১৭+১৮
মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১৭
মোনা’কে দুই’টা বিষয় ভীষণ ভাবাচ্ছে। জ্যাক কেন ও’কে এত সাহায্য করছে? প্রিয়ম কেন মোনার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে? জ্যাকের বিষয়’টা কিছুতেই ভেবে পেলো না। মোনার বার বার ইচ্ছে করছে জ্যাকের কাছে কারণ জিজ্ঞেস করতে। কিন্তু নানা সংশয়, দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে তা আর হয়ে উঠছে না। প্রিয়মের কথা ভাবতেই মোনার মুখ ইস্পাতের মত কঠিন হয়ে যায়। লিলি বেগম মোনাদের বাসায় আসে প্রায়ই। মোনা কে বার বার বলে,
-“মোনা তুই কি কোন কারণে আমার উপর রাগ করে আছিস?”
মোনা উত্তরে হেসে না বলে। আসলে মোনা লিলি বেগমের উপর রাগ করে নেই। লিলি বেগমের উপর কেন রাগ করবে? কিন্তু মোনা কেন জানি আগের মত সহজ আচরণ করতে পারছে না। বার বার সেই রাতের কথা মোনার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। মোনা নিঃশব্দে কেঁদে উঠে, মোনার চোখে কান্নার শুষ্ক রেখা।
__
মোনা প্রিয়মের মুখোমুখি বসে আছে। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে দেখাটা হয়েছে। মোনা বুক স্টোরে আসছে বই পড়তে। প্রিয়ম বই নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। মোনা আড় চোখে তাকাচ্ছে।
-“মোনা আমি প্রচুর বই পোকা মানুষ। পার্টি,আড্ডা ওসব বাদে যে টাইম থাকে আমি বই পড়েই কাটাই। হয়ত রাতে নাইটক্লাবে যেতাম নয়ত বই পড়তাম।”
খুব সহজ গলায় কথা গুলো বলল প্রিয়ম। এমন ভাবে বলেছে বোধ হচ্ছে ওঁদের সাথে সম্পর্ক খুব উন্নত। মোনা’কে নিরুত্তর দেখে আবার বলল,
-“এখন আর নাইট ক্লাবে যাই না। ওসব বাদ দিয়ে দিয়েছি। একটা চাকরির জন্য ট্রাই করছি। খুব ভালো একটা চাকরি।”
মোনার মনে হচ্ছে ও অন্য এক প্রিয়ম কে দেখছে। পরিবর্তনশীল একজন মানব। মোনা বলল,
-“ও।”
-“তুমি এখানে আজ প্রথম আসলে? আমি তো প্রায়ই আসি।”
মোনা বই থেকে চোখ তুলে বিরক্ত হয়ে বলল,
-“এখানে অনেক মানুষ বই পড়ছে , তাঁদের ডিস্টার্ব হচ্ছে। প্লীজ স্টপ।”
মোনা বুক স্টোর থেকে বের হয়ে যায়, প্রিয়মও পিছনে পিছনে বের হয়। মোনা দ্রুত পায়ে তাড়াতাড়ি হেঁটে প্রিয়মের থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করল। প্রিয়ম লম্বা লম্বা পা ফেলে মোনার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ।লম্বা সুরে মোনার নাম ধরে ডাকলো। মোনা কর্কশ গলায় কথা বলল না, বিরক্তও হলো না। খুব সহজ গলায় বলল,
-“কিছু বলবেন?”
-“হ্যাঁ।”
মোনা অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল,
-“প্রিয়ম ভাই আপনায় না আমার চিনতে কষ্ট হচ্ছে। উদ্দেশ্যে কি আপনার?”
-” পরিবর্তন হওয়া, তোমার মনের মত হওয়া,তোমায় ভালোবাসা।”
খুব স্বাভাবিকভাবেই বলল প্রিয়ম। মোনার মুখ কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে উঠছে।
-“আর কিছু?”
-“মোনা তুমি আমার কথা সিরিয়াস ভাবে নিচ্ছো না। প্লীজ মোনা বি সিরিয়াস।”
মোনা উত্তর দিলো না। এসব কথার উত্তর খুঁজে পেলো না। মোনার চোখে মুখে নির্লিপ্ততা, কোন পরিবর্তন নেই। একদম ভাবলেশহীন। প্রিয়মের চেহেরা দেখে মনে হচ্ছে ও খুব অনুতপ্ত, অনুশোচনায় ভুগছে।
-“আমি তো ছোট বেলা থেকেই আমেরিকায় বড় হয়েছি। শুধু মা-বাবার কাছ থেকে বাংলা ভাষা’টা শিখেছি। বাংলাদেশের আর কিছুই শিখি নি, কিছুই জানি না। তোমরা যেমন কারো সাথে দেখা হলে হ্যান্ডশেক করো বা সালাম দিয়ে ভাব বিনিময় করো। আমি ছোট বেলা থেকে জড়িয়ে ধরে, চুমু খেয়ে ভাব বিনিময় করা শিখেছি। এটা আমার ভুল? আমার কাছে নাইট ক্লাবে যাওয়া, ফুর্তি করা ওগুলো খুবই সাধারন ব্যাপার।‌‌‌‌‌‌‌কারণ আমি এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছি, সেখান থেকে আমি এগুলো শিখেছি স্বাভাবিক আর পাঁচটা জিনিসের মত। এগুলো তে আমার কোন পাপবোধ হতো না।তুমি আমার কাছ থেকে তোমার কালচারাল আচরণ প্রত্যাশা করতে, আমিও ঠিক তোমার কাছ থেকে আমার কালচারাল আচরণ প্রত্যাশা করেছি। এটা আমার অন্যায়?”
খুব কঠিন ধাঁধার মুখোমুখি হলো মোনা। কথা গুলো যুক্তিনিষ্ঠ। মোনা চুপ করে থাকল। প্রিয়ম আবার বলল,
-“আমি পরে বুঝতে পেরেছি এ বিষয় গুলো তোমার কাছে খুব সেনসিটিভ।আমি হঠাৎ করে তোমার মাঝে অন্যরকম বিশেষত্ব খুঁজে পাই। যখন তুমি আমাদের বাসা থেকে চলে আসলে দূরত্ব সৃষ্টি হলো।আমি তোমার লজ্জা পাওয়া,তোমার বিরক্ত হওয়া, তোমার রাগ হওয়া, তোমার অসহায় চাহনি সব আমি বাজে ভাবে মিস করতে থাকি। আমি অনুভব করলাম তোমায় প্রয়োজন আমার। আমি তোমার জন্য নিজেকে পরিবর্তন করতে পারব।”
কথা শেষে প্রিয়ম মোনার দিকে তাকায় মোনার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য।মোনা সহজ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। প্রিয়ম মোনার উত্তরের জন্য আগ্রহী গলায় উতলা হয়ে বলে,
-“মোনা কিছু বলছো না কেন?”
-“আচ্ছা প্রিয়ম ভাই আমি বুঝলাম, আপনি আমার সাথে যা করেছেন তা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। আপনার উপর তাহলে আমার আর কোন রাগ থাকলো না।”
মোনা হাতের কব্জিতে দেওয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আমার যেতে হবে।”
-“শুধু মাফ, আর কিছু না? মোনা তুমি সব কিছু বুঝেও অবজ্ঞা করছো।”
মোনা প্রিয়মের অস্থির হয়ে হয়ে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে গাঢ় গলায় বলে,
-“নাথিং এলস।”
মোনা দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়। কিছুদূর এসে পিছনে তাকায়।না..প্রিয়ম পিছু পিছু আসে নি। মোনা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। প্রিয়মের বলা কথা গুলো মোনার কথায় তীব্র ভাবে আন্দোলিত হচ্ছে। প্রিয়মের উপর যে রাগ ছিলো তা চলে গেছে। এর বেশি কিছুই মোনা ভাবছে না। ভাবার প্রশ্ন আসে না। মোনা ধীরে ধীরে ওর বাসার দিকে এগিয়ে যায়।

বাসায় পৌঁছানোর একটু পর জ্যাকের ম্যাসেজ। জ্যাক ছোট একটা ম্যাসেজ করে বলল,
-“প্রিন্সেস অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
জ্যাক মোনা’কে যেতে বলেনি। কিন্তু এই ম্যাসেজে যাওয়ার আহ্বান স্পষ্ট। প্রিন্সেসের অসুস্থতার কথা শুনে মোনার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেলো। মোনা,নিশান কে নিয়ে জ্যাকের বাসায় আসলো। প্রিন্সেস চিৎকার দিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। মোনার সাথে জ্যাকের যেদিন প্রথম দেখা হয়েছে সেদিনও এভাবে কেঁদেছিলো প্রিন্সেস। মোনার মনে হচ্ছে কান্না প্রিন্সেসের জন্য না, প্রিন্সেস সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মত হাসবে। জ্যাক’কে অস্থির দেখাচ্ছে। মেয়ের অসুস্থতার শোক চোখ মুখে তীব্র ভাবে প্রকাশিত। মোনা প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কান্না থামছে না। কিছুক্ষণ পর মেডিসিন নিয়ে আসে একজন। মেডিসিন খাওয়ানোর পর কান্না কিছুটা থেমে আসে। মোনা অনারাবত প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়ে হেঁটে পাঁয়তারা করছে। প্রিন্সেসের কান্না থেমে আসলে জ্যাকের চোখে মুখে স্বস্তি দেখা যায়। খুব বড় চিন্তা থেকে অবসান হয়েছে যেন। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকে জ্যাক’কে একজন ডাকলো। বলল,
-” ক্লাইন্ট এসেছে।”
জ্যাক মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“আপনি ও’কে নিয়ে বসুন, আমি আসছি।”
প্রিন্সেসের গোলাপী রঙা ঠোঁট দুটো কান্নার কারণে আরো গোলাপী হয়ে উঠেছে। চোখ গুলো ফুলে উঠেছে। মোনা প্রিন্সেস কে বিছানায় শুইয়ে দেয়। প্রিন্সেসের সয্যার পাশে বসে। নিশান বাসার এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। এ বাসাটা এখন নিশানের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে।
মোনা প্রিন্সেসের চোখ অবধি লেপ্টে থাকা চুল গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিচ্ছে। মোনার হঠাৎ চোখ যায় বেড সাইডে রাখা বেগুনি রঙের একটা ডায়েরির দিকে। ডায়েরি’টা তে মোটা আকৃতিতে গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে লিখা ‘প্রেগন্যান্সির দিন গুলো।’ এটা কম্পিউটারে টাইপ করা লেখা না, কারো হাতে লেখা। মোনা ভ্রু কুঁচকে প্রচন্ড আগ্রহে হাতে নেয় ডায়েরি’টা। ডায়েরি’টার প্রথম পৃষ্ঠা উল্টানোর ইংরেজি তে লেখা,
“তুমি এই ডায়েরি তে কি লিখেছো আমি আজও বুঝি নি।তোমার দেশের ভাষায় লেখা। তবুও আমি প্রায় এই ডায়েরি খুলে পৃষ্ঠা উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখি। এতে যে তোমার হাতের ছোঁয়া রয়েছে কুইন।”
(জ্যাক)
মোনার আগ্রহ বোধ সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছে যায় যেন। এটা জ্যাকের বউয়ের বাংলা ভাষায় লেখা একটা ডায়েরি। মোনা পৃষ্ঠা উল্টালো,
“আজ ডাক্তার বলল আমার মাঝে নতুন এক প্রান বেড়ে উঠেছে।এ আনন্দ প্রকাশ করব কিভাবে? মাতৃত্বের স্বাদ পেতে যাচ্ছি, পরিপূর্ণ এক নারী হতে যাচ্ছি।”
এক পৃষ্ঠায় শুধু এই টুকুই লেখা। মোনা পরের পৃষ্ঠা উল্টাতে উদ্যত হলেই রুমের দিকে আসতে থাকা পায়ের শব্দে অপ্রস্তুত ভাবে ডায়েরি’টা রেখে দেয়। জ্যাক এসেছে।
(চলবে)

পর্ব-১৮
জ্যাকের বাসা থেকে ফেরার পর মোনার মাথায় শুধু একটা কথাই আন্দোলিত হচ্ছে, জ্যাকের বউ বাংলাদেশি! এমন চঞ্চলকর তথ্যে মোনা চমকালো ভীষণ। বিশালাক্ষীর অধিকারী প্রিন্সেস,চোখের মনি কুচকুচে কালো, চুল গুলো ঘন কালো অথচ জ্যাকের চোখ গুলো ছোট আকৃতির, চোখের মনি কালো না, চুল ব্রাউন রঙের। জ্যাক বলেছিল প্রিন্সেস ওঁর মায়ের মত হয়েছে। স্ত্রীর প্রতি জ্যাকের গভীর ভালোবাসা ছিলো, স্ত্রীর প্রসঙ্গ‌ আসলেই গভীর বেদনায় জ্যাকের চোখ দুটো ছলছল করে মোনা লক্ষ্য করেছে।
সন্ধ্যা নেমে আসে। সূর্য রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার মত আভা নিয়ে আস্তে আস্তে তলিয়ে যেতে থাকে। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামে, চারদিক অন্ধকার হয় ক্রমশ। চারদিকের নীরবতা, নির্জনতা গাঢ় হয়। এতদিন চাঁদের আলোতে আলোকিত হত আকাশ-পাতাল, মোনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জোছনা বিলাস করতো। এখন অমাবস্যায় ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। মোনার গা মাঝে মাঝে ছমছম করে উঠে। নিশানেরও বোধ হয় এমনটা হয়। নিশান মাঝ রাতে হঠাৎ হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দিশেহারা হয়ে মোনা’কে খুঁজে। মোনা আশ্বস্ত ভরা গলায় বলে,
-“নিশান, এই তো আমি। কিসের এত ভয় তোর?”
নিশান ভরসা পায়। মোনা নিশানের হাত চেপে রাখে শক্ত ভাবে। মোনা ভাবে জ্যাক’কে জিজ্ঞেস করবে তাঁর স্ত্রীর প্রসঙ্গ‌ে। পরক্ষনে ভাবে জ্যাক তাহলে বুঝে যাবে মোনা ডায়েরি পড়েছে। অন্যের ব্যক্তিগত ডায়েরি এভাবে খুব অপরাধের। কিন্তু মোনা এত বেশি কৌতুহলী হয়ে উঠে যে অপরাধ বোধের কথা মাথায় আসে নি।

প্রতিদিনকার মত আরেকটা নতুন সকালের সূচনা হয়। মোনা ভার্সিটি তে যায়। আজ এক অদ্ভুত কান্ড ঘটেছে। ক্লাসের সব চেয়ে ভালো ছাত্র হেনরি, ও’কে নিয়ে দুই মেয়ের মাঝে প্রচন্ড মারামারি হয়। মোনা মনে মনে হাসছে কিন্তু মুখ গম্ভীর। মেয়ে দুটো কারো থেকে কেউ কম না। আর হেনরি ছেলেটার এই বিষয় নিয়ে কোন উদ্বিগ্নতা দেখা গেলো না। মোনা বিমূঢ় হয়ে দেখছে। তাঁর আরো অনেক গুলো গার্লফ্রেন্ড রয়েছে। ভালো স্টুডেন্ট হওয়ার সুবাধে গার্লফ্রেন্ডের অভাব নেই। হেনরি গম্ভীর গলায় বলল,
-“স্টপ ইট,স্টপ ইট। তোমরা কি পাগল হয়ে গেলে?”
শ্রুতি মোনার হাত ধরে টেনে সেখান থেকে নিয়ে এসে ধমক দিয়ে বলল,
-“ওগুলো এত মনোযোগ দিয়ে দেখার কি আছে?এমন ভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখেছো মনে হচ্ছে পন্ডিত মশাই তোমায় ম্যাথ বুঝাচ্ছে।”
মোনা হাসে। মোনা শ্রুতির অনেক কথারই প্রত্ত্যুতর করে না। শুধু সৌজন্যমূলক হাসে। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে মোনা বলে,
-” সমীরের সাথে তোমার ঝগড়া বিবাদ মিটেছে?”
শ্রুতি মুখে অহংকারের হাসি। গর্বের দীপ্তিতে বলে,
-“সমীর আমায় অনেক ভালোবাসে। আমি যতই অপরাধ করি ও মাফ করে দেয়।”
মোনা ক্লাসে মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করছে। যা বুঝে না তা শ্রুতির কাছে জিজ্ঞেস করে পরে। মোনা যতটা কঠিন ভেবেছিল ততটা কঠিন না। ভার্সিটি ছুটির পর শ্রুতি বলে,
-“এই মোনা যাবে এক জায়গায়?”
মোনা জোর গলায় তাড়া দেখিয়ে বলে,
-“না, না শ্রুতি আমি কোথায়ও যাবো না।”
-“কেন তাড়া আছে তোমার?”
-“হ্যাঁ, আমি ভার্সিটির পর পার্ট টাইম জব করি।”
শ্রুতি যেন মনোক্ষুণ্ন হলো। সহানুভূতি প্রকাশ করে বলল,
-“ভার্সিটির পর জব অনেক কষ্ট তো তোমার। বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয় তো তোমার।”
মোনা ম্লান হেসে কাজের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। লরি কোন নোটিশ ছাড়াই কয়েকদিন আসে নি। আজ আবার এসেছে। লরি মোনালিসা নামটা উচ্চারণ করতে হিমশিম খায়। মোনা বলে মোনালিসা না ডাকতে পারলে শর্টকাটে মোনা ডাকতে। লরি মোনা কে মনা বলে। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয়ে বলে,
-“মনা তোমার একটা আমেরিকান নাম রেখে দিই?”
লরি‌ এতদিন না আসার কারণে মোনা জিজ্ঞেস করে,
-“কোথায় ছিলেন এতদিন?”
-“খুব অসুস্থ ছিলাম। আমি একা থাকি এখানে, অসুস্থ হয়ে বিছানায় পরে ছিলাম। কারো সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারেনি,করার মত হুঁশ ছিলো না। আর আমায় দেখার মতোও কেউ ছিলো না। আর কয়েকদিন ওমন অসুস্থ থাকলে অসুখে না মরলেও, ক্ষুধায় মরতাম।”
মোনা দুঃখ প্রকাশ করে। লরি কে সহজ-সরল মনে হয় খুব। মোনার এখানে যত সমস্যা হয় লরি সমাধান করে দেয় নিমিষেই। লরি না থাকলে অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হতো। খুব আন্তরিক লরি।

মোনা বাইরে থেকে খাবার নিয়ে যায়। বিশ্রাম নিবে শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়েছে। বাসায় গিয়ে রান্না মোটেও সম্ভব না। বাসায় গিয়েই গা এলিয়ে দেয় বিছানাতে। নিশান কে শাসিয়ে বলে,
-“আমায় কোন রকম বিরক্ত করবে না, খুব ক্লান্ত আমি।”
নিশান কোন বিরক্ত করেনি মোনা কে। গভীর মনোযোগে আঁকছে। বাসায় সারাক্ষন আঁকাবাঁকা নিয়ে পড়ে থাকে, স্কুল থেকে এসেই আঁকতে বসে। মোনা বিভিন্ন রকমের রং পেন্সিল কিনে দিয়েছে। মোনার চোখ ঘুমে লেগে আসতেই ফোন বেজে উঠে। মোনা রাগে চিৎকার করে উঠে বসে। নিশানের মনোযোগে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। আচমকা চিৎকার এর ফলে নিশান হকচকিয়ে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে লিলি বেগমের ফোন নম্বর ভাসছে। মোনা কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রাগান্বিত গলায় বলল,
-“মোনা তুই এখনো আসলি না যে? কতক্ষণে আসবি? আসতে সমস্যা হলে বল প্রিয়ম’কে পাঠাই।”
মোনা ভুলেই গিয়েছিল আজ বার্থডে প্রিয়মের। অথচ লিলি বেগম কাল এসেও বলে গেছে, বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে। সেই কবে কার্ড দিয়ে গেছে, কার্ড কোথায় রেখেছে তাও খেয়াল নেই। নিশান হয়ত ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছে। মনে থাকলেও যে মোনা যেত এমনটাও না। মোনা বলে,
-“এই তো খালা আমি আসছি।”
লিলি বেগমের গলা শুনে মনে হলো প্রচন্ড খুশি হয়েছে। মোনা ফোন রেখে শুয়ে পরে। আজকাল খুব গুছিয়ে মিথ্যা বলা শিখে গেছে মোনা, কেউ বুঝতে পারে না। ওই বাসার কথা মনে হতেই মোনার মুখ কঠিন হয়ে উঠে। কখনো যাবে না ওখানে। মোনার ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে ঘুম আসছে না, মোনা চোখ বুঁজে শুয়ে আছে। মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে লিলি বেগমের উপর। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন বাজে। মোনা জানে ফোন অফ করে রাখলে লিলি বেগম মোনা কে নিতে হয়ত প্রিয়ম কে পাঠাবে নয়ত এরিক কে। মোনা ফোন ধরে বলে,
-“খালা আমার একটু কাজ পড়েছে, আসতে লেইট হচ্ছে। তোমরা শুরু করো।”
লিলি বেগম রেগে বলে,
-“এই রাতের বেলা তোর কিসের এত কাজ মোনা? সব গেস্ট এসে গেছে। কোথায় তুই?আমি কাউকে পাঠাচ্ছি।”
-“কাউকে লাগবে না খালা। আমি আসতেছি।”
লিলি বেগম ফোন রাখার কিছুক্ষণ পর প্রিয়মের ফোন নম্বর থেকে ম্যাসেজ আসে–
“আমি জানি তুমি বাসায় এবং আসবে না, আমি তোমার জন্য ওয়েট করছি। তুমি যদি আসো এক ঘন্টা পর শুরু করি পার্টি।”
মোনা রিপ্লাই করে,
“অপেক্ষা করার দরকার নেই আমি আসবো না, আপনার পার্টি আপনি শুরু করতে পারেন।”
“আচ্ছা মোনা তুমি বলেছিলে না আমার উপর তোমার এখন কোন রাগ নেই? তাহলে আসতে সমস্যা কোথায়?”
মোনা বিরক্ত মুখে উত্তর দেয়,
“কোন না কোন জায়গায় সমস্যা আছে।আসবো না আমি। আর শুধু আমার জন্য আপনি গেস্ট দের বসিয়ে রেখেছেন! আমার তো এখন নিজেকে খুব স্পেশাল পার্সন মনে হচ্ছে।”
মোনা ফোন হাত থেকে রেখে দেয়।প্রিয়ম অনেক গুলো টেক্সট করে মোনা উত্তর দেয়না। নিদারুণ এক অনাগ্রহ কাজ করছে মোনার মর্মদেশে।
___
সকালের আলো ফুটতে না ফুটতেই মোনার বাসার কলিং বেল অনাবরত বেজে যাচ্ছে। মোনা ঘুম ঘুম চোখে উঠে গায়ের কুঁচকানো জামা কাপড় ঠিক করে দরজা খুলে। লিলি বেগম হন্তদন্ত হয়ে দরজা দিয়ে ঢুকে। মোনা লিলি বেগমের রাগ শোনার জন্য প্রস্তুত হয়। লিলি বেগম ক্ষুব্ধ গলায় বলে,
-“একদম মায়ের মত রাগ, জেদের স্বভাব হয়েছে না? এই মেয়ে তোকে আমি কত বার ফোন করেছি? এই জেদের কারণে সারাটা জীবন তোর মা অশান্তি ভোগ করে গেছে।”
মোনা অরব থাকে কিছুক্ষণ। খানিক বাদে লিলি বেগমের দিকে আস্তে করে বলে,
-“মা না হয় রাগের কারণে অশান্তি ভোগ করছে, তুমি কিসের কারণে অশান্তি ভোগ করেছো?”
লিলি বেগমের মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। আসলেই তো সে কিসের কারণে অশান্তি ভোগ করেছে।নিরেট সত্য এক প্রশ্নতে ধাঁধার মুখে পড়লো লিলি বেগম।
নিজের কথায় নিজেই পরাস্ত হলো লিলি বেগম। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে ফেলে।
-“আমার কথার কোন দাম নেই? তোকে এত করে বললাম গেলি না, উল্টো আমায় মিথ্যা কথা বললি।”
রাগে নাকমুখ লাল হয়ে উঠে লিলি বেগমের। মোনা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিছানায় বসে পরে।লিলি বেগমের কথা মোনার কর্ণপাত হচ্ছে না। মোনা ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য রওয়ানা হতে লাগলো।
-“খালা তুমি যাবে নাকি থাকবে?”
লিলি বেগম নিজের ওয়ালেট’টা ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে হাতে নিয়ে বলে,
-“আর কখনো আসবো না তোদের বাসায়।”
মোনা লিলি বেগমের রাগ প্রশমিত করার চেষ্টা করছে না, মোনার ইচ্ছে করছে না। লিলি বেগম বেরিয়ে গেলো। মোনা একটু পর ভার্সিটির জন্য বের হলো। মোনার সামনে গাড়ি এসে থামে। এটা প্রিয়মের গাড়ি মোনা জানে।
-“মোনা গাড়ি তে উঠো পৌঁছে দিই।”
-“না,না দরকার নেই। আমি ট্যাক্সি করে যাবো।”
প্রিয়ম গাড়ি থেকে নেমে মোনার হাত ধরে বলে,
-“আজ আমি পৌঁছে দিবো চলো।”
মোনা বিরক্ত গলায় বলে,
-“দরকার নেই বলছি তো।”
প্রিয়ম জোর গলায় বলে,
-“দরকার আছে।”
প্রিয়ম অস্থির ভঙ্গিতে এদিক ওদিক তাকিয়ে আবার বলে,
-“তুমি যদি আমার কথা না শুনো কি হবে জানো?এই রাস্তার মাঝে জড়িয়ে ধরবো।”
মোনার মুখ বিবর্ণ হয়ে যায়। হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে,
-“এই পরিবর্তন হয়েছেন আপনি? ছাড়ুন আমার হাত!”
-“আমি পরিবর্তন হয়েছিই তো। কিন্তু তুমি তো আমায় পরিবর্তিত থাকতে দিচ্ছো না। ভালো কথা তোমার কানে যায় না, গেলেও অন্য কান দিয়ে বেড়িয়ে যায়।”
প্রিয়ম মোনা’কে জোর করে গাড়িতে তুলে। মোনা পেরে উঠে না প্রিয়মের অসুরে শক্তির বিরুদ্ধে। প্রিয়ম গাড়ি স্টার্ট করলো। গাড়ি মোনার ভার্সিটির সামনে আসলে মোনা গাড়ি থামাতে বলে। প্রিয়ম মোনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“কাল তো আমার বার্থ ডে তে যাও না, তাই আজ তোমায় নিয়ে লং ড্রাইভে বের হলাম।”
মোনা আঁতকে উঠে। অনুনয় করে বলে,
-“আমি ভার্সিটিতে যাবো,প্লীজ গাড়ি থামান।”
প্রিয়ম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল,
-“ভয় পেয়ো না, চুমু-টুমু খাবো না।”
গাড়ি চলতে থাকে। মোনা জড়সড় হয়ে বসে থাকে। নতুন এসব জায়গা মোনা আর দেখেনি। প্রিয়ম মোনা কে সব কিছুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে। মোনা হতাশ হয়ে চুপ করে থাকে। কিছুক্ষণ পর পর আর্তনাদের মত করে বলে,
-“আপনি আমার সাথে এমন কেন করছেন?”
-“তুমি বুঝো না কেন কি করি? ভালোবাসো আমায় তাহলে তোমার কথা মত চলবে।”
মোনার কপালে কয়েকটা ভাঁজ পড়ে। মুখ জুড়ে অমাবস্যার রাতের মত অন্ধকার নেমে আসে যেন। মুখটা বিবর্ণ, পান্ডুর,ফ্যাকাশে হয়ে থাকে।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here