মেঘের_আড়ালে_মেঘ”২২”
#জেরিন_আক্তার_নিপা
মেহরীন ফোলা পা নিয়ে হাঁটতে পারছে না। বেচারি ব্যথায় অস্থির হয়ে আছে কিন্তু রাগ পোষে রেখে কাউকে কিছু বলছেও না। বিছানা থেকে নেমে যে ওয়াশরুমে যাবে সেটাও সম্ভব হচ্ছে না। মাটিতে পা পড়লেই ব্যথায় আত্মা বেরিয়ে যাচ্ছে। ইরফান দুপুরে বাড়ি ফিরে তার পায়ের অবস্থা জানতেও চাইল না। আবার কোথায় বেরিয়ে গেল। মেহরীনের তখন এমন কান্না পাচ্ছিল! কেন কান্না পাচ্ছিল সে নিজেও জানে না। বাবা তাকে দুপুরে খাওয়ার জন্য কত জোর করল। খিদে নেই বলে সে বারবার বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আয়ামও বাসায় নেই। একা একা দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। আর ঠিক তখনই ওর ফোন রিং হতে লাগল। টেবিলের উপর ফোন। মেহরীন কষ্ট করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনভাবে উঠে গিয়ে ফোন রিসিভ করল। অনন্ত কল করেছে। ওপাশ থেকে অনন্তর উদ্বিগ্ন গলা শোনা গেল।
“মেহু ঠিক আছিস তুই? বেশি ব্যথা পাসনি তো? পায়ে এখনও ব্যথা আছে।”
“আমি ঠিক আছি। এখন ব্যথা কিছুটা কমেছে।”
সে অনন্তকে টেনশন দিতে চায় না। তাই ব্যথা থাকা স্বত্বেও মিথ্যা বলল। কিন্তু পরমুহূর্তে সে ভাবল, সে যে পায়ে ব্যথা পেয়েছে এটা অনন্ত জানলো কীভাবে? সে নিজে তো অনন্তকে বলেনি। তাহলে কে বলেছে?
“এক মিনিট, আমি যে পায়ে ব্যথা পেয়েছি এই কথা তোমাকে কে বলেছে? তুমি কীভাবে জানলে?”
অনন্ত নিজের ভুল ধরতে পেয়ে জিভ কামড় দিল। আজ তার সাথে সবকিছুই খারাপ হচ্ছে। মেহু তাকে সন্দেহ না করলেই হয়। অনন্ত নিজের মাথায় জোরে আঘাত করল।
“না মানে তুই কল তুলছিলি না। তাই মিস্টার ইরফানকে কল করেছিলাম। তোর জন্য চিন্তা হচ্ছিল। তুই ঠিক আছিস কিনা।”
“হুম। আমি এখন ভালো আছি।”
যাক একজন তো অন্তত তার জন্য টেনশন করে। তাকে নিয়ে ভাবে। কারো জীবনে তো ওর একটু গুরুত্ব আছে। নইলে একজন তো তার দিকে তাকানোর সময়টাও পায় না।
“মেহু?”
“হুম বলো।”
“তুই এখনও আমাকে আগের মত ভালোবাসিস তো?”
প্রশ্নটা শুনে মেহু এক সেকেন্ড চুপ করে রইল। অনন্ত এর আগে কখনও তাকে এমন প্রশ্ন করেনি। সে অনন্তকেই ভালোবাসে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবুও আজ প্রশ্নটা তার কাছে এতটা উদ্ভট লাগছে কেন? উত্তর দিতেই বা এত দ্বিধা লাগছে কেন?
“বাসব না কেন? বাসি তো। হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছো কেন তুমি! তুমি কি আমাকে আগের মত ভালোবাসো না?”
“বাসিরে মেহু। আগের থেকেও অনেক, অনেক, অনেক বেশি ভালোবাসি। তোর থেকে দূরে থেকে এখন বুঝতে পারছি আমি তোকে কতটা ভালোবাসি। তুই কখনও আমাকে ছেড়ে যাস না মেহু। তুই আমাকে ভুল বুঝিস না।”
অনন্তর সাথে কথা বলতে কেনই যেন মেহরীনের ভালো লাগছে না। সে অন্যমনস্ক হয়ে অনন্তর কথা শুনছে কিনা সন্দেহ।
“আমার শরীরটা ভালো লাগছে না। এখন রাখি। পরে কথা বলব।”
“আচ্ছা। পেইনকিলার নিয়ে শুয়ে থাক। ঘুমালে ব্যথা কমবে।”
“হুম।”
কল কেটে অনন্ত স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল। ইরফান মেহুকে কিছুই জানায়নি। জানালে মেহু তার সাথে এত সুন্দর করে কথা বলত না। মেহুটার গলা কেমন লাগছিল। বেশি ব্যথা পেয়েছে নিশ্চয়ই। এই মেহু এতটা কেয়ারলেস কেন? নিজের একটু খেয়াল রাখবে না। জুতা ছিড়ে পড়ে যায় কীভাবে!
.
আয়াম ঘুমোবার আগে মেহরীনের সাথে কথা বলেছে। একদিন আয়ামকে কাছে না পেয়ে মেহরীনের মনে হচ্ছে সে যেন যুগ যুগ ধরে আয়ামের থেকে দূরে আছে। বুকের ভেতরটা কেমন খালি খালি লাগছে। আচ্ছা এই এক বছরের চুক্তি শেষ হয়ে গেলে সে কীভাবে আয়ামকে ছেড়ে যাবে? আয়ামকে ছাড়া থাকার কথা ভাবতে গেলেই তো তার কান্না পায়। ছেলেটা সারাদিন মাম্মী, মাম্মী করে তার আগেপিছে ঘুরে। মেহরীন তাকে জন্ম না দিলেও যে, সে এখন তার মা হয়ে গেছে।
আয়াম বড় হলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে মেহরীন ওর মা না। ওর মা হামনা মারা গেছে। তখনও কি আয়াম তাকে মা ডাকবে? এখনকার মত ভালোবেসে মায়ের জায়গা দিবে?
“মাম্মী তুমি ব্যথা পেয়েছ?”
“হুম বাবা।”
“অনেক ব্যথা পেয়েছ? ”
“উঁহু।”
“তুমি কাঁদছো মাম্মী?”
“কাঁদব কেন বাবা?”
“আমি তো ব্যথা পেলে কাঁদি। তুমি কাঁদো না?”
“তুমি তো এখন ছোট, তাই ব্যথা পেলে কাঁদো। আমার মতন বড় হলে তখন আর কাঁদবে না।”
“খালামনি আমাকে আসতে দেয়নি মাম্মী। আমি বলেছি তোমার কাছে যাব, তবুও আসতে দেয়নি। আমি সকালেই চলে আসব। তোমাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাব। তুমি কেঁদো না কেমন?”
তার প্রতি আয়ামের ভালোবাসা দেখে চোখের পানি আটকে রাখতে পারল না মেহরীন। কল কেটে সে কাঁদতে বসে গেল। ইদানিং তার একটুতেই কান্না পায়। চোখে এত পানি কোত্থেকে এলো তার?
এই সময় ইরফান ঘরে আসে। তার রাগ কিছুটা কমেছে। মেহরীনকে কাঁদতে দেখে সে ভাবল, মেহরীন হয়তো পায়ের ব্যথায় কাঁদছে। ইরফান মনে মনে ভাবল,
“ইশশ বড্ড নির্দয় হয়ে গেছি আমি। মেয়েটাকে একটা বার জিজ্ঞেস করলাম না সে এখন কেমন আছে। ব্যথা কমেছে নাকি এখনও আছে। বাবা কি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে? নিশ্চয়ই এখনও ব্যথা আছে। নইলে কাঁদছে কেন?”
ইরফান গলা খাঁকারি দিলে মেহরীন ঘোর থেকে বের হয়ে চোখ মুছল। ইরফান শীতল গলায় জানতে চাইল,
“পায়ে এখনও ব্যথা আছে? ”
মেহরীন জবাব না দিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তার কান্না এখনও থামছে না।
“ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন?”
মেহরীন এবারও কথা বলল না। ইরফানের রাগ লাগছে। মেয়েটা মুখে কিছু না বললে সে বুঝবে কীভাবে? মনের কথা জানার ক্ষমতা তো তার নেই। মুখে তেলের পিঠা দিয়ে বসে বসে কাঁদছে। অসহ্য! এবার সে একটু কঠোর গলায় বলল,
“কাঁদছেন কেন? আপনার সমস্যা আমাকে না বললে আমি বুঝব কীভাবে? কাউকে কিছু না বলে বসে বসে কাঁদলে তো কোন সমস্যার সমাধান হবে না। কী হয়েছে আমাকে বলুন।”
মেহরীন রাগে, কষ্টে ফেটে পড়ে বলল,
“কেন বলব? আপনাকে আমি কেন বলব? আপনি আমার কে হোন? আমি মরি বা বাঁচি তাতে আপনার কী আসে যায়? আপনি আপনার নিজের মত থাকুন না। আমার কান্নার কারণ আপনাকে না জানলেও হবে।”
বলেই মেহরীন ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ইরফানের রাগ হলেও আবার মায়াও লাগছে। সে কিছুক্ষণ নীরবে মেহরীনের দিকে চেয়ে থেকে বলল,
“রাতে খেয়েছেন?”
মেহরীন তার কথা শুনেও না শোনার ভান করল। ইরফান মেহরীনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল জোর গলায় বলল,
“খেয়েছেন কিছু?”
“আমি খাই বা না খাই তাতে আপনার কি? আপনি জেনে কী করবেন?”
“আমার অনেক কিছু। এখন যা জিজ্ঞেস করেছি তার উত্তর দিন।”
মেহরীন নাক টেনে বলল,
“আমার খিদে নেই।”
ইরফানের এবার সত্যিই ভীষণ রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে কানের নিচে একটা লাগিয়ে দিক। না খেয়ে বসে বসে কান্না করা হচ্ছে। ঢং তো ভালোই পারে। শুধু পারে না নিজের খেয়াল রাখতে। উষ্টা খেয়ে পড়ে পা ভেঙে বসে আছে। অসহ্য!
“খাননি কেন? বাসায় রান্না করা হয়নি? বুয়া আসেনি আজ?”
“এসেছে। রান্নাও হয়েছে। আপনার খিদে পেলে গিয়ে খেয়ে নিন। আমার খিদে পায়নি, তাই খাইনি।”
“খাবেন চলুন।”
মেহরীন বাচ্চাদের মত জেদি গলায় বলল,
“বলেছি না আমি খাব না।”
“জেদ করবেন না। আপনি আয়ামের মত ছোট না। এক কথা দু’বার বলা আমি পছন্দ করি না।”
মেহরীন এবার চেঁচিয়ে বলল,
“আমি জেদ করছি! আপনি কী করছেন তাহলে? আমি একবার বলেছি তো আমার খিদে নেই। তবুও বারবার জোর করছেন কেন? আমিও এক কথা দু’বার বলা পছন্দ করি না৷ আপনি যান এখান থেকে। আমার চোখের সামনে থেকে এখন দূর হোন।”
ইরফান আর কথা ব্যয় করল না। ঝুঁকে এসে মেহরীনকে পাঁজাকোলা করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মেহরীন পাখির মত দুই হাত ছুঁড়ছে।
“ছাড়ুন আমাকে। নামান বলছি। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে? আজব মানুষ তো! আপনি আমার কথা শুনছেন না। কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? আল্লাহ! এমনিতেই তো পা ভাঙা। পড়ে গেলে কোমরও ভাঙবে।”
ইরফান ডাইনিংয়ে এসে মেহরীনকে চেয়ারে বসিয়ে দিল। চোখ পাকিয়ে ওর দিকে চেয়ে বলল,
“চুপ। একদম নড়াচড়া করবেন না। আমার কথা না শুনলে এমনই হবে। খাবার এনে দিচ্ছি, চুপচাপ খেয়ে না নিলে জোর করে মুখে ঠুসে দেব। আপনি চান আমি আপনাকে জোর করে খাওয়াই?”
এর পর আর মেহরীনের জেদ চলে না। ইরফান খাবার এনে তার সামনে রাখলে বাধ্য মেয়ের মত মেহরীন খেয়ে নিল। খেতে খেতে কয়েকবার আড়চোখে ইরফানকে দেখল। মেহরীন মনে মনে বলছে,
“এহহ ঢং। সারাদিন খোঁজ নেয়না। এখন জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। নাটক! একবার জিজ্ঞেস করেছে, আমার ব্যথা কমেছে কিনা। শুধু জোর খাটাতে আসে।”
মেহরীনের খাওয়া শেষ হয়ে গেলে ইরফান তাকে আবার কোলে করে রুমে নিয়ে গেল। বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“ব্যথা এখনও আছে?”
“হুম।”
“ডাক্তারের কাছে যাননি?”
“না।”
“কেন? বাবাকে বললে হতো না। বা আমাকে কল করতে পারতেন একবার।”
“আপনি নিজেও তো করতে পারতেন। আমি কেন করব? আপনিও তো কল করেননি।”
মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলে মেহরীন নিজেই বোকা হয়ে গেল। ইরফান ড্যাব ড্যাব করে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে ফোন হাতে বাইরে বেরিয়ে গেল।
মেহরীন নিজেকে ধমকাচ্ছে।
“গাধা! কার সামনে কী বলতে হয় কিচ্ছু জানিস না। উনি কী ভাববেন তোকে? নিশ্চয়ই ছ্যাচড়া ভাবছেন।”
ইরফান ডাক্তারের সাথে কথা বলে রুমে এসে মেহরীনকে বলল,
“কাল সকালে ডাক্তারের কাছে যাব। আপাতত পেইনকিলার নিয়ে নিন। আর পা বেশি ব্যথা করলে গরম পানির ছ্যাঁক নিতে বলেছে।”
“হুম।”
আজ আয়াম বাড়িতে নেই। প্রতিদিন তো ওরা এই রুমেই থাকে। আয়াম ওদের মাঝে ঘুমায়। আজ ইরফান এই রুমে থাকবে কিনা ভাবছে। অন্য রুমে গিয়ে থাকা যাবে ঠিকই। কিন্তু বাবা দেখে ফেললে সমস্যা হবে। বাবার প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে জান বেড়িয়ে যাবে। ইরফান কী করবে বুঝতে না পেরে ঘরেই পায়চারি করছে। বই হাতে নিচ্ছে। জানালার সামনে গিয়ে দাড়াচ্ছে। মেহরীন বেডে বসে চুপ করে ইরফানের কাণ্ড দেখছে। লোকটা হঠাৎ এতটা অস্থির হয়ে গেল কেন? কিছু হয়েছে নাকি? মেহরীন ইরফানকে কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না।
চলবে___
এক হাজার শব্দের উপরে লিখা ছিল। সময় পেয়ে বাকিটা লিখে ফেললাম। আপনাদের অপেক্ষা করাতে আমারও ভালো লাগে না। নেক্সট পর্ব তাড়াতাড়ি দেওয়ার চেষ্টা করব।
সবাই গঠনমূলক মন্তব্য করবেন।