মেঘের_আড়ালে_মেঘ”৩৫”
#জেরিন_আক্তার_নিপা
ইরফানকে আজও একাই বাড়ি ফিরতে হলো। মেহরীনকে আজকেও সাথে আনতে পারেনি সে। তার বউটা যে বড্ড অভিমানী। তার অভিমানের পাহাড় কিছুতেই ভাঙছে না। ইরফান ভাবছে ভেতরে গিয়ে আয়ামকে কী বলবে। তিনটা দিন ধরে কত বাহানা, কত মিথ্যা বলেই না ছেলেকে বোঝ দিচ্ছে। আজ কি আয়াম কোন বোঝ মানবে? সকালে সে বেরুবার সময় কতবার করে বলে দিয়েছে, আজ কিন্তু মাম্মীকে ছাড়া তুমি আসবে না পাপা। মাম্মীকে নিয়ে তবেই ফিরবে।
ইরফান হাতঘড়ির দিকে দেখল। নয়টা বাজে। আয়াম নিশ্চয়ই এখনও তার অপেক্ষায় জেগে বসে আছে। ছেলে টাও মায়ের মতনই জেদি। মাম্মীকে না পেলে তার খাওয়া, ঘুম, পড়াশোনা সব বাদ। আর ওদিকে মাম্মীও রেগে ভূত। কিছুতেই আসতে চাইছে না। ইরফান আল্লাহর নাম নিয়ে, বুকে ফুঁ দিয়ে ঘরে এলো। আয়াম সত্যিই জেগে আছে। তবে আজ শুধু আয়াম না, বাবাও সাথে যোগ হয়েছে। ইরফান ঘরে এলে আয়াম কিছু বলার আগে বাবা বলে উঠলেন,
“আজও মেহরীনকে ছাড়া তুই আমার বাড়িতে ঢুকেছিস! গাধা, এই গাধা এই। বউয়ের রাগ ভাঙাতে এতদিন লাগে কারো? কেমন বর তুই হ্যাঁ! আরে আমাকে দেখ, তোর মা যতই রাগ করত। ওর রাগ ভাঙাতে আমার তো দুই দিনও সময় লাগত না। মিষ্টি মিষ্টি করে ভালোবাসার দু’টা কথা বললেই তোর মা’র সব রাগ গলে পানি হয়ে যেত। তুই গাধা সারাজীবন চোর বাটপার মক্কেলদের নিয়েই থেকে যাবি। ভালোবাসার কথা তোর দ্বারা সম্ভব হবে না। আসলে তুই তো তোর বাপের মত হোসনি। হয়েছিস দাদার মত, নিরামিষ।”
ইরফান হতাশা ভরা শ্বাস ফেলে বাবার দিকে চেয়ে আছে। বাবা আজ তাকে ছাড়িয়ে নিজের বাবা পর্যন্ত চলে গেছে। বাবার আজকের লেকচার লম্বা চলবে। ইরফান আশেপাশে চোখ ঘুরিয়ে খুঁজে দেখছে কোথাও একটু তুলো পাওয়া যায় কিনা। কানে গুঁজে দিয়ে অন্তত বাবার প্যাঁচাল থেকে বাঁচা যেত। আরে বাবা, সে নিজে কি মেহরীনকে ফিরিয়ে আনার কম চেষ্টা করে যাচ্ছে? নিজের বউয়ের প্রতি কি তার একটুও টান নেই? হ্যাঁ, ইরফান মানছে মেহরীন যতদিন কাছাকাছি ছিল ততদিন তার জায়গা ইরফানের মনে কতটা জুড়ে ছিল তা বুঝতে পারেনি। কিন্তু মেহরীন চলে যাওয়ার পর তো সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তবুও কেন বাবা তাকেই দোষারোপ করছে। সে নিজে যদি পারত তাহলে তো মেহরীনকে কোলে করে তুলে নিয়ে চলে আসত। মেহরীনের উপর তো আর জোরজবরদস্তি করতে পারবে না। তারও একটা স্বাধীনতা আছে। বাবা এখনও কী কী যেন বলেই যাচ্ছে। আয়াম দাদুর কথার মাঝ থেকেই বলে উঠল,
“পাপা, মাম্মী তোমার সাথে আসেনি কেন? মাম্মী কি তোমার উপর অনেক রাগ করেছে?”
অসহায় মুখে ইরফান মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ বলল।
“মাম্মী আমার উপরও রাগ করেছে পাপা?”
“উঁহু। তোমার মাম্মী শুধু আমার উপরই রাগ করেছে বাবা। মাম্মী অন্য কারো উপর রাগ করতেই পারে না।”
“তাহলে পাপা তুমি কাল আমাকেও নিয়ে যেও। আমি মাম্মীকে বলব, মাম্মী যেন তোমার উপর বেশি রাগ না করে। তোমাকে একটু বকে দিয়ে যেন আবার বাসায় চলে আসে। আমি গেলে মাম্মী আসবে না পাপা?”
ইরফান অবাক নয়নে ছেলেকে দেখছে। আয়াম কবে এতটা বড় হয়ে গেল! এতকিছু কবে থেকে শিখতে শুরু করল! সম্পর্কের প্যাঁচ কি আয়াম বুঝতে শুরু করেছে। সে কি একদিন এটাও বুঝে যাবে যে, মেহরীন তার মা না। তার আসল মা হামনা মারা গেছে। তখনও কি আয়াম এভাবেই মেহরীনকে চাইবে? এরকমই ভালোবাসবে তাকে? মায়ের সম্মান দিবে।
ইরফান শুনল আয়াম দাদুকে বলছে,
“দাদু ভালোবাসার কথা বললে কি সবার রাগ ভেঙে যায়?”
“হ্যাঁ দাদু ভাই। পৃথিবীতে এই একটা জিনিসই তো কেউ ফেরাতে পারে না।”
“তুমি ভালোবাসার কথা জানো? আমাকে একটু শিখিয়ে দিবে? আমি মাম্মীকে বলব। তখন মাম্মী আর রাগ করে থাকবে না। আমি তো ভালোবাসার কথা জানি না। কীভাবে বলতে হয় তুমি আমাকে একটু বলো। আমি কাল পাপার সাথে মাম্মীর কাছে যাব।”
ইরফান আয়ামের কথা শুনে ঠোঁট টিপে হাসছে। বাবাকে আয়াম ঠিক জব্দ করেছে। এবার নাতিকে ভালো করে ভালোবাসার কথা শেখাও। নাতি দাদার শেখানো ভালোবাসার কথা মা’কে গিয়ে শোনাবে। বলো, বলো। একটু আগেই তো ভীষণ চাপা ঝাড়ছিলে। নিজের কালে নাকি মস্ত বড় প্রেমিক পুরুষ ছিলে।
হঠাৎ আয়াম ভালোবাসার কথা শিখতে চাইছে শুনে বাবা থতমত খেয়ে গেলেন। উনি স্ত্রীকে যে ভালোবাসার কথা শুনিয়ে রাগ ভাঙাতেন। সে ভালোবাসার কথা কি ছেলে মা’কে শুনিয়ে রাগ ভাঙাতে পারবে। বাবা মাথা চুলকিয়ে ইরফানের দিকে তাকালেন। ইরফানকে হাসতে দেখে ধমক দিয়ে বললেন,
“এই গাধা, তুই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছিস কেন? একটু সাহায্য কর না। কী বললে মেহরীনের রাগ ভেঙে যাবে বল তো।”
“আমি জানলে আগে নিজে এপ্লাই করতাম না! তোমাদের দাদা নাতির কাছে এসে গালি খেতাম না। নাতিকে তো অনেক বুঝিয়েছ, এককালে রোমিও ছিলে। দুই মিনিটে জুলিয়েটের রাগ ভাঙাতে পারতে। এবার সেটাই নাতিকে শেখাও। তিনদিন ধরে আদাজল খেয়ে বউয়ের পেছনে পড়ে আছি। তবুও বউয়ের মন গলাতে পারলাম না। আর উনি বাড়িতে বসে বসে নাতির সামনে লেকচার ছাড়ছে। মা বেঁচে থাকলে এখন মজা দেখাতাম। একটা ক্যাচাল বাঁধিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতাম। দেখতাম বুড়ো বয়সে কীভাবে বউয়ের রাগ ভাঙাও। মা মরে গিয়ে শুধু তুমি আজ বেঁচে গেলে।”
“দাদু শেখাও না৷ ও দাদু আমাকে ভালোবাসার কথা শেখাও না। তুমি কীভাবে দাদীজানের রাগ ভাঙাতে বলো না। ও দাদু…
.
মেহরীন চেয়ারে হাত-পা বাধা অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিল। অনন্ত তার সামনে অন্য একটা চেয়ারে বসে এক ধ্যানে মেহরীনের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে কী যেন ভেবে মাঝে মাঝে মুচকি হাসছে। মেহরীনের মাথা একটু হেলে পড়েছে। অনন্ত তার মাথা সোজা করে দিয়ে বসাল। আবার হেলে পড়লে অনন্ত আর সোজা করে দিল না। তার হাতের উপর মেহরীনের মাথা রেখে শুইয়ে দিল।
“তুই কেন আমার কথা শুনিস না মেহু। দেখ না তোকে কীভাবে ঘুমাতে হচ্ছে। আমার কথা শুনলে কি এমনটা হতো? আমি কি কখনও তোর খারাপ চাই। তোকে কষ্ট দিয়ে কি সুখ পাই বল? তোর জন্যই তো আমি এতকিছু করেছি। এখন তুই-ই যদি আমাকে ভুল বুঝিস তাহলে আমি কী করব বল। আমার হাতে তো আর কিছুই করার থাকবে না। তুই আমার মৃত্যু চাস। কিন্তু আমি তো তোকে রেখে একা মরতে পারব না। মরলে আমি তোকে নিয়েই মরব।”
কথাগুলো বলতে বলতে অনন্তর মুখ হিংস্র হয়ে উঠছিল। ঘুমন্ত মেহরীনের দিকে তাকিয়ে তার চেহারা আবার নরম হয়ে এলো।
“ঘুমের মধ্যে তোকে কত নিস্পাপ লাগে। জেগে থাকলেও লাগে। কিন্তু ঘুমালে তোকে বেশি সুন্দর লাগে।”
অনন্ত একা একাই হাসছে। জোরে জোরে শব্দ করে হাসছে। তার হাসির শব্দে মেহরীন জেগে উঠল। চোখ খুলে সামনে অনন্তকে দেখলে কাল রাতের ভয়টা আবার তাকে জড়িয়ে ধরল। অনন্ত পাগল হয়ে গেছে। ও সুস্থ নেই। মেহরীন কখনও ভাবেনি অনন্ত তার সাথে এমন করতে পারবে। সত্যিই অনন্তর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। সে উঠতে চাইছিল। কিন্তু পরক্ষণে নিজের দিকে দেখল। এখনও তার হাত পা চেয়ারের সাথে বাধা। অনন্ত এখনও তাকে খুলে দেয়নি! সে সারারাত এখানে, এভাবে বাধা অবস্থায় ছিল! মেহরীন ভয়ার্ত চোখে অনন্তর দিকে তাকাল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,
“তুমি আমার সাথে কী করবে? আমাকে মেরে ফেলবে? ”
“আমি মরলে তো তোকেও মরতে হবে। আমি মত পাল্টে নিলে তুইও বেঁচে যাবি। চিন্তা করিস না। আমি একা মরব না। আবার শুধু একা তোকেও মারব না।”
মেহরীন এবার নিশ্চিত হলো, অনন্ত সত্যিই পাগল হয়ে গেছে। কাল রাতে যখন অনন্ত তাকে জোর করে নিয়ে আসে তখন মেহরীন ভেবেছিল অনন্ত হয়তো তাকে শুধু ভয় দেখানোর জন্য নিয়ে যাচ্ছে। সে কোনো ভাবে ভয়টয় দেখিয়ে মেহরীনকে ফিরে পেতে চায়। এখানে আনার পর মেহরীন যখন চলে যাওয়ার জন্য জোড়াজুড়ি শুরু করে তখন অনন্ত তাকে বাঁধতে শুরু করে। অনন্তকে এই প্রথম তার ভয় লাগতে লাগে। অনন্ত একটা ছুরি নিয়ে মেহরীনের সামনে এসে বসে বলে,
“তুই আমাকে সত্যিই মরে যেতে বলিস?”
মেহরীনের তখন ভয়ে মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। সে স্বপ্ন দেখছে নাকি বাস্তবে এসব হচ্ছে! অনন্ত কি এখন তাকে মেরে ফেলবে!
“তোমার মরে যাওয়াই উচিত। তুমি যে পাগল হয়ে গেছো তা কি তুমি বুঝতে পারছো?”
“আমি জানি তো। তোকে ছাড়া আমি পাগল হয়ে যাব। শুধু তুই-ই এই কথা বুঝিস না। মেহু, এই মেহু কেন আমাকে এত কষ্ট দিচ্ছিস তুই।”
শেষের কথাটা বলার সময় অনন্ত হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলে মেহরীন ভয় পেয়ে সেঁধিয়ে গেল। অনন্ত মেহরীনের মুখ চেপে ধরে বলতে লাগল,
“কেন আমাকে কষ্ট দিস হ্যাঁ? কেন কষ্ট দিস? তোকে ছাড়া থাকতে আমার কষ্ট হয়। কেন বুঝিস না তুই? ওই ইরফানের কাছে তো আমি তোকে কখনও ফিরে যেতে দেব না। তুই আমার কাছে থাকবি। তুই আমার নয়তো আর কারোর না।”
মেহরীন গালে ব্যথা পাচ্ছে। সে কান্না চেপে রেখে কোনরকমে বলল,
“তুমি আমাকে ফিরে না যেতে দেবার কে? আমি মরে গেলেও তোমার সাথে থাকব না। আমার পরিবার ছেড়ে আমি কেন তোমার কাছে থাকব? তুমি আমাকে জোর করে রাখবে? হুহ্, পারবে না। ইরফান ঠিকই আমাকে খুঁজে বের করবে। আর ও তোমাকে শিক্ষা দিয়ে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। মানছি আমি উনার উপর রাগ করে আছি। কিছু সময়ের জন্য উনার থেকে দূরে আছি। তা বলে এই নয় যে সারাজীবন দূরে থাকব।”
অনন্ত ঘর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বলেছে,
“ওই ইরফান তো দেখি তোর কাছে হিরো বনে গেছে। ইরফান হিরো…হা হা হা… ইরফান মেহুর হিরো। ইরফান হিরো এসে মেহুকে অনন্ত ভিলেনের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাবে।”
অনন্তকে অপ্রকৃতিস্থের মতো হাসতে দেখে মেহরীন মনে মনে সত্যিই অনেক ভয় পাচ্ছিল। কাঁদতে কাঁদতে কখন যে চেয়ারে বসেই মেহরীনের চোখটা লেগে গেল। চোখ খুলে এখন সামনে এই পাগলকে দেখছে সে। অনন্ত সারারাত তার সামনে বসে ছিল! তাকে দেখছিল। মেহরীনের গা গুলিতে আসছে। অনন্তকে এখন তার ঘৃণার সাথে সাথে ভয়ও লাগছে।
.
ইরফান আয়ামকে নিয়ে ফুপির ফ্ল্যাটে এসে দেখে এখানে মেহরীন নেই। গতরাতেই তো সে মেহরীনকে দেখে গেছে। আজ এত সকাল সকাল মেহরীন কোথায় যাবে? ইরফানের কাছে সবচে আশ্চর্য লাগল, ফ্ল্যাটের দরজা খোলা। দরজা খোলা রেখে মেহরীন নিশ্চয়ই কাজে চলে যায়নি। সে আয়ামকে নিয়ে ভেতরে গেল।
“পাপা, ও পাপা। মাম্মী কোথায়? তুমি তো বলেছিলে এখানে এসে আমরা মাম্মীকে দেখব।”
“তোমার মাম্মী এখানেই আছে আয়াম।”
ইরফানের মনে অনেক ভাবনা এলেও সে ওসব ভাবনাকে আমলে নিল না। মেহরীন যেমন তেমন মেয়ে নয়। ও শক্ত প্রকৃতির মেয়ে। নিজের সাথে কখনও খারাপ কিছু করার কথা মাথায়ও আনবে না সে৷ ওরকম কিছু করার থাকলে তো প্রথম দিনই করত।
বেডরুমেরও দরজা খোলা। আশ্চর্য মেয়েটা কোথায় গেল। বেডের উপর মেহরীনের ব্যাগের দিকে ইরফানের নজর গেল। বিছানার চাদরে একটুও ভাজ নেই। তার মানে কি রাতে এই বেডে মেহরীন ঘুমায়নি! ঘরের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নিল ইরফান। না, হাতাহাতি বা ধস্তাধস্তির কোন চিহ্ন নেই। কেউ আসেনি এই ঘরে। তাহলে মেহরীন কোথায় গেল। ওর কোন ক্ষতি হয়নি তো? ইরফানের বুক কেঁপে উঠল। হঠাৎ মেহরীনের অমঙ্গলের কথা তার মনে উঁকি দিচ্ছে কেন?
“পাপা মাম্মী কোথায়?”
“জানি না বাবা। কিছুই বুঝতে পারছি না। আই হোপ তোমার মাম্মী ঠিক আছে। ওর যেন কিছু না হয়।”
চলবে___
আগের পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/107175347372111/posts/545908786832096/
গ্রুপ লিংক
https://www.facebook.com/groups/928548141001685/?ref=share