মোনালিসা0
লেখা-ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-১+২
‘বাসা থেকে হোস্টেলের বেতন দিচ্ছে না দুইমাস ধরে। এর আগের মাসে খুব কাছের এক ফ্রেন্ড এর কাছ থেকে ধার নিয়ে দিয়েছে, পনেরো দিনের কথা বলে ধার নিয়েছিলাম। সেই পনেরো দিন শেষ হয়েছে আরো বিশ দিন আগে। ইতোমধ্যে আরেক মাসের পাঁচ দিন হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো ওর টাকা শোধ করতে পারিনি। ও টাকা না চাইলেও নিজের কাছে খুব ছোট মনে হচ্ছে নিজেকে। বাসায় মায়ের কাছে ফোন নেই। বাবাকে প্রায় ফোন দিই। অধিকাংশ সময় ফোন রিসিভ করে না। রিসিভ করলেও সন্তোষ জনক কোন উত্তর পাইনি। হোস্টেলের ম্যাডাম এসে বলে গেছে এভাবে হোস্টেলে থাকা চলবে না। হোস্টেলের টাকা দিতে না পারলে সোজা বেড়িয়ে যেতে। কথাগুলো তো ম্যাডাম আমায় ডেকে আড়ালে নিয়ে বলতে পারতো। রুমের সবার মাঝে এভাবে কর্কশ গলার কথা গুলো আমি হজম করতে পারলাম না। মাথা নিচু করে ফ্লোলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম। চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জিত হলো। অপমানে মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। আমার সব থেকে কাছের ফ্রেন্ড পিয়ু এসে আমার পাশে বসলো, সান্ত্বনা স্বরুপ আমার বাম হাতটা চেপে ধরলো। বাদবাকি কেউ কোন কথা বললো না। অনেকে আমার এই অপমান দেখে মনে মনে অকারণে’ই আনন্দ পাচ্ছে, অনেকে সূক্ষ্ম ব্যাথা অনুভব করছে। আমি চোখ তুলে কারো দিকে তাকালাম না। তাকাতে ইচ্ছা করলো না। হয়ত কষ্টে নয়ত লজ্জায়। আমি ধীর হাতে ব্যাগ গোছাতে লাগলাম। পিয়ু আহত গলায় আমায় বলল,
-“ব্যাগ গুছাচ্ছিস কেন?সামনে এক্সাম।তুই আমার কাছ থেকে টাকা ধার নে।”
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা করলাম। তবুও ভিতর থেকে অবাধ্য কান্না তীব্র বেগে বেরিয়ে আসছে। আমি ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করছি,যার ফলে শরীর’টা ঈষৎ কাঁপছে।কান্নার বেগে ধরে আসা গলায় বললাম,
-“না।”
পিয়ু বার বার জোর করতে লাগলো। কারো কোন কথা শোনার আগ্রহ খুঁজে পেলাম না। ম্যাডামের বলা কথা গুলো ডাঙায় রাখা মাছের মত মস্তিষ্কে তাপড়াতে লাগল।
আমি ওকে নিচু স্বরে বললাম,
-“আমার বাসায় যেতে হবে। মায়ের শরীর টা ভালো না। তাছাড়া আরো সমস্যা আছে।”
মায়ের শরীর ভালো না এটা একদম মিথ্যা কথা। মায়ের সাথে দীর্ঘ অনেক দিন যাবৎ কথা হয়না। আমি ধীরে ধীরে ব্যাগ গুছিয়ে হোস্টেল সুপারের পারমিশন নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম।
পিয়ু নাছোড়বান্দা। আমায় বার বার বাঁধা দিতে লাগলো। আমি প্রচণ্ড বিরক্তে নির্বাক হয়ে রইলাম।
পিয়ু আমায় বার বার বলল,
-“এক্সাম সামনে। তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস।”
আমি কোন জবাব দিলাম না। পিয়ু আমার পিছু পিছু আসলো। আমি পিছনে ফিরে তাকালাম না। পিয়ু আশ্বস্ত গলায় বলল,
-“আমি তো আছি। তুই চিন্তা করিস না।”
এবার আমি ওর দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক একটু হাসলাম। একটা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলে উদাস গলায় বললাম,
-“তাড়াতাড়ি’ই ফিরে আসবো।”
বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। আমি বাসায় ফিরেই সোজা মায়ের রুমে গেলাম। মা খাটে আধশোয়া অবস্থায় ক্লান্ত মাখা চেহেরা নিয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলো। আমাকে দেখেই ভূত দেখার মত চমকে উঠলো। খাট থেকে দ্রুত নেমে আমায় জড়িয়ে ধরলো। আমার দুই গালে হাত দিয়ে আদুরে গলায় বলল,
-“মোনা কেমন আছিস মা?”
আমি কোন কথা না বলে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি।মায়ের মুখে বিষাদের ছায়া।আমার বুকে চিনচিনে সূক্ষ্ম ব্যথার সৃষ্টি হলো। কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে ব্যথাতুর গলায় বললাম,
-“বাবা তোমায় আবারো মেরেছে?”
মা ক্ষীণ নিঃশ্বাস ফেলল হতাশ ভঙ্গিতে।মায়ের কাছে স্বাভাবিক বিষয়, প্রতিনিয়ত নিয়ম করে হয়ে আসছে যেন।মায়ের মুখের অভিব্যক্তির কোন পরিবর্তন হলো না। সহজ গলায় বলল,
-“এসব বাদ দে।” মা যত দ্রুত সম্ভব প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে আবার অস্থির গলায় বলল,
-“তোর বাবা তোকে হোস্টেল খরচ, লেখাপড়ার খরচ সব ঠিক মত দিচ্ছে তো?”
-“দুই মাস ধরে কোন টাকা দিচ্ছে না। ফোনও রিসিভ করেনা।”
মায়ের চেহারায় তীব্র কষ্ট দেখতে পেলাম। অসহায়ত্বের একটা রেখা মায়ের স্পষ্টভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটালো। মায়ের বুক চিঁড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেড়িয়ে এলো। ভীষণ চিন্তিত মুখে বলল,
-“তাহলে এই দুই মাস খরচ চালিয়েছিস কিভাবে মা?”
মা’র যেন কষ্ট তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। এই কষ্টে অভ্যস্ত মানুষ’টা। আমি আর যন্ত্রনা বাড়াতে চাইলাম না।
-“চালিয়েছি ধার করে। ওসব বাদ দেও তো। তোমার চেহেরার কি হাল হয়েছে মা?চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে।”
মা এসব কথা নিপুণতার সাথে উপেক্ষা করে বলল,
-“তোর বাবা আমার ফোন আবার ভেঙে ফেলছে । তোর ছোট খালার সাথে কথা বলেছি বলে।”
-“তোমার ফোন বন্ধ পেয়েই আমি বুঝেছি বাবা তোমার ফোন ভেঙে ফেলেছে।”
-” এইচএসসি এক্সাম এর পর তোকে তোর খালা আমেরিকান স্কলারশীপের জন্য আবেদন করতে বলছে।”
মা কিছুক্ষণ পর উৎসুক গলায় আবার বলল,
-“মোনা শোন, তোর টাকা নিয়ে টেনশন করতে হবেনা। আমি তোর জন্য কিছু টাকা ম্যানেজ করেছি। তুই টাকা নিয়ে কালকে চলে যাস।”
মায়ের সাথে কথা বলে নিজের রুমে চলে আসলাম। ব্যাগটা খাটের উপর রেখে ফ্রেশ হয়ে রুমে আসতেই দেখি নিশান বসে আছে আমার রুমে। আমার ছোট ভাই। আমরা এক ভাই এক বোন।
নিশান আমার কোলে গুটিসুটি মেরে বসে রইলো। অনেক রাত হলো, নিশান আমার কোলে ওভাবেই বসে রইলো।মা আমাদের দুই ভাইবোন কে খেতে ডাকলো। আমার খেতে ইচ্ছে হলো না। মায়ের জোরাজুরি তে খেলাম। খাওয়া শেষে মা আমার হাতে কয়েক হাজার টাকা ধরিয়ে দিলো। গুনে দেখলাম পঞ্চাশ হাজার টাকা। আমি বিস্মিত চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-“এত টাকা কোথায় পেলে?”
-“তোর এত কিছু জানতে হবে। পরীক্ষা অবধি সব খরচ চালিয়ে নিস। তারপর স্কলারশীপের জন্য চেষ্টা করবি।”
আমি মুহূর্তে’ই চিন্তিত হয়ে গেলাম।আমার জানতে হবে কোথায় পেয়েছে টাকা। জোর গলায় বললাম,
-“না বলো। নয়ত আমি টাকা নিবো না, লেখাপড়ার দরকার নেই।”
লেখাপড়ার দরকার নেই কথা’টা শুনে মা আমার দিকে রোষারক্ত নয়নে তাকালো। চোখ-মুখে উপচে পড়ছে রাগ।রাগ সংযত করে বলল,
-“গহনা যা ছিলো বিক্রি করে দিয়েছে। তোর লেখাপড়া আগে।
মায়ের কথা গুলোর মাঝে কি ছিলো জানিনা।আমার চোখ আবারো ভিজে যাচ্ছে। উত্তর দিতে পারলাম না। মা পুনরায় গাঢ় গলায় বলল,
-“তোর কিন্তু স্কলারশীপ’টা পেতে হবে মোনা।”
-“আমি স্কলারশীপ পেয়ে দেশের বাইরে চলে যাবো আর তুমি আর নিশান এই নরকে পড়ে থাকবে? যে মানুষটা আমাদের নরকের চেয়ে বেশি যন্ত্রনা দেয় সেই মানুষটার জন্য কিসের এত মায়া?”
মা আমার কথার কোন উত্তর দিলো না। নিশান আমার সাথে আমার রুমে ঘুমালো। মধ্যরাতে হঠাৎ বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মায়ের রুম থেকে শব্দ আসছে। বাবা খুব বিশ্রী ভাষায় মা’কে গালি দিচ্ছে। মা’কে যে মারছে তাও বুঝতে পারলাম। মা আমাকে সব সময় বলে তোর বাবা যখন আমায় মারবে তখন তোরা দুই ভাইবোন আমার রুমের ধারেকাছেও আসবি না। নিশান তো কিছু বলতে পারেনা। শুধু তাকিয়ে থাকে আর কাঁদে।
আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে ধীরে ধীরে মায়ের রুমের দিকে গেলাম। জানালার ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। বাবা হঠাৎ মায়ের পেটের উপর লাথি মারে। মা ফ্লোরে পরে যায়। মায়ের চোখ উল্টিয়ে যায়, মায়ের মুখ থেকে গোঙানির মত আওয়াজ হয়। আমি দৌড়ে মায়ের রুমে গেলাম। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকি। মায়ের চোখে মুখে পানি ছিটাই। বাবা নির্লিপ্ত ভাবে বসে রইলো,তার কোন ভাবান্তর নেই। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“কিছু হয়নি ঢং করে।”
বাবার কথা জড়িয়ে আসছিলো। নেশা করেছে। মা নিঃশ্বাস নিচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর বুঝতে পারলাম মা আর বেঁচে নেই। আমার পৃথিবী থমকে গেলো। বাবা আমার মুখ চেপে ধরে বলল,
-“একদম কাঁদবি না। সবাই কে বলবি তোর মা অসুখে মরছে। একথা যদি কাউকে বলিস তোদের দুই ভাই বোন কে মারতে দুই বার ভাববো না।”
এই টুকু লিখে ডায়েরীটা বন্ধ করে রাখলো মোনা। এসব লিখতে গিলে বুকের ভিতরটা ভারী হয়ে যায়, অসহ্য যন্ত্রণা হয়।
মোনা ডায়েরীটা যত্ন করে ব্যাগের ভিতর রেখে দিলো। প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র ব্যাগে ভরলো। কাপড়-চোপড় গুছিয়ে নিলো। নিজে রেডী হয়ে, নিশান কে ও রেডী করিয়ে দিলো। মোনা আমেরিকান স্কলারশীপটা পেয়ে গেছে,যেটা ওর মায়ের স্বপ্ন ছিলো। আজ আমেরিকা যাচ্ছে। আমেরিকা মোনার খালা থাকে। নিশান কেও নিয়ে যাচ্ছে।
ব্যাগ গুছিয়ে রওয়ানা হতেই মোনা দেখলো বাসায় পুলিশ এসেছে। পুলিশের ভিতর থেকে একজন মোনা কে বলল,
-“আপনি মোনালিসা? আপনার বাবা ইমরুল চৌধুরী কাল খুন হয়েছে?”
মোনার চোখে মুখে শোকের ছায়া। আহত গলায় বলল,
-“হ্যাঁ।”
-“আমাদের কিছু ইনফরমেশন দরকার।”
মোনা কেবল আস্তে করে বলল,
-“বলুন।”
-“আপনার ফুফু, আপনার দাদা-দাদী থানায় গিয়েছে। তাঁরা আপনার বাবার খুনি যে করেই হোক বের করতে চাচ্ছেন।”
মোনা চমকালো।দাদা-দাদীর কথা শুনে তীব্র বিরক্ত হলো।ভারি গলায় বলল,
– “আপনাদের কি ইনফরমেশন দরকার আমায় বলুন? আমার লেইট হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ টায় আমার ফ্লাইট।”
বিস্মিত হয়ে পুলিশ অফিসার মোনার দিকে তাকিয়ে বলল,
-“ফ্লাইট মানে?কোথায় যাচ্ছেন আপনি?কাল আপনার বাবা খুন হলো , সে ব্যাপারে আপনার কোন মাথাব্যথা নেই! আপনার ফ্লাইট পাঁচ টায়!”
মোনা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। তৎক্ষণাৎ উত্তর করলো না। কয়েক মুহূর্ত পর শোকার্ত গলায় বলল,
-“বাংলাদেশে আমার কেউ নেই।‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌ পৃথিবী’তে আত্মীয় বলতে শুধু আমার একজন খালা আছে আমেরিকায় থাকে।এছাড়া শুধু আমার ছোট ভাই আছে,কথা বলতে পারে না। ভাই’কে নিয়ে একা থাকা সমস্ত না। আমাদের একমাত্র আশ্রয়স্থল আমার খালা।”
পুলিশ অফিসারের কপালে ভাঁজ পরলো। মনে হলো কোন ধাঁধায় পড়লো। প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো।
-“আপনার সব আত্মীয় স্বজনরা থানায় গিয়েছে আর আপনি বলছেন কেউ নেই?”
-“আমি আমার জন্মের পর কোন আত্মীয় স্বজন দেখিনি। এরও কারণ আছে। আত্মীয় স্বজন নেই বললে ভুল হবে আত্মীয় স্বজন আছে কিন্তু কাউকে আমি চিনি না বলতে পারেন কারো সাথে আমার বা আমাদের কোন‌ পরিচয় নেই।”
মোনা পুলিশের একটার পর একটা কথার জবাব দিয়ে যাচ্ছে। নিশান মোনার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে নিঃসাড় দৃষ্টিতে।
পুলিশ অফিসার মুহুর্তেই আগ্রহী হয়ে উঠলো। তীব্র আগ্রহী গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কেন পরিচয় নেই?”
-“আমার বাবা-মা প্রেম করে বিয়ে করেছে। তাই কেউ মেনে নেয়নি। আমার দাদার পরিবার আমার বাবাকে ত্যাজ্য পুত্র করেছে।কারো সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক ছিলো না। তারা বাবার মৃত্যুর পর খুনি খুঁজতে এসেছে অদ্ভুত না?”
(চলবে)

মোনালিসা
লেখা- ইসরাত জাহান তানজিলা
পর্ব-২
পুলিশি সব ঝামেলা মিটিয়ে মোনা নিশান কে নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হলো। ফ্লাইট পাঁচটায়। নতুন‌ কিছু মুখের সাথে পরিচিত হয়েছে মোনা । তাঁদের সাথে কথা বলার বিন্দুমাত্র আগ্রহ পেলো না। মোনার এমন অনাগ্রহ মিশ্রিত আচরণ তাঁদের কিছুটা বিচলিত করলো। যাদের জন্মের পর থেকে কখনো দেখেনি, চিনে না, জানে না, বাবার মৃত্যুর পর তাঁদের সহানুভূতি প্রত্যাশা করা’টা মূঢ়তা।মোনা আর নিশানের প্রতি আন্তরিকতা দেখিয়ে মোনার দাদা বলেছে মোনা আর নিশান কে তাঁদের কাছে বাংলাদেশে থাকতে। এমন আন্তরিকতায় মোনা সহানুভূতি খুঁজে পায়না বরংচ বিরক্ত হয় মনে মনে।
মোনা তাঁদের কাছে থাকতে চাচ্ছে না, না থাকতে চাওয়া পুলিশের চোখেও অস্বাভাবিক কিছু মনে হলো না। আর মোনার খালা ছাড়া যেহেতু আর কেউ নেই , এমন পরিস্থিতিতে মোনার খালার কাছে আমেরিকা চলে যাওয়া’টাও স্বাভাবিক। মোনা সবেমাত্র এইচএসসির গন্ডি পেরুনো একটা মেয়ে। বোবা ভাইকে নিয়ে তো কোন আশ্রয় ছাড়া থাকা সম্ভব না। তাই মোনার আমেরিকা চলে যাওয়া নিয়েও পুলিশের কোন খটকা লাগলো না। মোনার আচরণে যদিও বাবা মৃত্যুর শোকের কোন রেশ নেই তেমন,তবুও মোনার প্রতি খুন নিয়ে সন্দেহ করার কোন মানে খুঁজে পেলো না।
মোনা এয়ারপোর্টে পৌঁছালো। এখন মার্চ মাস। শীতের তীব্রতা যদিও কমে এসেছে তবুও বিকালের দিকে হালকা শীত লাগে। মোনা ব্যাগ খুলে গাঢ় বেগুনি রঙের একটা চাদর বের করলো। মোনার মায়ের চাদর এটা,ওর মায়ের খুব পছন্দের চাদর। মোনা এসএসসি পরীক্ষার পর যখন কলেজে ভর্তি হয়ে হোস্টেলের উদ্দেশ্য বাসা ছাড়ল তখন মোনার মা এই চাদরটা মোনা কে দিয়েছিল। চাদর টা মোনা নাকের কাছে নিয়ে ঘ্রান নিলো। ওর মায়ের শরীরের পরিচিত সেই ঘ্রানটা এখনো এই চাদরে যেন মিশে আছে। নিশানের শরীরে চাদরটা জড়িয়ে দিলো মোনা। মোনার মনে মনে আফসোস হলো, নিশান কেন আর পাঁচটা মানুষের মত স্বাভাবিক হলো না? নিশানের দিকে তাকালে মোনার অসহায়ত্ব যেন বৃদ্ধি পায়।
কিছুক্ষণ পর প্লেন উড়তে শুরু করলো। প্লেনে উঠে নিশান ভয়ে চুপসে গেলো। এর আগে কখনো প্লেনে উঠেনি নিশান। প্লেন জিনিস’টা নিশানের কাছে একদম নতুন কিছু।
আমেরিকা পৌঁছে প্লেন থেকে নেমে মোনা চারদিকে খুঁজতে লাগলো ওর খালা কে। মোনার হঠাৎ নিজেকে খুব নির্বোধ মনে হলো। মোনা তো কখনো ওর খালা’কে দেখেনি, যে মানুষটা’কে কখনো দেখেনি সে মানুষটা কে কিভাবে খুঁজে বের করবে? খালার সাথে মোনার শুধু ফোনে কথা হয়েছে। অনন্ত একটা ছবি দেখা উচিত ছিলো। নিশান মোনার হাত ধরে এদিক ওদিক হাঁটছে। মোনা খুব ভয়াতুর হয়ে গেলো। খালাকে যদি খুঁজে না পায় তাহলে কি হবে? যে মানুষটা কে কখনো দেখেনি সে মানুষটা কে খুঁজে কিভাবে বের করবে? ওর খালাও তো ওঁদের দেখেনি,তাহলে খালাও বা কিভাবে খুঁজে বের করবে ওঁদের?মোনা নির্বুদ্ধি হয়ে গেলো। একবারের জন্যও এই কথা’টা মাথায় আসেনি! কঠিন গোলকধাঁধায় পড়ে গেলো মোনা। মোনার মুখ দুশ্চিন্তায় পাণ্ডুবর্ণ হয়ে যায়।এক ঘন্টার মত হয়ে গেলো মোনা নিশান কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে উদ্বিগ্ন, উদগ্রীব চিত্তে। হাজার শঙ্কা মোনার চিন্তিত মনে উঁকি দিচ্ছে।
খানিক বাদে একটু তফাতে মোনা এক ভদ্র মহিলা’কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।মোনা কিছুক্ষণের জন্য বিগড়ে যায়। শ্যেন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।মোনার দৃষ্টি কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায়। প্রচণ্ড বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় যেন।
মোনা মন্থর গতিতে সেখানে এগিয়ে যায়। ভদ্রমহিলা দেখতে হুবহু মোনার মায়ের মত। মোনার হৃদস্পন্দন দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। নিজের দৃষ্টি’কে বিশ্বাস করতে পারছে না।মোনা কিছু মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বিমগ্ন আর নির্বাক হয়ে। খানিক বাদে মোনার মস্তিষ্ক সায় দেয় এটা ওঁর খালা লিলি বেগম ব্যতিত অন্য কেউ না। মোনা নিঃশব্দে ভদ্র মহিলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কি বলে কথা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। হতবাক হয়ে গেছে যেন মোনা। সংকোচ,জড়িমা কাটিয়ে মোনা ইতস্তত বোধ করে বলল,
-“আমি মোনালিসা। বাংলাদেশ থেকে এসেছি।”
এই টুকু বলে অজ্ঞাত এক শঙ্কা নিয়ে উত্তরের অপেক্ষায় থাকে মোনা।ভদ্রমহিলা মোনা আর নিশান’কে দেখে চমকালো। তাঁর অপেক্ষার অবসান ঘটলো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে মোনা আর নিশান’কে জড়িয়ে ধরলো। মোনার চোখ জুড়ে বিস্ময়ের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। মোনার কখনো বুঝতে পারেনি লিলি বেগম দেখতে ওর মায়ের মত হবে।
লিলি বেগম জড়িয়ে ধরায় মোনার কেন যেন লজ্জা লাগছে। কথা বলতে অস্বস্তি লাগছে। লিলি বেগম হৃষ্টচিত্তে বলল,
-“তোদের দুইজনকে দেখে আমার কি যে খুশি লাগছে।”
লিলি বেগম নিশানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় আদুরে ভঙ্গিতে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আসে। উদগ্রীব হয়ে বলল,
-“তোদের কে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বাসায় চল তারপর কথা হবে।”
মোনার তখনো অস্বস্তি লাগছে।সহজ ভাবে কথা বলতে পারছে না। নিশান হাঁ করে তাকিয়ে রইল লিলি বেগমের দিকে। মোনা অস্বস্তি বোধ কিছু’টা দমিয়ে বলল,
-“খালা তুমি দেখতে একদম মায়ের মত।”
লিলি বেগম ম্লান হেসে বলল,
-“আমায় দেখে অবাক হয়েছিস?”
প্রত্যত্তুরে মোনাও একটু হাসলো। লিলি বেগমের দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে । লিলি বেগমের চেহারা ওর মায়ের মত হলেও লিলি বেগম এখনো খুব সুন্দর। চেহেরায় বয়সের ছাপ নেই কোন। প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বাসিত মহিলাটি কে এখনো মোনার কাছে যুবতী মনে হচ্ছে যেন।মোনা কে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে লিলি বেগম বলল,
-“কি দেখছিস?তোর মায়ের মত দেখতে তাই এভাবে তাকিয়ে আছিস?”
লিলি বেগম একটু থেমে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“তোর মা আর আমার চেহেরার গঠন এক হলেও তোর মা আমার থেকে বেশি সুন্দরী ছিলো। চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য ছিলো ওর। আমার কাছে অনেক বাঁধানো ছবি আছে , ছবির এলবাম আছে তোকে দেখাবো নে।”
মোনার মায়ের ছোট বেলার ছবি! মোনা কৌতূহল বোধ করলো। খুব সন্তপর্ণে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মোনার কখনো লাবণ্যময়ী মা’কে দেখেনি।দেখেছে চোখের নিচে গাঢ় করে দেওয়া কাজলের ন্যায় কালি পড়া, গায়ে মাইরের দাগ, মুখে বিষাদের ছায়া।
লিলি বেগমের চেহারা ওর মায়ের মত বলে চিনতে পেরেছে, যদি ওর মায়ের চেহেরার সাথে মিল না থাকত তাহলে কি হত? এই অচেনা দেশে কোথায় যেত নিশান কে নিয়ে?ভাবতেই মোনা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে যায়। লিলি বেগম গাড়ি ড্রাইভ করছে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। আমেরিকার রাস্তায়।বাংলাদেশের মত যানজট নেই।
লিলি বেগম মোনার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বলল,
-“আচ্ছা আমার চেহেরা যদি তোদের মায়ের মত না হত তাহলে আমাকে খুঁজে বের করতি কিভাবে? আর আমিও কি নির্বোধের মতো কাজ করলাম। অন্তত তোদের একটা ছবি দেখা উচিত ছিলো।”
মোনা অবাক হয়ে গেল। এই কথাটাই মোনা মাত্র মনে মনে ভেবেছিল। লিলি বেগমও একই কথা জিজ্ঞেস করল। লিলি বেগমের করা প্রশ্নের উত্তরে মোনা একটু হাসলো ।
বাসায় পৌঁছে মোনা দেখে সোফায় বসে এক ভদ্রলোক কফির কাপে চুমুক দিচ্ছে। মোনা বুঝতে পারলো লোকটা ওঁদের খালু। ভদ্রলোক বিরক্ত চোখে মোনা আর নিশানের দিকে তাকালো। আশ্চর্য ব্যাপার ভদ্রলোকের সাথে ওর ওঁদের পরিচয় করিয়ে দিলো না।মোনার খালা লিলি বেগম ওঁদের একটা রুম দেখিয়ে দিয়ে বলল,
-“এই রুমে তোমরা দুই ভাইবোন থাকবে। তোমরা অনেক ক্লান্ত। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেও।”
মোনা জিজ্ঞেস করল,
-“খালু কোথায় খালা?”
-“সোফায় বসা একজন ভদ্রলোক কে দেখেছ? উনি তোমাদের খালু।”
মোনা আর নিশান রুমে গিয়ে ওঁদের ব্যাগ গুছিয়ে রেখে খাটে বসে। মোনার বার বার কেন জানি মনে হচ্ছে ওঁরা এখানে আসাতে খালু মোটেও খুশি নন। মোনার মন বিষণ্ন হয়ে গেলো।মোনা শুনেছে ওঁর খালার দুই ছেলে আছে। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, আর ছোট ছেলে মোনার এক বছরের ছোট। ওঁদের কাউকে তো দেখলো না।মোনা চিন্তা ভাবনা বাদ দিয়ে নিশান কে গোসল করিয়ে, নিজে গোসল করে নিলো। কয়েকদিন বাদে মোনার ভার্সিটি। নতুন জায়গা, নতুন পরিবেশ সব মিলিয়ে কেমন যেন অস্থির লাগছে মোনার।

মোনা ওর খালাকে দেখে খুব বেশী বিস্মিত হয়।চোখে-মুখে এখনো বিস্ময়ের ছাপ লেগে আছে যেন। মোনার খালা দেখতে একদম মোনার মায়ের মত। অথচ এ কথাটা মোনা এতদিন জানত না!
নিশান মোনার গা ঘেঁষে বসে আছে। মোনা নিশানের চুলে হাত বুলাচ্ছে আর নানান রকম চিন্তা ভাবনা করছে।ডাইনিং রুম থেকে চিকন গলায় মোনালিসা, মোনালিসা বলে ডাক আসলো। মোনা নিশান কে নিয়ে সেদিকে পা বাড়ালো।‌ মোনার খুব বেশী অস্বস্তি লাগছে এ বাসায়।মোনা দেখলো টেবিলে ওর খালা, খালু আর দুইটা ছেলে বসা। মোনা বুঝতে পারলো ছেলে দুইটা ওর খালাতো ভাই।
বড় ছেলেটা ব্লাক কালারের টি-শার্ট, কালো একটা থ্রী কোয়ার্টার প্যান্ট, হাতে চমৎকার একটা কালো ঘড়ি পড়া। গায়ের রং ধবধবে সাদা হওয়ার কারনে ব্লাক টি-শার্টে অদ্ভুত রকমের সুন্দর লাগছে ছেলেটা’কে। আর ছোট ছেলেটার গায়ের রং একটু চাপা।
মোনা’কে দেখে ব্লাক টি-শার্ট পরিহিত ছেলেটা চেয়ার ছেড়ে এগিয়ে এসে মোনা কে জড়িয়ে ধরলো। ইংরেজি তে বলল,
-“হায় মোনা! রিয়েলি ইউ আর লাভলি!”
মোনা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নিজেকে যত দ্রুত সম্ভব ছাড়িয়ে নিয়ে দূরে সরে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। লিলি বেগম এসে বলল,
-“মোনা ওঁরা তোমার খালাত ভাই। আমার বড় ছেলের নাম ইফতিয়াদ প্রিয়ম আর ছোট ছেলে ইফতিয়াজ এরিক।”
লিলি বেগম প্রিয়ম কে চোখের ইশারায় আড়ালে ডেকে নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“বাঙালি কালচারে বড় হওয়া মেয়ে। এভাবে জড়িয়ে ধরা ওঁদের কাছে খুব বেমানান।”
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here