মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৭+৮
মোনা অকারণে নিশানের মাথা ভর্তি চুলে আঙুল বিলি করছে।নিশানের চুল গুলো একদম ইমরুল চৌধুরীর মত,সিংহের কেশর যেন। বাবার কথা মনে পড়তেই মোনার চোখের সামনে আরেকটা ঘৃন্যিত মুখ ভেসে উঠলো । মোনার চূর্ণ বিচূর্ণ বুকটা বার বার ভারী হয়ে উঠছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছে, যায় মোনার শরীর ঈষৎ নড়ছে। হিমেল বাতাস লাগা দিঘির পানির মত মোনার ঠোঁট কাঁপছে। মোনা কষ্ট কে ঠাঁই দিতে চাচ্ছে না। কষ্টকে একবার ঠাঁই দিলেই ক্রমে ক্রমে বৃদ্ধি পায়। মোনা নিজেকে আবেগশূন্য একজন মানুষ বানাতে চায়। যার কোন কষ্ট,আফসোস কিছু নেই। ম্লানি দৃষ্টি মেলে জানালার দিকে তাকায় মোনা। চোখ গুলো নিজের অনিচ্ছাসত্ত্বেও বার বার ঝাঁপসা হয়ে আসে। মোনা চোখ মুছে!
__
লিলি বেগম রুমে বসে আছে হাবিবের সাহেবের অপেক্ষায়। হাবিব সাহেব কখন বাসায় ফিরবে?মোনার ঘাড়ে যে বদনাম দিয়েছে, তার পিছনের সত্যিটা জানাবে। সকাল পেরিয়ে দুপুর হয়ে গেলো প্রিয়ম বাসায় ফিরেনি। লিলি বার বার প্রিয়মের নম্বরে ডায়েল করছে, ফোন সুইচ অফ! লিলি বেগম যথারীতি হতাশ হয়। ছোট ছেলেটা লিলির খানিক বাধ্য থাকলেও প্রিয়ম একদম কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেছে।এই সবটাই হাবিব সাহেবের আশকারায়। নিজের ইচ্ছে মত ছেলেদের মানুষ করতে পারলো না। লিলি ক্ষীণ নিঃশ্বাস ছাড়ে। এ সংসারে তার যেন কোন গুরুত্ব নেই, তার অনুপস্থিতিতেও যেন কেউ অভাব বোধ করবে না।
গেটের সামনে গাড়ির শব্দ পাওয়া গেলো।লিলি বেগম জানালার ফাঁক দিয়ে তাকালো। কালো রঙা কারে চড়ে প্রিয়ম এসেছে। লিলি বেগম রুম থেকে বের হয়। প্রিয়ম গাড়ি পার্ক করে বাসায় ঢুকে। উদ্ভ্রান্তের মতো দেখাচ্ছে প্রিয়ম কে, চোখ দুটো ফুলে লাল হয়ে গেছে। এলেমেলো পায়ে হাঁটছে। লিলি বেগম ক্ষুব্ধ গলায় বলল,
-“প্রিয়ম আমার রুমে আয়।”
প্রিয়ম মায়ের দিকে তাকায়। লিলি বেগম ওদের সাথে শক্ত গলায় কথা বলা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে। নিছক রাগ দেখিয়ে কি লাভ, যে রাগে ছেলেদের কোন ভাবান্তর, পরিবর্তন নেই।প্রিয়ম লিলি বেগমের পিছনে পিছনে যায়।ধপ করে খাটের উপর বসে পড়ে ক্লান্ত ভর করা শরীরে। দুর্বল গলায় বলল,
-“কি বলবে আম্মু?”
-“রাত থেকে কোথায় ছিলি?”
প্রিয়ম ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বলে,
-“এমন ভাবে বলছো মনে হচ্ছে এটা খুব নতুন কিছু?”
লিলি বেগমের নাক মুখ শক্ত হয়ে আসে রাতে। সন্তান যদি এত বেপরোয়া হয়ে উঠে,তখন আফসোস করা ছাড়া উপায় থাকে না। লিলি বেগম চেঁচিয়ে উঠল।
-“তুই মোনা কে কেন নাইট ক্লাবে নিয়েছিস জোর করে?এতটা বেপরোয়া হয়েছিস ।কোনটা করা উচিত, কোনটা করা উচিত না তাও বুঝিস না? বিবেক, বুদ্ধি সব লোপ পেয়েছে।”
প্রিয়ম সহজ, স্বাভাবিক গলায় বলে,
-“হ্যাঁ আমি ওকে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু সকালে তো পাইনি ওকে। মোনা কি বাসায় চলে এসেছে?”
লিলি বেগম নির্বাক হয়ে যায়। কত সাবলীল ভাষায় কথাগুলো বলছে প্রিয়ম! লিলি বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“মোনার সাথে কথা বলবি না তুই। ওরা তোদের মত এত স্মার্ট নয়! ওদের লাইফস্টাইল, মেন্টালিটি , চিন্তা-ভাবনা তোদের মত না। এইটুকু অন্তত তোর বুঝা উচিত।”
প্রিয়ম কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিচু গলায় বলল,
-“স্যরি আম্মু।”
-“স্যরি না বলে নিজেই রিয়েলাইজ কর যে তুই ওর সাথে অন্যায় করিস নি?”
প্রিয়ম কোন উত্তর না দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। লিলি বেগম গম্ভীর মুখে বসে থাকে। লিলি বেগমের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে এখান থেকে চলে যেতে। এত টাকা,গাড়ি,বাড়ি কিন্তু সুখ কোথায়? সুখ যে বড্ড আপেক্ষিক জিনিস! প্রতিপত্তির মধ্যে তো সুখ বিদ্যমান না! বাহির থেকে লিলি বেগম কে সবাই দেখলে ভাবে কত হাসি খুশি মানুষ সে! অথয ভিতরটা ভীষণভাবে ক্ষতবিক্ষত। তৃষ্ণার্ত কাকের মত কম সুখের সন্ধান করেনি। কিন্তু পাইনি কখনো।
___
মোনা দরজা খুলেনি রুমের ভিতরই বসে ছিলো। সব কিছুতে অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছে, উদাসীন হয়ে যাচ্ছে। নিশান সব জামাকাপড় এলোমেলো করে রেখেছে। মোনা অভ্যস্ত হাতে জামাকাপড় গুলো ভাঁজ করছে। সময় কাটছে না! জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে যেন। বেঁচে থাকার কোন কারণ খুঁজে পায়না আজকাল।
হাবিব সাহেব অফিস থেকে ফিরে আসে। হাতের কব্জি থেকে ঘড়িটা খুলে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখে। ক্লান্ত হাতে টাই খুলে। লিলি বেগম বিধ্বস্ত মুখে খাটে বসে থাকে। হাবিব সাহেব একজনর সেদিকে তাকায়। তারপর চোখ ফিরিয়ে নেয়। ফ্রেশ হয়ে এসে তোয়ালে দিতে হাত মুখ মুছছে।
-“কি যেন বলেছিল তুমি? মোনা ছেলেদের সাথে রাত কাটিয়েছে?”
হাবিব সাহেব নির্লিপ্ত গলায় বলল,
-“আমি কি মিথ্যা বলেছি?”
-“সত্যি বলেছো?তোমার ছেলে জোর করে মোনা কে নাইট ক্লাবে নিয়ে গিয়েছে। আর গলা উঁচিয়ে মেয়েটা’কে যা ইচ্ছে তাই বলছো।”
হাবিব সাহেব বিদ্রুপ ভঙ্গিতে তাকায়। তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলল,
-“লাইক সিরিয়াসলি?প্রিয়ম জোর করে ওকে নাইট ক্লাবে নিয়ে গেছে? মানুষকে জোর করে কিভাবে নাইট ক্লাবে নেয়? আর আমার ছেলের সাথে নাইট ক্লাবে যাওয়া শুরু করেছে? ওই মেয়ে ফুঁসলিয়ে আমার ছেলের গলায় ঝুলে পড়ার পরিকল্পনা করছে। ওমন থার্ড ক্লাস মেয়েদের চিনা আমি।”
হাবিব সাহেবের দিকে বিধ্বস্ত মুখে তাকিয়ে রইলো লিলি বেগম। নির্বোধ এর মত যুক্তিহীন কথা বলছে! লিলি বেগম প্রত্যুত্তর করার মত কড়া জবাব খুঁজে পেলো না।একজন সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ হাবিব সাহেব, অথচ কোনটা ন্যায় কোনটা অন্যায় তা বুঝে না। লিলি বেগম কে তীব্র হতাশায় গ্রাস করল। ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে। হাবিব সাহেব রুম থেকে বের হয়ে গেলো।
মোনা চেঁচামেচির শব্দ পেলো।বুঝতে পারলো হাবিব সাহেব বাসায় এসেছে। আর এই চেঁচামেচির বিষয়বস্তু যে মোনা নিজে তা মোনা ভালো করেই উপলব্ধি করতে পারছে। এ বাসায় আর এক দন্ড থাকতে ইচ্ছে হচ্ছে না মোনার। নিজেকে নর্দমার কীট মনে হচ্ছে। নয়ত এত অপমানের পর কিভাবে এখানে পড়ে রইল? দুপুরে ভাত খেতেও বের হয়নি মোনা। লিলি বেগম অনেকক্ষণ দরজা নক করেছে, মোনা কে ডেকেছে। মোনা কোন সাড়াশব্দ দেয়নি।
সন্ধ্যা নেমে এলো। সূর্যটা গোলাপী আভা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে অস্ত যাচ্ছে। মোনা রুম থেকে বের হয় নিশান কে নিয়ে। নিঃশব্দে ছাদে যায়। আবছা অন্ধকার নেমে আসতে লাগলো। দুইজন মানুষের ছায়ার মত দেখা গেল এক কোণে। মোনা ভালোভাবে লক্ষ্য করলো। মোনা দুই হাত দিয়ে চোখ ডেকে ফেলল। এরিক আর পাশের বিল্ডিং এর একটা মেয়ে, এই মেয়েটা মোনা প্রায়ই দেখতো। দুইজনের দুইজনের ঠোঁটে এমন ভাবে চুমু খাচ্ছে মনে হচ্ছে প্রতিযোগিতা চলছে। নিশান সাথে থাকায় মোনা দ্রুত চলে যেতে উদ্যত হলো। এরিক মোনা কে ডাক দিলো। মোনা পিছনে ফিরে তাকালো না! এরিক এসে মোনার সামনে দাঁড়ালো।
-“আরে চলে যাচ্ছো কেন?তুমি এত লজ্জা কেন পাচ্ছ? শুধু চুমোই তো খেয়েছি।”
মোনা এদের নির্লজ্জতা দেখে অবাক না হয়ে পারে না। এরিকের সাথে থাকা মেয়েটা মোনার দিকে তাকিয়ে হাসছে। তারপর এরিকের দিকে তাকিয়ে হিন্দিতে কি যেন বলল। মোনা হিন্দি বোঝে না। এরিক হাসতে হাসতে বলল,
-“চুমু খেলাম আমরা আর লজ্জা পেলে তুমি?”
মোনা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে রেখে বলে,
-“লজ্জা পাবো কেন?আমায় খালা ডাকে তাই চলে যাচ্ছি।”
এরিক মেয়েটাকে দেখিয়ে মোনার উদ্দেশ্যে বলল,
-“ও হচ্ছে এ্যালি, আমার গার্লফ্রেন্ড।”
এ্যালি হ্যান্ডশেক এর জন্য মোনার দিকে হাত বাড়ায়। মোনার এ্যালির দিকে তাকাতেই লজ্জা করছে, পোশাক-পরিচ্ছেদের কারণে। আর একটু বড়সড় কাপড় পড়লে কি হয় কি জানে।মোনাও হাতে বাড়িয়ে দেয়। এ্যালি নিশান কে বলে,
-“হাউ আর ইউ কিউটি বয়?”
নিশান ফ্যালফ্যাল করে তাকায় এ্যালির দিকে। যেন চিড়িয়াখানা থেকে পালিয়ে আসা প্রাণী দেখছে।এরিক বলে,
-“ও কথা বলতে পারে না।”
এ্যালি দুঃখ প্রকাশ করলো।মোনা নিশান কে নিয়ে দ্রুত ছাদ থেকে নেমে যায়।বাসায় যে লিলি বেগম আর হাবিব সাহেবের সাথে এত ঝগড়াঝাঁটি হয়, মোনার সাথে প্রিয়ম যে সব ব্যবহার করে এগুলো কিছু নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই এরিকের। ও এসবে নেই! এগুলো নিয়ে ওর ভাবান্তর ও নেই।
দুপুরে মোনা খায়নি বলে নিশানও খায়নি। নিশান পেটের ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছে। ওদিকে ডাইনিং রুম থেকে লিলি বেগম ডাকছে। মোনা বুঝতে পারছে না এত কিছুর পরও তাঁদের সবার সাথে বসে খাওয়ার জন্য কেন ডাকে?মোনার তাঁদের সামনে যাওয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই কিন্তু নিশান তো না খেয়ে থাকতে পারবে না। মোনা টেবিলে গিয়ে মাথা নিচু করে বসে। আশেপাশে কোথায়ও তাকাচ্ছে না। টেবিলের সবাই চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। মোনার গলা দিয়ে খাবার নামতে চাচ্ছে না। শুধু বসে বসে খাবারের প্লেট নাড়াচাড়া করছে। নিশানের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে মোনা নিজের প্লেটে পানি দিয়ে উঠে যায়। মোনা রুমের দরজায় আসতেই কেউ একজন পিছন থেকে মোনার হাত টেনে ধরে। খুব শক্ত ভাবে মোনার হাত চেপে ধরে। মোনা পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে প্রিয়ম।
(চলবে)
মোনালিসা
ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-৮
মোনা অগ্নিবর্ণ চোখে প্রিয়মের দিকে তাকিয়ে আছে। রাগে মোনার ঠোঁট ঈষৎ কাঁপছে। প্রচণ্ড ক্ষোভে রাগে চোখ দুটি গভীর ভাবে বন্ধ করে, দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে রাগের বহিঃপ্রকাশ করছে। চোখ,মুখ কুঁচকে রেখেছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করতে।প্রিয়ম বলে,
-“তোমার লাইফস্টাইল, মেন্টালিটি, তোমাদের কালচার এসব আমার বুঝা উচিত ছিলো। তুমি এতটা কনজারভেটিভ আমি বুঝতে পারিনি। দুঃখিত আমি।”
এসব কথাও মোনার অসহ্য লাগছে। মনে মনে উগ্র রোষে ফেটে পড়লেও খুব ঠান্ডা গলায় বলল,
-“ইট’স ওকে।”
-“তোমার রাগ করাটা স্বাভাবিক। কিন্তু ক্লাবে তো তোমার সাথে খারাপ কিছু হয়নি, যাস্ট একটু চুমু।”
মোনার কপালে ভাঁজ পড়ে। অস্ফুট স্বরে বলে যাস্ট একটা চুমু? মোনা তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে পারলো না। কিছু মুহূর্ত পর বলল,
-“ওর থেকে বেশি কিছু হওয়ার জন্য আপনি আমায় ক্লাবে নিয়েছিলেন না? আপনাদের কথা শুনলে আমি হতবুদ্ধি হয়ে যাই, উত্তর দেওয়ার মত ভাষা খুঁজতে বেগ পেতে হয়।”
প্রিয়ম যেন একটু বিরক্ত হলো।নাক মুখ কুঁচকে বলল,
-“তুমি একটু বেশি বেশি বলছো। একটা চুমু দেওয়াতে পাপ হয়ে গেছে?”
মোনা তাচ্ছিল্য ভরা গলায় বলল,
-“না পাপ হয়নি। এবার আমার হাত ছাড়ুন। আমার হাতটা ভেঙে যাবে।”
-“তোমাদের মত মেয়েদের সমস্যা কি বুঝিনা।একটু প্রিয়োরিটি দিলে ন্যাকা নন্দনি হয়ে যাও।”
মোনা এবার রাগে চাপা চিৎকার করে বলল,
-“আপনার কাছে প্রিয়োরিটি কে চেয়েছে?আর আমাদের মত মেয়ে বলতে আপনি কি বুঝিয়েছেন বলুন?আপনারা তো সিক, আপনাদের ট্রিটমেন্ট দরকার।”
-“তুমি তো দেখছি আস্ত বেয়াদব।খুব কথা জানো।”
-“আমি বেয়াদব? আপনার বাপ কি বলেছে জানেন?বলেছে আমি নাকি আপনায় ফুঁসলাচ্ছি, নাইট ক্লাবে নিজের ইচ্ছেতে গেছি আপনার সাথে,আপনার গলায় ঝুলে পড়ার পরিকল্পনা করছি। আপনার বাপ একটা বেয়াদব।”
প্রিয়মের মুখ থমথমে হয়ে গেলো। মোনা নিজেও বুঝতে পারল না কথার স্রোতে কি বলতে কি বলে ফেলেছে। কিন্তু যা বলেছে তা সত্য! সত্য হজম করতে পারেনা সবাই। প্রিয়ম কোন উত্তর না দিয়ে মোনার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যায়।
মোনা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে।প্রিয়ম নিশ্চয়ই হাবিব সাহেবের কাছে বলে দিবে। মোনা হাবিব সাহেবের ডাকের অপেক্ষায়! হাবিব সাহেব যে এবার বাসা থেকে বের করে দিবে এতে কোন সন্দেহ নেই। মোনা মনে মনে ভাবছে এ বাসা থেকে বের করে দিলে কোথায় যাবে?জ্যাক এর সাহায্যে নিবে?
নিশান ধীরে ধীরে এসে মোনা পাশে দাঁড়ায়। মোনা কে উদাসীনতায় গ্রাস করেছে, নিশানের উপস্থিতি টের পায়না। নিশান মোনার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে যায়। মোনা নিশানের দিকে তাকিয়ে হাসে। নিশান আদুরে ভঙ্গিতে মোনার গাল টেনে দেয়। নিশানের ভবিষ্যৎ নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তিত হয়ে পড়ে মোনা। মোনা যেদিকেই যাবে নিশানও সেদিকে যাবে। মোনার শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকবে। মোনা কে একদন্ড না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ে।
মোনার ধারণা মিথ্যা হলো হাবিব সাহেব ওঁদের ডাকেনি। বাসা থেকেও বের করে নি। খাবার টেবিলে সবাই একসাথে খেয়েছে তখনো কিছু বলেনি। প্রিয়ম হাবিব সাহেবের কাছে কিছুই বলে নি তাহলে। এত অপমানের পরও খাবার টেবিলে এক সাথে নির্লজ্জের মত খেতে হয়। পরিস্থিতি যেন মোনা কে নির্লজ্জ বানিয়ে দিচ্ছে ক্রমশ।
_____
লিলি বেগম মানুষটা মোনা কে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে, কিভাবে খারাপ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হয় তা শিখাচ্ছে।জীবনের এই ক্লান্তিলগ্নে, তীব্র খড়ার পর এক পশলা বৃষ্টির মত লিলি বেগম মোনার মনে স্নেহের পরশ বিস্তার করে। মোনার মন সজীব হয়ে উঠে। মোনা বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পায়।
রাত বৃদ্ধি পাওয়ায় সাথে সাথে মোনার চিন্তা ভাবনা বৃদ্ধি পায়। রাত হলেই যেন চিন্তা গুলো মোনার মস্তিষ্ক গ্রাস করে। সেই চিন্তা-ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে রাত প্রায় অর্ধেক চলে যায়। মোনা ঘুমে তলিয়ে যায়। বাইরের কোলাহল বাড়ছে, রাত শেষ হয়ে আসছে। মোনা ঘুম ঘুম চোখ দুটো জোর করে মেলে। আকাশ সূর্যের ফিকে আলোয় উদ্ভাসিত হচ্ছে। রাত শেষ হয়ে গেছে। আস্তে আস্তে উষার রাঙা আলোয় ভরে যাবে শহর। কুয়াশার পর্দা ভেদ করে সূর্যোদয় হবে, আর এক উজ্জ্বল দিনের শুরু হবে সারা শহর জুড়ে।
মোনা বিছানা ছাড়ে। ছাদে যায়। ছাদে যেতেই কালকের কথা মনে পড়ে। মোনা চারদিকে তাকিয়ে দেখছে আজকে আবার কেউ ছাদে আছে কিনা? মোনা চারদিক অবলোকন করে, কাউকেই দেখছে না। কিছুক্ষণ পাঁয়তারা করে মোনা রুমে যায়। নিশান কে ডাকে। নিশান গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। মোনা ওড়নাটা আলনার উপর রেখে ওয়াশরুমে যায় ব্রাশ হাতে। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই মোনা চিৎকার করে উঠে। দৌড়ে রুমে চলে আসে! প্রিয়ম ওয়াশরুমের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ব্রাশ করছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রুমে এসে মোনার দিক তাকিয়ে বলল,
-“আরে এভাবে চিৎকার করছো কেন? আমার রুমের ওয়াশরুমে একটু প্রবলেম হয়েছে।”
মোনা ভুত দেখার মত ভয় পেয়েছিল। বিধ্বস্ত মুখে কেবল আস্তে করে বলল,
-“ও।”
-“ওয়াশরুম তো বড়ই আছে দুইজন একসাথে কি ফ্রেশ হওয়া যায় না?এটা তো টয়লেট না যে দুইজন একসাথে গেলে সমস্যা।”
প্রিয়মের এসব অসংলগ্ন কথা উপেক্ষা করে মোনা বলে,
-“আপনি ফ্রেশ হয়ে যান,আমি পরে ফ্রেশ হবে।”
প্রিয়ম জোর গলায় বলল,
-“না এক্ষুনি ফ্রেশ হবে তুমি এবং আমার সাথে।”
প্রিয়মের আচরণে মোনা তিক্ত হয়ে পড়ে। অধৈর্য হয়ে বিরক্ত গলায় বলল,
-“আপনি কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন।”
-“যদি বাড়াবাড়ি ভাবো তাহলে বাড়াবাড়ি।”
প্রিয়ম মোনার হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। এই অসুরে শক্তির সাথে মোনা পেরে উঠে না। প্রিয়ম ওয়াশরুমের দরজাটা বন্ধ করে দেয়।তারপর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। যাতে মোনা বের হতে না পারে। মোনা আতংকিত হয়ে বলে,
-“দরজা বন্ধ করলেন কেন?দরজা খুলুন। আমি বের হবো।”
-“ব্রাশ মুখে নেও,ফ্রেশ হও। যদি কথা না শুনো তাহলে কি হবে বুঝো তো।”
মোনা শঙ্কিত হয়ে বলে,
-“কি হবে?”
-“ওইদিন পার্টিতে যা হয়েছে তার থেকে খারাপ কিছু হবে। ওইদিন তো শুধু চুমু খেয়েছি।”
মোনার মুখ চুপসে যায়। কাঁপা কাঁপা হাতে ব্রাশ করে,মুখে পানি দেয়।প্রিয়ম হেসে বলে,
-“তোমায় মাঝে মাঝে খুব সাহসী মনে হয়,মাঝে মাঝে ভীতু।”
মোনা উত্তর দেয় না। দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বলে,
-“এবার যেতে দিন।”
প্রিয়ম নির্বিবাদে দরজা খুলে দেয়। মোনা তড়িৎ বেগে বেরিয়ে যায়।যেন জেলহাজত থেকে মুক্তি পেয়েছে। প্রিয়ম বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। প্রিয়ম সব সময় দুপুর ঘুম থেকে উঠে,আজ এত তাড়াতাড়ি! মোনা বুঝতে পারলো না। শুধু শুধু জোরজবরদস্তি করে ওয়াশরুমে নিলো। আবার ফ্রেশ হওয়ার পর দরজা খুলে দিলো। কি অদ্ভুত ব্যাপার!এঁদের যে জটিল হাবভাব, এঁরা যদি কোন সাবজেক্ট হত তাহলে অনার্স কমপ্লিট করতে বারো বছর লেগে যেত।
___
হাবিব সাহেব অফিসে চলে যাওয়ার পর লিলি বেগম মোনা কে রুমে ডাকে।লিলি বেগম রুমে মোনার উপস্থিতি বুঝতে পেরে সেদিকে না তাকিয়েই বলল,
-“তোকে আর নিশান কে নিয়ে কিছু কেনাকাটা করতে যাবো। একটু দ্রুত রেডি হয়ে নে।”
-“কেনাকাটা তো তুমি একাই করতে পারো। আমার যেতে ইচ্ছে করছে না খালা।”
-“আমি তোদের জন্য কেনাকাটা করব।”
-“না, না খালা। আমাদের কোন কিছু লাগবে না।”
লিলি বেগম রাগান্বিত গলায় বলল,
-“মোনা তুই কিন্তু বেশি বুঝিস।”
লিলি বেগমের রাগ দেখে মোনা দমে যায়। রুমে গিয়ে নিশান কে রেডি করিয়ে দেয়। তারপর নিজে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে। হোয়াইট কালারের একটা কুর্তি পড়েছে সাথে ব্লাক জিন্স প্যান্ট।গলায় একটা ওড়না ঝুলানো। মোনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের চেহেরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। চোখের নিচে কালি জমেছে, মোনা কাজল দিয়ে নেয়। রেডী হয়ে রুম থেকে বের হয়। লিলি বেগম কে দেখে মোনার খানিকটা অস্বস্তি লাগে। লিলি বেগম শর্ট কুর্তির সাথে জিন্স পরেছে। এই বয়সের সাথে এমন পোশাক-পরিশ্চেদ যায় না। ওরা বাসা থেকে বের হওয়ার পর পরই প্রিয়ম বের হয়। লিলি বেগম কে ডাক দেয়।লিলি বেগম পিছনে ফিরে বলল,
-“তোর আবার কি হলো?”
-“কোথায় যাচ্ছো তোমরা?”
-“শপিংএ।”
-“চলো আমি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
-“দরকার নেই তুই তোর কাজে যা।”
-“উফ আম্মু! উঠো তো গাড়িতে।”
প্রিয়ম আড় চোখে কয়েকবার মোনার দিকে তাকায়। মোনা চুপচাপ বসে আছে। প্রিয়মকে দেখে বিরক্ত হচ্ছে। প্রিয়ম বলল,
-“মোনা আজ তোমায় কি যে সুন্দর লাগছে!”
মোনা প্রত্ত্যুতর করে না। গাড়ি এসে বিশাল এক শপিং মলের এর সামনে থামে। মার্কেটের সম্মুখে বিশাল পার্কিং চত্বর। মানুষের ভীড়। কেউ কেউ ট্রলি হাতে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ গাড়ি পার্ক করছে, কেউ শপিং শেষে চলে যাচ্ছে। ওঁদের মার্কেটে পৌঁছে দিয়ে প্রিয়ম গাড়ি নিয়ে চলে যায়। শপিং শেষে আবার ফোন দিতে বলে।
দুই-তিন ঘন্টা ধরে কেনাকাটা করেছে লিলি বেগম। হাবিব সাহেব টাকার ব্যাপারে কখনো কিছু বলেনা লিলি বেগম কে, কোন কৈফিয়ত চায়না। মোনা শুধু ভাবছে কত ডলার খরচ হবে?এত কেনাকাটা! শপিং শেষে মোনা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কেনাকাটার প্রতি কোন আগ্রহ নেই মোনার। মোনা সব সময় ভাবে দরকার মত জামাকাপড় হলেই হলো।
লিলি বেগম মোনা কে উদ্দেশ্য করে বলে,
-“মোনা তোর মোবাইল আছে?একটা মোবাইল কিনে দেই?”
-“না খালা মোবাইল আছে, শুধু সিম কার্ড নেই।”
-“আচ্ছা তাহলে সিম কার্ড কিনি শুধু।”
মোনা মাথা নাড়ায়। প্রিয়ম কে কয়েকবার ফোন দেয়, ফোন রিসিভ করছে না। বাধ্য হয়ে ট্যাক্সি করে বাসায় যায়। লিলি বেগম বাসায় এসে দেখে হাবিব সাহেব সোফায় গম্ভীর মুখে বসে আছে। হাবিব সাহেব তো এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে না। লিলি বেগম মোনা আর নিশান কে রুমে চলে যেতে বলে। হাবিব সাহেব বলে,
-“কত ডলার খরচ করেছো?”
লিলি বেগম অবাক হয়ে বলে,
-“তুমি আমার কাছে কৈফিয়ত চাচ্ছো?”
-“টাকা কি পানিতে ভেসে আসছে যে তুমি টাকা যার তার জন্য খরচ করবে?”
লিলি বেগমের প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে। রাগ সংযত করে বলল,
-“তুমি যদি এটা নিয়ে চেঁচামেচি করো আমি সত্যি বলছি হাবিব আমি বাসা ছেড়ে চলে যাবো। তুমি প্রতিনিয়ত সবার কাছে আমায় ছোট করছো।”
-“আমার টাকা খরচ করেছো আর আমি চেঁচাবো না?”
লিলি বেগম হাবিব সাহেবের সামনে আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে রুমে চলে যায়। ওখানে দাঁড়ালেই ঝগড়া হবে।
মোনা রুমে এসে মোবাইল টা অন করে। মাঝে মাঝে মোনার মনে হত ওর মোবাইলের প্রয়োজন নেই। মাসে একবারের জন্যও কেউ ফোন দেয়না। মোনা জ্যাকের দেওয়া কার্ডটা বের করে। তারপর জ্যাকের নম্বরে ডায়েল করে। দুই বার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে কল রিসিভ হয়।জ্যাক বলল,
-“কে বলছেন?”
-“মোনালিসা।”
তারপর ওপাশ থেকে কোন কথায় শব্দ পাওয়া গেলো না। জ্যাক কি চিনতে পারছে না ওকে? মোনা আবার বলে,
-“ওইদিন রাতে আপনি আমায় হেল্প করেছিলেন।”
-“আপনার নাম শুনেই বুঝতে পেরেছি,আমার মেমোরি খুব শার্প। ভুলিনি আপনায়।কিন্তু আমি একটু ব্যস্ত আছি। ডোন্ট মাইন্ড মোনালিসা, পরে কথা বলি।”
(চলবে)