#মেঘফুল_৩
#লেখনীতে_উম্মে_সুমাইয়া_আক্তার।
______________________________

আর তখনই সে নিজেকে সামলে নিলো। তার সময় এখন পরীক্ষা দেওয়ার। এরজন্য প্রয়োজন ধৈর্য আর মনোবল। বিদায়ের পালা শেষ হলো। যে বাবা বিয়ের আগমুহূর্তেও কঠিন ছিলেন সেই বাবাই মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় হাউমাউ করে কেঁদেছেন। হাজার হোক মেয়েতো। একবার না কাঁদলেও আরেকবার ঠিকই নিজের অস্তিত্ব-রক্তের টানে কাঁদবেন! জান্নাত তার বাবার কান্না দেখে মন থেকে সব অভিমান ভেঙে সেও বাবার গলা জড়িয়ে অনেক কেঁদেছে। জিসান তো বোনকে ছাড়তেই চাইছিল না। জান্নাতের আঁচলে শক্ত করে ধরে বসেছিল। রাবেয়া ছেলেকে বুকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললেন। অনেক কষ্টে শাড়ীর আঁচল জিসানের মুঠোয় থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছিলেন। দীলু আর নীলুও অনেক কেঁদেছে।

বিকাল ঘনিয়ে সন্ধ্যায় জান্নাত তার শশুর বাড়িতে পা রাখলো। তাদের বাড়ির মতো এ বাসাতেও লোকজনের এত সমাগম নেই। নিরিবিলি পরিবেশ। মাঝে গাড়ির হর্ণের শব্দ। গাড়ি থেকে নামলে তার শাশুড়ী পুরনো সংস্কৃতি ধরে তাকে বরণ করে নিলেন। তারপর মেঘালয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন-” বাবা এ বংশের নিয়ম অনুযায়ী তুই তোর বউকে কোলে নিয়ে ঘরে আয়।”

মেঘালয় এসব পুরনো দিনের নিয়মকানুন একদমই পছন্দ করে না। সে একরাশ বিরক্তি নিয়ে বললো-” কিন্তু মা আমি এখন টায়ার্ড। এই মূহুর্তে ওসব নিয়ম টিয়ম আমি মানতে পারছি না!”

মেঘালয়ের বাবা চোখ লাল করে ছেলের দিকে তাকালেন। মেঘালয় তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়। বাবার ওরকম চাহনি দেখে আমতা আমতা করে বললো-” ঠি-ঠিকাছে নিচ্ছি! ”

মেঘালয় মুখ খিঁচে জান্নাতকে টুপ করে পাঁজা কোলে নিলো। মেঘালয়ের মা রুবি এবং তার দুই বন্ধু ফিক করে হেঁসে উঠলো। এদিকে লজ্জায়-অস্বস্তিতে জান্নাতের দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম।

মেইন ডোর পেরিয়ে ভেতরে আসলে,মেঘালয় জান্নাতকে নামাতে চাইলো। কিন্তু রুবি চেঁচিয়ে বললেন-” আরে আরে এখানে নামাচ্ছিস কেন! একেবারে তোদের রুমে নামাবি।”

রাগে মেঘালয়ের শরীরটা জ্বলে যাচ্ছে। পাছে বাবা কিছু বলবেন বলে কিছু বলতে পারছে না। তাই রাগ চাপা দিয়ে হন হন করে হেঁটে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। রুমে এসে জান্নাতকে নামিয়ে দিয়ে,বিছানায় ধপ করে পরলো। রুবি ছেলের অবস্থা দেখে হেঁসে ফেললেন। তারপর জান্নাতের কাছে এসে বললেন-” তুমি কিছু মনে করো না মা। ও একটু এরকমই!” জান্নাত উত্তরে কিছু বললো না চুপ করে রইলো। রুবি রুম থেকে চলে গেলেন। মেঘালয় একবার আড়চোখে জান্নাতের দিকে তাকিয়ে বিছানা থেকে উঠে পরলো। গায়ের শেরওয়ানী খুলে শাওয়ার করার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকলো। জান্নাত দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা তুলে রুমটা একবার পরখ করলো। রুমটা বেশ বড়সড়। দামী দামী আসবাবপত্রে ভরপুর। সাধারণত একটা ছেলের রুমে যতটুকু আসবাবপত্র থাকার কথা, তার চেয়েও মেঘালয়ের রুমে একটু বেশিই। মেয়েলী পরিবেশের মতো মনে হচ্ছে। ওর কাছে কেমন যেন একটা খটকা লাগছে। পরক্ষণেই বললো-” ধুর ফালতু চিন্তা-ভাবনা করছি! এসব ভাবতে না ভাবতেই মেঘালয় তোয়ালে চুল মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো। গলা খাঁকারি দিয়ে আমতা আমতা করে জান্নাতকে জিজ্ঞেস করলো-” উমম তোমার নামটা যেন কি…আহা মনে পরছে না!”

জান্নাত মিন মিনে গলায় বললো-” জান্নাত….সিদ্দিকা জান্নাত।”

মেঘালয় ঠোঁটের কোণে প্লাস্টিক মার্কা হাসি ফুটিয়ে বললো-” বিউটিফুল নেইম! যেটা বলছিলাম তুমি কি গোসল করবা?”

এত কথা থাকতে উনি গোসলের কথা বললো? হোয়াট দ্য হেল! তাছাড়া সকালে আমি গোসল করেই আসছি।আরেকবার করলে নির্ঘাত সর্দিকাশি হবে। উনি কথাটা মন্দ বলেননি,কিন্তু এখন গোসল করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়!” জান্নাত মনে মনে এসব ভেবে কপাল কুঁচকালো।
মেঘালয় কোনো উত্তর না পেয়ে আবারও বললো-” না মানে সারাদিন অনেক দখল গেছে তো। গোসল করলে শরীরটা ফুরফুরে লাগতো। এই দেখো আমিও গোসল করেছি। খুব ভালো লাগছে এখন।”বলে হেহে করে দাঁত কেলিয়ে হেঁসে বেলকনিতে চলে গেলো।

জান্নাত থ মেরে কতক্ষণ বসে রইলো। একটু পরে মাগরিবের আজান পরবে। এখন অজু করা প্রয়োজন। বিদায়ের আগে সে বাড়িতে আছরের নামাজ পড়েছিল। ও বিছানা থেকে উঠে হাস ফাঁস করছে কি করবে। এর মধ্যেই রুবি এসে বললেন-” বৌমা একটু পর আজান দিবে তুমি অজু করে নাও। আর হ্যাঁ লাগেজের চাবি দিতে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। এই নাও চাবি।” বলে জান্নাতের হাতে তার চাবি দিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। জান্নাত বিড় বিড় করে নিজেকে নিজেই বললো-” আচ্ছা উনি কি নামাজ পড়বেন না?”
পরক্ষণেই মন খারাপ করে মনে মনে বললো-” যে লোকের মুখে দাঁড়ি নেই, সে যে নামাজ পড়বে এটা আশা করা নিতান্তই বোকামি!”

ও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটুখানি জড়তা নিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ওয়াশরুমে গেলো অজু করার জন্য।

এদিকে মেঘালয় বেলকনিতে এসে মাথার চুল টানছে। বাবার প্রতি তার চরম বিতৃষ্ণা। তার হৃদয়টা তিনি জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছেন। জান্নাতের সাথে কথা বলা-হাসি এ সবই তার অভিনয়। অকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবে কি না, এটা নিয়ে সে দুটানায় আছে। বিয়ে তো করতেই চায়নি শুধুমাত্র তার বাবার ভয়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। ও ভেজা তোয়ালটা বেলকনির এক কোণে ছুড়ে মারলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে প্যান্টের পকেটে হাতিয়ে সিগারেট আর লাইটার খুঁজছে। এক পকেটে না পেয়ে অন্যটা চেক করলো। কিন্তু পেলো না। শেষে টুলের উপরে তাকিয়ে দেখলো,সকালে যেভাবে লাইটার আর সিগারেটের বাক্সটা রেখে গিয়েছিলো, ওগুলো ওভাবেই পরে আছে। ও চট করে একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে আবার টুলের উপর রেখে দিলো। সিগারেটে দু’টো টান মারলো। ধোঁয়াগুলো নাক-মুখ থেকে আঁকিবুঁকি হয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। ও ধোঁয়া গুলো ফু দিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিলো। মেঘালয় একা একা কথা বলতে লাগলো-” আমিও তো সিগারেট আর তার ধোঁয়ার মতো একজনকে আপন করে নিয়েছিলাম। তারপর আমার বাবা আমার জান পাখিটাকে তাড়িয়ে দিলেন!” কথাগুলো বলে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। প্রভার কথা খুব মনে পরছে তার। কে জানে বেচারি কেমন আছে! প্রভা সিগারেট খাওয়া থেকে শুরু করে সিগারেটের গন্ধ একদম সহ্য করতে পারতো না। কিন্তু ধুমপান মেঘালয়ের অনেক দিনের অভ্যাস। তাই ছেড়ে দিতে পারেনি। তাই যখন সে সিগারেট পান করতো, তারপরই দাঁত ব্রাশ করে চুইংগাম চিবিয়ে চিবিয়ে প্রভার সামনে আসতো। প্রভা গাল ফুলিয়ে বলতো-” এইসব ছাইপাঁশ খেয়ে কি মজা পাও? আল্লাহ মালুম!”

মেঘালয় প্রভাকে জড়িয়ে ধরে ওর মুখের সামনে তার মুখ এনে বলতো-” আচ্ছা প্রভারাণী মুখ থেকে কি এখনও সিগারেটের গন্ধ পাচ্ছো তুমি?

প্রভা আড়চোখে তাকিয়ে বলতো-” একটা গন্ধ তো পাচ্ছিই!”

মেঘালয় চুইংগাম চিবোতে চিবোতে চোখ-মুখ বড় করে বলতো-” কি বলো!

প্রভা গম্ভীর হয়ে বলতো-” এইতো চুইংগামের গন্ধ, বলে ফিক করে হেঁসে ফেলতো। মেঘালয়ও প্রভার সাথে প্রাণ খুলে হাসতো!”

এই সুন্দর অতীতের দৃশ্যগুলো তার চোখের সামনে ভেসে উঠতেই, দুচোখ ভিজে এলো। গাল গড়িয়ে মেঘফুল ঝরে পরলো। খুব কষ্ট হচ্ছে তার। সাথে সাথে সিগারেট নিয়ে ধুমসে কয়টা টান মারলো। তার মনটা বিষাদে ঘেরা। সিগারেটের স্বাদও যেন পানসে হয়ে গেলো। ও হাত থেকে অর্ধেক সিগারেট নিচে ফেলে দিলো। চোখমুখ মুছে গম্ভীর হয়ে রুমে আসলো। আজান বেশকিছুক্ষণ আগে হয়েছে। জান্নাত নামাজ পড়ছে। মেঘালয় ব্ল্যাক কালারের শার্ট গায়ে দিয়ে, ছাঁদের দিকে হাঁটা শুরু করলো। ছাঁদে এসে দেখলো…

চলবে……

ব্রিঃ দ্রঃ ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ছোট করে দেওয়ার জন্য দুঃখীত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here