মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৩+২৪
পড়ন্ত অপরাহ্নে গোধূলি লগ্নে রক্তিম প্রভাকর ক্রমশ হেলে পড়েছে। অস্তমান বিভাবসুর লালচে আভা মহী তে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। দখিনা পবন জানালার ঈষৎ ফাঁক দিয়ে রুমে ঢুকে পড়ছে। একটু আগেই প্রচণ্ড বৃষ্টি ধারা ধরত্রীর বুকে স্নিগ্ধ, ঠাণ্ডা ভাব দিয়ে গেছে। মোনার শীত লাগছে, ঈষৎ ফাঁক হয়ে থাকা জানালা’টাও বন্ধ করে দেয়, রুমে বাতাস আসার সব পথ রুদ্ধ করে দেয়।
মোনা নিশানের অগোছালো করে রাখা সব কাপড় গুছিয়ে ওয়াড্রবে রাখল। যেগুলো ময়লা জমেছে সেগুলো ওয়াশিং মেশিনে কাচলো। ছেলেদের এই বাজে স্বভাব’টা বোধ হয় জন্মসূত্রে লাভ করা। এলোমেলো করে কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা!ছোট বেলা থেকে মা বা বোন কেউ একজন অগোছালো জামা-কাপড় গুছিয়ে রাখবে, ধুয়ে দিবে ।আর বিয়ের পর বউ। এটা’ই তাঁদের জীবনচক্র।
আজ রুম ,কিচেন পরিষ্কার, জামা কাপড় ধোয়া,এসব করতে করতে মোনার প্রাণ ওষ্ঠাগত। এগুলো সব লিলি বেগমই করে দিতো। কয়েকদিন যাবৎ আসছে না লিলি বেগম। মোনা প্রায়ই ফোন দেয়। বার বার একই কথা বলে,’ প্রিয়ম হাঁটতে পারে না,ওর দেখাশোনা করা লাগে।’ এই টুকু বলে অনুনয় বিনয় করে বলে,’ মোনা তুই আয় না একবার।’ মোনা দ্রুত চতুরতার সহিত প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে ফেলবে।
আরো কয়েকদিন কেটে গেলো। মোনার পরীক্ষার ফলাফল বের হলো। এক কথায় খারাপ হয়েছে রেজাল্ট। মোনা মন খারাপ করছে না, মোনা ভেবেছে এর থেকেও খারাপ হবে। নতুন জায়গা,নতুন পরিবেশ, নতুন ধাঁচে লেখাপড়া সব কিছুর সাথে নিজেকে মানাতে একটু সময় লাগা স্বাভাবিক। নিশান কে সামলানো, রান্না-বান্না, জব এসবের পরে লেখাপড়া।
মোনা অবচেতন মনে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ল। প্রিয়মের পা এখনো ভালো হয়নি? মোনা প্রিয়মের সাথে প্রেম করুক আর না করুক! প্রিয়ম নিয়ম করে মোনার ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকুক, রাত-বিরাতে নিঃশব্দে এসে বারান্দার নিচে দাঁড়িয়ে থাকুক।‌ এগুলো যেন স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিক নিয়মের বিঘ্ন সৃষ্টি হলে মানুষ যেমন শুন্যতা অনুভব করে, মোনাও হয়ত শূন্যতা অনুভব করছে। এটা’কে ভালোবাসা বলে ভুল করা যাবে না।
আমাদের নিত্যঘটিত স্বাভাবিক নিয়ম গুলো হোক সেটা ভালো কিংবা খারাপ, পছন্দের কিংবা অপছন্দের। কোন কারণে তার থেকে ব্যতিক্রম কিছু ঘটলে চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক।
মোনা লিলি বেগমের কাছে ফোন দেয়, উদ্দেশ্য প্রিয়মের খোঁজ নেওয়া। মোনা অনেকক্ষণ কথা বলল কিছু দ্বিধাদ্বন্দব, সংকোচ আর ইতস্তত বোধের কারণে জিজ্ঞেস করা হয়ে উঠল না। মোনা ফোন রেখে দিলো। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিলো। ওপাশ থেকে বলল,
-“আবার ফোন দিয়েছিস কেন?কিছু বলবি?”
মোনার গলায় আড়ষ্টতা স্পষ্ট ফুটে উঠে। দ্বিধাদ্বন্দ্ব যেন মোনার গলায় আস্ত হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে তাই কথা বের হচ্ছে না। মোনা একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলল,
-“আচ্ছা প্রিয়ম ভাই সুস্থ হবে কবে? আর তুমি আমাদের বাসায় আসবে কবে?”
লিলি বেগম নিঃশব্দে হাসলো।বলল,
-“প্রিয়ম এখন সুস্থ, বেশি হাঁটলে প্রবলেম হবে তাই যায়না কোথায়ও। আচ্ছা আমি কালই আসবো যা।”
-“এসো কিন্তু।”
মোনা ফোন রাখে। ফোন রাখার সাথে সাথেই শ্রুতির ফোন। মোনা নিশানের মুখে নাস্তা তুলে দিচ্ছে। নিশান’কে খাওয়ানো শেষে, স্কুলের জন্য রেডি করিয়ে দেয়। এর ভিতর শ্রুতি ফোন দিয়েছে অনেকবার। মোন কল ব্যাক করে। ওপাশ থেকে উথালপাতাল হয়ে বলে লম্বা সুরে বলে,
-“আজ খুব একটা খুশির খবর আছে মোনা। তুমি তাড়াতাড়ি এসো।”
মোনা তেমন গ্রাহ্য করে না। শ্রুতির খুশি তো সব কিছুতেই। শ্রুতির খুশি নিয়ে গুরুত্বর ভাবনা চিন্তার কিছু নেয়। মোনা ভার্সিটিতে গিয়ে দেখা শ্রুতি শুধু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে কারো জন্য অধীর আগ্রহে ব্যাকুল হয়ে আছে। শ্রুতির পাশে বসা ওয়াটস। মোনা কে দেখেই নিদারুণ হৃষ্টতার গলায় বলে,
-“আমার আর সমীরের বিয়ে’টা বোধ হয় এবার হয়ে যাবে। সমীর রাতের বেলায় নাকি আমায় ভীষণ মিস করে।”
মোনার মুখের হাস্যউজ্জ্বল ভাব অপ্রস্তুত ভাবে বিলীন হয়ে যায়। সমীর আর ওঁর ঘনিষ্ঠ কথা নির্লজ্জের মত ওয়াটসের সামনে মোনার কাছে বলছে। মোনা অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে পড়ে। শ্রুতি আবার বলা শুরু করল,
-“আর কি বলেছে জানো—”
মোনা তীক্ষ্ণ স্বরে বলে,
-“এই শ্রুতি থামো, থামো। তোমাদের ব্যক্তিগত কথা এভাবে কেন প্রকাশ করছ? তোমাদের বিয়ে হবে এটা খুশির খবর। কিন্তু তুমি এখন থামো প্লীজ।”
কথাটা সম্পূর্ণ শেষ করতে না পারায় শ্রুতি হতাশ হয়ে যায় যেন, ব্যর্থ চোখে তাকালো মোনার দিকে।এই আলোচনা থেকে সম্পূর্ণ বের হতে মোনা বলল,
-“তোমাদের পরিচয়,প্রেম, আশির্বাদ কিভাবে হয়েছে?”
শ্রুতি কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। সব কিছু গুছিয়ে তুলছে বলার জন্য। কিছুটা উদাস ভাব শ্রুতির মুখে দেখা যাচ্ছে। পুরানো কথা, পুরানো স্মৃতি মানুষ’কে যেন কারণে অকারণে উদাস বানিয়ে দেয়।
-“আমার আর সমীরের বাসা পাশাপাশি। সমীর বনেদি পরিবারের ছেলে। আর আমাদের পরিবারের অবস্থা ছিলো মোটামুটি। সমীর আমার প্রায় দশ বছরের বড় হবে। সমীর যখন তাগড়া যুবক আমি তো তখন ছোট। প্রেম, ভালোবাসা ওসব কিছুই বুঝিনা তখন। আমার পরিবারের সবাই কুৎসিত, গায়ের রং কুচকুচে কালো। এর জন্য যে মানুষ আমাদের হেয় চোখে দেখত তাও বুঝতাম। আমি স্কুলে যাওয়ার পথে প্রায়ই সমীরের সাথে দেখা হত,আমার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণ আমি খুঁজে পেতাম না,আমায় দেখার কি আছে? আমি তো কালো। আমিও আড়চোখে তাকাতাম,প্রেম- ভালোবাসা এসব থেকে তাকাতাম না। সুন্দর তাই তাকাতাম। আমি তো ঘুনাক্ষরেও ভাবতে পারিনি ওই ছেলে আমায় পছন্দ করবে। আমায় প্রেমের প্রস্তাব দিলো,আমি কিছু না বুঝেই রাজি হয়ে গেলাম। অত কিছু ভাবার বয়স তখনো হয়নি। আমি তো প্রেমে রাজি হয়েছি সুন্দর বলে। সে বয়সে শুধু সৌন্দর্য অনুমান করার ক্ষমতা ছিলো, অন্য কোন আবেগ অনুভূতি ছিলো না। আস্তে আস্তে বুঝতে পারি আসলে সমীরের বাহ্যিক সৌন্দর্যের থেকে ভিতরের সৌন্দর্য আরো বেশি উৎকট। তখন আমার মনে হতো সমীর যদি সুন্দর না হয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত মানুষ হতো তাহলেও আমি ও’কে ছেড়ে যেতে পারতাম না। এর মাঝে শুরু হয় ট্রাজেডি। বাপ আমার বিয়ে ঠিক করে বুড়ো এক টাকাওয়ালা লোকের সাথে। কালো মেয়ে বিয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। সমীর দাঁড়ায় বাঁধা হয়ে। তখন সবাই জেনে যায় আমাদের প্রেমের কথা। সবার মুখে একই কথা,’কি দেখে প্রেম করেছিস ওই মেয়ের সাথে? চেহেরার কি শ্রী!’
সমীরের পরিবারে যেন দাবানলের সৃষ্টি হয়। সমীর নিজের জায়গায় অনড়, সে আমায় বিয়ে করবেই। সমীর সবার বিরুদ্ধে যায়। শেষে আরেক ঝামেলা ‌। আমাদের বংশে বংশে মিলছে না। সমীর’রা মজুমদার, আর আমরা দাস। কি যে ঝামেলা! সব ঝামেলা ঊর্ধ্বে গিয়ে আমাকে বিয়ে করতে চায়। সমীরের পরিবার আমাদের সমাজচ্যুত করার ভয় দেখায়, সে এক লম্বা কাহিনী। বিয়ে হলো না, শেষ পর্যন্ত আশির্বাদ হলো। সমীর বলে আমার লেখাপড়া শেষ হওয়ার পর বিয়ে। সমীরের আমেরিকায় জব হয়, আমায় নিয়ে আমেরিকা চলে আসে।”
শ্রুতি এক নাগাড়ে অনার্গল ভাবে বলল কথা গুলো। মাঝে মাঝে শ্রুতির গলা ধরা আসছিল যেন। কান্নায় ধরে আসা গলায় কাঁপা কাঁপা ভাবে বলেছিল শ্রুতি। শ্রুতির চোখ ছলছল করছে। দুই ফোঁটা পানি জমেছে সেখানে। হয়ত সমীর’কে সব বাঁধা বিপত্তি অতিক্রম করে পেয়েছিল সেই সুখে নয়ত পুরনো ম্লান স্মৃতির বুকের ভিতর তোলপাড় শুরু করেছিল সেজন্য। পুরানো স্মৃতি বন্দনায় শ্রুতির মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেলো যেন। চোখে মুখে লেগে থাকা চঞ্চলতা কিছু সময়ের জন্য বিলীন হয়ে গেছে। মুখ’টা বিবর্ণ, বিধ্বস্ত রূপ ধারণ করেছে। পরিবারের কথা মনে পড়েছে হয়ত।
এই গাঢ় নিস্তব্ধতা রেশ কাটিয়ে পরিবেশ’টা কে স্বাভাবিক করতে মোনা বলল,
-“সমীরের পরিবারের লোকের সাথে তোমার কথা হয়?”
শ্রুতি স্মৃতির জানালা’টা বন্ধ করে তাকালো মোনার দিকে। চোখ মুখ স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল।
-“না, আমার সাথে কথা হয়না। সমীরের সাথে হয়। তাও মাঝে মাঝে। তাঁরা সমীরের উপর রাগ।”
ওয়াটস মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিস্মিত গলায় বলল,
-“কি সুন্দর প্রেম কাহিনী তোমার! পাক্কা প্রেমিক-প্রেমিকা তোমরা।”
উত্তরে শ্রুতি গর্বের দীপ্তি নিয়ে হাসলো। মোনা বলল,
-“তো হঠাৎ এখন বিয়ে করতে চাচ্ছো?তোমার তো লেখাপড়া শেষ হয়নি।”
-“সমীর তো ফাইনাল বলে নি। সমীর শুধু বলে বিয়ের পর মেয়ে’দের মাথায় কুবুদ্ধি চাপে। হাজবেন্ডের ঘাড়ে চেপে থাকতে চায়। লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেনা। সমীর খুব মেধাবী ছিলো, তাঁর কাছে লেখাপড়ার গুরুত্ব সর্বপ্রথম।”
ওয়াটস কি যেন ভেবে বলল,
-“আচ্ছা সমীর যদি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলে?”
শ্রুতি ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওয়াটস এর দিকে। কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর উত্তর দিলো।
-“সিদ্ধান্ত বদলে ফেলার ভয়ে বিয়ে করব? যদি সিদ্ধান্ত বদলানোর হয় সেটা তো বিয়ের পরও বদলাতে পারে। ছেড়ে চলে না যাওয়া যদি বিয়ের মাধ্যমেই নিশ্চিত হত তাহলে তো ডিভোর্স শব্দ’টা থাকত না।”
মোনা শ্রুতির কথায় বিমুগ্ধ হলো। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কত সুস্থ চিন্তা ভাবনার মানুষ সমীর। আচ্ছা সমীরের যদি এই ভালোবাসা বদলে যায়? হয়ত বদলাবে না.. তবুও যদি বদলে যায় তাহলে শ্রুতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে যাবে। কত ভালোবাসার মানুষ বিয়ের আগে কিংবা বিয়ের পরও বদলে গেছে। প্রেম, ভালোবাসায় ছেড়ে যাওয়া কিংবা বদলে যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে না?তাহলে তো কোন সন্দেহ, অবিশ্বাস কিছুই থাকবে না।
শ্রুতি বলল,
-“আমি আজও বুঝতে পারছি না সমীর কেন আমায় এত ভালোবাসে? আমার মনে হয় ইশ্বর তো আমায় কুৎসিত করে তৈরি করেছে, সেই অপূর্ণতা সমীরের ভালোবাসা দিয়ে পূর্ণ করে দিয়েছে।”
আজ সারা ক্লাসে শুধু সমীর আর শ্রুতির কথা ভাবছে মোনা। ওঁদের নিয়ে ভাবনা যেন আজ ওর অস্থি মজ্জায় গেঁথে গেছে। ঘোরলাগা প্রেম কাহিনী। মোনা আজ অফিসে গিয়েও এই ভাবনা মাথা থেকে সরাতে পারেনি। অদ্ভুত ভাবে মোনার মস্তিষ্কে চেপে বসেছে। মোনা রোমাঞ্চিত হচ্ছে।
—-
বাসায় ফিরে মোনা বিশ্রাম নিয়ে পড়তে বসে। মোনার ক্ষোভ হয় প্রিয়মের কথা ভেবে। প্রিয়ম নাকি ওঁর জন্য বদলে গেছে, ওঁর ভালোবাসায় বিভোর হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।‌ কই এতদিনে তো একটা ম্যাসেজও করল না! ফোনও দেয় নি। প্রিয়ম হেঁয়ালি করছে, নিছক মজা নিচ্ছে। এছাড়া কিছুই নয়।
পড়া শেষে বারান্দায় যাওয়া মোনার নিত্য স্বভাব হয়ে উঠেছে। অমাবস্যার তমসা রাত। পৃথিবী’কে গ্রাস করেছে আঁধারে। ধরা আজ অন্ধকার সজ্জায় সজ্জিত হয়েছে। আকাশের দিকে তাকালে মোনার দৃষ্টি অন্ধকারে হারিয়ে যায়। সেই বিলীন হওয়া দৃষ্টি ফিরে পায় জানালার ফাঁক দিয়ে আসা খন্ড খন্ড আলোর মিছিল দেখে।
দখিনা মৃদু হাওয়ায় মোনার কর্ণপ্রান্তের কুন্তল মুখে উড়ে আসছে বার বার।মোনা বিরক্ত নিয়ে বার বার মুখে উড়ে আসা চুল গুলো সরাচ্ছে। মোনার এই রাতে কফি খেতে ইচ্ছে করতে। মোনা চুলা জ্বালিয়ে চুলা কফির তৈরির জন্য পানি বসায়। মোনা অকারণে তাকিয়ে আছে চুলায় দাউদাউ করে জ্বলা হুতাশনের দিকে। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, অবলোকন করছে।
নিশান সজাগ হয়ে যায়। ঘুম জড়ানো চোখে খুঁজতে থাকে মোনা’কে। মোনা কফির মগ নিয়ে বসে নিশানের পাশে। দুই ভাই – বোনে কফির মগে চুমুক দিচ্ছে তৃপ্তি সহকারে। মোনা প্রশান্তি পায়, নিশান ভালো আছে! নিশানের শরীরের সেই মারের আঘাত গুলো এখনো আছে,কত অমানবিক ভাবে মারত ইমরুল চৌধুরী। বাবা নাম টার সাথে কি এত পিশাচশতা যায়?
—-
মোনা জ্যাকের বাসায় যায়।জ্যাকের বাসায় খুব শোরগোল। কোন প্রোগ্রামের আয়োজন করা হচ্ছে মনে হচ্ছে। জ্যাক সেদিনও ফোন করে বলেছিল,’মোনালিসা আপনি আসুন না একবার আমার বাসায়, আমি ইদানিং খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।’
মোনাও সময় করে উঠতে পারে না। প্রিন্সেস’কে দেখার জন্য অধীর হয়ে উঠেছে। জ্যাক বলেছে প্রিন্সেস নাকি কথা বলতে শিখছে। ফাদার ডাক শিখেছে। প্রিন্সেসও আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছে।
জ্যাক সবাই’কে কিভাবে কি করতে হবে নির্দেশ করছে। মোনা’কে দেখে জাগতিক সব কাজ উপেক্ষা করে রুমে নিয়ে গেলো প্রিন্সেসের কাছে। জ্যাক উৎসুক গলায় বার বার বলছে,
-“প্রিন্সেস ফাদার বলো ফাদার।”
প্রিন্সেস অস্পষ্ট ভাবে কিছু একটা বলল। মোনা হেসে উঠলো। বলল,
-“জ্যাক আপনি কিন্তু মিথ্যা বললেন। প্রিন্সেস মোটেও ফাদার বলে নি।”
জ্যাক মোনার কথার প্রত্ত্যুতরে ব্যাখ্যা করে বলে,
-“বাচ্চা’রা স্পষ্ট ভাবে কিছু বলতে পারে না। বুঝে নিতে হয় মোনালিসা। বুঝার মত ব্রেন থাকতে হয়।”
বাচ্চা দের ব্যাপারে বাবা-মা খুব উৎসুক থাকে। আদো আদো গলায় কিছু একটা বললেই বাবা-মা উচ্ছ্বাসিত হয়ে সেটার ব্যাখ্যা খুঁজে। নিজেদের মত করে অর্থ বের করে।
জ্যাক আদুরে গলায় বলল,
-“প্রিন্সেস মোনালিসা’কে মাদার ডাকো তো। মোনালিসা বিশ্বাস করছে না।”
জ্যাকের কথা শুনে কোন এক অজ্ঞাত কারণে মোনার হাসি বিলুপ্ত হয়ে গেলো। প্রিন্সেসের দিকে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকায়। এর ভিতর জ্যাক বলে,
-“মোনালিসা আমার বাসায় পার্টি, বন্ধু-বান্ধব আসবে। কিন্তু আপনায় দাওয়াত করতে পারছি না। আমি জানি আপনি এসব পছন্দ করবেন না।”
কেমন পার্টি?সেই নাইট ক্লাবের মত পার্টি? মোনালিসা বলল,
-“আপনি এত বুঝেন কিভাবে?”
জ্যাক জবাব দিলো না। মোনা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আশাহত হলো উত্তর না পেয়ে। জ্যাকের ডাক এলো, বুঝা গেলো জরুরি কিছু।
(চলবে)

মোনালিসা
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২৪
মোনার ভার্সিটি বন্ধ। নিশান স্কুলে গেছে। ভরদুপুরে মোনা খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে বইয়ে মুখ গুঁজে আছে। খানিকক্ষণ পর বাইরের দিকে তাকায়। বাইরে আজ অত্যুজ্জ্বল রোদ। রোদের তীক্ষ্ণ’তা একটু বেশি। মোনা আবার বইয়ে মগ্ন হয়।
ডোর বেলের শব্দে মোনা মুখ কুঁচকে ফেলল। নিশান তো এত তাড়াতাড়ি ফিরে না। লিলি বেগম এসেছে?এসব ভাবতে ভাবতে মোনা দরজা খুলে। দরজার সামনে প্রিয়ম দাঁড়িয়ে আছে। মোনার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, অর্থবহ সে দৃষ্টি। অনেকদিন দেখে নি, মনে হচ্ছে সেই তৃষ্ণা মিটাচ্ছে। মোনা আগের ন্যায় রুক্ষ ব্যবহার করল না। চমকানো গলায় বলল,
-“আপনি! কোত্থেকে আসলেন এত দিন পর?পায়ে ব্যথা কমেছে?”
প্রিয়ম তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো না। মোনার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে মগ্ন হয়ে আসছে, যেন ঋষি এক ধ্যানে তাপস্য করছে। প্রিয়ম মোনার দিকে দুই পা এগিয়ে গেলো। দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে মোনার চোখে চোখ রেখে অদ্ভুত এক স্বরে বলল,
-“চলে যাবো?”
মোনা না করতে পারল না। অদ্ভুত এক আচরণ করছে প্রিয়ম। এর বিপরীতে না বলা খুব কঠিন। কোন জোরজবরদস্তি করছে না। শান্ত গলায় কথা বলছে, যেখানে কিছু’টা রাগ, চাপা অভিমানও বিরাজ করছে।
প্রিয়ম রুমের ভিতরে ঢুকলো। বাসায় নিশানও নেই, প্রচন্ড অস্বস্তি মোনা’কে গ্রাস করছে যেন। প্রিয়মের সামনে একা মোনার অস্বস্তি লাগে, অস্থির , বিব্রত লাগে।
-“আমায় দেখতে গেলে না কেন?পায়ে প্রচন্ড ব্যাথা পেয়েছিলাম।‌‌‌ ভেবেছি তুমি একবার হলেও দেখতে যাবে!এত অপ্রিয় আমি?”
উৎকট এক অভিমান প্রিয়মের গলায়। মোনা আঁতকে উঠলো, প্রিয়মের প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে ও? প্রিয়মের সাথে তাহলে কেন খারাপ আচরণ করতে পারছে না? ভিতর থেকে আড়ষ্ট’টা কেন কাজ করছে? মস্তিষ্ক যেন সায় দিচ্ছে না।
প্রিয়ম আবার বলল,
-“আমায় কেন দেখতে গেলে না?”
মোনা কি বলবে গুছিয়ে উঠতে পারল না। এলোমেলো কিছু শব্দ হাতড়ে হাতড়ে খুঁজে বের করে বলল,
-“ভার্সিটি,জব সব মিলিয়ে ব্যস্ত ছিলাম খুব।”
মোনা আজ প্রিয়মের চোখের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। প্রিয়মের চোখে যেন আজ সাগরের মত গভীরত্ব, অনুরাগ পূর্ণ। আবার কিছু অনুযোগও রয়েছে।
মোনার প্রিয়মের সামনে বসে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। মোনা এরূপ পরিস্থিতি এড়াতে বলল,
-“চা বা কফি খাবেন?”
প্রিয়ম মাথা ঝাঁকিয়ে না বলে। বাসার ভিতর বিজনমূর্তি বিরাজ করছে । মোনার দৃষ্টি ফ্লোরে আবদ্ধ। আর প্রিয়ম এক আহ্বায়ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যে দৃষ্টি মোনা’কে ভালোবাসার আহ্বান জানাচ্ছে।
-“প্রিয়ম ভাই, নিশানের কে এগিয়ে আনতে যেতে হবে। ওঁর স্কুল ছুটি হবে এখন।”
প্রিয়ম হাসলো। প্রিয়মের এই অহেতুক হাসির কারণ খুঁজে পেলো না মোনা। প্রিয়ম বলল,
-“মিথ্যা কেন বলছো? আমার সামনে থাকতেও তোমার সমস্যা হয়?এত সমস্যা আমায় নিয়ে?”
মিথ্যা বলে ধরা খেলে মুখের অবস্থা যেমন সঙ্গিন হয় মোনাও তাই হলো। মোনা সমস্ত আড়ষ্ট’টা কাটিয়ে গাঢ় স্বরে বলল,
-“আপনার সামনে থাকতে আমার অস্বস্তি লাগে।”
প্রিয়ম যেন মনোক্ষুণ্ন হলো। আগে প্রিয়ম সব কিছু’তে জোর করত, মোনা যা বলত কর্ণপাত করত না। কিন্তু আজকাল কেমন বোকা বোকা হয়ে গেছে, মোনা যা বলে তাই বিনা বাক্যে মেনে নেয়। তাই মোনা আগের মত কঠোর গলায় কিছু বলতে পারে না।
-“আচ্ছা তাহলে আমি চলে যাচ্ছি।”
প্রিয়ম উঠে পা বাড়ালো। মোনা কিছুই বলল না। কয়েক পা সামনে এগিয়ে আবার পিছনে ফিরে তাকালো প্রিয়ম। হঠাৎ ছুটে গিয়ে জাপটে জড়িয়ে ধরলো মোনা’কে। মোনা হতভম্ব হয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। প্রতিবাদ করতে ভুলে গেল যেন। হতভম্বের রেশ কাটতেই জোর গলায় বলল,
-“ছাড়ুন!আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।”
প্রিয়ম মোনার কোন কথাই শুনছে না। মোনা নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছে। তীব্র এক মোহনীয় ঘ্রান আসছে প্রিয়মের শরীর থেকে। প্রিয়মের নিঃশ্বাস মোনার শরীরে বিঁধছে, মোনার সমস্ত শিরায় উপশিরায় অস্বস্তি’তে তোলপাড় শুরু করে দিলো। মোনার শরীর যেন অবশ হয়ে যায়। কি হবে কি না হবে , এসব না ভেবে মোনা মোনা চুপচাপ প্রতিবাদ হীন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। মোনার মস্তিষ্কে থেকে এমন’টা-ই সায় দিলো।‌‌‌‌এর ঊর্ধ্বে গিয়ে কিছুই করতে পারল না মোনা। মোনা জানে না কতক্ষণ ওভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো। মোনার সময়জ্ঞান ছিলো না, চিন্তাশক্তি যেন লোপ পেয়ে গেছে পুরোপুরি। কিছুই ভাবতে পারছিলো না। মোনার মনে হয়েছে অন্য কেউ ও’কে নিয়ন্ত্রণ করছে। সেই নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে মোনা যেতে পারলো না।
প্রিয়মের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে মোনা নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করল। প্রিয়মের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল সীমাহীন ভালোবাসার জোয়ার মোনা’কে তার আপন সুরে ডাকছে। মোনার দৃষ্টি হঠাৎ পরিবর্তন হয়ে গেলো । রোষারক্ত নয়নে তাকিয়ে রাগে চিৎকার দিয়ে বলল,
-“বেরিয়ে যান এখান থেকে।”
প্রিয়ম বের হয়ে গেল। কোন কথা বাড়ালো না। মোনা শব্দ করে দরজা আটকে ওয়াশরুমে চলে গেলো। বেসিনের সম্মুখে অবস্থিত আয়নায় নিজেকে নিরীক্ষণ করতে লাগল। বড্ড অচেনা লাগছে। কেন প্রতিবাদ করল না? কেন প্রিয়মের সাথে খারাপ আচরণ করতে পারলো না? নিজের উপর ক্ষোভে ফেটে পড়ল, তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করছে। মোনা চোখে-মুখে পানি দিলো। নিজেকে উদ্ভ্রান্তের মতো মনে হচ্ছে। মোনা নিঃসাড় দৃষ্টিতে আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে রইল।
মোনার চোখ দিয়ে আষাঢ়ের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে। মোনা বুঝতে পারছে না ও কেন কাঁদছে। শুধু মনে হচ্ছে নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। পুরুষ মানুষ’কে কেন বিশ্বাস করবে? তাও প্রিয়মের মত মানুষ’কে!
মোনার রাগ হয় শ্রুতির উপর। শ্রুতি মোনার ব্রেন ওয়াশ করেছে। তাই প্রিয়ম’কে নিয়ে পজেটিভ চিন্তা এসেছিল। আর সেই চিন্তা থেকেই মোনা দুর্বল হয়ে পড়েছে। শ্রুতি তো ভালোবাসায় মত্ত। ও তো কখনো কাছের মানুষ’দের হিংস্র রূপ দেখে নি। শ্রুতি তো সমীরের কাছ থেকে অগাধ ভালোবাসা পেয়ে যাচ্ছে, তাই ভালোবাসার উপর এত শ্রদ্ধা। ভালোবাসা এত সহজ শ্রুতির কাছে।
মোনা কাঁদল কেন জানি। কান্নার নির্দিষ্ট কোন কারণ খুঁজে পেলো না। জীবনে পাওয়া সব আঘাত গুলো যেন উথলে উঠছে।মোনার চোখ দুটো ফুলে উঠেছে। কান্নার ফলে লালচে এক আভা দেখা যাচ্ছে। মোনা রুমে গিয়ে খাটের উপর বসল। অতিরিক্ত চিন্তায় মাথা’টা ঝিমঝিম করছে। আস্তে আস্তে মাথা ব্যথা শুরু হয়। মোনার মাথার দুই পাশের রগ গুলো সব দপদপ করছে। ছিঁড়ে যাবে যেন। মগজ গলে যাবে যেন ব্যথায়।
নিশান বাসায় এসে মোনার পাশে বসে। মোনার একটু অসুস্থতায় নিশান অসহায় হয়ে পড়ে যেন। নিশানের মুখ চুপসে গেল। কেঁদে ফেলব যেন। ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিশান। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখে ইশারায় জিজ্ঞেস করল,
-“কি হয়েছে আপা?এমন দেখাচ্ছে কেন?”
মোনা মুখে কিছু বলল না। কথা বললেই যেন ব্যথা আরো তীব্র হবে। নিশান মোনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, চুল গুলো টেনে দিচ্ছে। নিশানের চোখ দিয়ে যেন পানি গড়িয়ে পড়বে এক্ষুনি। মোনা নিশান’কে শাসিয়ে বলল,
-“আমার মাথা ব্যথা করছে। এতে কাঁদার কি হলো? মরবো না আমি।”
নিশান কান্না গিলে ফেলল । ছোট দুইটা হাতে মোনার মাথা টিপে দিচ্ছে পরম আদরে। মোনার আরাম বোধ হচ্ছে, মাথা ব্যথা কিছুটা কমছে। মোনা ঘুমিয়ে গেলো।
—-
ঘুম থেকে উঠার পর মাথা’টা ভারী লাগল ,ব্যথা নেই। মোনার মনে পড়ল ভরপুরের কথা। কিভাবে পারল মোনা প্রতিবাদ না করে ওভাবে প্রিয়মের আলিঙ্গন আবদ্ধ হয়ে থাকতে? নিজেকে নিজের ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হচ্ছে। মোনার মনে হচ্ছে মাঝেমধ্যে কিছু জিনিস আপনাআপনি ব্যক্তির ইচ্ছা উপেক্ষা করেই হয়ে যায়। মোনা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল।
মোনার ফোনে রিং হচ্ছে। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রিয়ম ফোন করেছে। মোনা ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে দিলো। খানিক বাদে ম্যাসেজ আসলো-
“মোনা, তোমার চোখ গুলো আজ ভিন্ন কথা বলেছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছো না। তোমার অবচেতন মন আমায় ভালোবেসে ফেলেছে।”
মোনার বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো।প্রিয়ম যা বলছে তা কি সত্যি? মোনা নিজেকে নিজে বিশ্বাস করতে পারছে না।নিজের মন বুঝতে পারছে না। মোনার মনে হচ্ছে ও পাগল হয়ে যাবে।
রাতে ভালো ঘুম হয়নি। নানান চিন্তা-ভাবনা মাথা অবশ করে রেখেছে। মোনার চোখ গুলো ছোট হয়ে গেছে ফুলে, লালচে দেখাচ্ছে। ভার্সিটি’তে যাওয়ার পর শ্রুতি হঠাৎ প্রিয়মের প্রসঙ্গ তুললে। মোনার মুখ ইস্পাতের মত কঠিন হয়ে গেলো। চেহেরা যেন ভয়ংকর কালবৈশাখীর রূপ ধারণ করেছে। চোয়াল শক্ত করে বলল,
-“শ্রুতি এর পর থেকে তুমি কখনো আমার কাছে প্রিয়মের কথা বলবে না। এ প্রসঙ্গে কখনো আমার সাথে কথা বলবে না।”
হঠাৎ মোনার এমন আচরণে চমকালো শ্রুতি,মনোক্ষুণ্ন হলো। শ্রুতি পুরো ক্লাসে তেমন কথা বলল না। মোনা বুঝেও শ্রুতি’কে স্যরি বলল না।
—–
মোনা অফিসে যায়। শরীর খারাপ লাগছে আজ। চোখ গুলোও জ্বলছে বড্ড। চোখের বিশ্রাম প্রয়োজন। মোনা অফিসে যাওয়ার সাথে সাথেই লরি আসে।
-“মোনা আজ আমার বার্থডে। তোমাদের রেস্তোরাঁয় খাওয়াবো। আমার গার্লফ্রেন্ডও আসবে,ও’কে তোমার কথা বলেছি। ও তোমায় দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে।”
মোনার লরির দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,
-“বার্থ ডে আগে তো বলেন নি।আর আমার শরীর’টাও ভালো না।”
লরি মোনা কে থামিয়ে দিয়ে বলল,
-“প্লীজ মনা ডোন্ট শো এ্যানি এক্সুয়েজ।”
মোনা আর কিছু বলতে পারল না। লরি প্রথম থেকেই মোনা কে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। তাছাড়া লরি খুব আন্তরিক এবং বন্ধুসুলভ। কিন্তু মোনা চিন্তায় পড়ে গেল! নিশান তো বাসায় একা। শরীর ,মন কিছুই সায় দিচ্ছে না। উপহারও তো নিতে হবে। এ মুহূর্তে মোনার কাছে ভালো উপহার দেওয়ার ডলার নেই। লরি বলেছিলে ও বই পড়তে পছন্দ করে। মোনা ঠিক করল বই উপহার দিবে।
মোনা অফিস শেষে বই কিনলো। এলিন ও গেলো। মোনার উপস্থিতি’তে এলিন যেন বিরক্ত বোধ করছে।
লরির গার্লফ্রেন্ড আসলো এর ভিতর। লরি পরিচয় করিয়ে দিলো। চঞ্চল, প্রাণবন্ত ,উচ্ছ্বাসিত মেয়ে’টা। মুখের কোণে হাসি লেগে আছে। হোয়াইট স্লীভলেস শর্ট কুর্তি টাইপ কিছু পড়েছে, আর হাঁটুর অবধি স্কার্ট‌। মোনাও হাত বাড়িয়ে হায় জানালো। লরির গার্লফ্রেন্ড মোনা’কে বলল,
-“তোমার কথা লরি বলেছে অনেক বার। প্রশংসা করেছে তোমার।”
নিজের প্রশংসার কথা শুনে মোনা একটু লাজুক হলো। মেন্যু কার্ড দেখে অর্ডার দিতে বলা হলো। মোনা খুব বেশি কিছু অর্ডার করল না। লরির গার্লফ্রেন্ড ওঁদের সামনেই লরি’কে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে। দুইজনে কোন সংকোচহীন ভাবে আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। মোনা অন্যদিকে দৃষ্টি আবদ্ধ করলো। বিরক্ত লাগছে মোনার। তিনজনে যা অর্ডার করেছে, এলিন একাই তার দ্বিগুণ খাবার অর্ডার করল। লরির গার্লফ্রেন্ড একটু সরু চোখে তাকালো এলিনের দিকে। মোনার খাবার প্রায় অর্ধেক শেষ। এর ভিতর রেস্তোরাঁয় হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল প্রিয়ম।‌ প্রিয়ম মোনার দিকেই আসছে। মোনা অপ্রস্তুত ভাবে তাকালো। মোনার কাছে এসেই মোনার হাত ধরল। জোর গলায় বলল,
-“এদিকে আসো।”
মোনা রোষারক্ত নয়নে তাকালো। প্রিয়মের এত অধিকার খাটানো, কর্তৃত্ব বোধ ফলানো এসবে মোনা প্রচন্ড তেতো হলো। মোনা এখানে কোন ঝামেলা করল না। প্রিয়মের পিছু পিছু গেলো। লরি উদগ্রীব হয়ে বলল,
-“মনা কি হয়েছে?কোথায় যাচ্ছো?”
মোনা সে সব কথা ভ্রুক্ষেপ করল না। মোনার শরীর রাগে কাঁপছে। কিছুদূর গিয়ে দাঁড়ালো। প্রিয়ম রাগান্বিত গলায় বলল,
-“ছেলে’টা কে? রাতের বেলায় রেস্তোরাঁয়! বাহ্ মোনা।”
প্রিয়মের কথায় মোনার মুখের অভিব্যক্তি আবছা অন্ধকারে স্পষ্ট বুঝা গেলো না। তবে মোনার গলার স্বর শুনে বুঝা গেলো প্রচন্ড ক্ষুব্ধ মোনা।
-“সমস্যা কি আপনার?কিসের এত অধিকার দেখান আপনি? কর্তৃত্ব বোধ ফলাতে এসেছেন? আমি যার সাথে ইচ্ছে রেস্তোরাঁয় আসবো, যা ইচ্ছে তাই করবো। এর জবাবদিহিতা আপনার কাছে করতে হবে?”
রাগে মোনার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে যেন। প্রিয়ম মোনার হাত হিংস্র ভাবে চেপে ধরল। বলল,
-“তোকে ভালোবাসি এটা’কে তুই আমার দুর্বলতা ভেবেছিস?তোর মত মোনা মেরে রাস্তায় ফেলে রাখবো। চিনিস তুই আমায়? আমি তোর সব অবজ্ঞা সহ্য করি, তাই বলে এসবও সহ্য করব?”
মোনার চোখ জোড়া আবছা অন্ধকারের মধ্যেও যেন রাগের ফুলকি ছড়াচ্ছে। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসছে রাগে। কি যেন হয়ে গেলো মোনার মাঝে, ক্রোধে থরথর করে কাঁপছে।
-” ডোন্ট জাজ এ্যা বুক বাই ইট’স কভার।”
মোনার এই কথার অর্থ বুঝলো না প্রিয়ম। জিজ্ঞেসও করল না।প্রিয়মের রাগ যেন মুহূর্তে মিইয়ে গেল। প্রিয়মের গলার স্বরে পরিবর্তন আসলো।‌ একটু আগে করা রাগের জন্য যেন অনুতপ্ত সে।
-“মোনা স্যরি,স্যরি মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তুই-তুকারি করে ফেলছি। রাগ হয়েছিল।”
মোনা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-“ইট’স ওকে।”
প্রিয়ম বলল,
-“মোনা আমি অনুতপ্ত। আমি খারাপ আচরণ করে ফেলেছি।” প্রিয়ম একটু থেমে আবার বলল,
-“চলো পৌঁছে দিই তোমায়।”
মোনা গাড়িতে উঠলো। গম্ভীর হয়ে বসে রইলো। অন্য সময় হলে হয়তো উঠত না। মোনার আচরণে অবাক হলো প্রিয়ম।
পুরো রাস্তায় কোন কথাই বলল না। প্রিয়ম অনাবরত স্যরি বলে গেলো।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here