#মেঘবরণ কন্যা
লিখা: সুরমা
পর্ব : ৮ ( অন্তিম পর্ব)
মিহির মোবাইল বাজছে।এই সময় কে কল দিল?মিহি পার্স থেকে মোবাইলটা বের করে দেখে বাসার নম্বর।মিহি ফোনটা রিসিভ করে।
-কুসুম,বল
-আফামনি,,,হিয়া মামুনি কাঁদছে।কুসুমের কথা শোনে মিহির বুক কেঁপে উঠে।মিহি অস্থির হয়ে বলে,,,,
-কাঁদছে কেন??মিহির চোখে মুখে হঠাৎ অন্ধকার নেয়ে আসে।লেখক এবং জেমিও চমকে উঠে।
-জানিনা।তখন থেকে থামানোর চেষ্টা করছি।কিন্তু হিয়া মনি তো কেঁদেই যাচ্ছে।
-আচ্ছা হিয়াকে মোবাইলটা দে।কুসুম হিয়াকে মোবাইলটা দিলো।কিন্তু হিয়া নিলো না।তার কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেছে।হিয়ার কান্না শোনে এখন মিহির বুক আরো কাঁপতে লাগলো।কুসুম বললো,,,,
-হিয়া ফোন নেয় না আফামনি।
-তুই রাখ।আমি আসছি।মিহি পার্স নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।সাথে সাথে লেখক এবং জেমিও দাঁড়ালো।লেখক বললো,,,
-কি হয়েছে??
-আমার মেয়ে কাঁদছে।আমাকে বাসায় যেতে হবে।
-কেন?কি হয়েছে???
-জানি না
-আমি যাবো আপনার সাথে??
-দরকার হবে না।আসি।মিহি ওদের থেকে বিদায় নিয়ে কফিশপ থেকে বের হয়ে যায়।লেখক জেমির দিকে তাকিয়ে বলে,,,,,
-তোর এতো সুন্দর একটা বান্ধবী আছে আমাকে তো আগে কখনও বলিস নি।
-বললে কি হতো???
-কি আর হতো,বিয়ে হতে দিতাম না।আমার মায়ের জন্য নিয়ে যেতাম।লেখক হাসলো,,,জেমি বললো,,,
-তুই কি মিহির প্রেমে পড়লি নাকি??
-পড়েছিলাম বাট লাভ হলো না।ওরতো বিয়ে হয়ে গেছে।একটা বাচ্চাও আছে।জেমি বললো,,,,
-বাচ্চা আছে ঠিক তবে বিয়ে হয়নি।এবার লেখক অবাক হয়ে গেলো।
-বিয়ে হয়নি মানে???আর বিয়ে না হলে বাচ্চা এলো কোথায় থেকে???
-কাউকে জন্ম দিলেই মা হওয়া যায়?নয়তো মা হওয়া যায় না???লেখকের চোখ গোল হলো।তার চোখে হাজার রকমের প্রশ্ন। জেমি বললো,,,,,
-বাচ্চাটা ওর না।আর ওকে যেমন দেখছিস ওও কিন্তু এমন না।
-তাহলে বাচ্চাটা কার???আমাকে সবটা ক্লিয়ার করে বল,,,,
-শোন,বলছি,,,,,,,
মিহির সব আছে।মা,বাবা ভাই।ওও স্ট্যান্ডার্ড ফ্যামিলির মেয়ে।মিহির বাবা একজন ব্যাংকার ছিল।আমি মিহি আর তনয়া খুব ভালো ফ্রেন্ড ছিলাম।আমরা তিনজন এক কালার জামা পরতাম সব সময়। ভার্সিটিতে এক সাথে যেতাম আসতাম।আমারা তখন সবেমাত্র পড়াশোনা শেষ করেছিলাম।আর ভার্সিটি লাইফে তনয়ার রিলেশন ছিল ফাহাদের সাথে।ওরা রুম ডেটও করেছিল।বাট আমরা জানতাম না।কিন্তু আমরা যখন পাস করে ভার্সিটি থেকে বের হয়েছিলাম তখন হঠাৎ একদিন তনয়া আমাদের বললো সে কনসিভ করেছে।তখনও ফাহাদের সাথে তার বিয়ে হয়নি।তখন তনয়া ফাহাদকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে থাকে।বাট ফাহাদ বলে এখন তার পক্ষে বিয়ে করা সম্ভব না। সে যেন এভরশন করায়।বাট তনয়া কিছুতেই রাজিনা। তনয়ার ডিডি ডেট এগিয়ে আসছে। ততদিনে তাদের পরিবারো জেনে ফেলে তাদের রিলেশনের কথা। স্পশালি তনয়ার ফ্যামিলি। তারাও বাচ্চাটা নষ্ট করতে বলে। কিন্তু তনয়াকে কেউ বুঝাতে পারে না। অবশেষে তনয়াকে তার পরিবার ত্যাগ করে। বাড়ি থেকে বের করে দেয়। অন্যদিকে ফাহাদও দেশের বাইরে চলে যায়। তনয়ার পাশে কেউ ছিল না। তনয়া থাকার কোনো জায়গাও ছিল না। তখন মিহি তনয়াকে তার বাসায় নিয়ে যায়।সেখানেও অনেক ঝামেলা। মিহির পরিবারের লোকজনেরও খারাপ লাগতে থাকে। কিন্তু মিহির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেও পারে না। অবশেষে তনয়ার ডিডি ডেট আসে। তনয়াকে হাসপাতালে এডমিট করায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়,সেদিন তনয়া বাচ্চাটার জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। কিন্তু তার শেষ স্মৃতি হিসাবে রেখে গিয়েছিল একটা সুন্দর,পরীর মতো মেয়ে। সেই ছোট্ট পরী টাই হিয়া। এখন মিহির মেয়ে।
-তা না হয় বুঝলাম কিন্তু মিহি একা থাকে কেন?? তার পরিবার????
-সেদিন তনয়ার বাচ্চাটা কোলে নিয়েছিল মিহি। তনয়ার মৃত্যুতে মিহি আঘাত পেয়েছিল। মিহির বাবা বলেছিল বাচ্চাটাকে অনাথ আশ্রমে রেখে আসতে। বাট মিহি দেয়নি। সে নিজেই বাচ্চাটাকে বড় করতে লাগলো। তখন হলো আরো বিপত্তি । তাদের বাসার আশে পাশের লোকজন এই বাচ্চা নিয়ে সমালোচনা করতে শুরু করে। এসব কথা মিহির পরিবারের কানেও আসতে লাগলো। অন্যদিকে মিহির বিয়েও ঠিক করা ছিল। অন্য কারো সাথে না। মিহি বয়ফ্রেন্ড আবিরের সাথে। এবার লেখক একটা ধাক্কা খেলো। সে একটু নড়েচড়ে বসলো। লেখক হাল্কা গলায় বললো,,,,
-বয়ফ্রেন্ড???
-হুম। বয়ফ্রেন্ড। আবির আর মিহির রিলেশন ছিল ভার্সিটিতে যাওয়ার প্রথম থেকে। চার বছর রিলেশন করার পর পারিবারিক ভাবেই তাদের বিয়েটা ঠিক হয়। দুই পরিবার মেনে নিয়েছিল। আবিরেরও ততদিনে জব হয়ে যায়।আর মিহিরও ইচ্ছে ছিল সেও জব করবে। দেন বিয়ে করবে। কিন্তু তার আগেই তাদের দুজনের মাঝে চলে এলো হিয়া। আবির মিহিকে বলেছিল বাচ্চাটা আশ্রমে দিয়ে দিতে। আর বাচ্চার সমস্ত খরচ আবির বহন করবে। কিন্তু মিহিকে কে বুঝাবে। সে এতো সুন্দর একটা বাচ্চাকে অনাথ আশ্রমে দিবে না। মিহি তখন বাচ্চাটাকে নিজের বলে পরিচয় দিতে শুরু করে। এ নিয়ে মিহির আর আবিরের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। আবির তখন বলে বাচ্চা সহ মিহিকে তার ফ্যামিলি মেনে নিবে না। মিহিও আবিরকে না করে দেয়। তখন সমাজের লোকজন তাকে নিয়ে আরো সমালোচনা করতে শুরু করে। তখন আবিরের পরিবারও বিষয়টা জেনে যায়। আবিরের ফ্যামিলি কিছুতেই বাচ্চা সহ মিহিকে মেনে নিলো না। আর এদিকে মিহিও বাচ্চাটাকে ছাড়বে না। তখন বাধ্য হয়ে আবির বিয়েটা কেন্সেল করে। কারণ,আবিরের কাছে তার ফ্যামিলির গুরুত্ব অনেক বেশি।
তখন মিহির পরিবারের সবাই ক্ষেপে যায়। তারাও মিহির প্রতি অসন্তুষ্ট প্রকাশ করে। দেন মিহির বাবা মিহিকে বলে হয়তো বাচ্চাটাকে ছাড়তে হবে নয়তো তার ফ্যামিলিকে ছাড়তে হবে। কারণ,মিহির বড় ভাই ছিল,ছোট একটা বোনও ছিল। তাদেরও ভবিষ্যৎ আছে। বিয়ে না হওয়ার সত্ত্বেও একটা মেয়ের বাচ্চা আছে এটা শোনার পর কোনো ফ্যামিলি তাদের সাথে আত্মীয়তা করতে আসতো না। কিন্তু মিহি তখন বাচ্চাটার নেশায় এতই বিভোর ছিল যে সে নিজের ফ্যামিলিকেও ছাড়তে রাজি। কিন্তু বাচ্চা টাকে না। তাই সে বাচ্চা টাকে কোলে নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসে। জেমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। লেখক স্তব্ধ হয়ে গেলো। তবে লাস্ট পর্যায়ে এসে লেখকের মুখে হাসি ফোটলো। সে যেন আসার আলো দেখতে পেলো। মনে হচ্ছে আল্লাহ নিজে থেকে একটা সুযোগ দিয়েছে তাকে। মিহিকে আপন করে নেওয়ার। লেখক বললো,,,,
-মেয়েটা জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। প্রিয়জনকে হারানোর মতো কষ্টও সে পেয়েছে। আর না।
-কি করবি তুই??
-মিহির বাসা চিনিস তুই???
-হুম, কেন??
-আমাকে নিয়ে যা মিহির বাসায়। দরকার আছে।
-এখন??
-হুম।
-আচ্ছা চল। জেমি লেখককে নিয়ে মিহির বাসায় রওনা দেয়।
মিহি এসে হিয়াকে কাঁদতে দেখেছিল। হিয়ার কান্না মিহির গহীন থেকে গহীনে আঘাত হেনেছিল। মিহি দৌঁড়ে এসে হিয়াকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে নেয়। মিহিকে কাছে পেয়ে হিয়াও শান্ত হয়ে যায়।
হিয়া আর মিহি খেলনা নিয়ে খেলা করছে। এমন সময় কলিং বেল বাজতে থাকে। মিহি বেশ অবাক হয়। কারণ এই সময় বাসায় কেউ আসার কথা নয়। মিহি কুসুমকে বলে,,,
-দেখতো কে এসেছে।কুসুম গিয়ে দরজা খুলে দেখে জেমি দাঁড়িয়ে আছে। সাথে একটা ছেলে। কুসুম জোরে বলে,,,,
-আফামনি,জেমি আফা আইছে।সাথে জানি আরেকজন কে আইছে। মিহি অবাক হয়ে বলে,,,,
-আরেকজন কে?
-আমিতো চিনি না।
-আচ্ছা আসতে বল। মিহি খেলা রেখে উঠে দাঁড়ায়। লেখক আর জেমি দুজনে রুমে প্রবেশ করে। লেখক কে দেখে মিহি এবার অবাক। মিহি বলে,,,,,
-আপনি আমার বাসায়???
-বলেছিলাম না একদিন আসবো চা খেতে। দাওয়াত ছাড়াই চলে এলাম। লেখক খেয়াল করলো হিয়া খেলা করছে। লেখক কোনো কথা না বলে হিয়ার পাশে গিয়ে বসে। নিজের পকেট থেকে চকলেট বের করে হিয়ার সামনে ধরে। হিয়া একবার চকলেটের দিকে,একবার লেখকের দিকে তাকিয়ে আবার মিহির দিকে তাকায়। মিহি চোখ দিয়ে ইশারা করলে হিয়া চকলেট গুলো নেয়। লেখক বলে,,,,
-তোমার নাম কি???হিয়া আধো আধো কণ্ঠে বলে,,,,
-আমার নাম হিয়া, তোমার নাম কি??হিয়ার কথা শোনে লেখক হেসে দেয়। লেখক হিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,,,
-আমার নাম লেখক। আমি তোমাকে মাম্মাম বলে ডাকবো। কেমন??? লেখকের কথায় হিয়া কিল কিল করে হেসে বলে,,,,
-আমার মাম্মাম আছে। আমি চুটু।
-আমি জানিতো। তুমি আমার চুটু মাম্মান কেমন??লেখক হিয়ার গালে চুমু খায়।
-আচ্ছা। আমি তোমাকে কি বলে ডাকবো??? হিয়ার কথা শোনে লেখক একটা হাসি দিয়ে মিহির দিকে তাকায়। মিহি তার দিকেই চেয়ে ছিল। তারপর লেখক যা বললো তার জন্য মিহি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। লেখক বললো,,,
-তুমি আমাকে পাপা ডাকবা। আমি তোমার পাপা। লেখকের কথায় মিহি হা হয়ে যায়। জেমি মিষ্টি করে হাসে। জেমির হাসি শোনে মিহি জেমির দিকে তাকালে জেমি চোখ বন্ধ করে মিহিকে আশ্বাস দেয়। মিহি চলচল চোখে লেখকের দিকে তাকালে লেখক বলে,,,
-এই যে ম্যাডাম,আমি একজন ভালো বাবা হতে পারবো ঠিকাছে??? আর আপনার মেয়েও আমার মতো ভালো,রেডিমেড বাবা পাবে। আমি কিন্তু এতটা খারাপ বাবা না। সো চোখে পানি না। মিহি এবার মিষ্টি করে হেসে মাথা নিচু করে ফেলে। লেখক হিয়াকে কোলে নিয়ে তার মাকে কল করে।নাজনিন আরা ফোন রিসিভ করলে লেখক বলে,,,,
-এই যে আমার মা জননী,,, তাড়াতাড়ি বরণ ঢালা সাজাও। আপনার বউ এবং নাতনি নিয়ে আসতেছি।কথাটা বলে লেখক হাসলো,সাথে মিহি এবং জেমিও।
সমাপ্ত-