#রৌদ্রদেশে_মেঘের_বেশে
#পুষ্পিতা_প্রিমা
[২৯]
প্রায় সপ্তাহখানেক পর সোরার বাচ্চাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দেওয়া হলো। সোরাকে ঠান্ডা থেকে দূরে দূরে থাকতে বললেন ডক্টর। সামাদ মিয়াকে সহ সোরাকে সাহিল নিয়ে গেল বাড়িতে। সোরা যেতে চাইল না। দ্বিমত পোষণ করল। নিজ স্বামীর বাসস্থানে ফিরবে সে। কিন্তু সাহিল যেতে দিলনা। বলল,
‘ কিছুদিন এখানে থাক। আমি নিজেই গিয়ে তোকে দিয়ে আসব।
সাহিলের জোরাজুরিতে সোরা কিছু বলতে পারল না। মেয়েকে নিয়ে উঠল আহম্মেদ বাড়িতে। তার মেয়ে রাহা। রাতুল দিয়েছিল নামটা। রাহামণি ডাকত গালভরে। বাবা পাগল মেয়েটা বাবাকে দেখলে দন্তহীন গাল দেখিয়ে খিলখিল সুরে হাসত। গালে গাল লাগিয়ে রাখত। বাবা আর নেই এই পৃথিবীতে সে জেনে গিয়েছে বোধহয়, তাই বাবার কাছে যাওয়ার জন্য ও তার এত লড়াই। কিন্তু মা। মায়ের জন্য থেকে যেতে হলো তাকে। মায়ের ধূসর পৃথিবীটা রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য তাকে থেকে যেতে হলো। কতগুলো দিনপর মেয়ে সোরার দিকে তাকাল। খিলখিল করে হাসল। লাল জিহবা বের করে দিয়ে চুকচুক করে খিদের কথা জানান দিল। হাত পা নেড়ে খেলা করল। দুচোখ ভরে দেখল সোরা। স্বামী তাকে ছেড়ে গিয়েছে কিন্তু দিয়ে গিয়েছে একটি ভালোবাসার প্রতীক। সোরার লড়াই এবার মেয়েকে নিয়ে। মেয়েকে মানুষের মতো মানুষ করার লড়াই। মেয়েকে নিয়ে ঠিকে থাকার লড়াই।
রাতের খাবার টেবিলে জিনিয়া ডাকল সোরাকে। বিছানা থেকে উঠে দোলনায় শোয়া মেয়েকে কোলে তুলে নিল সোরা। গুটিগুটি পায়ে হেঁটে নেমে আসল নিচে।
সাহিল এসে রাহাকে কোলে নিল। বলল,
‘ তুই যাহ। আগে খেয়ে নে।
সোরা বলল,
‘ নাহ আমি এখন খাবনা। দাদু কোথায়?
জিনিয়া বলল,
‘ দাদু উপরে। এখুনি আসবেন।
তরিনা খাতুন এলেন অনেক্ক্ষণ পর। সোরার সাথে কথাবার্তা বলে খাবার টেবিলে বসলেন। এদিকওদিক তাকালেন। তারপর নাতাশাকে ডাকলেন,
‘ ছোট বউ নিচে আসো। সারাক্ষণ ঘরের ভেতর কি করো?
সোরা সোফায় গিয়ে বসল ততক্ষণে। নাতাশা বেগম নিচে নেমে এলেন। সোরাকে আঁড়চোখে দেখলেন। কেন এসেছে এই মেয়ে আবার? সোরার কোনো ভাবান্তর দেখা গেলনা। সাহিল রাহাকে আদর করতে করতে বলল,
‘ সোরা তোর মেয়ে একদম তার বাপের মতো হয়েছে না?
সোরার দিকে তাকাতেই সাহিল আবার চুপ হয়ে গেল। হেসে বলল,
‘ তাননা মুননাকে দিসনা এখন। টেনেটুনে হয়রান করে ফেলবে। সোরা চেয়ে রইল রাহার দিকে। আসলেই মেয়েটা একদম হুবহু বাবার কার্বন কপি। নাক, ঠোঁট, গাল সবকিছুই বাপের মতো। চোখের কোণায় জলের কণার দেখা মিলল সোরার। কব্জি দিয়ে মুছে নিয়ে দোতলায় চোখ দিতেই কেউ একজনকে দ্রুত সরে যেতে দেখা গেল। সোরা কৌতূহল দেখালো না।
নাতাশা বেগম সাহিলকে ডাকল। বলল,
‘ নাহিল কি খাবেনা?
সাহিল বলল,
‘ কিছুক্ষণ পর ডেকে আনব। ও আর আমি একসাথে খাব।
নাতাশা বেগম মাথা দুলালেন। বললেন,
‘ ওই মেয়েটা কখন যাবে?
সাহিল চেয়ে রইল নাতাশা বেগমের দিকে। নাতাশা বেগম সাহিলকে বুঝিয়ে বললেন,
‘ মেয়েটা এখানে থাকলে তো আমার নাহিল ভালো থাকবেনা। মেয়েটাকে এই অবস্থায় দেখে, ও কষ্ট পাচ্ছে। শুরু থেকেই আমার ছেলেটা কষ্ট পেয়ে যাচ্ছে। এখন ও পাচ্ছে। ওর কষ্ট কি কখনো কমবেনা?
সাহিল শান্ত স্বরে বলল,
‘ ছোটমা তুমি নাহিলের খারাপ থাকা নিয়ে সোরাকে কেন দায়ী করছ? শুধুই কি নাহিল ভালো নেই। সোরা? সোরা কি ভালো আছে? ওর স্বামী মারা গেছে, ওর মনের অবস্থাটা একটু বুঝার চেষ্টা করো। তুমি নাহিলের জন্য মেয়েটেয়ে যেভাবে দেখছ দেখতে থাকো। সোরাকে টেনোনা এসবের মাঝে। ভালো নেই মেয়েটা। আর নাহিলকে ম্যানাজ করার দায়িত্ব আমার। ওকে আমি রাজী করাবো। সোরা চলে যাবে গ্রামে।
সালেহা আর তরিনা খাতুন অনেক জোর করল সোরাকে। খেতে চাইল না সে। অনেকটা জোরাজুরি করে তরিনা খাতুন খাইয়ে দিল তাকে। রাহা কেঁদে উঠল। সাহিল সোরার কোলে দিয়ে দিল তাকে। মায়ের বুক পেয়ে শান্ত হয়ে গেল রাহা। তাননা মুননা হামাগুড়ি দিয়ে নেমে এল নিচে। এসেই কোমড়ে হাত দিয়ে মুননা বলল,
‘ চবাই ইখানে, মুন্টু ওখানে কিনো?
সবাই তাকাল মুননার দিকে। উত্তর না পেয়ে মুননা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে আসল সোরার কাছে। তাননা এসে সোরার পাশে বসল। বলল,
‘ তুমাল বাবুকে আমাদেল দিউ। আদোল কববো। বিশিবিশি আদোল কববো।
সোরা মাথা নামিয়ে বলল,
‘ আদর করবে? আসো আদর করো। জিনিয়া বলল,
‘ সোরা সাবধানে। কোলেটোলে দিওনা আবার। ফেলে দেবে।
মুননা নাক ফুলালো।
‘ জুননু মাববো তুমাকে । বাবুকে আমলা কুলে নিবো। আদোল কবব। একচোবার, একচোবার কুলে নিবো।
মুননা সোফায় বসল। তার পাশে তাননা। সোরা দুজনের কোলের উপর রাহাকে দিল একটুখানি। নিজে ও ধরে রাখল। ভাইবোন দুজনে একসাথে আদর দিতে গিয়ে বাড়ি খেল মাথায়। তাননা বলল,
‘ মুননু বিথা দিচো কিনো? আল্লাহ মাববে।
মুননা বলল,
‘ কুথায় মাচচি। মিছি বুলো কিনো? তুমাকে আল্লাহ মাববে।
সোরা বলল,
‘ কেউ কাউকে মারেননি। মাথায় মাথায় টোকা লেগেছে।
দুজনই তাকিয়ে থাকল সোরার দিকে। সোরা আদর করল দুজনকে।
সাহিল এসে বলল,
‘ এটা তোমাদের সোরা ফিপি। ফিপি ডাকবে।
মুননা তাননা দাঁত দেখিয়ে হাসল। বলল
‘ ফিফফিপ।
সোরা হেসে ফেলল। সাহিল সোরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। এভাবে হাসিখুশি থাক সবসময়।
সোরার সাথে সাথে দোতলায় উঠে গেল তাননা মুননা। সোরা বলল,
‘ বাবুর সাথে খেলবে দুজন?
তাননা মুননা।
‘ হ্যা খিলবো। আদোল কববো। চকলেত দিবো।
সোরা রাহাকে বলল,
‘ আপু আর ভাইয়ার সাথে খেলবেন?
রাহা জিহ্বা বের করে মায়ের দিকে পিটপিট করে তাকালো। সোরা মেয়ের গালে স্নেহের পরশ দিল। সোরার চুল টেনে ধরল রাহা। সোরা বলল,
‘ পঁচা মেয়ে আম্মুর চুল এভাবে কেউ ধরে? লাগছে তো।
মেয়ের সাথে দুষ্টুমিষ্টি কথা বলতে বলতে পিছু চেয়ে চেয়ে আসা ছেলেটা হঠাৎই সামনে পড়ে গেল সোরার। মেয়ের সাথে হেসে হেসে চোখ উপরে তুলল সোরা।
স্তব্ধ হয়ে গেল। হাসি ও থেমে গেল।
তাননা নাহিলের হাতের আঙুল ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ চাচ্চু সুলা ফিপিল সাথি কুথা বুলো। সুলা ফিপিল বাবুকে আমাদেল কুলে দিতে বুলো। তালাতালি বুলো। বাবুকে আদোল কববো। তুমি ও আদোল কববে।
মুননা বলল,
‘ এই মুন্টু তুমি সুলা ফিপিল বাবুকে কুলে নাও। নাও না? বাবুকে আদোল কববো। কুলে নাও।
নাহিল চোখ নামিয়ে রাহাকে দেখল। ঠোঁট টানতে টানতে কেঁদে উঠল রাহা। সোরা তাকে থামাতে থামাতে নাহিলকে ডিঙিয়ে গেল। নাহিল দাঁড়িয়ে রইল। মুননা নাহিলের অন্যহাতের আঙুল ধরল। ঝাঁকিয়ে বলল,
‘ সুলা ফিপি তুমাল সাথি কুথা বুলেনা কেন? তুমি বুলোনা কিনো? মুন্টু কুথা বুলোনা কিনো?
নাহিল দুজনের গালে আদর বসালো। বলল
‘ আমার আম্মা আব্বারা কি খেয়েছে?
দুজনই বলে উঠল।
‘ না, খানি। ইখুন খাবো । তুমাল সাথি খাবো। তুমাল হাতে খাবো।
নাহিল দুজনকে দুহাত আগলে কোলে তুলে নিল। আদর দিতে দিতে বলল,
‘ আচ্ছা চলেন।
সোরা রুমে ডুকে দরজা বন্ধ করল। রাহাকে ঘুম পাড়াল। বুকের মাঝে মেয়েকে নিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফোঁপাতে ফোঁপাতে কাঁদল। বালিশ ভিজল। চোখের জল বেয়ে কানের কাছে নামল। ওপাশের বালিশটা একদম খালি পড়ে আছে। মানুষটা নেই। সোরাকে নিঃস্ব করে একেবারে হারিয়ে গেছে। সেই না ফেরার দেশে। সোরা যে কাঁদছে, এত কষ্ট পাচ্ছে কই আসছেনা তো মানুষটা। ওপারে গিয়ে একদম ভুলে গেছে সোরাণীকে। মনে নেই আর। মনে নেই নিজের রাজকন্যাকে। মনে নেই প্রিয়তমাকে।
___________
পূজার কথা অনেক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে সাহিলকে বলল জায়িদ। সাহিল হেসে পিঠ চাপড়ালো জায়িদের।
‘ সাবাশ ভাই, শেষমেশ একটা মেয়ে মনে ধরল তোর।
জায়িদ বলল,
‘ ধুরর। বলি একটা শুনিস আরেকটা। আমি বলছিলাম যে ওই মেয়েকে তুই গিয়ে একবার দেখে আয়। আজকেই প্লিজ।
সাহিল বলল,
‘ আচ্ছা দেখব।
জিনিয়া দুজনের কথা শুনল। সাহিলকে বলল,
‘ গিয়ে দেখে আসুন না। কোন মেয়েকে দেখতে বলছে। হয়ত,
জায়িদ বিরক্তিকর শব্দ করল।
‘ উফ জুননু, তোরা যা ভাবছিস এমন কিছু না। ব্যাপারটা ও একটা কেস। বুঝেছিস? আমি সলভ করতে পারছিনা তাই তোদের হেল্প চাইছি।
সাহিল বলল,
‘ আচ্ছা ঠিকাছে। সন্ধ্যায় যাব।
সময় হলোনা সাহিলের। সেদিন যেতে পারল না। তারপরের দিন সন্ধ্যার দিকে জায়িদের সাথে গেল চ্যাটার্জি বাড়িতে। মিঃ চ্যাটার্জি খুব খুশি হলেন। সাহিল আর জায়িদের সাথে গল্প করার এক ফাঁকে নিপ্পিকে কোলে নিয়ে দৌড়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল পূজা। কপাল কুঞ্চন করে ঠোঁট নেড়ে নেড়ে বলল,
‘ বাবা নিপ্পির খিদে পেয়েছে সাথে পূজার ও। মা খেতে দিচ্ছেনা কেন?
মিঃ চ্যাটার্জি হেসে বললেন,
‘ আর পনের মিনিট পর খেতে পারবে। ঔষধ খেয়েছ তো তাই। আর তুমি না খেলে নিপ্পি কি করে খাবে?
পূজা মাথা দুলিয়ে যেতেই সাহিল আর জায়িদকে দেখল।
সাহিল ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে পড়ল। চোখ চকচক করে উঠল। বুক ধড়ফড় করল। বিড়বিড় করে সাহিল ডাকল
‘ বোন?
পূজার কপালে ভাঁজ পড়ল।
‘ তোমরা কেন এসেছ? কেন এসেছ? কিজন্য এসেছ?
সাহিল জায়িদের দিকে তাকাল। বলল,
‘ জায়িদ ও কি আমাকে চিনতে পারছেনা?
জায়িদ বলল,
‘ ও তোর বোন নয়। চল, আমরা যাই।
সাহিল জায়িদের হাত ছুড়ে ফেলল। পূজার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,
‘ বোন তুই?
পূজা দৌড়ে সিঁড়িতে উঠে গেল। দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেল। লোহার ফুলের টব এনে সাহিলকে দেখিয়ে বলল
‘ এটা দিয়ে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেব। তোমাকে ও, ওই পুলিশকে ও। যাও আমাদের বাড়ি থেকে।
প্রমিতা আর মিঃ চ্যাটার্জি একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলেন। প্রমিতা পূজার কাছে গেলেন। বললেন,
‘ পূজা চলো আমরা ঘরে যায়। চলো।
সাহিল বলল,
‘ না। ও আমার বোন। ও পূজা নয়, আমার বোন আনহা।
ভেতরে ভেতরে প্রমিতার রাগ লাগল। বলল
‘ ও পূজারিনী। আমার মেয়ে। আপনার বোন কি করে হবে। আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে। অফিসার এসব কি হচ্ছে?
জায়িদ সাহিলের কাছে গেল। হাত ধরে টেনে এনে বলল,
‘ সাহিল তুই বাচ্চা নস ভাই। চল।
সাহিল জায়িদকে ঠেলে দেয়। বলে,
‘ আরেহ তুই কি অন্ধ জায়িদ? ও আনহা তুই দেখতে পাচ্ছিস না? ও আনহা? ও মরেনি তো। তুই বল না আমরা ওর লাশ পায়নি। সীমান্ত শুধু বলেছে ওকে মেরে ফেলেছে কিন্তু লাশের খবর দেয়নি। জায়িদ একটু ভেবে দেখ।
জায়িদ পূজার দিকে তাকায়। কপাল কুঁচকে চেয়ে আছে মেয়েটা। চরম বেয়াদব একটা মেয়ে। আনহা ওর চাইতে ভালো ছিল।
সাহিল মিঃ চ্যাটার্জিকে গিয়ে বলল,
‘ ওকে আপনারা কি খুঁজে পেয়েছেন? কোথায় খুঁজে পেয়েছেন? ও আমাকে চিনতে পারছেনা কেন?
মিঃ চ্যাটার্জি কিছু বললেন না। পূজার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নেন।
সাহিল দিশেহারা হয়ে পড়ে সোফায় বসে পড়ে। পূজা আঙুল দিয়ে সাহিলকে দেখিয়ে দিয়ে বলে,
‘ এটা পুলিশের মতোই খারাপ। বেশি খারাপ। এ দুটোকে মেরে মেরে লাল করে দেব একদম।
জায়িদ ভেতরে ভেতরে হেসে ফেলে। সাহিল থাকায় আওয়াজ করে হাসল না।
উঠে দাঁড়াল সাহিল। একমুহূর্ত ও দেরী না করে গটগট পায়ে হেঁটে বেরিয়ে গেল। জায়িদ তার পিছুপিছু দৌড়াল। পূজার ডাকে আবারও পিছু ফিরল।
‘ এই পুলিশ? আর যদি আসো এখানে বেঁধে রাখব রশি দিয়ে, তারপর মেরে মেরে লাল লাল করে দেব একদম। হাত পা ভেঙে দেব। হাতে ইনজেকশন মেরে দেব। তোমার গুলি দিয়ে তোমাকে মেরে উড়িয়ে দেব। হ্যা।
জায়িদ বের হয়ে গেল। চেপেচিপে হাসল। সাহিলের জন্য আওয়াজ করে হাসা গেলনা। সাহিল বাড়িতে পৌঁছে সবাইকে বলে দেয় , আনহা বেঁচে আছে।
সবাই ওর কথা শুনে হা করে তাকিয়ে থাকে। সোরা ও অবাক। আনহা আপা?
সালেহা বেগম কাঁদতে শুরু করেন। আনহার কাছে নিয়ে যাওয়ার বাহানা করেন। সাহিল মায়ের কান্না দেখে বলে
‘ মা ও আনহা নাও হতে পারে। কেঁদোনা প্লিজ।
সালেহা বেগমের কান্না থামেনা। পরিবেশ ভারী হয়।
তাননা মুননা তখনও ঘুম। আলুথালু হয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে ঘুমোচ্ছে দুজন। সাহিল ঘরে দুজনের কপালে, গালে গাঢ় চুম্বন বসালো। জিনিয়া তার পিছুপিছু ঘরে এল। বলল,
‘ আপনি মাকে কেন বলতে গেলেন? যদি মেয়েটা আনহা না হয়? আপনি এত সিউর কি করে? চেহারার মিল থাকতেই পারে।
সাহিল বলল,
‘ তুমি আমায় অবিশ্বাস করছ জিনি?
জিনিয়া বলল
‘ না না একদম না।
সাহিল খাটে গিয়ে বসল।
জিনিয়া তার পাশে গিয়ে বসে বলল,
‘ রাগ করেছেন?
সাহিল জিনিয়ার মুখের দিকে তাকালো। মৃদু হেসে বলল,
‘ তোমার সাথে রাগ করে আমি ঠিকতে পারি?
জিনিয়া হাসল। হাত বাড়িয়ে সাহিলের গলা ধরে পড়ে থাকল তার কাঁধে। বলল,
‘ আমার সাথে রাগ করবেন না। আমি করব শুধু।
সাহিল তার চুলের ভাঁজে ঠোঁট ছুঁয়ালো। বলল,
‘ আচ্ছা।
______
মেয়েকে কোলে নিয়ে ছাদের দোলনায় বসেছিল সোরা। তাননা মুননা বকবক করছে খেলনাপাতি নিয়ে।
‘ সুলা ফিপি তুমাল বাবু খেলেনা কিনো? আমলা খেলি । পুতুন পুতুন খেলি ।
তাননার কথায় হাসে সোরা। বলল,
‘ বাবু বড় হলে তোমাদের মতো পুতুল পুতুল খেলবে।
মুননা বলল
‘ বলো ককখন হবে? আমাদেল মুতো। বলো?
সোরা বলল,
‘ আর কিছুদিন পর।
খেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল তাননা মুননা। হঠাৎ করে দুজনের মাঝে লেগে গেল তুমুল ঝগড়া। সোরা পড়ল মহাবিপদে। চুল টানাটানির শেষে দৌড়াদৌড়ি শুরু হলো। মুননা দৌড়াচ্ছে তাননাকে। সোরা ডাক দিল,
‘ পড়ে ব্যাথা পাবে বাবুরা।
তাননা দৌড়াতে দৌড়াতে বলে,
‘ আল্লাহ মুননু আমাকে মেলে ফেলবে। আল্লাহ মুননুল সাথে লাগ কলো। আল্লাহ, ও আল্লাহ, আমি ইখুন পলে যাব।
মুননা তার পিছু দৌড়াতে দৌড়াতে বলল,
‘ আমি তুমাকে মেলে ফেলব আচ। তুননুকে মেলে ফেলব।
হোঁচট খেয়ে পড়ল তাননা। মুখ থুবড়ে পড়ল। চিৎকার দিয়ে উঠল সোরা। সবাইকে চেঁচিয়ে ডাকল। ওই বাড়ির ছাদে শফিক সাহেব এসেছেন মাত্র। সোরার চেঁচামেচি শুনে বুঝে গেল। দৌড়ে নিচে নেমে আহম্মেদ বাড়িতে চলে এলেন তিনি।
মুননা এককোনায় ভয়ে ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। নাহিল এল সবার আগে। তাননাকে শান্ত হয়ে পড়ে থাকতে দেখে দৌড়ে গেল। সাহিল আর জিনিয়া ও চলে এল তারমধ্যে। জিনিয়া মাত্রই কোর্ট থেকে ফিরল। নাহিল কোলে তুলে নিতেই আওয়াজ করে কেঁদে উঠল তাননা। নাহিলের কোল থেকে কোলে নিয়ে ফেলল সাহিল। সাহিলকে দেখে আর ও জোরে কেঁদে দিল তাননা। ভয়ে ফোঁপাতে থাকল। সাহিল জোরে ধমক দিল মুননাকে।
‘ এই ছেলে তোর সাহস কি করে হয় আমার মেয়ের গায়ে হাত তোলার? হ্যা? হাত পা বেঁধে পেটাবো একদম।
জিনিয়া বকতে যাচ্ছিল মুননাকে। সাহিল বকে দেওয়ায় আবার খারাপ লাগল। নাহিল বলল,
‘ ভাই কি করছ?
মুননা ঠোঁট ফুলিয়ে চেয়ে রইল। চোখে টলমলে জল। নাক কাঁপছে। ঠোঁট টানছে। জিনিয়ার কান্না পেয়ে গেল ছেলেকে দেখে। দৌড়ে গিয়ে ছেলেকে কোলে তুলে নিল সে। বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল
‘ না না এগুলোতো এমনি এমনি বলেছে আব্বা। কাঁদতে হয়না।
মুননা আওয়াজ করে কেঁদে উঠল। জিনিয়া শান্ত করাতে পারল না। সাহিলকে বলল
‘ কিভাবে বকেছেন আমার ছেলেকে? ওরা খেলবে ও ঝগড়া ও করবে। এখন কি করেছেন দেখুন তো।
সাহিল চুপ করে থাকল। মুননা জিনিয়ার গলায় মুখ গুঁজে কাঁদল।
নাহিল মুননার পিঠে হাত বুলিয়ে বলল
‘ কেঁদোনা বাবাই। গুড্ডুকে মারব।
নাহিলের চোখ গেল নিচে। লাল রক্তের ছাপ। বসে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল নাহিল। বলল,
‘ তাননার কি মুখ থেকে রক্ত পড়েছে?
সাহিল তাননার মুখ তুলল। বলল’ না না। কেন?
নাহিল বলল,
‘ তাহলে এসব কিসের রক্তের ছাপ ? শুকিয়ে ও গেছে।
জিনিয়া দেখল। বলল
‘ তাই তো। কিসের রক্ত?
তাননা সাহিলের কাঁধ থেকে মাথা তুলে বলল,
‘ রততো?
সাহিল বলল,
‘ মা বেশি ব্যাথা পেয়েছ?
তাননা মাথা নাড়াল ঘনঘন।
মুননা কেঁদেই গেল। জিনিয়ার তীক্ষ্ণ চোখ গেল ছাদের আনাচে কানাচে। সিমেন্টের বস্তা রাখা ছাদের একপাশে। মুননাকে শান্ত করাতে করাতে জিনিয়া এগিয়ে গেল সিমেন্টের বস্তার পাশে। নাহিলকে ডেকে বলল,
‘ ভাইয়া এই বস্তাগুলো একটু সরান তো।
নাহিল সরিয়ে দিল। সাহিল বলল,
‘ কি হয়েছে রে?
রক্ত শুকিয়ে যাওয়া মোটা একটি লোহার রড পড়ে আছে।
আঁতকে উঠল জিনিয়া। সাহিলের কপালে ভাঁজ পড়ল। তাননাকে নাহিলের কোলে দিয়ে সে হাতে তুলে নিল লোহার রডটি। নড়াচড়া করে দেখতে দেখতে বলল,
‘ এটি কিসের? কার?
নাহিল বলল,
‘ কে জানে ভাই? এখানে কে রাখল?
শফিক সাহেব এলেন। বললেন
‘ কি হয়েছে রে জুনু? তোর বাচ্চাদের কি হয়েছে?
জিনিয়া মুননাকে গালে আদর করে বলল,
‘ আর বলোনা আব্বা, দুইজন ঝগড়া করছে আর কি।
সাহিল লোহার রডটি নিয়ে নিচে নেমে গেল। জিনিয়া ডাকল,
‘ কোথায় যাচ্ছেন আপনি? শুনছেন?
সাহিল বলল
‘ জায়িদের কাছে।
জিনিয়া নেমে গেল তার পিছুপিছু। নাহিল তাননার পিঠে হাত চাপড়াতে চাপড়াতে বলল,
‘ মা কি ঘুমাবেন?
তাননা হু করে শব্দ করল। নাহিল চলে যেতেই সোরাকে দেখল৷ সোরা মেয়েকে কোলে দুলাতে দুলাতে হাঁটল। নাহিল পিছু ডাকল,
‘ সোরা?
সোরা থেমে গেল। পিছু ফিরল।
_________
লোহার রডটি জায়িদের হাতে দিল সাহিল । রক্ত কার ডিএনএ টেস্ট করানোর জন্য।
জায়িদ রক্ত পরীক্ষা আর ডিএনএ টেস্ট করাতেই রিপোর্ট এল সাহিলের হাতের ছাপ। আর রক্ত কিছুদিন আগে মৃত বাবলুর।
এসে তা বলতেই জিনিয়া অবাক হলো। রাগে কেঁদে ফেলল। জায়িদ বলল,
‘ এরকম রক্তমাখা রড তুই সাহিলকে খালি হাতে ধরতে দিলি কেন জুননু? জানিস না হাতের ছাপ উঠে যায়।
সাহিল হেসে উড়িয়ে দিল জায়িদের কথা।
‘ আমার হাতের ছাপ উঠেছে তাই বলে কি আমি খুনী নাকি?
জিনিয়া চলে গেল গটগট পায়ে হেঁটে। চাপা রাগ সাহিলের উপর। কেন ধরতে গেল লোকটা। এমনিতে জিনিয়া কত ভয়ে ভয়ে থাকে।
রুমে গিয়ে ধুপধাপ দরজা বন্ধ করল জিনিয়া। সাহিল এসে দরজায় কড়া নাড়ল। তাননা মুননার ঘুম ছুটে যাবে তাই জিনিয়া দরজা খুলে দিল। বলল,
‘ আসুন। সাহিল ঘরে ডুকেই হেসে দিল। জিনিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘ কি হয়েছে?
জিনিয়া কথা বলল না। চলে যেতেই সাহিল ধরে ফেলল তাকে। পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চিবুক রাখল জিনিয়া কাঁধে। নাক ঢলে বলল,
‘ এত ভয় কেন পাও মেয়ে?
জিনিয়া ছাড়াছাড়ি করতে করতে বলল
‘ ছাড়ুন আমায়। ধরবেন না। কোনোকথা শুনতে চান না আমার।
সাহিল বলল,
‘ আরেহ এত ভয় কেন পাচ্ছ?
জিনিয়া বলল,
‘ কেন জানেন না? আমাকে টেনশনে রাখতে ভালোলাগে আপনার?
সাহিল বলল,
‘ একদম না।
জিনিয়া কেঁদেই ফেলল। আবার চোখ মুছে সাহিলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দুহাতের শক্ত বেষ্টনী দিয়ে সাহিল আবদ্ধ করল প্রিয়তমার মুখ নিজের বুকে। বলল,
‘ আমি কোথাও যাচ্ছিনা মেয়ে।
জিনিয়া আরও আওয়াজ করে কাঁদল। বলল,
‘ আমাকে নিঃস্ব করবেন না প্লিজ। আমার কথা শুনবেন।
সাহিল হাসল। বলল,
‘ মনে করো সোরার স্বামীর মতো ছেড়ে চলে গেলাম।
জোরে কেঁদে উঠল জিনিয়া। সাহিল উচ্চস্বরে হেসে দিল। বলল,
‘ পাগলী,, যাচ্ছিনা কোথাও।
জিনিয়া বলল,
‘ স্বার্থপরের মতো কথা বলেন কেন? আমার কথা না ভাবুন, বাচ্চা দুটোর কথা ও তো ভাবতে পারেন। সারাক্ষণ আজেবাজে কথা।
সাহিল বলল,
‘ আচ্ছা, আর হবেনা এমন ভুল। জিনিয়ার চোখের জল মুছে নেয় সাহিল অতি সন্তর্পনে। ভেজা মুখ আর ও ভিজিয়ে দেয়। জিনিয়া সাহিলকে আটকাতে আটকাতে বলল,
‘ বাবলুকে মারা রডটি তো পুলিশের তত্ত্বাবধানে। তাহলে এই রডটি কোথা থেকে এল? এখানে কি করে এল? কে রাখল? আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।
সাহিল সামনে চলে আসা চুলগুলো জিনিয়ার কানের পেছনে গুঁজে গুঁজে দিতে দিতে বলল,
‘ তুমি এখন আমার আদালতে আছ। সো নো ডিস্টার্ব। বুঝেছ মেয়ে?
জিনিয়া বলল,
‘ বুঝিনি। বুঝব ও না। আপনি আমার সব কথা শুনবেন। কথা দিন।
সাহিল তার মাথা দিয়ে জিনিয়াকে মারল। বলল,
‘ কথা তো বিয়ের আগে দিয়েছিলাম। মনে নেই?
চলবে,