#মেঘফুল_৮
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার
______________________________________

নিশুতি রাতে ঝিঁঝিঁপোকা ডাকে। মেঘমুক্ত আকাশে জ্যোৎস্নার ফুল ঝরে। হ্যাঁ মাঝেমধ্যে একটানা ভেক ও ঝিল্লির ডাক শোনা যায়। ক্ষণকাল পর সেই ডাক আবারও নীরব হয়ে যায়। পরিবেশে নিস্তব্ধতা এখন বিরাজ করছে। পাখপাখালি গাছের আড়ালে নীরবে তাদের প্রভুর উপাসনা করে যাচ্ছে। তার মধ্যে একটি মেয়ে ঘুমহীন চোখে বেলকনির গ্রিলে হাত রেখে,দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তাঁরায় ভরপুর রাতের বিশাল আকাশের দিকে অপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলতে লাগলো,” ওগো মাবুদ! আমার জীবনটা এরকম কেন আমি জানি না। সবই তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী চলছে। তোমার অপরুপ সৃষ্টির মেঘ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া খন্ড খন্ড বরফ গলে গিয়ে বৃষ্টির ন্যায় ফুল,রহমত হয়ে পৃথিবীর বুকে ঝরে পড়ে। এই বৃষ্টি নামক ফুলের ন্যায় আমার চোখ দিয়েও মেঘফুল ঝরে পড়ে! কিন্তু তোমার মেঘের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া খন্ড খন্ড বরফ যখন পৃথিবীর বুকে ফুল হয়ে ঝরে পড়ে, আর পৃথিবীর মানুষ তা স্পর্শ করে তখন তোমার হাবিবের, আমার রাসূলের সুন্নাহ পালন হয়,সওয়াব হয়! তেমনি আমিও চাই মেঘের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া খন্ড খন্ড বরফের ন্যায় আমার প্রিয়তমের মনটাও যেন গলে যায়। সে যেন বৃষ্টি স্বরুপ তোমার রহমত হয়ে আমার কাছে আসে। আর তার প্রতিটা স্পর্শে বৃষ্টির স্পর্শের ন্যায় সুন্নাহ পালন করতে চাই। তাকে নিয়ে চিরস্থায়ী জান্নাতকে খুঁজে পেতে চাই। তবেই তো আমার প্রিয়তম মেঘালয়ের জীবন নামক গল্পের নাম হবে ‘মেঘফুল’!

জান্নাত শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে তার রুমে ঢুকলো। এরমধ্যেই একটা জায়গায় তার চোখ আটকে গেলো। ও দেখলো ওয়ারড্রবের উপর একটা ডায়েরি রাখা। জান্নাত চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো একবার। তারপর সন্তপর্ণে যারপরনা ছাড়াই দ্বিধাহীনভাবে ডায়েরিটা হাতে নিলো। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখলো প্রথম পাতায় লেখা,”তোমার হাসিমাখা মুখখানা দেখলে আমার হৃদয়টা প্রশান্তিতে ভরে যায়!” দ্বিতীয় পাতায় লেখা,”প্রভা তুমি ভীষণ সুন্দরী! তোমার প্রতি আমি মুগ্ধ।” তৃতীয় পাতায় লেখা,” তুমি কেন আমাকে ডিভোর্স দিলে? তোমাকে কতটা ভালোবাসি সে কি জানো না? আরেকটু সহ্য করলে কি হতো?”

জান্নাত আরও কয়েকটা পাতা উল্টিয়ে দেখলো আর কোনো লেখা আছে কি না। কিন্তু আর কোনো লেখা নেই। ডায়েরিটা পড়ে তার মনে এখন বহু প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারছে। সে মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,” প্রভাকে তিনি ডিভোর্স দেন নি বরং প্রভা নিজেই তাকে ডিভোর্স দিয়েছে! বড়ই আশ্চর্য হলাম আমি! একটা মানুষ তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে অথচ প্রভা তাকে ডিভোর্স দিয়ে দিলো? কিন্তু কেন? এমনটা নয়তো যে,মেঘালয়ের পরিবারের অদ্ভুৎ নিয়মকানুন? কিন্তু এই অদ্ভুৎ নিয়মকানুন এর জন্যই কি শুধু কেউ তার ভালোবাসার মানুষকে ছেড়ে দিতে পারে? নাহ আমার মাথা ধরছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাবো।” বলে ডায়েরিটা আগের জায়গায় রেখে দিলো। পরক্ষণেই সে কাতর হয়ে বিড়বিড় করে বললো,” ছোটবেলা থেকেই আমার অগ্নিপরীক্ষা আরম্ভ হয়। আজও বিধাতা আমাকে সেই পরীক্ষায় ফেলে রেখেছেন। আমি কবে এর থেকে মুক্তি পাবো জানি না। তবে আমি একটা দ্বীপের ন্যায়। আর যে দ্বীপ জ্বলার জন্য হয়েছে তার তেল অল্প হয় না; রাত্রিভোর জ্বলে তবে তার নির্বাণ!” সে চোখ দু’টি বন্ধ করে বললো,” আমি আশ্রয় প্রার্থনা করছি ঊষার প্রতিপালকের কাছে [১]। অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া’তায়ালা যেমন রাতের অন্ধকারকে দূরীভূত করে দিনের উজ্জ্বলতা নিয়ে আসতে পারেন,তেমনি তিনি ভয় ও আতঙ্ক দূর করে আশ্রয় প্রার্থীকে নিরাপত্তা দান করতে পারেন। অথবা মানুষ যেমন রাত্রে এই অপেক্ষা করে যে, সকালের উজ্জ্বলতা এসে উপস্থিত হবে, ঠিক তেমনিভাবে ভীত মানুষ আশ্রয় প্রার্থনার মাধ্যমে (নিরাপত্তা লাভে)সফলতার প্রভাত উদয়ের আশায় থাকে[ফাতহুল ক্বাদীর]।

সে মনে প্রবল জোর সঞ্চয় করে বললো,” অজ্ঞতার অন্ধকার যখন সমগ্র আত্মাকে আচ্ছাদিত করে ফেলে, আল্লাহ্‌র হেদায়েতের আলো তখন সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে আত্মাকে আলোকিত করে।অন্ধকার অস্থায়ী। কর্মচঞ্চল জীবনকে আলোর প্রতীক হিসেবে কল্পনা করা যায়। আর এই জীবনের মূল কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে আল্লাহ্‌র হেদায়েতের আলো। আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে মেঘকে দ্বীনের পথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাবো। আমি আশাবাদী। প্রভা কেন তাকে ডিভোর্স দিয়েছে আমি এর মূল কারণটা খুঁজে বের করবই। আর আমার মেঘকে আমার করে নিয়ে,মেঘালয় থেকে মেঘফুল হিসেবে গড়ে তুলবো ইনশাআল্লাহ!

রাত এখন এগারোটা। এরমধ্যেই মেঘালয় রুমে এসে ঢুকলো। তার শরীর থেকে মিষ্টি একটা স্মেল চারদিকে ভেসে বেড়াচ্ছে। গভীর দৃষ্টিতে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে হেঁটে আসছে । চোখে চোখ পড়তেই জান্নাত বিব্রত হলো। মেঘালয়কে কেমন মাতাল টাইপ মনে হচ্ছে তার। এই মূহুর্তে সে অনুভব করছে, তার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। জড়তা তাকে ঘিরে ধরেছে। সোফা থেকে সে উঠতেও পারছে না। যেন অশরীরী কেউ তাকে ধরে-বেঁধে বসে আছে। এদিকে মেঘালয় এক পা দু’পা করে তার দিকে এগিয়ে আসছে। জান্নাতের পাশের সোফায় গম্ভীর হয়ে বসলো। একটানে জান্নাতকে তার কোলে এনে বসালো। কপালের সামনে থাকা অবাধ্য চুলগুলো পরম আবেশে কানের পাশে গুঁজে দিলো। জান্নাত তার স্পর্শে প্রকম্পিত হলো। বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়ছে। সে কোনো বাঁধা দিলো না। তার মনে হচ্ছে আজ তার প্রণয়ের রাত! একটা অবিশ্বাস্য কান্ড ঘটিয়ে ফেললো মেঘালয়। জান্নাত যেন বিশ্বাস করতেই পারছে না,মেঘালয় তার কপালে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিয়েছে। কত গাঢ় সেই আলিঙ্গন। কত যত্নের,গভীর আবেশের সেই আলিঙ্গন। এই প্রথম মেঘালয় তাকে এতটা কাছে টেনে নিয়েছে। একের পর এক অবাক হচ্ছে জান্নাত। আরও অবাক হলো যখন মেঘালয় তাকে পাঁজা কোলে নিয়ে বিছানায় এনে বসালো। জান্নাত শুধু বিস্মিত চোখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেঘালয় জান্নাতের অমন বিস্মিত আর নিষ্পাপ চক্ষু দেখে মুচকি হাসলো। ঘোর লাগা কন্ঠে বললো,” অবাক হচ্ছো জান্নাত? অবাক হওয়ার কিছু নেই। আমাদের মন পরিবর্তনশীল। আজ তোমাকে নতুন এক জগৎ দেখিয়ে আনবো। এ রাতটা হবে আমাদের কাছে সেরা একটি রাত। হ্যাঁ আজ আমাদের প্রণয় হবে! জান্নাত কিছু বলতে পারলো না। লজ্জায় তার মাথা নুইয়ে পড়েছে। মেঘালয় তা দেখে ফিচেল হাসলো। তাদের প্রণয় দেখে রাতের আকাশে থাকা তাঁরা-রাও যেন মিটমিট করে হেঁসে উঠলো!

ফজরের আগে গোসল করে নিলো জান্নাত।তারপর আজান হলে নামাজ পড়লো। ভোর বেলা বেলকনিতে গিয়ে কেদারায় বসলো। শীতপ্রভাতের স্নিগ্ধ রৌদ্র যেন প্রিয়মিলনের উত্তাপের মতো তার সমস্ত শরীরকে চরিতার্থ করে দিলো। রাতের ঘটনাটা মনে পরতেই সে ভীষণ পুলকিত হলো। এক ফালি লজ্জা তাকে ঘিরে ধরলো। ওষ্ঠদ্বয়ে স্নিগ্ধ-মিষ্টি হাসির ঢেউ খেলে গেলো। সে নিশ্চিন্তমনে শশব্যস্ত হয়ে উঠলো রান্না ঘরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বেচারি জানেও না আজ তার কপালে কি আছে। এত সুখ কি সে আধো সইতে পারবে?

জান্নাত রান্না ঘরে এসে দেখলো তার শাশুড়ী রুটি বেলছেন। সে শুকনো ডুব গিলে এগিয়ে গেলো সামনে। রুবি একটা ধমক দিয়ে বললেন,” এত বেলা করে কেউ ঘুম থেকে উঠে? কেন এসেছো রান্নাঘরে? আজ সারাদিন ঘুমোলেও পারতে। কামচুন্নি মেয়ে কোথাকার!”

জান্নাতের চোখে নোনা পানি টলমল করছে। ও কি বলবে? বুঝতে পারছে না। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে শেষে কিছু না বলে চা বানাতে গেলো। চা বানিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে রুবিকে বললো,” মা আপনার চা নিন!”

রুবি একটা চামচ নিলেন। তারপর চা নেড়ে বললেন,” এত দুধ দিয়ে কেউ চা পান করে? আরেকটু কম দিলে কি হতো? বাবার বাড়িতে তো মনে হয়না কোনোদিন চা পান করেছো! তাই পরের ঘরে এসে এত অপচয় করছো।”
জান্নাত দৃষ্টি নত করে বললো,” মা আপনি আমার ভুল ধরেছেন। আমাকে শুধরানোর সুযোগ দিন। দয়া করে আমার বাবার বাড়ি নিয়ে কিছু বলবেন না!”

রুবি কটমট করে বললেন,” একশোবার বলবো। আমি কেন শুধরানোর সুযোগ দিবো? তোমার মা তোমাকে কেন চা বানানো শেখায়নি? যেমন মা তেমন তার মেয়ে!”

রুবির শেষ কথাটি শুনে জান্নাত সহ্য করতে পারলো না। চোখের জল আর বাঁধ মানলো না। ও নিঃশব্দে তার রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমে এসে কান্নায় ভেঙে পরলো। মেঘালয় তখনও পরে পরে ঘুমোচ্ছিলো। জান্নাতের হেঁচকি তোলার শব্দে তার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটলো। তারপর অবিশ্বাস্যকর একটি কাজ করে বসলো!
___
রেফারেন্সঃ-
[১] সূরা আল ফালাক,আয়াত:০১

চলবে………

বিঃদ্রঃ ভুলক্রটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। গঠনমূলক মন্তব্য করবেন। দেরি করে দেওয়ার জন্য দুঃখীত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here