মেঘের_আড়ালে_মেঘ”১৭”
#জেরিন_আক্তার_নিপা

অনন্ত দৌড়ে গিয়ে পেছন থেকে মেহরীনের হাত ধরে ওকে দাঁড় করাল।

“তোর সাহস তো কম না। আমাকে দেখেও চলে যাচ্ছিস।”

“তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই।”

“কী হয়েছে রাগ করেছিস কেন?”

“কী হয়েছে জানো না তুমি! তোমার মত আজব লোক আমি আর দেখিনি। গার্লফ্রেন্ডকে বিয়ে দিয়ে দিলে। তখন আবার তার খোঁজও নিচ্ছ না! নতুন কাউকে পেয়ে গেছ মনে হয়। এখন আর পুরানোটা দিয়ে কী করবে।”

“দেব এক চড়। উল্টাপাল্টা কী বলছিল এসব? আমার আগের ফোনটা চুরি হয়ে গেছে। তাই তোকে কল করতে পারিনি।”

“জানি। তোমার এসব বাহানা।”

“আরে পাগল বাহানা না। সত্যিই। দেখ আজ নতুন ফোন নেওয়ার জন্যই এদিকে এসেছি।”

মেহরীন কতক্ষণ অনন্তর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। সত্যি বলছে না মিথ্যে তা এই ছেলের মুখ দেখে বোঝা দায়।

“সত্যি বলছো তো?”

“হ্যাঁ রে বাবা সত্যি। চল তোকে চা খাওয়াই। অনেকদিন হলো এক সাথে চা খাই না।”

অনন্ত মেহরীনকে নিয়ে একটা চায়ের দোকানে গেল।

“তো বল, সংসার কেমন চলছে?”

মেহরীন রাগী চোখে ওর দিকে তাকালে অনন্ত হেসে ফেলল।

“এখন বুঝতে পারছি মেহু। তোকে রাজি হতে বলে ভুলই করেছি। আমি তোকে মিছেমিছিও কারো সাথে ভাগ করতে পারি না। তিনটা রাত ধরে একফোঁটাও ঘুমুতে পারি না আমি। মনে হয় তুমি যেন আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস।”

“আরও যেচে গিয়ে মানুষের সাহায্য করো। আমি রাজি হয়েছিলাম নাকি? তুমিই তো বুঝালে বুড়ো লোকটার খুশির জন্য একটু নাহয় নাটক করলি। তোমার মত পরোপকারী মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। অন্যের খুশির কথা ভেবে এখন নিজে কষ্ট পাচ্ছ।”

অনন্ত ভেবে পাচ্ছে না মেহরীনকে এই কথাটা কীভাবে জিজ্ঞেস করবে। সে ইতস্তত করে বলল,

“ওই ইরফান লোকটা তোর সাথে কোন…

অনন্ত বলার আগেই মেহরীন বুঝে গেল।

” না,না। ওই লোক তোমার মতই ভালো। তুমি যেমন আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা ভাবতে পারো না। ঠিক তেমনই ওই লোক তার মৃত স্ত্রীকে ছাড়া অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা কল্পনাও করতে পারে না। লোকটার ভীষণ দুঃখ। উনার সবচে প্রিয় মানুষটাই উনার কাছে নেই।”

“ওই লোকের জন্য তোর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মনে হয়!”

“কষ্ট না। কিন্তু উনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারি।”

“ওই বেডার মনের অবস্থা তোকে অত বোঝা লাগবে না। তুই তোর কাজে মন দে।”

মেহরীন ঠোঁট টিপে হাসল।

“তোমার খুব হিংসে হচ্ছে মনে হয়। হিংসার একেবারে জ্বলে পুড়ে মরছো। উহ দেখ দেখ তোমার গা থেকে কেমন পোড়া গন্ধ আসছে।”

“হয়েছে হয়েছে। আমাকে নিয়ে আর মজা নিতে হবে না। তুই কিন্তু ওই লোকের আশেপাশে বেশি যাবি না। ওই লোকের সাথে তোর কোন কাজ নেই, বুঝলি?”

“বুঝলাম।”

মেহরীন মনে মনে ভাবছে মনের দিক থেকে কতটা সরল হলে মানুষ নিজের গার্লফ্রেন্ডকে অন্য কারো বউ হয়ে অভিনয় করতে দেয়। শুধু আঙ্কেল আর আয়ামের কথা ভেবে অনন্ত তাকেও রাজি করাল। যাদের জীবনে দেখেনি তাদের জন্য কত বড় ত্যাগ করলো অনন্ত। মেহরীন মনে মনে বলল,

“আমি সত্যিই ভাগ্যবতী। নইলে কি তোমার মত একজনকে আমার জীবনে পেতাম! ”
.
হুমায়রা অনন্তর চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। লোকটা সেদিন রেস্টুরেন্ট থেকে যাবার পর একবার কল দিয়েছিল মাত্র। গ্রামে গিয়ে কোনো অসুবিধায় পড়লো নাকি? মানুষটা ঠিক আছে তো। অসুখে পড়েছে নাকি চাচীকে নিয়ে কোন ঝামেলা হয়েছে। তাকে কল না দিক। মানুষটা ঠিক থাকলেই হলো।
হুমায়রা জানে বারবার কল করলেও কোন লাভ নেই। এবারও ফোন অফই আসবে। তবুও সে আবার চেষ্টা করল।

“ফোন বন্ধ আসছে কেন? চার্জ নেই। নাকি গ্রামে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। উনি তো এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ না। ভালো থাকলে নিশ্চয়ই একটাবার হলেও আমাকে কল করে জানাত।”

হুমায়রা আর চাপ নিতে পারছে না। ফোন ছুড়ে রেখে সে কাঁদতে লাগল। তার মন কয়দিন ধরেই কু ডাকছে। যেন তার সাথে খারাপ কিছু হতে চলেছে। সেই খারাপটা কী, সেটাই তো ভেবে পাচ্ছে না।

“অনন্ত আপনি সেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। সব ঝামেলা শেষ করে আপনি তাড়াতাড়ি আমার কাছে ফিরে আসুন। একবার শুধু বিয়েটা হয়ে যাক। তখন আমি আপনাকে কোথাও একা ছাড়ব না। আপনি যেখানে যাবেন আমিও আপনার সাথে সাথে যাব।”
.
হামনার ডায়েরি পরে মেহরীন জানতে পারল কাল আয়ামের বার্থডে।

“কালই তো দশ তারিখ। মা’কে ছাড়া এটা হয়তো আয়ামের প্রথম বার্থডে। যাক, হামনা না থাকুক। আমি আছি তো। আমার সাথে এটা আয়ামের প্রথম বার্থডে। ওকে এতটুকু মায়ের কমতি অনুভব করতে দেব না। আমি নিজে ওর জন্য কেক বানাব। বাড়িঘর সাজাব। আয়ামকে সারপ্রাইজ দিয়ে চমকে দেব। ছেলেটা অনেক খুশি হবে।”

যেই ভাবা সেই কাজ। পরের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে মেহরীন বাড়ির সব কাজ সেরে কাউকে কিছু না বলে বাজারে চলে গেল। তার নিজের কাছে কিছু টাকা আছে। এ দিয়েই আয়ামের জন্য গিফট কিনবে।
আয়াম স্কুল থেকে ফেরার কিছুক্ষণ পরই ইরফানও বাসায় ফিরে এলো। মেহরীন বুঝতে পেরেছে আজ ইরফান কেন এত তাড়াতাড়ি ফিরে এসেছে। সারাদিন সে নিজের হাতে সব রান্নাবান্না করল। বিকেলের দিকে আয়ামকে বাবার সাথে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে সে আর ইরফান মিলে ঘর সাজাল। ইরফান মেহরীনকে দেখে অবাক না হয়ে পারছে না। আয়াম তার নিজের কেউ হয়না। তবুও মেহরীন আয়ামের জন্য যা যা করছে তার কোন প্রতিদান হয়না।

“শুনুন, আয়ামের ফেভারিট কালার কী?”

“সবুজ।”

“সবুজ! যাহ, এখন সবুজ রঙের ফুল কোথায় থেকে পাব? সবুজ রঙের পাতা আছে। আচ্ছা লতাপাতা দিয়ে ঘর সাজিয়ে দেব? আমার জানামতে সবুজ রঙের কোন ফুল হয়না।”

মেহরীন নখ মুখে দিয়ে গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে দেখে ইরফানের হাসি পেল। মেয়েটা সত্যিই ছেলেমানুষ।

“আপনি অত চিন্তা করবেন না। সবুজ রঙের ফুল লাগবে না। বেলুন দিয়ে সাজালেই হবে।”

“উঁহু। সেটা চিন্তার বিষয় না। আমি তো পিংক কালারের কেক বানিয়ে ফেলেছি। বানানোর সময় একবার ভেবেছিলাম, পিংক কালার মেয়েরা পছন্দ করে। আয়ামের যে গ্রিন কালার পছন্দ তা তো আগে জানতাম না।”

ইরফান আড়চোখে মেহরীনকে দেখছে আর বেলুন ফোলাচ্ছে। এই মেয়ে সত্যিই পাগল।
ওদিকে অনন্ত বারবার কল করেও মেহরীনকে পাচ্ছে না। পাবেই বা কীকরে? মেহরীন কাজের চাপে ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছিল। এখন তো তার ফোনের কথা মনেই নেই।
.
অনন্ত রাগ সামলাতে না পেরে সজোরে ফ্লোরে ফোন আছাড় মারল।

“কোথায় থাকিস তুই মেহু? ওই বাড়িতে তোর এত কী কাজ যে আমার কল ধরার সময় পাচ্ছিস না।”

অনন্ত হুমায়রার জন্য আগের সিম খুলে রেখেছে। হুমায়রা কিছুদিন তাকে নিয়ে টেনশন করুক। তবেই তার কাজ হাসিল হবে। আজ সে নতুন সিম নিয়েছে। সকালে মেহরীনের কাছে মিথ্যে বলেছিল যে,তার ফোন চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু এখন মেহরীন তার কল তুলছে না কেন।

“তোর সাথে কথা না বলে আমি থাকতে পারছি না মেহু। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার এমন অদ্ভুত ফিল হচ্ছে কেন আমি নিজেও জানি না।”
.
সন্ধ্যার আগে আগে হুমায়রা তার বাবাকে নিয়ে ইরফানেদর বাড়িতে আসে। এতক্ষণ মেহরীন আর ইরফান মিলে সব আয়োজন শেষ করে ফেলেছে। বাবাও আয়ামকে নিয়ে ফিরে এসেছে। ঘর সাজানো দেখে আয়াম দাদুর কোল থেকে নেমে দৌড়ে মেহরীনের কাছে আসে।

“মাম্মী, আজ কার বার্থডে? এত বেলুন! ওয়াও!”

মেহরীন আয়ামকে কোলে তুলে নিয়ে হাসল। বলল,

“তুমিই বলো না আজ কার বার্থডে।”

“পাপার?”

“উঁহু।”

“তোমার? ”

“না।”

“তাহলে কার?”

“আজ আমার আয়াম সোনার বার্থডে।”

“আমার! এই যা! আমার বার্থডে ভুলে গেছি।”

কপালে হাত রেখে আয়াম এমন ভাবে কথাটা বলল এখানে উপস্থিত সবাই হেসে ফেলল। নিজের বার্থডে ভুলে গিয়ে এখন আয়াম দুঃখের সাগরে ভাসছে।
মেহরীন ওকে রেডি করাতে নিয়ে গেল। হুমায়রাও সাথে গেল। তবে আজ হুমায়রা অন্য দিনের মত চঞ্চল না। সে গুম মেরে আছে। মেহরীন একবার হুমায়রাকে জিঙ্গেস করল।

“হুমায়রা, তোমার কিছু হয়েছে? আজ চুপ করে আছো যে। তোমার মন খারাপ? ”

হুমায়রা হাসার চেষ্টা করে বলল,

“না। তেমন কিছুই হয়নি। শুধু একটু মাথা ব্যথা করছে। আমি ঠিক আছি। তুমি আমাকে নিয়ে ভেব না।”

আয়াম মহা আনন্দে সবার সাথে কেক কাটল। কেক কেটে সে সবার আগে মেহরীনকে খাইয়েছে।
ইরফান নিজের ছেলের হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে মেহরীনকে ধন্যবাদ দিল। আজকে আয়াম এতটা খুশি হওয়ার পেছনে মেহরীনের ভুমিকাই সবচে বেশি। সে-ই আয়ামকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এতসব করেছে। মেহরীন কী কথা নিয়ে যেন আয়ামের সাথে খুব হাসছে। ইরফান ওকে দেখে মনে মনে বলল,

“সত্যিই যদি মেয়েটা অনন্তর আসল চেহারা না জেনে থাকে, তাহলে ও জীবনে ভীষণ বড় ভুল করছে। ভুল একটা মানুষকে বেছে নিয়েছে সে। অনন্তর মত নীচু মনের লোভী লোক ওকে ডিজার্ভ করে না। আমি কি ওকে অনন্তর বিষয়ে জানাব? ওকে নিয়ে আমাদের ডিলের ব্যাপারে। মেহরীন কি অনন্তকে অবিশ্বাস করে আমার কথা বিশ্বাস করবে?”

চলবে___

নাইস,নেক্সট,স্টিকার কমেন্ট করবেন না প্লিজ।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here