মেঘে ঢাকা জোৎস্না
পর্ব -২
উনি আমার ডিপার্টমেন্টের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আর আমার ১ম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। কিন্তু উনি উনার ক্লাস ছেড়ে আমার ক্লাসের আশে পাশে থাকতে শুরু করলেন। পরীক্ষা শেষে রোজ জিজ্ঞেস করেন, কেমন হলো পরীক্ষা। পাশে পাশে হেটে হস্টেল পর্যন্ত আসেন।
পরীক্ষা শেষে বাড়ি চলে এলাম, কিছুদিনের জন্যে। কয়েকদিন পর সকাল ১১ টার দিকে আরশী আমার বাসায়, সাথে রাজিব ভাই আর অপু। আরশীর নাকি আমার কথা খুব মনে পড়ছিল, দেখতে খুব ইচ্ছে করছিল তাই চলে এসেছে। মা বাবার সাথে ওদের পরিচয় করে দিলাম। সারাদিন থেকে সন্ধ্যার দিকে ওরা শহরের জন্যে রওনা হলো।
দিনটা আমার খুব মনে আছে। আরশী, রাজিব ভাই বার বার কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। যদিও আমি তা বুঝতে পেরেছিলাম, যে ইচ্ছেটা আসলে অপুর ছিল।
ছুটি শেষে ইউনিভার্সিটি এসে আরশী কে বলেছিলাম, যে আমার ভাই খুব ছোট। বাবার পাশে শক্ত হাতে দাঁড়ানোর মতো আমি বর্তমানে। ছোট বোনটাও ক্লাস টেনে পড়ে। জীবনে ভালো কিছু করবার প্রচন্ড ইচ্ছে আমার। গ্রামে পড়া শোনা করার সময় চেয়ারম্যানের ছেলে খুব বিরক্ত করতো। না পেরে খালার বাসায় থেকে পড়াশোনা করেছি। তারপরও পড়েছি। ভালো রেজাল্ট করেছি, অবশ্যই তা প্রেম করবার জন্যে নয়!
আরশী কি বুঝলো বা অপুকে কি বলেছিল জানিনা। অপু সব সময় আমার আশে পাশে থাকলেও আমাকে বিরক্ত করতো না। বরং আমাকে কেউ বিরক্ত করলে, তাকে মানা করত। আমার দিত্বীয় বর্ষ শেষ হলে অপুর অনার্স শেষ হয়ে গেলো। সে সময় প্রথমবার অপু নিজে মুখে আমাকে ভালোবাসার কথা বলেছিল। মুহূর্তটা অদ্ভুত সুন্দর ছিল। শেষ দুপুরের মিষ্টি রোদের মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি। ডিপার্টমেন্টের সামনে একটা গাছের নিচে আমরা দাড়িয়ে ছিলাম বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে। অপু যে অনেক সময় ধরে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল, খুব বুঝতে পারছিলাম। মেয়েরা এই ব্যাপার গুলো কেমন করে যেন বুঝতে পারে।
ধির পায়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এমন অসংখ্য বর্ষনে তোমার হাতে হাত রেখে ভেজার বড় স্বপ্ন আমার। তুমিকি আমার জীবনের বাকি সকল বর্ষনে সঙ্গ দেবে?
আমি কিছু বলিনি, বলার কোন ভাষা আমার ছিল না। কারন ভালবাসার উপলব্ধি আমার মাঝে জাগার কোন অবকাশ ছিল না। গ্রামে বাবা একা, চাচারা সব সময় সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা করে। ছোট বোনটা বড় হচ্ছে, তাকে নিয়ে চিন্তা হয়। বাবার শরীর বিশেষ ভালো নেই। ছোট ভাইটা কবে বড় হবে। মায়ের বুকে ব্যাথা, ডাক্তার দেখাতে হবে। কত শত চিন্তা আমার সংসার ঘিরে। সেখানে প্রেম ভালোবাসার যায়গা কোথায়?
তবে অপুর ধৈর্য্য দেখে মাঝে মাঝে অবাক হতাম। অন্য কোন মেয়ের সাথে এভাবে তাকে দেখিনি। শুনিও নি কারো মুখে। সবাই অকপটে বলতো, অপু ভাই তোকে খুব ভালোবাসে।
বাবা মা শহরে ডাক্তার দেখাতে আসলে, আমি আরশী কে বলতাম সাথে যেতে। কি আশ্চর্য সাথে অপুও যেতো। ডাক্তারের সিরিয়াল, টেস্ট করানো সব কিছুতেই সাহায্য করতো। রাজিব ভাইয়ের বন্ধু, সে কারনে বাবা মাও বেশ ভালোবাসতো অপুকে।
দিন গুলো কেমন করে যেন চলে যাচ্ছিল খুব দ্রুত। রাজিব ভাই আর অপুর মাস্টার্স শেষ হয়ে গেলো। রাজিব ভাই পড়া শেষ হবার সাথে সাথে চাকরি পেয়ে গেলো। আর অপু তার বাবার ব্যবসায় বসলো। যেহেতু অপু এই শহরের ছেলে, সে শহরেই রয়ে গেলো। রয়ে গেলো ইউনিভার্সিটিতে তার আনা গোনা।
আমি যখন শেষ বর্ষে, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করলেন। আমি আরশীর সাথে গল্পে গল্পে বলে ফেলেছিলাম। ব্যাস কোথা থেকে অপু এসে পাগলের মতো উদ্ভট সব কান্ড করতে শুরু করলো। প্রথমে আমাকে বার বার করে একে ওকে দিয়ে ডেকে হোস্টেলের বাহিরে নিয়ে আসলো। তারপর কখনও সুন্দর করে বোঝালো, আবার রেগেও গেলো। চিৎকার করছে, কি করছে সে হয়ত নিজেও জানে না।
অপুকে যে আমার পছন্দ নয় তা আসলে না। সে দেখতে সুন্দর খুব সুন্দর, স্মার্ট ভদ্র একটা ছেলে। পড়াশোনায় বেশ ভালো। ক্যাম্পাসে তাকে ভালো বলেই সবাই চেনে। একটা মেয়ে যেমনটা চায় ঠিক সব গুন গুলোই অপুর আছে।
আমার সমস্যা গুলো আরশীর মাধ্যমে অপু জানে, আমি সেদিনই প্রথম জানতে পারলাম। অপু আমার বাবা মায়ের সব দায়িত্বই নিবে, এমন আরও বহু কথা সে বলেই যাচ্ছে।
আমার বুকের মাঝে যে পাহাড় সম আবেগ জমা হয়ে আছে তা হয়ত আমি নিজেও কখনও বুঝতে পারিনি। একটা পর্যায়ে অপুর ভালোবাসার কাছে হার মানতে বাধ্য হই। তবে শর্ত দিয়েছিলাম যে আমি চাকরি করবো, আর আমার টাকার হিসেব অপু কোন দিন নিতে পারবে না। অপু তাতেও রাজি। আমি মাস্টার্স শেষ করবো, তারপর বিয়ের কথা বলতে পারবে। অপুর তাতেও সই।
এরপরের দিন গুলো ছিল স্বপ্নের মতো সুন্দর এবং রঙ্গিন। অপুর বাবা আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিলে আমার বাবা রাজি হয়ে গেলেন। আমাদের বিয়ে ঠিক হয়ে রইল। আমার মাস্টার্স শেষ হলেই বিয়ে। অপু যেনো পুরো পৃথিবী ওর হাতে পেয়ে গেছিলো।
আমায় অপু ডাকতে “শখের বৌ” বলে। পুরো ক্যাম্পাস জানতো আমি অপুর “শখের বৌ”। বাকি দিন গুলো যেন চোখের সামনে ভেসে উঠলে, পৃথিবীতে আমি স্বর্গ দেখতে পাই। অপুর বাইকে করে ছুটে বেড়াতাম। ক্লাসের পরে বাকি সময়টা ঘুরে বেড়াতাম, আড্ডা দিতাম গল্প করতাম। আর দুজনে কল্পনায় সংসার সাজাতাম।
এর মাঝে বিসিএস এর জন্যে প্রিপ্রারেশন শুরু করে দিলাম আমি। আমার স্বপ্ন যে নিজের পায়ে শক্ত করে দাঁড়ানো। এ আমার আজীবনের লালায়িত স্বপ্ন। বুদ্ধি পড়ে থেকেই আমার সংসারে বন্দী জীবন ভালো লাগতো না। আমি চাইতাম স্বাধীন জীবন। কল্পনাতেও তাই ছিল আমার। শাড়ি পরবো, চোখে চশমা পরে অফিসে যাবো। পুতুল খেলার সময়ও আমি এমনটাই সাজতাম।
কিন্তু ধীরে ধীরে আমি যেন আমার স্বপ্ন থেকে সরে যাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে অপুকে বলতে ইচ্ছে হতো যে বিসিএস পরীক্ষার পর বিয়ে করবো, কিন্তু ওর ভালবাসার কাছে হার মেনে যেতাম। তাই সে কথা আর বলা হয়নি।
কেমন করে দিন গড়িয়ে যেতে লাগলো। চোখের সামনে স্বপ্নের মতো সব কিছু ঘটে যেতে লাগলো যা আমার চেতনায় থাকলেও অনুভুতি তে অসাড প্রায়।
মাস্টার্স শেষ হলো! বিয়ের দিন তারিখ হলো, দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে আসলো। আত্বীয় স্বজন বাড়ি ভরে গেলো। বিয়ের দিন আমার কেমন যেন একটা অনুভূতি ছিল তা কাইকে বোঝাতে পারবো না। অপুকে স্বামী হিসেবে পাবার আনন্দ আবার নিজের জীবন নিয়ে যে স্বপ্ন দেখেছি তার প্রায় অবসান হওয়ার আশঙ্কা! সব মিলিয়ে কেমন যেনো দমবন্ধ করা অনুভূতি।
বিয়ের দিন শশুর বাড়িতে প্রথম যখন আসলাম, আমার শাশুড়ী আমায় বরন করার সময় মুখটা আলতো ধরে বলছিলেন, ছেলের আমার পছন্দ আছে! অপুর শখের বৌ যে আমার ঘর আলো করে দেবে! আমার রাঙ্গা বৌকে ঘরে তোল তোরা। পুরো বাড়ি যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। অপুরা দুই ভাই। ছোট ভাই ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
অপুর ঘরে যখন প্রথম পা রাখলাম, পা পড়লো ফুলের পাপড়ির ওপর! অপুর ছোট ভাই নিলয় বললো, ভাই বলেছে তার শখের বৌয়ের পা যেন মাটিতে না পড়ে। তাই ফুল ছিটানো ঘরে। নিখুঁত পরিপাটি পুরো ঘর, যেনো কল্পনার অতীত। সবচেয়ে বেশি ভালো লেগেছিল বেলকুনিটা। পুরো বেলকনিতে টকটকে লাল গোলাপ ফুল ফুটে ছিল। আর তখনও এই দোলনাটা ছিল। কি আশ্চর্য! সেদিনও এমনই চাঁদনী রাত ছিল। রাত গভীরে অপু আমায় বেলকনিতে ওর বাগান দেখাতে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, এ বাগান তার খুব প্রিয়। শখের বাগানে শখের বৌ, সাথে এমন চাঁদনী রাত। জীবনে সেদিন অপুর নাকি চাইবার আর কিছু ছিল না। মৃত্যূ এলেও নাকি সে হাসি মুখে মরতে পারবে, এতোটা পূর্নতাই পরিপূর্ন ছিল সেদিন অপু।
বিয়ের পর আমার শাশুড়ী আমায় শখের বৌ বলে ডাকতেন। আসতে আসতে সে নাম হলো “শখ”। কিন্তু শশুর আমার নাম ধরেই ডাকতেন। বলতেন তোমার নামেই তুমি সুন্দর হেমন্তি মা। হ্যা আমার নাম হেমন্তি রহমান, আমার বাবার নাম সাহেদ রহমান। উনার বড় আদরের মেয়ে আমি। উনি আমাকে হৈমন্তি বলে ডাকেন। ছোট বোন বলে হিমু। মা আজীবন হেমন্তি বলেই ডাকেন। বাবা খুব শখ করে নাম রেখেছিলেন হেমন্তি। তবে পরে শুধু শখ টুকু ছিল, নামটাই বাদ হয়ে গেছিল। তবে কেন যেন তাতে কখনও দু:খ হয়নি আমার।
কিন্তু………………..
এরপর জীবন যেন মধুচন্দ্রিমা। এমনটাই মনে হতে লাগলো। অপুর ভালোবাসায় আমি ভেসে গেছিলাম কূলহীন সাগরে। পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম আমি অপুর উপর। বিয়ের পর দুজনে একসাথে বিসিএস পরীক্ষা দিলাম। আমার একার পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু অপুও ফরমফিলাপ করলো। তাই দুজনে একসাথেই পরীক্ষা দিলাম।
বিয়ের পর অপু রোজ বেড়াতে নিয়ে যেতো। মন চাইলে বাইক নিয়ে রাতেই বের হয়ে যেতো। শপিং করতে প্রায়ই। আমার প্রতিটা জিনিস অপু নিজ হাতে কিনত। ত্রিপিস কিনুক বা শাড়ি, ম্যাচিং ব্যাগ, স্যান্ডেল, নেইলপলিশ, চুড়ি আরও যে কতো কি কিনতো। আমি মানা করলেও শুনতো না। মানা করলে বলতো, তুমি অপুর বৌ। অনেক শখের……..।
আমিও অপুর কথায় বিমোহিত হয়ে দিনে দিনে আরও বেশি ভালোবেসে ফেলেছি অপুকে। শাশুড়ী মায়ের স্বপ্ন যেনো আমি একটা বাবু নেই। কিন্তু আমার স্বপ্ন যে অন্য। অপু অবশ্য বলেছিল, তোমার একটা চাকরি হলে তোমার শখ পূরন হবে। তখন তুমি মায়ের শখটা পূরন করো।