যখন এসেছিলে অন্ধকারে

একটা আবাসিক এলাকার বিলাসবহুল এপার্টমেন্ট। এখানেই রাজন মানিকের স্টুডিও কাম বাসা। ফ্যাশন ফটোগ্রাফিতে রাজন মানিক পাকাপোক্ত অবস্থান তৈরি করে ফেলেছে। নামকরা একটা ফিল্ম ম্যাগাজিনে কাজ করছে। তার তোলা ছবিতে সেই ম্যাগাজিনের কাভার হতে পারা মানে ফিল্ম বা টিভি ইন্ড্রাস্ট্রিতে ক্যারিয়ার সেট হয়ে যাওয়া।
রাজনের ক্রিয়েটিভিটি প্রশংসনীয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যাকগ্রাউন্ড নির্বাচন, লাইট ফোকাসে সর্বোচ্চ নান্দনিকতায় ওর একেকটা ক্লিক একেকটা শিল্প হয়ে যায়। উঠতি তারকারা তো বটেই টপ স্টাররাও ওর ফটোগ্রাফি সাবজেক্ট হওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। স্টিল ফটোগ্রাফিতে রাজন মানিক নামটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

জার্সি শর্টস আর টিশার্ট পরে, কফির মগ হাতে রাজন মানিক যখন অনিকে দেখা দিলেন পেছনের দেওয়াল ঘড়িটা তখন ঘন্টার কাঁটায় বারোটা নির্দেশ করছে। ঘুম ঘুম ফোলা চোখমুখে তাকে অনেক বিরক্ত দেখা গেল৷ বয়স বোঝা যায় না লোকটার। ত্রিশ ও হতে পারে। চল্লিশের কোঠাও পার হয়ে গেছে এমনও মনে হয়। চেহারা বা জেসচার কোনোটাতেই দামী আলোকচিত্রী রাজন মানিক মনে হলো না অনির কাছে। তবু্ও বড় বেশি তাচ্ছিল্য যেন তার চোখে। ইমরানের চোখে তাচ্ছিল্য দেখেই ও মানুষের চোখ পড়তে শিখে গেছে।

কফির কাপে সিপ নিলো রাজন, সামনে কেউ আছে তোয়াক্কাই করল না। টেবিলের উপর কাপ রেখে জোরে চিৎকার করল ‘আলকাস? আলকাস?’

কেউ না আসাতে বিড়বিড় করল ‘কাজের সময় কই থাকে এরা?’ রিভলভিং চেয়ারটা ঘুরিয়ে অনির দিকে ফিরে বসে বলল ‘কী ব্যাপার?’

অনি ইতস্তত করল। তারপর বলল ‘স্পেশাল ফটোসেশান করব।’

‘টাকা জমা দিয়েছেন?’

‘হ্যাঁ।’

অনির হাত থেকে মানিরিসিট আর ইনফরমেশন পেপারটা নিয়ে চোখ বুলিয়ে বলল ‘এটা তো ফুয়াদের প্যাকেজ। জুনিয়র ফটোগ্রাফার। মেকওভার, কস্টিউম আর প্রপস আমাদের। আড়াই ঘন্টার সেশন। বেস্ট এডিটেড কপিগুলোর প্রিন্ট দেওয়া হবে। মডেলিং পোর্টফোলিও রাইট করে দেওয়া হবে। পডকাস্ট রেডি করে দেওয়া হবে।’

অনি জিজ্ঞাসু হলো ‘আপনি করবেন না?’

রাজনের গাঢ় ভুরুদুটো কুঁচকে গেল ‘আমি সেভেন্টি থেকে শুরু করি। ইনডোর, আউটডোর সেশন থাকে। ম্যাগাজিনে ছবি আসে। কাভারেও আসতে পারে।’

অনির চোখ উজ্জ্বল হয়েই দপ করে নিভে গেল।

রাজন বলল ‘কোনো অসুবিধা নেই। ফুয়াদ আর আমি একই। এমনিতেও সব ছবি আমি তুলি না। ওরাই করে সব। আমি ফিনিশিং টাচ দিয়ে দেই।’

‘সত্তরই দেবো। আপনিই করবেন কাজটা।’ অনিকে চমকে দিয়ে পরশ বলে উঠল৷ ‘এই সপ্তাহেই টাকা দিয়ে যাব। আর কী করতে হবে বলুন?’

‘ওয়েট। আমার শিডিউল কবে দিতে পারব দেখতে হবে। আর সব কাজ আমি করিও না। বিয়েশাদির ব্যাপার না তো? বিয়ের বায়োডাটায় অনেকে ফ্যাশন ফটো করায় আজকাল। আমার তোলা ছবি দিয়ে সেটা হবে না। আমি শুধু প্রফেশনাল ফটোগ্রাফি করি। সেটা আর ব্যাক্তিগত থাকে না। মডেলের ছবি আমি ম্যাগাজিন, আমার আইডি, পেইজ সবজায়গাতেই পোস্ট করি।’

‘অসুবিধা নেই।’

‘ওকে তাহলে দেখা হবে। পেমেন্ট ক্লিয়ার করে জেনে নেবেন সবকিছু। বেশি কিছু না। প্রিফটোশ্যুট মেকওভার, হেয়ারস্টাইলিং, আউটফিটের মেজারমেন্ট সব আমরাই করে দেবো।’

‘আচ্ছা আসি আমরা।’

দুইভাইবোনে বেরিয়ে এসে রিকশায় উঠতেই অনি মুখ খুলল। ‘কী হলো ভাইয়া? এতগুলো টাকা?’

‘হ্যাঁ দেবো। তোর জন্য আমার সামর্থ্যের বেস্টটা করব আমি। শুধু তুই কথা দিবি পড়াশোনা করবি ঠিকঠাক। আর এইকাজেই যদি তোর মন লাগে তুই করবি কিন্তু কোনোধরণের লোভ করা যাবে না। বুঝতে পেরেছিস?’

অনি অনিশ্চিত মাথা নাড়ল। পরশের কথা ও বুঝতে পেরেছে কীনা বোঝা গেল না। পরশ আবার বলল ‘তোর শখ হয়েছে যখন, করবি। কিন্তু এই কাজটা কিন্তু পড়াশোনার মতো সহজ না। পড়ার সময় কী হয় দেখ, তোকে একাই পড়তে হয়৷ তোর যদি মেধা থাকে, তুই যদি পরিশ্রম করিস তো তুই ভালো করবি। মিডিয়া কিন্তু সেরকম না। এখানে টিমওয়ার্ক হয়।’

অনির চোখে প্রশ্ন।

‘মডেলিং বল, বা নাটক হোক বা সিনেমা – এখানে পরিচালক থাকে, মেকআপ করার লোক থাকে, ক্যামেরার লোক থাকে, গল্প লেখে কেউ, গানের সুর দেয় কেউ – এমনকি কাজ শেষ হওয়ার পরেও পোস্ট প্রডাকশন এর অনেকগুলো সেক্টর আছে ; এইসবকিছু মিলেই কিন্তু কাজ হয়। আর্টিস্ট একা যতই পরিশ্রম করুক না কেন, যেগুলো বললাম, তার কোনো একটা কাজ ঠিকঠাকমতো না হলে পুরো কাজটাই ঝুলে যায়। বুঝেছিস? তাই ভেবেচিন্তে যা করার করবি।’

অনি আবারও মাথা নাড়ে।

‘এটা মাথায় রাখবি, কাজ করার জন্য বা কাজ পাওয়ার জন্য কোনো লোভ রাখবি না, অনি। লোকে খুব খারাপ জানে এই জগতটাকে। তুই খারাপ কিছু করবি না, এটা আমার অনুরোধ তোর কাছে। রাতারাতি বড় হওয়ার, নাম করার লোভ করিস না।’

বাড়িতে কাউকে না জানিয়েই এন্টিওয়েভ প্রডাক্টের বিজ্ঞাপন করে ফেলেছে অনি। যত ছোটো প্রডাকশনই হোক না কেন, ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে চেহারা দেখিয়ে ফেলেছে। পরশ জানে, এইটুকুও অনি একা একাই করে ফেলত, অনুমতি না পেলেও। হয়তো গয়না বেচে দিতো নইলে অন্য যেকোনোভাবেই টাকা জোগাড় করে নিতো ও। ফটোশুট ও করাতোই! বাধা পেলে আরও বেশি অসহযোগ করত। তাই পরশ সাথে থেকে, পাশে থেকে, নিজে নিয়ে এসেছে ওকে এখানে।

‘কথা দিচ্ছিস, অনি?’

জেদি অনি এইমূহুর্তে বিগলিত অনেকটাই। তরল মন ঝটপট সায় দিলো ‘হ্যাঁ, ভাইয়া।’

‘লোভ করবি না?’

‘না।’

‘পড়াশোনা করবি?’

‘হু।’

‘হ্যাঁ বল?’

‘হ্যাঁ।’

অনি ঝট করে পরশকে জড়িয়ে ধরল, ‘থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া!’

*****

‘এগুলো কী সর্বনাশের কথা পরশ? আমাদের মতো ঘরে এইসব নাটক-সিনেমা কী মানায় বাবা?’

‘কেন মানাবে না, মা? কাজ তো কাজই। অসৎ না হলে কোনো কাজই ছোটো বা খারাপ না।’

‘এত কথা মানুষ কেন বুঝবে? সমাজে চলতে হয় আমাদের। ছিঃ ছিঃ করবে মানুষ।’

‘আমাদের নিয়েই সমাজ মা, সমাজের জন্য আমরা না। আমার দুটো বোন, তুমি আর আমি – আমরা যদি ভালো থাকি, সমাজ কী বলল তাতে কিছু আসবে যাবে না।’

‘এসব বললে হয় না, বাবা। তোমার চাচারা রাগ করবে।’

‘বড়চাচাকে আমি সব বলেছি, মা। প্রথমে বকেছেন, পরে পরিস্থিতি বুঝিয়ে বললে আর কিছু বলেননি। আমি সাপোর্ট না দিলে অনি খারাপ কিছু করে ফেলত মা। ও এখন কারো কথা শুনবে না, ওর পক্ষে কথা না বললে।’

‘না, না, পরশ কাজটা ভালো হয়নি’ অস্থির হলেন সুমনা বেগম ‘সাইদা আপা কী না কী মনে করবে আবার?’

‘কে কী মনে করবে, মা?’

ছেলের দৃষ্টির সামনে একটু ইতস্তত করলেন সুমনা বেগম ‘সাইদা আপা। অনির শাশুড়ি!’

‘অনির আবার শাশুড়ি কীরকম? ওর বিয়েটা তো ভেঙে গেছে?’

‘হ্যাঁ। কিন্তু সাইদা আপা আশা করে আছেন, ইমরান ফিরলে আবার ওদেরকে এক করে দেবেন। এভাবে ভাঙতে চাইলেই কী ভাঙা যায়?’

‘মা, এই আশা তুমি আর মনে রেখো না। এসব থেকে বেরিয়ে এসো। বেরিয়ে এসে অনির হাতটা শক্ত করে ধরো। অন্ধকার যে চোরাগলিটাতে ওর জীবনটা ঢুকে গেছে, সেখান থেকে বের করে আনতে না পারলেও, ওর হাতটা শক্ত করে ধরো। যেন, হোঁচট খেয়ে পড়ার মূহুর্তে ও জানতে পারে, আমরা আছি ওর সাথে। ওর পাশে। তাহলে গলির শেষপ্রান্তে একটা রাস্তা ও নিজেই বানিয়ে নিতে পারবে।’

‘তাই বলে নিজে গিয়ে এইভাবে এইপথে এগিয়ে দেওয়াটা তোমার ঠিক হয়নি। এমনিতেই কথা শোনে না। আরও আস্কারা পেয়ে বসল। অনি অবুঝ, কিন্তু তোমার বুদ্ধির প্রশংসা সবাই করে বাবা।’

‘সেটাও ভেবেছি মা। কিন্তু ও মনস্থির করেই ফেলেছে। মডেলিংই করবে। ওকে আমরা আটকাতেও পারতাম না। আমরা ওর হাতটা ছেড়ে দিলে, যদি খুব খারাপ কারো খপ্পরে পড়ে যায়, সেই ভয়টাই আমি পাচ্ছি, মা।’

‘হাত, পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখি না কেন?’

‘সেটাই তো আমরা করেছি মা। ওকে ভেতর থেকে ভেঙে দিয়েছি! ও যে বেঁচে আছে, সেটাই খুব বেশি মনে হয় না তোমার? যে জীবনটা আমরা ওকে দিতে চেয়েছিলাম, সেটা ওকে মেরে ফেলেছে। এখন ওর মতো করে একটা জীবন, ও বাঁচুক! এত ভেবো না মা।’

‘ভাবতাম না পরশ। মেয়েটা যদি খুব চালাক চতুর হতো, তবে ভাবতাম না। এই মেয়েতো মনের খেয়ালে চলে, লোকে ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে যাবে।’

এই ভয়টা পরশেরও। অনি এত বেশি আবেগপ্রবণ যে ঝড়ের মুখে একেবারে হুড়মুড় করে ভেঙে যাবে।

রাজন মানিক ডেট দিয়েছে। ওনার স্টাইলিং টিমের সাথে অনির বেশ কয়েকটা গ্রুমিং সেশন হবে…

চলবে…

Afsana Asha

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here