানে কি করছ তুমি? তোমাকে সবাই খুঁজছে। আর তুমি এখানে কেন? হসপিটাল থেকে পালালে কেন?
আনহা বলল,
‘ শেষমেশ আমাকে তো এখানেই আসতে হতো অফিসার। আমার বিয়ে হয়েছে। আমি হসপিটালে কি করে গেলাম সেটাই তো বুঝতে পারছিনা। সিফাত কোথায়? ও আমাকে মেরে হসপিটালে নিয়ে গেছে? আপনি কিছু জানেন ও কোথায়?
জায়িদের চোয়াল শক্ত হলো। শক্ত কন্ঠে বলল,
‘ আমি জানিনা। তোমাকে সিফাত নিয়ে যায়নি। কাল তোমার একটা অপারেশন হয়েছে ছোটখাটো। তুমি চ্যাটার্জি পরিবারের সাথে ছিলে এই আড়াই বছর।
আনহা কপাল চাপল আবার। বলল,
‘ আড়াই বছর? কিন্তু সিফাত কোথায়?
জায়িদ বলল,
‘ সিফাতকে দিয়ে তুমি কি করবে? কি করবে তুমি?
আনহার চোখে জল। গাল ভেজা। কান্নামাখা গলায় সে বলল
‘ ও আমার স্বামী অফিসার। যত বড় অপরাধী হোক না কেন, ও আমার স্বামী।
‘ জানোয়ারেরা কখনো কারো স্বামী হতে পারেনা আনহা। তুমি ভুলে গিয়েছ তোমার সাথে কি হয়েছে? ভুলে গিয়েছ?

আনহার চোখের সামনে ভাসল সেই কালোরাতের ঘটনা। চোখের জলের নহর আর ও বড় বড় ফোঁটারূপে গড়াল। কাঁপাকাঁপা কন্ঠে আনহা বলল,
‘ ভুলিনি।
জায়িদ বলল,
‘ তাহলে? তুমি আবার কেন ফিরে এসেছ সিফাতের কাছে? কেন এসেছ?
আনহা তাকাল তপ্ত চোখে। গলায় কাঠিন্যতা ফুটিয়ে বলল,
‘ আমি আপনাকে কেন বলব? কে আপনি?
জায়িদ তোতলালো।
‘ আমি? আমি পুলিশ। পুলিশ অফিসার । তোমার স্বামী অপরাধী মিসেস আনহা। ওকে আমি হাজতবাস করাবো। ফাঁসিতে ঝুলাবো।
আনহার ঠোঁটের কোণায় তাচ্ছিল্যের হাসি।
জায়িদ বলল,
‘ সিফাত কোথায়? সরো।
আনহা আটকালো।
‘ কোথায় যাচ্ছেন আপনি?
জায়িদ বলল
‘ আমাকে আমার ডিউটি করতে দাও আনহা।
আনহা চেঁচালো।
‘ কিসের ডিউটি করছেন? সিফাত কোথাও নেই। ওর খোঁজ নেই। কোনো খোঁজ নেই।
আমি ওর কাছেই এসেছি, ওর সাথে থাকতে নয় ওকে খুন করতে এসেছি। কিন্তু ও নেই। যে বাসায় আমাকে ও পাঁচদিন রেখেছিল সেটা এই বাসা। এখানে সে নেই। অন্যকেউ থাকে৷
জায়িদ বলল,
‘ তাহলে তুমি কি করছ এখানে? এই দুই সপ্তাহ?
আনহা বলল
‘ সিফাত আমাকে যে গহনাগুলো দিয়েছে সেগুলো এই বাসায় ছিল। বাড়িওয়ালা সেগুলো নিজের কাছে রেখেছে, আমি আসায় আমাকে দিয়েছে। আমি সেগুলো বেঁচে এখানে বাসা ভাড়া নিয়েছি৷
জায়িদ বলল
‘ সিফাতের বাড়ির ঠিকানা দাও। তুমি সব জানো।
আনহা সোজাসাপটা বলল
‘ আমি কিছুই জানিনা।
জায়িদ চাপা গর্জন করল।
‘ তুমি সব সবটা জানো।
আনহা সমান তালে চেঁচালো।
‘ আমি কিচ্ছু জানিনা। সিফাত সেদিন বাসায় ফিরে আমাকে সব সত্যি বলবে বলেছিল। আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিল। আর আমি ওকে মারার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু ওর ভাগ্য ভালো ও আর বাসায় আসেনি। ও যখন আর ফিরছেনা তখন আমি নিজেই বাড়িওয়ালার সাহায্য নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। তারপর তেমন কিছু মনে নেই আমার।
জায়িদ আর কিছু বলল না। আনহা বলল,
‘ আপনি চলে যান এখান থেকে। বাড়ির কাউকে কিচ্ছু বলবেন না।
‘ সবাইকে বলে দিয়েছি আমি।
জায়িদ কথা বলা শেষ করতে পারলনা। আনহা চেপে ধরল তার ইউনিফর্মের কলার। দাঁতে দাঁত চেপে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল
‘ কেন বলেছেন? কেন? আমি একা বাঁচতে চাই ৷ একা। আমি কি করে মুখ দেখাবো সবাইকে। ছিঃ ছিঃ করবে সমাজ। আমি কলংক। আনহার হাত আলগা হয়ে এল। জায়িদ বলল,
‘ আমার সাথে বাড়ি চলো। তোমার মা বাবা ভাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
আমহা দূরে সরে গেল।
‘ যাব না আমি। কিছুতেই না।
জায়িদ এগোলো।
‘ যেতেই হবে।
জায়িদ ইশারা করল মহিলা কনস্টেবলকে। দুইজন এগিয়ে এসে আনহাকে ধরল। চেঁচিয়ে কাঁদল আনহা।
‘ আমি যাবনা। যাবনা কোথাও। অফিসার আমাকে জোর করবেন না।
জায়িদ শুনল না। গাড়িতে গিয়ে উঠে বসল।
আনহা কাঁদতে কাঁদতে একসময় জ্ঞান হারালো।

সবাই বাড়িতে জায়িদের অপেক্ষায় ছিল। ফোন করে জানিয়েছে জায়িদ। আনহাকে গাড়ি থেকে যখনি নামানো হলো তখন সে অজ্ঞান। সালেহা বেগম দৌড়ে ঝাপটে ধরেন মেয়েকে৷ এলোপাতাড়ি চুমু দিতে দিতে ডাকে,
‘ আনু, এই আনু চোখ খোল মা।
সাগর সাহেব মেয়ের কাছে ছুটে যান। মেয়েকে দুচোখ ভরে দেখতেই চোখ জলে ভরে যায়। তার সন্তান!
সাহিল দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। তার চোখ থেমে গিয়েছে আনহার গায়ের লাল শাড়িটার কাছে৷ লাল শাড়ি কেন? কেন লাল শাড়ি?

জিনিয়া দৌড়ে গিয়ে সাহিলের কাছে যায়। শক্ত করে হাত ধরে বলে,
‘ কিচ্ছু করবেন না আপনি। প্লিজ।
সাহিল জিনিয়ার দিকে তাকাতেই শান্ত হয়ে যায়৷
জিনিয়া বলল
‘ আপনার বোন ফিরেছে।
সাহিল তাকাল আঁড়চোখে। আবার চোখ সরিয়ে চুপ করে থাকল। অনেক্ক্ষণ পর বলল,
‘ ওকে কবে একটা সুস্থ জীবন দিতে পারব জিনি? সীমান্ত আমার বোনের জীবনটা শেষ করে দিল। বেশ করেছি, ওকে কুঁপিয়েছি। কুত্তাকে খাইয়েছি৷ বেশ করেছি।
জিনিয়া আর ও শক্ত করে সাহিলের হাত ধরল। বলল,
‘ প্লিজ শান্ত হোন।

আনহার যখন জ্ঞান ফিরল তখন নাহিল ও ফিরেছে। আনহাকে কতবছর পর দেখল সে!
আনহা চোখে জল নিয়ে সবার দিকে একেএকে তাকালো। মা বাবা পরিবারকে দুচোখ ভরে দেখল। কান্না ছাড়া কিছুই বলতে পারল না সে।
তাননা মুননাকে দেখে চিনতে পারল না। কারা এরা?
তাননা মুননা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। ভীত চোখে আনহার কান্না দেখে। নাহিলের দুহাতের আঙুল দুজনে ধরে বলে,
‘ ইতা কানো কিনো? সুলা ফিপিল মুতো কানে।
নাহিল তরিনা খাতুনের পাশে দাঁড়ানো বাচ্চা কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকায়। আবার চোখ সরিয়ে আনহার দিকে তাকিয়ে বলে
‘ ও তোমাদের ফিপি। আনহা ফিপি। যাও, গিয়ে কাঁদতে বারণ করো।
তাননা মুননা মাথা নাড়ায়। গালে আঙুল দিয়ে ভয়ে ভয়ে তাকায় আনহার দিকে। আনহার কান্না থেমে যাচ্ছে ওদের আসতে দেখে।
তাননা মুননা আনহার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুননা বলল,
‘ আননা ফিপি কানো কিনো? সুলা ফিপিও কানে।
তাননা বলল,
‘ কানলে আল্লাহ মাববে। আম্মা বুলে, বিশিনিশি কানলে আল্লাহ মালে।
আনহা চেয়ে থাকল দুজনের দিকে। সালেহা বেগম তার মুখে ঘনঘন চুমু খেয়ে হাত বুলিয়ে বলল,
‘ দেখ এরা তোর ভাইঝি আর ভাইপো। তাননা মুননা । দেখ।
মুননা বলল,
‘ দাদুমুনি আমলা ভেইবুন। তুননু মুননু।
সোরা হেসে উঠল।
‘ ভেইবুন!
আবার থেমে গেল সোরা। নাহিল চোখ সরিয়ে নিল।

___________

প্রায় সপ্তাহ খানেক পার হলো। সোরার ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। কিন্তু তরিনা খাতুন হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাই আর যেতে পারল না। তরিনা খাতুনের অবস্থা যখন বেগতিক তখন তাকে হসপিটাল ভর্তি করানো হলো। বাড়িসুদ্ধ সবাই চিন্তিত, বিমর্ষ। একের পর এক বিপদ ছাড়ছেনা এই বাড়িকে।
তিনদিনের মাথায় হসপিটালেই মারা গেলো তরিনা খাতুন। হার্টের রোগ ছিল ওনার। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সেই নিস্তব্ধতা কাটিয়ে কান্না ভেসে এল আসল সাগর সাহেবের। তার চাচী ছিল তরিনা খাতুন, মায়ের চাইতে ও বেশি ছিল। চাচা মারা গেলো চাচীর বিয়ের কয়েকবছর পরপর। চাচীর এমনিতে ও কোনো সন্তান হচ্ছিল না। তার বছরখানেকের মধ্যে মারা যায় মা। সেই থেকে চাচী আগলে রাখলেন সাগর সাহেব আর সাজেদ সাহেবকে।
সাজেদ সাহেব তরিনা খাতুনের হাত ধরে বসে থাকেন শুধু। কাঁদেন ও না, কথা ও বলেন না।
মনে হলো কি যেন চলে গেছে। কি যেন হারিয়ে গেছে। সাহিল আর নাহিল দিশেহারা। সাহিল আর গ্রান্ডমা বলে কাকে ডাকবে? গুড্ডু আর মুন্টু বলে বলে চেঁচাবে কে?
সোরা ও কান্নায় ফেটে পড়ল। দাদু তাকে কত ভালোবাসত। জিনিয়ার নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হলো। যখন সে প্রথম এই বাড়িতে পা রাখল তখন দাদুই তার একমাত্র সঙ্গী ছিল। সব শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিল। সবাইকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল জিনিয়া। তাননা মুননা ও আওয়াজ করে কাঁদতে শুরু করল কান্নার আওয়াজ শুনে। জিনিয়া নাহিলের সাথে তাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল দুজনকে। শফিক সাহেব, জাহেদা, জায়িদ ও এখানে। নাহিল দুজনকে নিয়ে কোনোমতে সরে পড়ে।
দুজন শুধু প্রশ্ন ছুড়ে
‘ বলোআম্মুল কি হছে? ঘুম কিনো? চবাই কানে কিনো?
নাহিল উত্তর দিয়ে কূল পাইনা। আনহা নীরব চোখে দেখে আর্তনাদ। চারদিক এত বিষণ্ণ কেন? কেন এত কান্না চারপাশে। কেন এত বিষাদ?
তরিনা খাতুনের মেজবানের পরের দিন হাজির হয় মিঃ চ্যাটার্জি, প্রমিতা আর প্রণয়।
আনহাকে দেখে তাদের যেন চোখ জুড়াল। হু হু করে কেঁদে দিল প্রমিতা। সোরা এসে আনহাকে ডাকল,
‘ আপা তুমি ওনাদের কাছেই ছিল এতবছর। দেখো তোমাকে কত ভালোবাসে?
আনহা তাকিয়ে থাকল প্রমিতার দিকে। প্রণয় বলল,
‘ পূজারিণী তোর জন্য আইসক্রিম এনেছি। খাবি?
আনহা মাথা নাড়িয়ে না বলল। মিঃ চ্যাটার্জি ডাকলেন,
‘ মা আমাদের ভুলে গিয়েছ?
আনহা তাকিয়ে থাকে একদৃষ্টে। অনেক্ক্ষণ পর সময় নিয়ে বলে,
‘ মনে হচ্ছে চিনতে পারছি। কিন্তু মাথায় ব্যাথা করছে ভীষণ।
সোরা আনহাকে সোফায় বসায়। বলে,
‘ আপা তুমি এখন এত চাপ নিওনা তো। দেখবে ধীরে ধীরে সব চিনে যাবে।
আনহা বলল,
‘ হ্যা চিনব। কিন্তু চিনলেই কি হবে?
মিঃ চ্যাটার্জি মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আনহার। বলে,
‘ মনে পড়লে, চিনলে হুট করে একদিন বাড়ি যাবে। আমরা অ্যাপয়ন করব তোমায়। শান্তি পাব এই ভেবে যে একদিনের জন্য হলেও তোমার বাবা হতে পেরেছি।
প্রণয় বলল
‘ পূজা তুই আমাদের কি করে ভুলে গেলি?
আনহা বলল,
‘ ভুলিনি। আমার সব এলোমেলো লাগছে। সবকিছু উলটপালট লাগছে। সব ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা।
প্রণয় বলল,
‘ ঠিক আছে এত চাপ নিসনা এখন। আমি মাঝেমাঝে তোকে দেখতে আসব। নিয়েও যাব। আর হ্যা শীঘ্রই তোর বিয়ে ও খাব।
আনহা বিড়বিড় করল,
‘ আমি বিবাহিত।
প্রণয় হাসল। বলল,
‘ আচ্ছা আচ্ছা তুই যা বলবি তাই। তোকে আমরা এমনিতেও বিয়ের শাড়ি পড়া অবস্থায় পেয়েছি। হতেই পারে তুই বিবাহিত। তোর বরের সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিবি কিন্তু। বেচারা তোকে ছাড়া এতগুলো দিন কিভাবে ছিল রে? বিয়েটিয়ে করে ফেলেনি তো?
আনহা হাসল তাচ্ছিল্যের হাসি। প্রণয় তারজন্য আনা দুটো আইসক্রিম বক্স হাতে দিল। তাননা মুননা এসে দৌড়ে নিয়ে গেল। বলল,
‘ আচকিলিম। আচকিলিম খাব। মুজা মুজা কলে খাব।
জিনিয়া মাথায় হাত দিল।
‘ কি হচ্ছে আব্বা? দিয়ে দাও।
আনহা বলল, থাক।
মুননা আইসক্রিম বক্স মাথায় নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
‘ দু তাকা আচকিলিম । কে কে খাববে? আচকিলিম। দু তাকাল আচকিলিম।
নাহিল বলল,
‘ দু টাকা দিয়ে পুরো বক্স দিবেন?
মুননা মাথা নাড়াল। একটা আঙুল দেখিয়ে বলল,
‘ একতা দিবো। আল দিবোনা।
সবাই হাসল তার কথায়। তাননা বলল,
‘ আমি একতা ন তাকায় দিবো। ন তাকাল আচকিলিম।
নাহিল বলল,
‘ নয় টাকা? ওরেবাপ এত দাম কেন?
তাননা বলল,
‘ আমাল আচকিলিম বিশিবিশি মুজা। মুননুল আচকিলিম মুজা নাই
একসাথে হাসল বাড়ির সবাই। আনহা ও। এই বাচ্চাদুটো দিনশেষে বাড়িটাকে প্রাণবন্ত করে রাখে।

রাতেই বাড়ি ফিরল সাহিল। আনহাকে শাড়ি পড়া দেখে রাগ উঠল মাথায়। সবাই আনহার পুরোপুরি সুস্থ হওয়ায় অপেক্ষায় নাহলে শাড়ি পড়তে দিতনা। এখন যা চাইছে তাই করতে দিচ্ছে। কিন্তু সাহিল রাগ সামলাতে পারল না। তরিনা খাতুনের ঘরে যায়। সাদা ধবধবে শাড়ি এনে ছুঁড়ে মারে আনহার দিকে। ভয়ে কুঁকিয়ে উঠে সবাই। জিনিয়া দৌড়ে সাহিলের কাছে আসে। বলে,
‘ কি হয়েছে আপনার? ওরদিকে শাড়ি কেন ছুড়ে মারলেন। ও অসুস্থ এখনো।
সাহিল বলল
‘ ও সাদা শাড়ি পড়বে। শুধু সাদা শাড়ি। ওর স্বামী মৃত।
আনহা কেঁদে উঠে। সোরা বলে
‘ বড়দাভাই একটা জীবিত মানুষকে তুমি কি করে মৃত বলছ?
সাহিল বলতে গেল। জিনিয়া শক্ত করে তার হাত ধরল। টেনে নিয়ে গেল রুমে। সাহিল হাত ছাড়িয়ে বলল
‘ বলতে দাও আমাকে। জেলে গেলে যাব তারপরও বলব ওর জানোয়ার স্বামীকে আমি মেরেছি।
জিনিয়া তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে আটকে ফেলল। একদম শক্ত করে ধরে বলল
‘ না না বলবেন না। দোহাই লাগে।
জিনিয়া কাঁদল।
সাহিল শান্ত হয়ে গেল জিনিয়ার কান্না দেখে। তাননা মুননা দৌড়ে এল জিনিয়ার কান্নার আওয়াজে। সাহিলকে তাননা বলল
‘ আম্মা কানে আব্বা। আদোল কলো। আল্লাহ মাববে তুমাকে।

সাহিল বলল
‘ বলব না, এবার কান্না থামাও৷ জিনিয়া মাথা তুলে সাহিলকে চাইল। সাহিলের হাত তুলে জিনিয়া মাথায় রাখল। বলল,
‘ আপনি কখনো বলবেন না ওসব কথা। কথা দিন আমাকে। আপনি বারবার কথার খেলাপ করতে যাচ্ছেন।
সাহিল হাত নামিয়ে ফেলল।
‘ আজ না হোক কাল সত্যিটা সামনে আসবেই জিনি।
জিনিয়া আবার হাতটা মাথায় রাখল। বলল,
‘ কথা দেন। নাহলে আমি চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে। আপনার বাচ্চাদের ও নিয়ে যাবনা।
তাননা কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল,
‘ নানুল বালি যাব।
মুননা চোখ কচলে কচলে বলল,
‘ জুননু কানে কিনো?
সাহিল বলল,
‘ বাচ্চামো হচ্ছেনা?
জিনিয়া বলল,
‘ না। কথা দেন আমাকে। দেন।
সাহিল অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
‘ দিলাম। কিন্তু তুমি ওকে বলবে শাড়ি না পড়তে। ওর বিয়ে টিয়ে ওসব আমি মানিনা। ওকে আমি আবার বিয়ে দেব। একটা জানোয়ারের জন্য ও কেন এভাবে থাকবে? কেন নিজেকে কষ্ট দেবে?
জিনিয়া বলল,
‘ ও আগে সুস্থ হোক। তারপর এসব নিয়ে কথা হবে।

________

সোরা চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল সাহিলকে। আনহা সায় দিল না সোরাকে। রাহাকে কোলে নিয়ে ফেলে বলল,
‘ যাসনা সোরা। কেন যাচ্ছিস? ওখানে একা একা কি করে থাকবি অতবড় বাড়িতে?
সোরা বলল
‘ আমার মেয়েকে নিয়ে থাকব আপা। সাদিদকে নিয়ে আসব। আম্মা ও এসে এসে থাকে। দাদীর ও শরীর খারাপ আজকাল। তুমি দেখোনি দাদু মারা গিয়েছে যে সেদিন আসছে, কেমন রোগা হয়ে গেছে। বয়স হচ্ছে এখন। আমার জন্য চিন্তায় চিন্তায় একদম শেষ। আমাকে ফিরতে হবে আপা। ওই বাড়িটা আমাকে ডাকছে। ওখানেই আমি ভালো থাকি আপা।
আনহা চোখজোড়া ছলছল করে উঠল। বলল,
‘ খুব ভালোবাসিস তোর মাষ্টারকে? সোরা চোখ সরিয়ে নিল। বলল,
‘ তুমি ভালো থাকো আপা । নিজেকে আর একবার সুযোগ দাও। তোমার স্বামী তো তোমাকে ব্যবহার করেছে। তাকে ভুলে নিজেকে সুযোগ দাও, নতুন করে সবকিছু শুরু করো।
আনহা বলল,
‘ তুই?
চমকালেও দেখালো না সোরা। মেয়েকে কোলে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে বলল,
‘ আমার পথ চলা ওকে নিয়ে আপা। উনি আমাকে ভালোবাসতেন, আর আমি উনাকে বেসে যাব। ব্যস। আমি বিশ্বাসই করিনা উনি নেই, আমার মনে হয় উনি এখানেই আছেন, আমার পাশেই আছেন। আমার আর তার মেয়ের ছায়া হয়ে থাকেন। আমাকে ছেড়ে গিয়েছেন উনি কিন্তু আমাকে নিঃস্ব করে দিয়ে যায়নি। আমাকে বেঁচে থাকার জন্য সম্বল দিয়ে গেছে আপা। এটা ও তার ভালোবাসার একটা নমুনা।
ঠোঁটের কোণায় হাসি থাকলেও চোখের কোণায় কান্না সোরার। আনহা স্পষ্ট টের পেল। বলল,
‘ একটা কথা বলব সোরা?
সোরা বলল
‘ বলো!
আনহা বলল,
‘ অতীতকে কি পুরোপুরি ভুলা যায় সোরা? তুই কিভাবে ভুলেছিস। বল না?
সোরা চোখ তুলে তাকায়। একদম চোখাচোখি। আনহার মনে হলো সে কি ভুল কিছু বলে ফেলেছে?
সোরা চলে যেতে চাইল। আনহা আটকালো।
‘ উত্তর দিয়ে যা সোরা।
সোরা ফিরল আবার। বলল,
‘ আমার জীবনে অতীত শব্দটা নামমাত্র আপা। এর কোনো অস্ত্বিতই নেই। ছিলনা।
আনহা হা করে তাকিয়ে থাকল। একসময় চোখ গেল কিছুটা দূরে আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে। আনহা ডাকল,
‘ ভাইডি ?
হুট করে সরে গেল নাহিল। রাহা কেঁদে উঠল। সোরা মেয়ের নরম গালে আদর বসালো। দোলাতে দোলাতে যেতে যেতে বলে,
‘ এই তো মা, আম্মু আছি তো।
মেয়ের গালে লেগে যায় তার চোখ থেকে পড়া সদ্য জলের নহর। সোরা মিনমিন করল,
‘ আমাকে ক্ষমা করুন। ক্ষমা করুন ছোটদাভাই।
আনহা নাহিলের পিছু পিছু দৌড়াই। নাহিল নিজের রুমে ডুকে পড়ে দরজা বন্ধ করে বলে,
‘ কিছু হয়নি আনহা । আমি একটু ঘুমোবো। ডিস্টার্ব করিস না।
আনহা চলে গেল মন খারাপ করে।
নাহিল চোখজোড়া উপরে করে রাখল। জ্বলতে শুরু করল চোখজোড়া। বৃষ্টি না নামলে এভাবেই জ্বলতে থাকবে। কিন্তু বৃষ্টি নামা বারণ। নিষিদ্ধ। নাহিল একহাত দিয়ে কপালের কাছে চুল মুঠোয় নেয়। ফোঁপাতেই চোখ যায় নিজের বেডের কাছে। মা!
নাতাশা বেগম একদৃষ্টে চেয়ে থাকে ছেলের দিকে। কার জন্য তার ছেলের এই অবস্থা?
নাহিল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বলে,
‘ মা তুমি এখানে? কি করছ?
নাতাশা বেগম বলে,
‘ তোর কাছেই এসেছিলাম। তুই নেই তাই অপেক্ষা করছিলাম।
নাহিল বের হয়ে গেল রুম থেকে। কোথাও কেন শান্তি নেই? কোথাও নেই। কতবড় ভুল ধারণা নিয়ে বসেছিল নাহিল? ভেবেছিল হয়ত অতীতটা রঙিন ছিল এখন সব বিদীর্ণ। কিন্তু ভুল নাহিল। অতীত কখনোই রঙিন ছিলনা। ক্ষণিকের ভালোলাগায় মত্ত হয়েছিল সোরা তার প্রতি। ক্ষণিকের। সোরা তাকে ভালোবাসেনি কখনো। বাসেনি। সেজন্যই তো সে ডাকা স্বত্বে ও এড়িয়ে গিয়েছে। সেজন্যই এত কাছে থেকে ও সোরা নাহিলের আর্তনাদ শুনতে পায়না। নাহিলের কষ্ট অনুভব করতে পারেনা। নাহিলকে বুঝতে পারেনা। নাহিলের চোখের ভাষা বুঝতে পারেনা।
সোরা সেদিন ও স্বার্থপর ছিল। আজ ও। সোরা কখনোই নাহিলের ছিলনা, সোরা শুধুই তার মাষ্টারের। সোরার একটাই পরিচয়, সোরা মাষ্টারের প্রিয়তমা আর রাহার মা। আর কোনো পরিচয় নেই সোরার। অতীতের কোনো অস্তিত্বই নেই সোরার জীবনে। নেই।

সোরার যাওয়ার দিন এল। রাহা ঘুম ছিল। জিনিয়ার রুমে গেল সোরা। বড়দাভাই তার সাথে রেগে আছে। বাড়িতে নেই। জিনিয়ার সাথে কথা বলে নিচে আসল সে। সবার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ঘটল অপ্রত্যাশিত ঘটনা। রাহা দোলনায় নেই। সোরার চিৎকারে পুরো বাড়ি কাঁপে। কোথায় তার মেয়ে?

নমুনা পার্কটি কিন্টার গার্ডেন স্কুলের পাশেই। নাহিল এদিকওদিক তাকিয়ে হাঁটল। কিন্তু সাহিলকে কোথাও দেখলনা। ভাই তাকে কেন এখানে আসতে বলেছে? কেন বলেছে?
বেশদূরে ছোট বাচ্চা কোলে দাঁড়িয়ে থাকা সাহিলকে দেখতে পায় নাহিল। কার বাচ্চা এটা।
সাহিল নাহিলকে দেখে এগিয়ে আসে। নাহিলের কোলে রাহাকে দিয়ে বলে
‘ হয় এই বাচ্চার বাবা হয়ে ওঠ, নয়ত নিজেকে আরেকবার সুযোগ দে। ছোটমার কথামতো বিয়ে কর। যেকোনো একটা। পারবি নাহিল?
নাহিলের চক্ষু কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
‘ আমি?
সাহিল বলল,
‘ হ্যা। রাহাকে আর সোরাকে আগলে রাখ, নয়ত বিয়ে কর।
নাহিল বলল,
‘ কিন্তু সোরা?
সাহিল বলল,
‘ তার মাষ্টারের জায়গা সে কাউকেই দেবেনা। কিন্তু সন্তানের খাতিরে তার সন্তানের বাবার জায়গাটা দিতে পারে। আমি চায়না রাহা পিতৃহীন বড় হোক। সোরাকে যখন ভালোবেসেছিস তখন শেষপর্যন্ত বেসে যাহ। নয়ত নিজেকে সুযোগ দে।
নাহিল বলল,
‘ কেউ আমার সাথে ভালো থাকবেনা ভাই।
সাহিল বলল,
‘ তোর কোলে যে আছে, তাহলে তাকে ঘিরে পৃথিবী সাজা। একজন দায়িত্ববান বাবা হয়ে ওঠ।
নাহিল বলল,
‘ আমি পারবনা ভাই।
সাহিল তার কাঁধ চাপড়ে বলল,
‘ তোকে পারতে হবে। তুই পারবি। দেখবি তোর বিষাদময় পৃথিবীটা রাহায় রঙিন করে দেবে। ওকে ভালোবেসে ধরে রাখ নাহিল, যেভাবে সোরাকে রেখেছিস মনে। ভালো রাখ ভালো থাক ভাইটা।
নাহিল ফিরে গেল। সাহিলকে নিজের রূপ দেখাতে চাইল না। কব্জি দিয়ে চোখ ঢলে হাঁটা ধরল নাহিল । রাহা চুপটি মেরে চেয়ে আছে তার দিকে।

____________

গতরাতের মিশনে গিয়ে কপাল ফাটল জায়িদের। তাদেরই কন্সটেবলের ধাক্কা লেগে পড়ে গিয়েছিল ইটের কোণার উপর। ফলসরূপ কপালের পাশে ফুটো হলো। রক্ত গড়ালো। সাদা ব্যান্ডেজটা কপালে মোড়ানোই আছে। সাহিল তাকে কেন ডাকল এমন একটা পার্কে?
কপালে চিনচিনে ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। একটু যে রেস্ট নিবে তার ও জোঁ নেই।
সাহিল নিজেই এগিয়ে আসল জায়িদের কাছে। বলল,
‘ কপাল কোথায় ফাটিয়েছিস আবার?
জায়িদ বলল,
‘ সেসব কথা পরে বলি। আগে বল কেন ডেকেছিস?
সাহিল সোজাসাপটা বলল,
‘ আনহার জন্য পাত্র দেখ।
জায়িদ সাথেসাথেই বলল,
‘ আচ্ছা।
সাহিল বলল,
‘ ক্রিমিনাল নয়, অন্তত একজন দায়িত্ববান মানুষকে যাতে আমার বোন জীবনসঙ্গী হিসেবে। জায়িদ বলল,
‘ আচ্ছা।
সাহিল বলল,
‘ সিফাতকে আর খুঁজিস না। মনে কর মরে গিয়েছে। আমি চাই সিফাত নামক কোনো কালো অধ্যায় আমার বোনের জীবনে না থাকে?
জায়িদ বলল,
‘ আচ্ছা। ফোনে বলতে পারতি এত সামান্য বিষয়টা। এখানে ডাকার কোনো প্রয়োজন ছিলনা।

চলবে,

সবার মন্তব্য আশা করছি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here