#মেঘের_অন্তরালে
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ০২
তাই তো বলি এমন কয়লার মতো মেয়েকে কীভাবে এমন রাজপুত্রের মতো ছেলের সাথে বিয়ে দিলো ? এতো সুন্দর পরিকল্পনা করেছে কেউ বুঝতেই পারেনি।
ভাবতে পারো এই যুগে এসে এমন বউ পাল্টানোর কাহিনী কেউ কল্পনা করতে পারবে ?
ইখতিয়ার সাহেবকে দেখে কিন্তু বুঝা যায় না উনি এমন ধোঁকাবাজি করতে পারেন।
তুমি ঐ মেয়ের কথা একবার ভাবো। দেখে মনে হয় ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। এদিকে বাপের সাথে মিলে দিব্যি এমন একটা ধোঁকাবাজি করে ফেললো।
ছেলের পরিবার ভালো ছিলো তাই এমনই এমনই ছেড়ে দিয়েছে। আমি হলে তো গোষ্ঠী শুদ্ধ জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়তাম।
ইসরা,,,,?
মায়ের ডাকে চমকে উঠলো ইসরা। নিহানের সাথে বিয়ের আজ পনেরো দিন। চলে আসার পর আর কোনো যোগাযোগ হয়নি ও বাড়ির সাথে। একটা পেপার পাঠিয়েছিলো নিহান, ইসরা না দেখেই সাইন করে দিয়েছে। আজ বসে আছে কোর্টের সামনে একটা ফাঁকা জায়গায়। এই পনেরো দিনে ইসরা ভালো করে বুঝে গেছে তার পরবর্তী জীবন কেমন হতে চলেছে। বাড়ির বাইরে বের হওয়া মুসকিল হয়ে গেছে তার পরিবারের জন্য। দশ বছরের ছোট ভাইটা সেদিন মায়ের কোলে মাথা রেখে কেঁদেছে অনেকটা সময়। ইমন নিজের আপুকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু বিয়ের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর ইসরা আর তার পরিবারের নামে ইমনকে অনেক কথা বলেছে ইমনের বন্ধুরা। ছোট ছেলেটা এসব সহ্য করতে পারেনি। বাড়ি ফিরে মায়ের কোলে মাথা রেখে নিঃশব্দে কেঁদেছে। ইসরা অনেকটা চঞ্চল ছিলো আগে কিন্তু গত পনেরো দিনে কেউ তার গলার আওয়াজ শুনেছে বলে মনে করতে পারবে না।
কী ভাবছিস তখন থেকে ? চল ভেতরে ডাকছে তোকে।
ইসরা কোনো কথা না বলে, মায়ের সাথে পা মিলিয়ে চলতে লাগলো। মেয়ের অবস্থা দেখে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে পারভীন বেগমের। এই পনেরো দিনে মেয়েটা যেনো আরো শুকিয়ে গেছে। সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখা মেয়েটার গলা শুনে না আজ পনেরো দিন। পারভীন বেগমও স্বামীর সাথে কথা বলে না। ইসরা ভেতরে গিয়ে একবার সামনে তাকালো। নিহান আর তার পরিবারের কিছু মানুষকে দেখতে পেলো। নিহান ছাড়া বাকি কাউকে ততটা চিনতে পারছে না সে। আকাশী কালারে একটা ফুল হাতা শার্ট নিহানের গায়ে। ফর্সা গায়ে শার্টটা যেনো নিজের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তুলেছে। চশমার পিছনে চোখদুটোর দৃষ্টি এই মুহূর্তে ইসরা দিকে। কপালটা পূর্বের মতো কুঁচকে গেলো ইসরাকে দেখে। গালের চাপ দাঁড়ি নিহানের সৌন্দর্য একটু বাড়িয়ে তুলেছে। ইসরা একটা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো, সত্যি তাকে মানায় না নিহানের পাশে। নিহানের পাশে হুরের মতো মেয়েই মানায়।
নিহান ইসরাকে দেখে নিজের মনে বিড়বিড় করে বলে উঠলো, প্রতারক।
ইসার কীভাবে যেনো নিহানের ঠোঁট নাড়ানো দেখেই বুঝে গেলো নিহান তাকে প্রতারক বললো। ইসরা সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো।
বিয়ের মাত্র পনেরো দিনের মধ্যে ডিভোর্স সম্ভব নয়। অন্তত তিন মাস তাদের একসাথে থাকতে হবে। এরপরও যদি তাদের মনে হয় একসাথে থাকা সম্ভব নয় তাহলে ডিভোর্সের কার্যক্রম শুরু করা হবে। এতে সময় লাগবে তিন মাস। মোট কথা তাদের একসাথে থাকতে হবে ছয় মাস।
কোর্টের নির্দেশ শুনে নিহান বিস্মিত কণ্ঠে বললো, অসম্ভব, ঐ প্রতারক মেয়ের সাথে আমি ছয় মাস কেনো একটা দিনও এক ছাঁদের নিচে থাকতে পারবো না।
নিহানের বাবা নিহানকে বুঝিয়ে বললো, ডিভোর্স পেতে হলে কিছু করার নেই। কোর্টের নির্দেশ মানতেই হবে। আর তুই একা থাকবি নাকি আমরা সবাই তো আছি বাড়িতে নাকি ?
নিহান কিছু না বলে ইসরার দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলো কোর্ট থেকে। ইসরা ক্লান্ত ভঙ্গিতে মায়ের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। কী দরকার ছিলো আবার এই ঝামেলার ? সব শেষ হয়ে গেলেই তো ভালো হতো। ঐ বাড়িতে গিয়ে তিলে তিলে শেষ হতে হবে ইসরাকে। সেটা আর কেউ বুঝতে না পারলেও ইসরা বেশ ভালোই বুঝতে পারছে।
৪.
নিজের রুমে বসে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে ইসরা। ইখতিয়ার আহমেদ একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে। বেতন ভালোই পায় আর তাতে ইসরাদের জীবন বেশ সাচ্ছন্দ্যে চলে এসেছে এতোদিন। পাঁচতলা একটা ফ্ল্যাটে থাকে ইরসা নিজের পরিবারের সাথে। তিনটা বেডরুম, একটা ড্রয়িংরুম আর কিচেন। প্রত্যেক রুমে ওয়াশরুম আছে আর একমাত্র ইসরার রুমে একটা ছোট বেলকনি, বেশ সাজিয়ে রেখেছে সেটা ফুলের গাছ দিয়ে। ফ্লোরে একটা মাদুর পাতা থাকে সেখানে ইসরা বসে থাকে মাঝে মাঝে। ইসরা বেড থেকে নেমে ধীরপায়ে বেলকনিতে গিয়ে বসলো। দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করতেই চোখের কোণ থেকে নোনা জলের ধারা বয়ে যেতে লাগলো।
মাত্র পনেরো দিন আগেই তার জীবনটা একদম অন্যরকম ছিলো আর আজ একদম ভিন্ন। ইসরা যেনো দিন দিন নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।
ফ্ল্যাশ ব্যাক
বাবা তুমি যেটা করছো সেটা একদম ঠিক নয়। এভাবে এতোগুলা মানুষকে তুমি ঠকাতে পারো না।
ইসরার বাবা কড়া গলায় বললো, আমি যা করছি তোমার ভালোর জন্যই করছি। একবার বিয়েটা হয়ে গেছে সবাই এমনই সব মেনে নিবে।
বাবা তুমি ভুলে যাচ্ছো বিয়ে হয়ে গেলেও অনেক কিছু করার থাকে। তারা চাইলেই ডি,,,
দিন দিন তুমি বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো ইসরা। এতো ভালোবাসায় আগলে রাখি বলে এতো সাহস হয়েছে তোমার। যে আদর করে সে শাসনও করতে জানে সেটা ভুলে যেও না।
কথাগুলো বলে বড় কদমে ইসরার রুম থেকে বের হয়ে গেলো ইখতিয়ার আহমেদ। ইসরাকে সব জানাতেই ইসরা পরিষ্কার মানা করে দেয় সে এভাবে কাউকে ঠকাতে পারবে না। কিন্তু ইখতিয়ার আহমেদ একরোখা মানুষ নিজের কথার উপর কারো কথা শুনতে পছন্দ করেন না। ইসরা নিজের ফোন বের করে তাড়াতাড়ি হুরকে কল দিলো।
ঘুম ঘুম গলায় হুর রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ইসরা ব্যস্ত গলায় বললো, হুর এটা তুই কী করে করতে পারলি ?
ইসরার গলা শুনে হুরের ঘুম ছুটে গেলো আর লাফ দিয়ে উঠে বসে আমতা আমতা করে বললো, তুই কী বলছিস আমি কিছু বুঝতে পারছি না ইশু।
ইসরা রেগে বললো, তুই বাবার কথায় কোনো ছেলের সাথে দেখা করেছিলি আমার পরিচয়ে ?
হুর ভয়ে ঢোক গিলে বললো, দেখ ইশু আমার কোনো দোষ নেই। ফুপা আমার হাতে ধরে অনেক অনুরোধ করেছিলো আমি কীভাবে না করতাম তুই বল ?
ইসরা ধপ করে বেডে বসে পড়লো। রাগে দুঃখে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে তার।
ইসরা চোখ মুছে ব্যস্ত গলায় বললো, ঐ ছেলের নাম্বার আছে তোর কাছে ?
আমার কাছে নাম্বার নেই কিন্তু তোর ফোনেই আছে।
ইসরা বিস্মিত কণ্ঠে বললো, আমার ফোনে আছে মানে ?
কয়েকদিন আগে আমার ফোন হারিয়ে গেছে বলে তোর আগের ফোনটা এনেছিলাম না ? সেটা ফুপার কথাতেই এনেছিলাম আর তোর ফোন দিয়েই দুদিন কথা বলেছিলাম নিহান ভাইয়ার সাথে । ফুপা কী বলে ম্যানেজ করেছে জানি না। এখন আর ফোনে কথা বলার দরকার নেই বলেছে, তাই তোকে গতকাল ফোন ফেরত দিয়ে এসেছি।
ইসরা নিজের মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এতসব করে ফেলেছে কেউ বুঝতেই পারেনি। ইসরা আর ইসরার মা আজই সব জানতে পেরেছে। আগামীকাল নিহান নিজের পরিবার নিয়ে পাকা কথা বলতে আসবে তাই সব জানিয়েছে ইসরাকে আর তার মাকে।
ভেজা গলায় ইসরা বললো, তুই যে এতোকিছু করেছিস মামা মামি জানে ?
হুর কিছুটা সময় নিয়ে বললো, ফুপা আর আমি ছাড়া কেউ জানতো না। ফুপা আমাকে অনুরোধ করেছিলো কাউকে যাতে না জানাই। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম তাই কাউকে বলতে পারিনি।
ইসরা এক মুহুর্ত লেট না করে হুরের কল কেটে দিলো। হুর আর ইসরা সমবয়সী, বোন আর বেস্টফ্রেন্ড দু’টোই। বাসা খুব বেশি দূরে নয় তাই একসাথেই থাকা হয় সবসময়। ইসরা কল কেটে হন্তদন্ত হয়ে হুরের ফেরত দেওয়া ফোনটা খুজতে লাগলো। আগের ফোনটা হারিয়ে গিয়েছিলো তাই নতুন ফোন কিনে দিয়েছিলো ইসরার বাবা। নতুন ফোন কেনার কিছুদিনের মধ্যে আগের ফোন একজন ফেরত দেয়। ইসরা ফোন পেয়ে নিহানের নাম্বার খুজতে লাগলো। নাম্বার দেখে ইসরার মুখে হাসি ফোটে উঠলো। কিন্তু যেই কল দিতে যাবে কোথা থেকে ইখতিয়ার আহমেদ এসে ছুঁ মেরে ফোনটা নিয়ে নিলো।
বাবা ফোনটা দাও।
তুমি কাকে কল দিচ্ছিলে ?
তুমি যাকে চরমভাবে ঠকাতে চাইছো ?
ইখতিয়ার আহমেদ সজোরে থাপ্পড় মারলেন মেয়ের গালে। বিস্ময়ে চোখ বেড়িয়ে আসার উপক্রম ইসরার। জ্ঞান হয়েছে পর তাকে কখনো ফুলের টোকা দেয়নি তার বাবা। আজ সেই বাবা তাকে থাপ্পড় মারলো, ইসরা বিশ্বাস করতে পারছে না।
টলমলে চোখে বাবার দিকে তাকালো, বাবা তুমি আমাকে থাপ্পড় মারলে ?
বলেছিলাম, যে আদর করে সে শাসনও করতে জানে। তোমার কোনো ধারণা আছে সব কিছু গুছিয়ে আনতে আমাকে কতো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। আর তুমি এক সেকেন্ডে সব শেষ করে দিচ্ছিলে ?
ইসরা কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরে বসে পরে বললো, বাবা তুমি বুঝতে পারছো না কেনো ? এটা ভুল, এটা অন্যায় আর তার মাশুল ভয়ংকর হবে। এভাবে আমি কখনো সুখী হতে পারবো না। আমি যেমন আমাকে সেভাবেই যে মেনে নিতে পারবে সব সত্যিটা জেনে, তার সাথে সুখে থাকবো আমি।
রাগে মুখ শক্ত করে ইখতিয়ার আহমেদ বললো, আমি এতোকিছু শুনতে চাই না। তুমি যদি আবার এই বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করো তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে। আর তোমার বাবাকে তুমি চেনো। যেটা বলে সেটা করে দেখাতেও কখনো পিছুপা হয় না।
ইসরার দু’টো ফোন নিয়েই ইখতিয়ার আহমেদ বের হয়ে গেলো ইসরার রুম থেকে। ইসরা হাঁটু মুড়ে বসে হাঁটুতে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলো। অনেক সময় কান্না করার পর উঠে হাতের উল্টো পিঠে চোখ মুছে নিলো।
তুমি যা করছো তার জন্য আমার থেকে তোমাকে বেশি আফসোস করতে হবে বাবা। সেটা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি, তুমি কাঁদবে আমার থেকেও বেশি। আমি আর কিছু করবো না তুমি যা খুশি করো আর তার পরিণতির জন্য প্রস্তুত হও।
ইসরা আর কিছু করেনি। নিহানের পরিবারের থেকে ইসরাকে সবসময় লুকিয়ে হুরকে তাদের সামনে রাখা হয়েছে। ইসরার মা বারবার ইসরার বাবাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন কিন্তু সে নিজের সিদ্ধান্তে অটল। হুরের বাবা-মা এই বিষয়ে কিছুই জানতে পারেনি। ইখতিয়ার নিজের বড় ভাইকে সব বললে সেও অনেক বুঝায় কিন্তু তাকে উল্টো অপমান করে ইখতিয়ার। সবার এতো বাঁধা উপেক্ষা করে ইখতিয়ার মেয়ের বিয়েটা সম্পন্ন করেই ছাড়েন।
ইসরা ?
কারো ডাকে ইসরার অতীত বিচরণে ব্যাঘাত ঘটালো। মাথা ঘুরিয়ে হুরকে দেখতে পেলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে৷ হুর ইসরার সামনে আসার সাহস যোগাড় করে উঠতে পারেনি এতোদিন।
হুর মাথা নিচু করে কষ্টে কাতর গলায় বললো, একজন বাবার বয়সী মানুষ যখন হাতে ধরে নিজের মেয়ের একটা সুন্দর জীবন ভিক্ষা চায়। তখন কিছু করার আছে বলে আমার মাথায় আসেনি। আমিও চেয়েছিলাম তোর সুন্দর একটা জীবন।
হুর খুব নরম মনের একজন মানুষ। ইসরা ভালোই বুঝতে পারছে তার বাবা হুরের ভালোভাবে ব্রেনওয়াশ করেছে। মেয়েটার নরম মনের খুব সুন্দর ব্যবহার করেছে। বাবার প্রতি অভিমানের পাহাড়টা ইসরার একটু একটু বেড়েই চলেছে পরিস্থিতির সাথে সাথে। হুর অসহায় দৃষ্টিতে ইসরার দিকে তাকিয়ে আছে উত্তরের অপেক্ষায়।
চলবে,,,