মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৭+২৮
প্রিয়মের প্রশ্ন লিলি বেগম’কে খানিক ভাবালো। লিলি বেগম জানে ইমরুল চৌধুরী খুন হয়েছে। মোনা’কে জিজ্ঞেস করেছিল,’কিভাবে খুন হয়েছে?’। মোনা উত্তর দেয় নি, এড়িয়ে গেছে। লিলি বেগম মোনার শোক বাড়াতে চায়’নি। তাই জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করেনি।লিলি বেগম উদ্বেগপূর্ণ গলায় বলল,
-“আমি জানি না, শুধু জানি খুন হয়েছে।”
প্রিয়ম কিছু’টা অবাক হয়ে বলল,
-“এটা কেমন কথা?তুমি ও’কে জিজ্ঞেস করো নি?”
-“জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু তত জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করে নি। তাছাড়া ওঁর বাবার সাথে ওঁদের সম্পর্ক ভালো ছিলো না, আর আমিও ইমরুল চৌধুরী’কে পছন্দ করতাম না। তাই জানার তেমন আগ্রহ জাগে নি।”
প্রিয়মের ফোন আসলো। বারান্দায় গিয়ে ফোনে কথা বলে রুমে আসলো। মোনা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। প্রিয়ম কয়েক বার তাকালো মোনার দিকে। লিলি বেগম কে বলল,
-“আম্মু ওঁর খেয়াল রেখো, আমার একটা জরুরী ফোন এসেছে।”
প্রিয়ম বের হয়ে যায়। লিলি বেগম গিয়ে মোনার শয্যার পাশে বসে। বার বার নিচু স্বরে মোনা, মোন বলে ডাকে। কয়েক বার ডাকার পর মোনা ক্ষীণ গলায় শুধু হুম বলল। লিলি বেগম বিরামহীন ভাবে প্রশ্ন করে যাচ্ছে। কোন প্রশ্নের জবাব পাওয়া গেলো না। মোনার শরীরের সব শক্তি যেন ফুরিয়ে গেছে। অবশিষ্ট থাকা শক্তি টুকু জড়ো করে বলল,
-“খালা নিশানের দিকে খেয়াল রেখো।”
নিশান খাট থেকে দুই-তিন হাত দূরে রাখা সোফার উপর বসে আছে। নিশানের চোখে মুখে আতংকের ছাপ। শূন্য দৃষ্টিতে বার বার তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। মোনার অসুস্থতায় অসহায় হয়ে পড়ল নিশান। বার বার চোখের কোণে জমা পানি টুকু হাতের তালু দিয়ে মুছছে।
____
জ্যাক কয়েক দিনের জন্য সিঙ্গাপুর গিয়েছিলো। জ্যাক হুট করেই গেলো। তাই মোনা’কে যাওয়ার আগে বলা হয়ে ওঠে নি। সিঙ্গাপুর গিয়ে কয়েকবার কল দিয়েছে মোনার কাছে, ফোন অন অথচ রিসিভ করল না।‌ জ্যাকের খানিক’টা রাগ হলো। ব্যারিংটন ফিরে জ্যাক বাসায় গেলো। মোনা এই কয়েকদিনে একবারও ফোন দেয় নি, কোন যোগাযোগ করেনি জ্যাকের সাথে। এমন আগে কখনো হয়নি। জ্যাক বাসায় ফিরে ক্লান্ত হয়ে খাটে গা এলিয়ে দেয়। কিছুক্ষণ বাদে কাজের লোক’কে ডাকল। দরজার কাছে তাঁর উপস্থিতি বুঝতে পেরে দরজার দিকে না তাকিয়েই বলল,
-“আমি যাওয়ার পর মোনালিসা এসেছিলো একবারও?”
-“নো স্যার।”
জ্যাক হতাশ হলো। প্রিন্সেস’কে কোলে নিয়ে চুমু খাচ্ছে। প্রিন্সেস এখন আদো আদো গলায় ফাদার ডাকে। জ্যাকের মন প্রাণ প্রশান্তি’তে শীতল হয়ে যায়। জ্যাক প্রিন্সেসের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলল,
-“মোনালিসা তোমায় দেখতে একবারও আসলো না?”
প্রিন্সেস যেন জ্যাকের কথা বুঝতে পারলো। কেঁদে উঠলো প্রিন্সেস। জ্যাক উচ্চস্বরে হেসে দেয় প্রিন্সেসের কান্না দেখে, কি অদ্ভুত ব্যাপার! প্রিন্সেস মুখাবয়ব দেখে মনে হলো ও মানুষের কথা বুঝতে পারেন। প্রিন্সেস হয়ত অন্য কারণে কেঁদেছে। জ্যাক নিজের মত একটা ব্যাখ্যা খুঁজে নিলো।
জ্যাক কতক্ষণ ধরে মোনার দরজার কলিংবেল‌ বাজিয়ে যাচ্ছে ভিতর থেকে কোন সাড়া দিচ্ছে। ভিতরে মানুষ আছে অথচ সাড়া দিচ্ছে না। জ্যাকের কপালে ভাঁজ পড়লো বিরক্ত’তে। একটু পরে লিলি বেগম দরজা খুলে দিলো।‌ জ্যাক অস্থির গলায় বলল,
-“মোনা আছে বাসায়?”
এর থেকে বেশি কিছু লিলি বেগমের কাছে জিজ্ঞেস করতে পারলো না। লিলি বেগম কে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কোন বিষয়ে গভীর ভাবে চিন্তিত মনে হচ্ছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গম্ভীর গলায় বলল,
-“আছে, ভিতরে আসো।”
লিলি বেগমের আচরণ, মোনার ফোন না ধরা, প্রিন্সেস’কে দেখতে না যাওয়া সব কিছু মিলিয়ে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে, স্বাভাবিক নিয়ম ভঙ্গ হয়েছে। এমন কখনো হয়না। এমন চিন্তা করতে করতে জ্যাক বাসার ভিতরে যায়।
মোনার চুল গুলো উস্কখুস্ক হয়ে আছে, চোখে মুখে তীব্র বিষাদের ছায়া। চোখের নিচে লেপ্টে কাজল দিয়েছে যেন। মুখ পাণ্ডুর আর শীর্ণ। চেহেরায় কোন লাবন্যতা নেই, যেন নিস্তেজ একটা শরীর বিছানায় মিশে আছে। জ্যাক চমকে উঠল।প্রবল ভাবে উদ্বিগ্ন, উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“মোনালিসা,কি হয়েছে আপনার?আপনি অসুস্থ?কি হলো আপনার হঠাৎ?”
জ্যাক আঁতকে উঠে ঢোক গিলে । পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“আপনি অসুস্থ আপনি হসপিটালে না গিয়ে বাসায় কেন? আমায় কেন বলেন নি এসব? আরে আপনার কি হাল হয়েছে!”
লিলি বেগমের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো জ্যাক। লিলি বেগম একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে। জ্যাক উতলা হয়ে প্রশ্ন করল,
-“আপনারা উনাকে হসপিটালে কেন নেন নি?হোয়াট দ্যা হেল!”
-“জ্যাক ওঁর হসপিটালে নেওয়ার মত অসুখ হয়নি। ওঁর বাবার মৃত্যুর সময় ও ভয় পেয়েছে, সেই ভয় নতুন করে নাড়া দিয়েছে। মোনা মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
-“তাহলে সাইকিয়াট্রিস্ট ডাকুন। মোনালিসা কেমন হয়ে গেছে! কথা বলছে না।’
সাইকিয়াট্রিস্টের কথা শুনে মোনার নিস্তেজ শরীরে যেন রাগের হুতাশনের সৃষ্টি হলো। মোনার স্তব্ধ হয়ে যাওয়া গলায় যেন তেজ ফিরে এলো। মোনার ক্ষীণ হওয়া গলায় যেন তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। কঠিন স্বরে বলল,
-“সাইকিয়াট্রিস্টের কোন দরকার নেই, দ্বিতীয় বার এ কথা বললে খারাপ হবে খালা।”
মোনা শুদ্ধ বাংলায় বলল। লিলি বেগম বুঝলেও, জ্যাক নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মোনা কথা বলেছে ভেবে খুশি হলো জ্যাক, কিন্তু কি বলেছে তা বুঝতে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালো লিলি বেগমের দিকে। লিলি বেগম ইংরেজি’তে বলে বুঝালো জ্যাক’কে। জ্যাক বলল,
-“মোনালিসা আপনি কি বলছেন এসব নির্বোধের মত? প্লীজ আপনি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করুন।”
মোনা আর কোন কথা বলল না। মোনা চোখ মেলেই তাকায় না। চোখ মেলে তাকালেই ইমরুল চৌধুরী’কে দেখে। ক্ষত -বিক্ষত লাশ’টা দেখে। গলার ভয়ঙ্কর আঘাত’টা হাঁ করে আছে যেন। জ্যাক পুনরায় বলল,
-“মোনালিসা আমি জ্যাক, চোখ খুলুন।”
মোনার কর্ণপাত হয় না। জ্যাকের কোন কথাই যেন শুনতে পারছে না, কোন প্রতিক্রিয়া নেই। কথার বিপরীতে মুখের অভিব্যক্তি প্রকাশ পায়’না। মুখ’টা আগের ন্যায় বিষদময়’ই থাকে। জ্যাক লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
-“আমি সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলব শীঘ্রই।”
মোনা রাগে চিৎকার দিয়ে উঠে। আর্তনাদ করে বলে,
-“আমার কানের কাছে বসে কথা বলেন না, আমার বিরক্ত লাগছে। আমায় একটা থাকতে দেন। আমি আপনা-আপনি সেরে উঠবো।”
জ্যাক বুঝতে পারে মোনা মানসিক ভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত। মোনার কথায় জ্যাকের তাই রাগ হয় না। বরংচ সহানুভূতি প্রকাশ পায়। জ্যাক অনেকক্ষন ধরে বসে থাকে। কয়েক ঘণ্টা বসে রইলো। বাসার ভিতরে পিনপতন নীরবতা। বাসার পরিবেশ’টা কেমন ভারি হয়ে ওঠে। জ্যাক গভীর মনোযোগে মোনা’কে নিরীক্ষণ করছে। গাঢ় এই নিঃশব্দ’তা ভেঙে জ্যাক বলে বলল,
-“মোনালিসা ভয় পেয়েছে সত্যি, কিন্তু ভয়ের চেয়ে কয়েক গুন বেশি ডিপ্রেসনে ভুগছে।‌‌‌‌‌উনার ভয় কেটে গেছে। উনার জীবনে এমন কিছু একটা ঘটেছে যা উনা’কে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়। উনার জন্য সাইকিয়াট্রিস্টের দরকার নেই। মোনালিসার সুস্থতা উনার নিজের উপর নির্ভর করছে, উনি উনার মন’কে স্ট্রং করতে পারলেই সেরে উঠবে। সাহস জোগাতে হবে‌ শুধু।”
জ্যাকের কথা গুলো দুর্বোধ্য মনে হলো লিলি বেগমের কাছে। ভ্রু কুঁচকে তাকালো জ্যাকের দিকে। মোনার কিসের ডিপ্রেসন?বাবা খুন হওয়ার পরের দিন যে মেয়ে আমেরিকা চলে আসতে পারে, ডিপ্রেসন কথা’টা যেন তাঁর সাথে বেমানান।‌‌‌‌‌‌ তাছাড়া এত গুলো দিন পর কেন এত ডিপ্রেসনে ভুগবে নতুন করে? লিলি বেগম বলল,
-“না, না জ্যাক। তুমি ভুল ভাবছো।”
জ্যাক জোর গলায় বলল,
-“আমি সঠিক ভাবছি। আমি সাইকিয়াট্রিস্ট না হলেও, একজন ডাক্তার। ডাক্তারি ছেড়ে ব্যবসা ধরেছি। তাই বলে অভিজ্ঞতার খাতা শূণ্য হয়ে যায়নি। আপনি মোনার কাছে জিজ্ঞেস করুন।”
মোনার চোখ বুঁজে জ্যাকের বলা প্রতি’টা কথা শুনছে। জ্যাকের বলা কথা গুলো সত্যি। এই সত্যি মোনা কারো কাছে স্বীকার করবে না,কখনো না।
জ্যাক মোনার হাত চেপে ধরল, আবেগে কিংবা অনুরাগে নয়। আশ্বাস,ভরসা দিতে।
-“বি স্ট্রং মোনালিসা। আমি সর্বদা তোমার পাশে থাকব।”
মোনা ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
-“থ্যাংক্স জ্যাক।”
জ্যাক একটু হাসলো। লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“মোনালিসা প্রথমে ভয় পেয়েছে, ভয় থেকে ডিপ্রেসন।”
জ্যাক কিছুক্ষণ বাদে চলে গেলো।জ্যাক’কে নিয়ে নানান প্রশ্ন জাগছে লিলি বেগমের মনে। লিলি বেগমের মনে হলো জ্যাক’ই একমাত্র মানুষ যে মোনা’কে শতভাগ বুঝে। জ্যাক আর মোনার মাঝে সম্পর্ক নিয়েও লিলি বেগম দ্বিধান্বিত।

মোনা এখন দিনের বেলায় ভয় পায় না। চিৎকার করে উঠে না। নিশান সব সময় মোনার একটা হাত ধরে পাশে বসে থাকে। মোনা চিন্তিত ভঙ্গিতে শুধু শুয়ে থাকে। লিলি বেগম খাবার নিয়ে এসে মোনার পাশে বসে। মোনার মুখে একবার তুলে দিচ্ছে খাবার, আরেকবার নিশানের মুখে। এর ভিতর লিলি বেগমের ফোন বেজে ওঠে। হাবিব সাহেব ফোন দিয়েছে। লিলি বেগম ফোন রিসিভ করে। ওপাশ থেকে কর্কশ গলায় বলে,
-“আমার সংসার করার ইচ্ছে আছে তোমার? যদি ইচ্ছে থাকে বাসায় আসো এখুনি। আমি প্রয়োজনীয় কাগজ পাচ্ছি না। সব কিছু তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম।”
হাবিব সাহেবের চিৎকারে লিলি বেগমের কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হলো। শরীরের সমস্ত শক্তি জড়ো করে কথা গুলো বলছে হাবিব সাহেব। লিলি বেগম একটা ক্ষীণ শ্বাস ফেলে নিচু গলায় বলল,
-“আসছি আমি।”
মোনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমার বাসায় যেতে হবে, আবার আসবো।”
লিলি বেগম চলে যাওয়ার পর নিশান খাবার প্লেট হাতে নিয়ে মোনার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে। মোনার চোখ ভিজে এলো কেন জানি। এর থেকে সুন্দর দৃশ্য বুঝি হয় না আর।
_____
বিকালের দিকে প্রিয়ম আসে। নিশান দরজা খুলে দেয়। প্রিয়ম মোনার পাশে বসে। মোনার একটা হাত আলতো করে ধরল। মোনা হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল না।
-“বেটার ফিল হচ্ছে আগের থেকে?”
মোনা মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে। প্রিয়ম গভীর চিন্তিত মুখে বলল,
-“মোনা তুমি কি নিয়ে চিন্তিত এত?কিসের জন্য এত ভয় পাচ্ছো?”
মোনার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। প্রিয়ম পুনরায় জিজ্ঞেস করল। মোনা বিরক্ত হয়ে বলল,
-“আমি এখন সুস্থ।”
-“তুমি যখনই আমার সাথে খারাপ বিহেভ করবে , আমি তখনই বুঝবো তুমি সুস্থ হয়েছে। তুমি এখন অসুস্থ বলে আমায় কিছু বলছো না।”
মোনা প্রিয়মের দিকে তাকায়। প্রিয়মের কথায় প্রথমে খানিক’টা বিরক্ত হলেও পরে কি ভেবে যেন হেসে দিলো। প্রিয়ম মোনা কাছে বসা,খুব বেশী দূরত্বে না। মোনার হাত আঁকড়ে ধরে আছে। মোনার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মোনা অস্বস্তি বোধ করে, কেন জানি মোনার শ্বাস রুদ্ধ অবস্থা হয়েছে। বুকের ভিতর হাতুড়ি পেটা করছে যেন কেউ, দুরুদুরু করতে থাকে বুকের মাঝে।
(চলবে)

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৮
চারদিকে ঘন অন্ধকারে আচ্ছন্ন।যেদিকে তাকায় দৃষ্টি ঘন অন্ধকারে হারিয়ে যায়।রাত দুইটা কি তিনটা হবে তখন। মোনার ঘুম ভেঙ্গে যায়। মোনার পাশেই শুয়ে আছে লিলি বেগম। নিমীলিত নেত্রে পিটপিট করে তাকায়। কয়েকদিন বিছানায় মুমূর্ষু রোগীর ন্যায় শুয়ে থাকতে থাকতে মোনা হাত-পায়ের সব শক্তি যেন হ্রাস পেয়েছে। মোনা স্বপ্ন দেখে ভয় পেয়েছিল, দুই দিনের ব্যবধানে ভয় কেটে গেলেও মোনা দুশ্চিন্তা থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেনি। মোনার অনিচ্ছাকৃত ভাবেও দুশ্চিন্তা, বিষন্নতা ,বিমর্ষতা মোনার স্কন্ধে চেপে বসেছিল। মোনার মাথায় সারাক্ষণ সেসব আন্দোলিত হতো আর মোনা বিষাদের আগুনে দগ্ধ হতো। মোনা ধীর পায়ে খাট থেকে নামে। মোনার হাত-পা ঈষৎ কাঁপছে,মাথার ভেতর চক্কর দিচ্ছে।‌ টানা কয়েকদিন বিছানায় থাকায় এমন হয়েছে। শক্তিহীন পায়ে এলোমেলো ভাবে পায়ে হেঁটে বারান্দায় গিয়ে বসে মোনা। নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে,’সে রাতে কেন অত ভয় পেয়েছিল?’ এখন ভয় করছে না কেন?’ মোনার মাথা ঝিমঝিম করে। মোনার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি, মোনা সবার সব কথা শুনতো।‌ কিন্তু উত্তর দেয় নি, কি যেন হয়েছিল। মোনার মনে হয়েছে ভিতর থেকে কেউ একজন বাঁধা দিচ্ছে মোনা’কে কথা বলতে।
প্রিয়ম কয়েকবার মোনার কপালে চুমু খেয়েছে, মোনার চুলে হাত ডুবিয়ে বিলি কেটেছে, মোনার চুলে নাক ডুবিয়ে ঘ্রান নিয়েছে, মোনার হাত গভীর আবেগে চেপে ধরেছে। মোনার মাঝে মাঝে মনো হতো ওঁর চোখে-মুখে কারো গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পরছে। মোনার চোখ খুলে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে হতো‌ না কে ওঁর পাশে, মোনা জানে প্রিয়ম। প্রিয়ম মোনার শয্যার পাশে বসে খুব কাছ থেকে দেখতো মোনা’কে।
মোনার চুল গুলো জট পাকিয়ে আছে, কতদিন আঁচড়ায় না চুল। মোনা সব চিন্তা ভাবনা থেকে বের হয়ে আসতে চায়, স্বাভাবিক হতে চায়। কিন্তু পারছে না কিছুতেই। মোনা বারান্দার মেঝেতে বসে থাকে। বার বার দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসছে। আর পাঁচ’টা মানুষের মত সুস্থ, স্বাভাবিক একটা জীবন কেন হলো না? মোনার চোখ বেয়ে বেদনা অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছে।মোনা ঠিক করেছে কাল থেকে ভার্সিটি’তে যাবে,অফিসে যাবে।‌ বাকী রাত’টা বারান্দায়ই কাটিয়ে দেয়।
ভোরের আলো ফোটার আগেই আগেই লিলি বেগম উঠে ঘুম থেকে‌‌ নামাজে উদ্দেশ্য। পাশের বালিশ’টা খালি। মোনা’কে না দেখে মুহুর্তেই মনে ভিতর নানান শঙ্কার তৈরি হয়। অস্থির হয়ে ছুটে বাসার এদিক ওদিক তাকায়। মোনা’কে বারান্দায় দেখে খানিকটা রাগি গলায় বলে,
-“তুই এখানে কখন এসেছিস?এখানে কাজ কি?”
মোনা লিলি বেগমের দিকে চোখ তুলে তাকায়। মোনা চোখে হারালেই লিলি বেগমের মনে নানান শঙ্কার তৈরি হয় যেন। অস্থির হয়ে উঠে চিন্তায়।মোনা আস্তে করে বলে,
-“একটু আগে এসেছি খালা, নামাজের ওয়াক্ত যায়। তুমি নামাজ পড়ো।”
লিলি বেগম ওযু করে নামাজে দাঁড়ায়। মোনা বারান্দা থেকে উঠে কিচেনে যায়। কত দিন বাদে এসেছে কিচেনে! কত দিন বাদে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখেছে চারপাশ। মোনা রুটি বানায়। লিলি বেগম নামাজরত অবস্থায় শুনতে পায় কিচেনে শব্দ হচ্ছে। মোনা কিচেনে গিয়েছে? লিলি বেগম চমকালো মনে মনে। এসব ভাবনা চিন্তা বাদ দিয়ে নামাজে মনোযোগী হয়।
লিলি বেগমের নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে মোনার নাস্তা বানানোও শেষ। লিলি বেগম কিচেনে এসে বিস্মিত চোখে তাকায় মোনার দিকে।
-“মোনা তুই ঠিক আছিস তো?তুই হঠাৎ কিচেনে?”
মোনা নিজের কাজে ব্যস্ত থেকে লিলি বেগমের দিকে না তাকিয়েই স্বাভাবিক গলায় প্রত্যুত্তর করল,
-“কেন কিচিনে আসলে কি?”এইটুকু বলে থেমে একটু দম ফেলে বলল,
-“খালুর সাথে এখানে থাকা নিয়ে তোমার তো তুমোল তুলকালাম কাণ্ড।বাসায় চলো যাও।”
লিলি বেগম অবিশ্বাস্যর সুরে বলল,
-“এই মোনা হঠাৎ কি হলো তোর বল তো আমায়?তোর আচরণ তো স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।”
মোনা একটু বিরক্ত বোধ করল যেন এত প্রশ্নে। উত্তর না করে চুলার আগুনের দিকে অকারণে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। লিলি বেগম ফের একই প্রশ্ন করলো। মোনা তাৎক্ষণিক উত্তর না দিয়ে, আগের মত গম্ভীর হয়ে আছে। খানিক বাদে ভারি গলায় বলল,
-“আহা খালা আমি অসুস্থ ছিলাম, এখন সুস্থ।আর তুমি কি সারা বছর আমার বাসায় থাকবে? তোমার তো সংসার আছে।”
লিলি বেগম সরু চোখে তাকালো। ভ্রু কিঞ্চিৎ কুঁচকে বলল,
-“তুই হঠাৎ সুস্থ হয়ে গেলি?তাহলে জ্যাক’ই ঠিক বলেছে।”
মোনা প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায়।কপালে ভাঁজ পড়ে।
-“কি বলেছে জ্যাক?”
-“তোর সুস্থ হওয়া তোর উপর নির্ভর করে। তুই তোর মন’কে স্ট্রং করতেই পারলেই সেরে উঠবি।”
মোনা বিরক্ত’তে মুখ কুঁচকায়।লিলি বেগমের দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,
-“খালা জ্যাক মানসিক ভাবে অসুস্থ কয়েক বছর ধরে। বলতে পারো আধ পাগল। কিন্তু কেউ বুঝতে পারে না। জ্যাক বাসায় আসলে পরবর্তী’তে আড্ডা জমাতে যেয়ো না। মাঝে মাঝে কিন্তু পাগলাটে হয়ে যায়। মানুষের গায়ে হাতও তুলে।”
জ্যাকের সম্পর্কে এমন চঞ্চলকর তথ্যে লিলি বেগম হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। যেন বিশ্বাস করতে পারে না। জ্যাকের সম্পর্কে এতদিনের সব ধারণা মিছে হয়ে যাওয়ার খানিক দুঃখ পেলো যেন। রাজ্যের বিস্ময় গলায় এনে বলে,
-“বলছিস কি তুই?আমি তো এতদিনে বুঝতে পারি নি। তুই আগে কেন বলিস নি।”
মোনা উত্তর না দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মনে মনে প্রচণ্ডভাবে হাসছে মোনা, কিন্তু বাহিরে গুরুগম্ভীর। কত বছর পর জোকস করেছে।
____
মোনার স্বাভাবিক আচরণ দেখে লিলি বেগম বাসায় চলে যায়। কয়েকদিন ধরে আগের তুলনায় অনেক খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয়েছে হাবিব সাহেবের সাথে। লিলি বেগম ওসব পাত্তা দেয় না, কয়েক বছরে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাঝে মাঝে কোন অবকাশে বুক চিঁড়ে বিষাদের সুর বেরিয়ে আসতে চায়।
মোনা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চুল আঁচড়াচ্ছে। পাক্কা আধা ঘন্টা লেগেছে। চুলের জট খুলতে গিয়ে চিরুনি ভরে চুল উঠে এসেছে। মোনা গোসল সারে। নিশান’কে ঘুম থেকে তুলে। ভারি গলায় বলল,
-“অনেক স্কুল ফাঁকি দিয়েছো।এবার উঠো।”
নিশান’কে টেনেহিঁচড়ে ঘুম থেকে তুলে। ঘুম ঘুম চোখে নিশান মোনার দিকে তাকিয়ে থাকে! নিশান’কে আগের মত নাস্তা খাইয়ে,রেডি করিয়ে স্কুলে পৌঁছে দেয়।‌‌‌‌ নিশানের স্কুল থেকে কিছুদূর আসতেই একটা কার এসে মোনার পাশে থামে।মোনা ফিরে তাকায়। কার থেকে প্রিয়ম নেমে প্রবল অবিশ্বাস্যর দৃষ্টিতে তাকায়। প্রিয়মের চোখ-মুখ উপচে বিস্ময়ের রশ্মি নির্গত হচ্ছে যেন।
-“মোনা তুমি?তুমি ভার্সিটি তে যাচ্ছো? তুমি সুস্থ হয়ে গেছো।”
মোনা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,
-“এত প্রশ্ন করলে কোন’টার জবাব দিবো?” এই বলে থেমে আবার বলে,
-“হ্যাঁ আমি মোনা,আমি ভার্সিটি’তে যাচ্ছি, আমি সুস্থ হয়ে গেছি। কাল আমি অসুস্থ ছিলাম বলে আজ আমি সুস্থ হতে পারবো না?”
প্রিয়ম ভারি গলায় বিড়বিড় করে বলল,
-“অদ্ভুত ব্যাপার তো।”
মোনা হেসে উঠে। এভাবে হাসতে মোনা’কে খুব কম দেখেছে। মোনা রসহ্যময় ভঙ্গিতে বলল,
-“সুস্থ হওয়ার জন্য মনোবল’ই যথেষ্ট।”
-“আচ্ছা..আচ্ছা বুঝেছি,চলো ভার্সিটি’তে পৌঁছে দিই।”
মোনার মুখের হাস্যউজ্জ্বল ভাব গায়েব হয়ে গেলো। কঠিন স্বরে বলল,
-“আমি একা যেতে পারবো আপনি যান।”
প্রিয়ম এমন আচরণ আশা করেনি। ভেবেছে মোনার সাথে সম্পর্ক কিছু’টা হলেও উন্নত হয়েছে। প্রিয়ম বজ্রাহত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল। তারপরও কয়েক বার সাধলো মোনা’কে। একই প্রত্যুত্তর করলো মোনা।প্রিয়ম জোর করল না। আগে জোর করা’টা মানাতো, প্রিয়মের মনে হয় এখন জোর করা বেমানান।

জ্যাক দিনে কয়েকবার ফোন দিয়ে মোনার খোঁজ নেয়। মোনার সুস্থতা জ্যাক’কে প্রশান্তি দিলো যেন।
প্রিয়ম ভেবেছিল সুস্থ হয়ে ওঠার পর হয়ত সম্পর্ক’টা কিছু’টা হলেও উন্নতি হবে কিন্তু তা কিছুই হলো না। প্রিয়ম হতাশ হলো। প্রিয়ম একদিন খুব সকালে মোনার বাসায় আসলো। মোনা তখন ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হচ্ছে।
-“তুমি আমার ফোন কেন রিসিভ করছো না মোনা?”এই টুকু বলে থেমে আবার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলল,
-“আচ্ছা কি করলে তুমি আমায় ভালোবাসবে বলবা? আমার প্রতি সামান্য সহানুভূতি জাগে না?”
মোনা সহজ গলায় বলল,
-“জাগে মাঝে মাঝে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় আপনায় ভালোবাসি কিন্তু আমার ভিতরে এক সত্ত্বা আছে, যে প্রেম-ভালোবাসার বিরুদ্ধে। যে কারো মায়াজালে আবদ্ধ হওয়ার পক্ষে না।”
মোনা এক অভাবনীয় উত্তর দিলো। কোন ভনিতা করলো না। কিছুক্ষণ পর আবার বলল,
-“ভালোবাসার প্রতিদানে সবারই ভালোবাসতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু আমার ইচ্ছে যে নিয়ন্ত্রণ করে সে ভালোবাসা বিদ্বেষী।”
প্রিয়ম অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। এত সহজ স্বীকারোক্তি প্রিয়ম আশা করে নি। প্রিয়ম অসহায় গলায় বলল,
-“আমি প্রতিনিয়ত কোন শূন্যতায় ভুগছি। অসহ্য যন্ত্রণা আমায় তাড়া করছে। মোনা আমায় এসব থেকে মুক্তি দেও। একতরফা ভালোবাসা যে কত তীক্ষ্ণ যন্ত্রনার তা তুমি বুঝো?”
-“আমি বুঝতে চাই না। আপনি চলে যান এখন।”
হঠাৎ কি যেন হয়ে গেলো প্রিয়মের। প্রিয়মের চোখ টলমল করছে।‌ এত চেষ্টা করে ও ব্যর্থতা,এত অবজ্ঞা যেন চোখের জল হয়ে টলমল করছে। মোনা তাকালো নির্বাক দৃষ্টিতে একবার সেদিকে। সকল বাধা উপেক্ষা করে নির্লজ্জের মতো দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।
মোনা বজ্রাহত হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। এই চোখের পানি যেন স্বচ্ছ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। মোনার ভিতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। মোনার চোখের দৃষ্টি প্রিয়মের গাল বেয়ে পড়া পানি দুই ফোঁটার দিকে নিবদ্ধ।
মুহূর্তের ব্যবধানে মোনার কি যেন হয়ে গেলো। ভালোবাসা বিদ্বেষী ভাব’টা যেন পরাজিত হয়ে গেলো। কি হবে কি না হবে ভেবে মোনা ছুটে গিয়ে প্রিয়ম’কে জড়িয়ে ধরলো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here