#মেঘের_পালক
পর্ব- ৭

এতদিন পর্যন্ত প্লাবন জানত সে নিঃসন্দেহে জিনিয়াসদের পর্যায়ে পড়ে৷ স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটিতে কম শোনেনি প্রশংসা। গণিতে তার মগজ সত্যিই প্রখরতার সাথে চলে। সেই সাথে দুর্দান্ত ক্রিকেট খেলে সে। বাড়ি থেকে পছন্দ করে না বলে ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে নেয়া শেষ পর্যন্ত হয়নি। আর দিনশেষে কবিতা আবৃত্তি। কবিতা আবৃত্তি করে এই পর্যন্ত সে অজস্র পুরষ্কার পেয়েছে। স্কুলে বা কলেজের প্রতি বছর সংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতার জন্য প্রথম পুরষ্কারটা তার নামেই লেখা থাকত।

কিন্তু এতকিছু হয়েও লাভ হলো না। প্রেমে পড়ে প্রথমবার সে যেটা আবিষ্কার করল সেটা হলো সে কিছু ক্ষেত্রে যথেষ্ট বোকা। এবার এই বোকাটা প্রেমে পড়েই হয়েছে কি না তা ঠিক বলা যায় না।

আজ দু’দিন হলো অরিন তার সাথে কথা বলছে না। এই দু’দিনে সে একটা কাজও ঠিকমতো করতে পারেনি। শুধু মোবাইল নিয়ে বসে থেকেছে।

প্লাবন একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায়। ছাত্রদের উপদেশ দিতে থাকে, “জীবনের অনেক বড় বড় উদ্দেশ্য আছে, যদি তোমরা প্রেমিক বা প্রেমিকা নামক মরিচিকার পেছনে সময় নষ্ট করতে থাকো, তাহলে হাতছানি দিয়ে ডাকতে থাকা একটা সুন্দর জীবন তোমাকে পেছনে ফেলে চলে যাবে৷ জীবনের প্রতিটা মুহূর্তকে কাজে লাগানো উচিত।”

নিজের বক্তৃতা নিজের ওপরেই বোঝা হয়ে পড়ল। এদিকে অস্থির লাগছে। অরিন কি আর ফোন ধরবেই না? এত রাগ? যদি আর ফোন না ধরে তাহলে সে কি আগের মতো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে যেতে পারবে না?

সেদিনকার কথাগুলো মনে পড়ে প্লাবনের। পরপর দৃশ্যগুলো ভাসে চোখের সামনে।

অর্নবের বিলাসবহুল পার্টি। সেই পার্টিতে ঢোকার পরপরই কোথা থেকে মেয়েটা ওয়েটারের সাথে ধাক্কা খেয়ে তার গায়ে জুস ফেলে দিল।

প্লাবন সবসময় চেষ্টা করে মাথা ঠান্ডা রাখতে। অপরপক্ষকে দোষ না দিয়ে ঘটনার ভালো দিক খুঁজে বের করতে। সেদিনও তাই করল।

মেয়েটার চেহারায় আহামরি কিছু ছিল না যেটা খুব দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তাই বাকি সময়টাতে মেয়েটার কথা তার মনেও ছিল না। ঝামেলা লাগল কখন?

সেই যে বাজি! কেন যে সেদিন ওসব করেছিল কে জানে! যখন অর্নবের বন্ধু চ্যালেঞ্জ দিয়ে বসল হয় কোনো মেয়েকে প্রপোজ করতে হবে,আর নয়তো ড্রিঙ্ক করতে হবে, তখন তার কাছে আদতেই আর কোনো উপায় ছিল না। বাবাকে সে কথা দিয়েছিল কোনোদিন নেশাদ্রব্য পানবে না। কথা সে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে আপ্রাণ।

ইচ্ছে ছিল কোনো মেয়েকে প্রোপোজ করবে, তারপর তার কাছে মাফ চেয়ে নেবে। কিন্তু তার ইচ্ছেমতো কোনো মেয়েকে বেছে নিলে হবে না৷

অর্নবটা এত বদ! সে সেদিনকার আসা প্রত্যেকটা মেয়ের নাম কাগজে লিখে একটা কাচের বয়ামে ভর্তি করে রেখেছিল। অগত্যা সেখান থেকে একটা বেছে নিতে হলো প্লাবনকে। কাগজটাতে নাম লেখা ছিল অরিনের।

অরিন তখন সেখানে ছিল না। কোথায় যেন গিয়েছিল। ছেলেদের অরিন রব ছড়িয়ে গেল। কোথা থেকে যেন হাজির হলো অরিন। তার মুখে বিষ্ময়। আমার মনে হলো ভালোই হলো। এই মেয়ের সাথে একবার কথা হয়েছে। দ্বিতীয়বার কথা বলতে কম ঝক্কি হবে।

সে যখন অরিনকে প্রপোজ করতে যায় তখন একটু ভয় হচ্ছিল। খুবই অস্বস্তি নিয়ে মেয়েটার সামনে গিয়ে সে হাঁটু মুড়ে বসে বলেছিল সে তাকে ভালোবাসে।

কিন্তু সেই কয়েক মুহূর্তে কী যেন একটা হলো। কী হলো? আবারও ভাবে প্লাবন। অরিনের চোখদুটো ঝিলিক দিয়ে উঠেছিল। হঠাৎ প্রচন্ড আকাঙ্খিত কিছু পেয়ে গেলে বাচ্চাদের চোখ যেমন হয় তেমন। সেই সাথে সেই চোখে প্লাবন প্রথমবার দেখতে পেয়েছিল ভালোবাসা আর সারল্য। যে সারল্য সে খুঁজে বেড়িয়েছে কতকাল!

তারপর মেয়েটা যখন তাকে পাল্টা ভালোবাসে বলে দৌড়ে চলে গেল ভীষণ লজ্জায়, ঠিক সেই মুহূর্ত থেকে প্লাবনের মনের কিছু অংশও চলে গেল মেয়েটার সাথে৷ এমন কখনো হয়নি৷ এবার কেন হলো? এক দেখায় প্রেম? বা এক ঝলকে? বলা যায় না। তবে তীব্র মায়ায় ছেয়ে গেল তার অন্তর। আর তারপর থেকেই সে অরিন ছাড়া আর কিছু ঠিক ভাবতে পারছে না।

সেদিন অর্নবের থেকে নাম্বার নিয়ে যখন কথা বলছিল, মনে হচ্ছিল সে ফিরে গেছে কৈশরের দিনগুলোতে। যখন প্রথম প্রেমের দোলা গায়ে লাগে মাতাল হাওয়ার মতো।

হতে পারে এটা প্রেম, কিংবা শুধুই আকর্ষণ। কিন্তু সে বের হতে পারছে না কেন সেটা থেকে?

***

রাতে পড়তে বসে অরিনের আর ভালো লাগছে না৷ মনে হচ্ছে কী যেন নেই। কেন এমন হচ্ছে? আগে তো কখনো এমন হয়নি!

সে দুম করে কিছু না ভেবেই প্লাবনকে ফোন করে বসল। এবার বোঝাপড়া শেষ হোক। না করে তো কোনোভাবে শান্তি পেল না দুটো দিনে!

প্লাবন খাচ্ছিল৷ অরিনের ফোন পেয়ে খাবার গলায় আটকে যেতে যেতে বেঁচে গেল সে৷ খাবার রেখে এঁটো হাতেই উঠে পড়ল সে। মাকে ইশারায় বলল, জরুরি ফোন।

“হ্যালো।”

প্লাবনের কন্ঠ শুনে অরিন কী বলবে ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ চিন্তার পর বলল, “আপনি কেন আমাকে ফোন করছেন? আরও নাটক বাকি?”

“তুমি আমার সব কথা শুনবে?”

“না। আপনার মতো লোকের কথা আমি শুনি না।”

“আমার মতো লোক মানে?”

“মিথ্যেবাদী, প্রতারক।”

প্লাবনের আর সহ্য হলো না। প্রায় চেঁচিয়ে উঠে বলল, “আমি মিথ্যেবাদী?”

“তা নয়তো কী? সেদিন পার্টিতে মিথ্যে কে বলেছে?”

“কী মিথ্যে বলেছি?”

“এইযে আপনি আমাকে ভালোবাসেন? সব তো ছিল প্ল্যানের অংশ।”

“আচ্ছা! তো তুমি কি ছোটো বাচ্চা নাকি? তখন প্রতিবাদ করতে পারোনি? তখন তো সুড়সুড় করে আই লাভ ইউ টু বলে চলে এলে। কেন বললে?”

“আমার…আমার….” কথা খুঁজে পেল না অরিন।

“বলো? শুনতে চাই। কেন বলেছিলে?”

“জানি না।”

“কথাটা কি সত্যি ছিল?”

“না।”

“মিথ্যে বলেছিলে?”

“বোধহয়।”

প্লাবন এবার শক্ত গলায় বলল, “তুমিও তাহলে মিথ্যেবাদী, প্রতারক।” বলে ফোন কেটে দিল প্লাবন৷

অরিনের চোখ পানিতে ভরে গেল। এভাবে তার সাথে কেউ কখনো কথা বলে না৷ ছেলেটা এতটা খারাপ ব্যবহার করবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি। তার বলা মিথ্যেবাদীর স্বরে ছিল অভিমান। আর প্লাবনের উদ্দেশ্য ছিল অপমান করা৷ তাও কথার প্যাচে ফেলল কেমন করে!

অরিনের একবার ইচ্ছে হলো মরে যেতে। কী জঘন্য লোক!

এদিকে ফোন রেখে প্লাবন বারান্দায় রাখা সোফায় বসে পড়ল। তার ভীষণ খারাপ লাগছে এখন৷ এত বাজেভাবে অরিনকে কথাগুলো না বললেও হতো। কোনো দরকার ছিল না বলার। কিন্তু মেয়েটা তো তার কথা শুনবে!

এখন কী হবে?

সে অরিনকে ফোন করল। ব্যস্ত দেখাল। ঘন্টাখানেক টানা চেষ্টা করার পর প্লাবন বুঝল অরিন তার নাম্বার ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিয়েছে৷

সে ভাবল অরিনকে একটা চিঠি লিখবে। চিঠিতে ক্ষমা চাওয়ার পাশাপাশি সবটা খুলে বলবে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here