মেঘের_আড়ালে_মেঘ”১৮”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

মেহরীন হামনার ডায়েরি অনেকটাই পড়ে ফেলেছে। মেহরীন যতই একটা একটা করে পৃষ্ঠা পড়ে সামনে এগোচ্ছে ততই সে ইরফানের কষ্ট নিজের মধ্যে অনুভব করতে পারছে। মানুষটা হামনাকে হারিয়ে কীভাবে বেঁচে আছে! সে তো হুবহু হামনার মতই দেখতে। চব্বিশ ঘন্টা সে মানুষটার সামনে আছে। তাকে দেখে নিশ্চয়ই মানুষটার হামনার কথা মনে পড়ে। ভালোবাসার মানুষকে হারানোর বেদনা তাকে কুড়ে কুড়ে খায়। তবুও সে তাকে সহ্য করছে।
মেহরীন পড়ছে,

“সেদিন বল নিয়ে ঝামেলা করার পর দুই দিন আমি আর ওই ছেলেটাকে দেখিনি। ওরা যে বিল্ডিংয়ে থাকে, ওই একই বিল্ডিংয়ে উঠেছি আমরা। ওরা পাঁচ তলায়। আমরা ছয় তলায়। মা’র কাছে শুনেছি ছেলেটার নাকি মা নেই। এটা শুনে একটু কষ্ট লাগল। কিন্তু ওই ছেলে কারো সহানুভূতি পাওয়ার যোগ্য না। রাতেই ওকে নিয়ে হুমু আর মায়ের সাথে দুঃখ প্রকাশ করলাম। আর সকালে ছেলেটা করলো কী? আমি রোজ রোজ বেলা করে ঘুম থেকে উঠি। সেদিন সকালে চোখ খোলার পরই হুমুর কাছে শুনলাম আমার পুচিকে পাওয়া যাচ্ছে না। পুচি হারিয়ে গেছে ভেবে আমার মাথা ঘুরে উঠল। চিৎকার চেচাঁমেচি করে সারাদিন বাড়ি মাথায় তুলে রাখলাম। বাবা মা ভয়ে আমার সাথে কথা বলছে না।
” একটা বেড়ালকে দেখে রাখতে পারলে না তোমরা! আমার পুচিকে হারিয়ে ফেললে! আমি কিচ্ছু জানি না। তোমরা যেখান থেকে পারো আমার পুচিকে এনে দাও। পুচিকে না পেলে আমি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। যেখানে আমার পুচির কোন দাম নেই। সেখানে আমি থাকব না।”
পুচির শোকে আমি সেদিন সকালে, দুপুরে না খেয়ে ছিলাম। জেদ করেছিলাম পুচিকে না পেলে রাতেও না খেয়ে থাকব। হুমু, বাবা,মা অনেক বোঝালো। আমি কারো বোঝই মানলাম না। আমার এক কথা, যেখান থেকে পারো পুচিকে এনে দাও। পুচির জন্য কান্নাকাটি করে আমি চোখ ফুলিয়ে দুপুরে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন হোক আর যাই হোক, ঘুম ভাঙার সাথে সাথে পাঁচতলায় দৌড়ে গেলাম। পুচি হারায়নি নিশ্চয়ই ওই শয়তান ছেলে তার বল ফোটো করার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আমার পুচিকে লুকিয়ে রেখেছে। স্বপ্নেও আমি এটাই দেখেছি। কলিংবেল বাজাতে বাজাতে ভেঙে ফেলতে চাইছি তবুও কেউ দরজা খুলছে না। অবশেষে শর্টস পরা খালি গায়ের এক যুবক পুচিকে কোলে নিয়ে দরজা খুলে দিল। শয়তানটাকে দেখেই আমার গা জ্বলে গেল। কেমন নির্লজ্জের মত খালি গায়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে ভ্রু কুঁচকে আমাকে জিজ্ঞেস করল
“কী চাই?”
আমি রাগে কিড়মিড় করে পুচিকে ওর থেকে নেওয়ার চেষ্টা করে বললাম,
“আমার পুচিকে দিন।”
সে যেন কিছুই জানে না, এমন ভাব নিয়ে আশেপাশে দেখতে লাগল।
“পুচি! কে পুচি?”
“আপনি যাকে কোলে নিয়ে আছেন। সে-ই আমার পুচি।”
“ও পুচি নাকি? ও তো একটা বেড়াল ছানা।”
“ও আমারই বেড়াল ছানা। আমি ওর নাম পুচি দিয়েছি।”
“পুচি! ছি কী বিশ্রী নাম! যাক, এটা যে আপনার বেড়াল ছানা তার কী প্রমাণ আছে।”
“প্রমাণ! আপনি আমার কাছে প্রমাণ চাইছেন! ওকে না পেয়ে সারাটা দিনে আমার কী অবস্থা হয়েছে জানেন আপনি? এখন আপনি আমার কাছে প্রমাণ চাইছেন! দিন ওকে। আমার পুচিকে আমার কাছে দিন।”
“উঁহু। এভাবে যার তার হাতে আমি ওকে তুলে দিতে পারি না। পাক্কা প্রমাণ দেখাতে পারলে তবেই আমি ওকে দেব। নইলে ওর কথা ভুলে যান। আমার সাথে ও ভালোই আছে। কীরে বল, ভালো আছিস না আমার সাথে?”
পুচিও লেজ নাড়াল। আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। যেখানে এতদিনে হুমু পুচিকে নিজের কথা শোনাতে পারে না,সেখানে এই লোক অর্ধেক দিনে পুচিকে বশ মানিয়ে নিয়েছে। শয়তান ব্যাটা নিশ্চয়ই জাদু জানে।
“পুচি, আমার কাছে আয়। মাম্মাম তোকে না পেয়ে কত টেনশন করেছে তুই বুঝতে পারছিস না! এই লোকের কোল থেকে নেমে আয় তুই। মাম্মামের কাছে আয় পুচি।”
ইরফান শরীর কাঁপিয়ে হাসতে হাসতে বলল,
“মাম্মাম! আপনি এই বেড়াল ছানার মা! মানুষ হয়ে বেড়ালের মা! অহ গড!”
“একদম হাসবেন না। দাঁত ফাটিয়ে দেব কিন্তু আপনার। আপনি যে আস্ত একটা বদ তা আমার প্রথম দিনই জানা হয়ে গেছে। ওই দিন আমার দু’টা মাছ মারলেন। আজ পুচিকে চুরি করলেন। আপনি চোর। শুধু চোর না, বদমাশও। দিন আমার পুচিকে।”
বদটা পুচিকে দিচ্ছিলই না। তখনই আঙ্কেল আসে।
“হামনা মা, তুমি? ভেতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ইরফান তুই দরজার সামনে থেকে সরে ওকে ভেতরে আসার জায়গা দে। সকাল থেকে কী এক বেড়াল নিয়ে পড়ে আছে। নিচে থেকে নাকি পেয়ে এনেছে। কে জানে কার বেড়াল হারিয়ে গেছে। রাস্তায় বেড়িয়ে যাচ্ছিল দেখে ও নিয়ে এসেছে। নইলে আবার গাড়ির নিচে চাপা পড়ত যদি।”
আমার তখন বাবা,মা,হুমুর প্রতি এত রাগ হচ্ছিল। ওদের জন্য যদি আজ আমার পুচির কিছু হয়ে যেত। তাহলে আমি কাউকেই ক্ষমা করতাম না।
“আঙ্কেল এটা আমার বেড়াল। সকাল থেকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভেবেছি হারিয়ে গেছে হয়তো।”
“তোমার বেড়াল! ইরফান ওকে নিয়ে এসে তাহলে ভালোই করেছে। এই ইরফান, এখন ওকে ওর বেড়াল ফেরত দে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে বেচারি ওকে অনেক খুঁজেছে।”
আঙ্কেলের কথা শুনে এবার পুচিকে আমার কাছে ফেরত দিতেই হলো। আমি চলে আসার সময় আঙ্কেল পেছন থেকে ডেকে বললেন,
“দাঁড়াও হামনা। আমার পাগল ছেলে এইটুকু সময়েই ওর জন্য কত খাবার কিনে এনেছে। কিছু খাইয়েছে। বাকি সবই আছে। আমাদের বাসায় কোন বেড়াল নেই। খাবার গুলো তোমার বেড়ালের জন্য নিয়ে যাও। নইলে শুধু শুধু নষ্ট হবে।”
সেদিন বুঝতে পারলাম ইরফানকে আমি মনে মনে যতটা খারাপ ভাবি, ইরফান ঠিক ততটা খারাপ না। নইলে কুড়িয়ে পাওয়া একটা বেড়াল ছানাকে বাসায় নিয়ে গিয়ে ওর এত খেয়াল কেউ রাখবে না। সে খাবার এনে পুচিকে খাইয়েছে। আচ্ছা সে কি তখন জানত ওটা আমার বেড়াল? সব জেনেও সে দিনের বদলা নেওয়ার জন্য পুচিকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেয়নি?”

মেহরীন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ডায়েরি বন্ধ করে রাখল।

“ওদের ভালোবাসার গল্প কত মিষ্টি। ঝগড়া ভালোবাসা সবই ছিল ওদের মধ্যে। হামনা তুমি কেন উনাকে ছেড়ে গেলে? তোমাকে ছাড়া মানুষটা ভালো নেই।”

মেহরীন নিজেও বুঝতে পারছে না ইরফানের জন্য তার মনে আস্তে আস্তে এক ধরনের অনুভূতি জন্ম নিচ্ছে। ইরফানের কষ্টে সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। মেহরীন এখন মনে প্রাণে চাইছে ইরফান যেন আর কোন কষ্ট না পায়। সে ইরফানের সুখ কামনা করছে। ইরফানের জন্য তার মনে ভালোবাসা তৈরি না হলেও এই অনুভূতিটুকুও কম কিসে? কে জানে পুরো ডায়েরিটা পড়তে পড়তে সে হয়তো ইরফানকে ভালোবেসে ফেলবে।

দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ কেটে গেল। এই বাড়িতে থাকতে থাকতে মেহরীন এখন ইরফানের সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনেছে। কিসে ইরফানের ভালো লাগা, কিসে খারাপ লাগা। ইরফান যে কাজ গুলো পছন্দ করে না মেহরীন সে কাজগুলো না করে এড়িয়ে চলে। সে এখন রোজ সকালে ইরফানকে অফিসে আর আয়ামকে স্কুলে পাঠিয়ে নাচের ক্লাসে যায়। সেখানে সে এক ঘন্টা সময় দেয়। ফেরার পথে অনন্ত রোজই ওর জন্য অপেক্ষা করে। অনন্তটা পাগল। মেহরীন এই বাড়ি নিয়ে,ইরফানকে নিয়ে তার সামনে কোন কথা বললে মাঝে মাঝেই অনন্ত রেগে যায়।
একদিন সন্ধ্যায় মেহরীন আয়ামকে পড়াচ্ছে। কিন্তু আজ আয়ামের পড়ার প্রতি কোন মনোযোগ নেই।

“মাম্মী তুমি নাচতে পারো?”

“হ্যাঁ পারি। তুমি হোমওয়ার্কটা শেষ করো না বাবা।”

“মাম্মী তুমি সব গানে নাচতে পারো?”

“পারি বাবা।”

“লুঙ্গি ডান্স গানেও পারো?”

“আয়াম, আজ তুমি অনেক দুষ্টুমি করছো।”

“মাম্মী তোমাকে কে নাচ শিখিয়েছে? ”

“আয়াম তুমি আজ পড়বে না?”

“পড়ব। বলো না মাম্মী। তোমাকে কে নাচ শিখিয়েছে?”

“আমার ম্যাম।”

“তোমার কোন ম্যাম?”

এবার মেহরীন রাগী ভাব নিয়ে আয়ামকে দেখল। আয়াম তার রাগের তোয়াক্কা না করে বলেই চলল,

“তুমি নাচ শেখাতে পারো মাম্মী? ”

“পারি বাবা, পারি।”

“আমাকে শেখাবে? আমিও তোমার মত নাচ শেখব।”

“ছেলেরা নাচ শিখে না বাবা।”

“শিখে। আমি টিভিতে দেখেছি।”

“টিভিতে তুমি যে নাচ দেখো আমি সেই নাচ শেখাতে পারি না বাবা।”

“তাহলে কোনটা পারো?”

“তুমি বুঝবে না আয়াম।”

“বুঝব।”

“বলেছি না বুঝবে না।”

“আচ্ছা তাহলে তুমি একটু নাচো না মাম্মী। আমি তোমার নাচ দেখব।”

“আয়াম এখন তোমার পড়ার সময়।”

“একদিন না পড়লে কী হয়। তুমি আমাকে নাচ দেখাও।”

এই ছেলের সাথে তর্ক করে মেহরীন কখনও পেরে উড়বে না। আয়াম তার বাবার মতই জেদি হয়েছে। সে যতক্ষণ নিজের বায়না পূরণ করতে না পারবে ততক্ষণই জেদ করে যাবে। মেহরীন ডিভিডি প্লেয়ারে গান ছেড়ে কোমরে ওড়না বেঁধে নিয়ে রেডি হয়ে দাঁড়াল। আয়াম মেহরীনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাম্মীর সাথে সে-ও নাচবে।

“আমাকে দেখে দেখে করবে। আমি যেমন যেমন করি তেমন। ঠিক আছে? ”

“আচ্ছা।”

গান বাজতে শুরু করল। মেহরীন গানের তালে তালে পা মিলিয়ে নাচতে শুরু করল। আয়ামও তার দেখাদেখি হাত পা নাড়িয়ে উদ্ভট এক ধরণের নাচ আবিষ্কার করে ফেলেছে।
ইরফান দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ নয়নে মেহরীনকে নাচতে দেখছে। সে এতদিন ভাবেনি মেয়েটা এত সুন্দর করে নাচতে পারে।
ওড়নাটা কোমরে বাধা। কোমর পর্যন্ত লম্বা বিনুনিটা নাচের তালে তালে দুলছে। কয়েকটা খোলা চুল অবাধ্য হয়ে মেহরীনকে জ্বালাতে মুখের উপর এসে পড়েছে। তবুও তার নাচে এতটুকু ডিস্টার্ব হচ্ছে না। ইরফানের একবার ইচ্ছে করল, সে গিয়ে চোখে মুখে আসা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দেয়। পরমুহূর্তে সে নিজেকে ধমকাল।

“কী ভাবছিস এসব তুই? তোর মন এমনটা কেন চাইছে? তুই জানিস না, এই মেয়ে তোর কেউ হয়না। যার অবাধ্য চুল সামলানোর অধিকার তোর ছিল সে একমাত্র হামনা। হামনাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবা বারণ তোর।”

ইরফান এখানে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। তার মন আজ বড্ড অবাধ্য হতে চাইছে। বারবার মেহরীনকে নিয়ে ভাবতে চাইছে। ওকে এক নজর দেখতে চাইছে। ইরফান নিজেও বুঝতে পারছে না ওর সাথে কী হচ্ছে এসব। সে ভেবে নিয়েছে এখন থেকে যতটা পারে নিজেকে মেহরীনের থেকে দূরে রাখবে। মেয়েটা সবাইকে নিজের মায়ায় বাঁধতে পারে।

রাতে ইরফান সোফায় বসে ল্যাপটপে কিছু একটা কাজ করছে। মেহরীন আর আয়াম বেডে বসে গল্প করছে। মেহরীন যেন কী বলছে। সে নিজে নিজেই কথা বলতে বলতে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরছে। হাসতে হাসতেই মেহরীন বলল,

“এত মজার একটা গল্প বললাম। তোমার হাসি পাচ্ছে না আয়াম? আচ্ছা দাঁড়াও তোমাকে কাতুকুতু দিয়ে হাসাই। এই তো, এবার হাসো।”

ইরফান আড়চোখে ওদের দেখে বিরক্ত হচ্ছে। তবুও কিছু বলছে না। মেহরীনের হাসির শব্দ তার কানে আসতে বুকের ভেতর কেমন যেন ধাক্কা খাচ্ছে। ইরফান নিজের ভেতরের অস্থিরতা সহ্য করতে না পেরে রেগে চিৎকার করে উঠল।

“কী হচ্ছে এসব হ্যাঁ? এটা বাড়ি নাকি অন্য কিছু। একজন মানুষ কাজ করছে, সেটা চোখে পড়ছে না কারো? তখন থেকে পাগলের মত হেসে যাচ্ছে। রাত বিরাতে এতই হাসতে মন চাইলে পাগলা গারদে গিয়ে হাসুক।”

ইরফানের চিৎকারে প্রথমে মেহরীন থতমত খেয়ে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিল। এই লোকটার হঠাৎ করে হলোটা কী, হ্যাঁ! এমন রেগে গিয়ে চেঁচাচ্ছে কেন? ওরা তো হাসছিলই। অন্যায় কোন কাজ তো করেনি। মেহরীনও ভয় না পেয়ে গলায় ঝাঁঝ এনে বলল,

“আমরা কি একটু মন খুলে হাসতেও পারবে না? হাসি পেলেও একজনের থেকে অনুমতি নিয়ে হাসতে হবে! আশ্চর্য! এটা কি কাজ করার জায়গা? বাড়িতে বসে এতই কাজ করতে হলে স্টাডি রুমে চলে যাক না। কে ধরে রেখেছে? অযথা অন্যের উপর চোটপাট করবে। আয়াম চলো তো আমরা দাদুর কাছে বিচার দিয়ে আসি।”

“চলো মাম্মী। পাপা দিনদিন পঁচা হয়ে যাচ্ছে। শুধু আমাদের বকে।”

মেহরীন আয়ামকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে ইরফান হতভম্ব হয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল।

“এই মেয়েকে এত সাহস কে দিয়েছে! আমার মুখে মুখে কথা বলে চলে গেল! না, আমি এসব একদম সহ্য করব না৷ ওই মেয়ে নিজেকে কী ভাবে? সত্যি সত্যিই ও নিজেকে আমার বউ ভাবতে শুরু করেছে নাকি? এভাবে আমার সাথে কথা বলার সাহস ওই মেয়ে পেল কোত্থেকে?”
.
অনন্ত মেহরীনের বের হওয়ার অপেক্ষায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে এখানে এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেহরীনের আসার অপেক্ষা করছে সে। মেহরীন বের হয়েই চোখের সামনে অনন্তকে দেখে একগাল হাসল। অনন্ত ওর সামনে গিয়ে বলল,

“আজ তোকে আমার ওখানে নিয়ে যাব। দুপুর পর্যন্ত আমার সাথে থাকবি। আমি নিজের হাতে রান্না করব। তুই খেয়ে যাবি।”

“আজ! না,না। আজ কীভাবে যাব? আজ বাবাকে নিয়ে চেকআপের জন্য যেতে হবে। আজ পারব না। অন্য দিন যাই প্লিজ।”

“বাবা! তুই ওই বুড়োকে বাবা ডাকিস এখন!”

“ডাকব না? উনার ছেলের বউ হয়েছি। শ্বশুরকে কে আঙ্কেল ডাকে?”

মেহরীন কথাগুলো সহজ ভাবে বললেও অনন্ত সহজ ভাবে নিতে পারল না। সে চেঁচিয়ে বলল,

“বিয়েটাকে তুই সত্য ভাবছিস নাকি? ওই লোকের সাথে তোর মিথ্যা বিয়ে হয়েছে। অভিনয় করছিস তুই। এটা কি ভুলে গেছিস?”

অনন্তর কথা শুনে মেহরীন মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। তাদের বিয়েটা মিথ্যে না। মেহরীন সত্যি সত্যিই ইরফানের বউ হয়ে গেছে। কিন্তু এই কথাটা সে অনন্তকে কীভাবে বলবে? অনন্ত জানতে পারলে কী করবে কে জানে। তাকে যে আস্ত রাখবে না,এটা মেহরীন ভালো করেই জানে। না, এখন অনন্তকে কিছু বলা ঠিক হবে না। ইরফান তো বলেছে নব্বই দিনের মধ্যে ওদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। একবার ডিভোর্সটা হয়ে গেলে আর কোন ঝামেলা থাকবে না। তখন অনন্তকে ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলা যাবে।

“বুঝতে চেষ্টা করো অনন্ত। যতই অভিনয় করি। আমরা জানি বিয়েটা সত্য না, অভিনয়। বাবা তো আর জানেন না। উনি আমাকে নিজের ছেলের বউয়ের জায়গাই দিয়েছেন।”

“আমি তোর কোন কথা শুনতে চাই না। তুই এখন আমার সাথে আমার বাসায় যাবি ব্যস।”

“আজ না লক্ষীটি। আমি কথা দিচ্ছি অন্য একদিন বাড়ি থেকে কিছু একটা বলে এসে পুরো দিন তোমার সাথে কাটাব। কিন্তু আজ কোনমতেই সম্ভব না। আমি বাসায় গিয়ে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।”

অনন্ত জেদি গলায় বলল,

“আমার থেকে ওই নকল শ্বশুর তোর কাছে বেশি হয়ে গেল?”

“তোমার জন্যই তো এসব করছি। তুমিই তো জোর করেছিলে।”

“ভুল করেছি। তখন বুঝতে পারিনি, তুই অভিনয় করতে করতে আমার থেকেই দূর হয়ে যাবি।”

“এমন বলছো কেন? আমি কি তোমাকে ছেড়ে সত্যিই ওই লোকের সাথে ঘর সংসার করছি নাকি?”

অনন্ত রাগে মেহরীন বাহু শক্ত করে চেপে ধরল,

“করছিস না। কিন্তু করবি। আমি বেশ বুঝতে পারছি। তোর মন আমার থেকে আস্তে আস্তে উঠে যাচ্ছে। তুই ওই ইরফানকে পছন্দ করতে শুরু করেছিস।”

“কী যা তা বলছো! তুমি আমাকে সন্দেহ করছো!”

“সন্দেহ করার মত কাজ তুই করছিস বলেই সন্দেহ করছি।”

মেহরীন হাতে ব্যাথা পাচ্ছে।

“আমার লাগছে অনন্ত ছাড়ো প্লিজ। ”

“লাগুক। আমারও লাগে। চল আজই আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করব। আমাকে বিয়ে করে তুই যত অভিনয় করতে পারিস কর। তখন আমার কোন আপত্তি নেই।”

“তার মানে তুমি আমাকে বিশ্বাস করো না। তোমার এখন মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে ধোঁকা দিয়ে ওই বাড়িতে থেকে যাব। আমাকে বিয়ে করে তোমার নামের সিলমোহর লাগিয়ে দিলে তবে তুমি ভরসা পাবে! আমি তোমার থেকে এমনটা কখনও আশা করিনি৷ তুমি অন্তত আমাকে বুঝতে পারতে। আমার মনে হত পৃথিবীতে আমার পাশে কেউ না থাকুক, তুমি সব সময় থাকবে। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে তুমি তো আমাকে বিশ্বাসই করো না। যেখানে বিশ্বাসই নেই, সেখানে কিসের ভালোবাসা! এখন আমার এটা মনে হচ্ছে তুমি যেমন আমাকে বিশ্বাস করো না। তেমনই হয়তো ভালোও বাসো না। নইলে বিয়ে বিয়ে করে ছয়টা মাস আমি তোমার পেছনে ঘুরেছি। কতভাবে বলে, কত অনুরোধ করে তোমাকে রাজি করাতে পারিনি। তখন তুমি একটা বারের জন্য রাজি হওনি। আর আজ বলছো, চল আমরা কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করে নিই! আজ আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় হচ্ছে তোমার। তাই তুমি বিয়ে করতে চাইছ!”

মেহরীন রেগে গিয়ে কথাগুলো বলে অনন্তর থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটতে লাগল। অনন্ত থমকে দাঁড়িয়ে মেহরীনকে চলে যেতে দেখছে। এর আগে মেহরীন কখনও তার সাথে এমন ভাবে কথা বলেনি।

চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here