#মুনিয়ার_পৃথিবী
বড় গল্প (৫ম পর্ব)
নাহিদ ফারজানা সোমা
সিনথিয়া কিছুতেই নানার বাড়ি ছেড়ে যাবেনা। কান্নাকাটি, হৈচৈ। মুনিয়াকে জাপটে ধরে আছে। মামা আর মামীর মাঝখানে সে ঘুমাতো।ঘুম ভাঙলেই মামীর আদরভরা মুখ। নানার সাথে মর্নিং ওয়াক, নানুর কত শত গল্প- রাক্ষস -খোক্কসের, দৈত্য -দানোর, পরীর রানির, সিন্ডারেলার,কত গল্প যে নানু জানে! শুধু যে গল্প বলা তাতো না, একটু পরপর চুৃুমু খাওয়া, “আমার সোনা,চাঁদের কণা,” “আমার ময়না পাখি, টিয়া পাখি” বলে আদর করা,উফ্,কি যে ভালো লাগে। সিনথি একবার বড় মামার ঘাড়ে চড়ে তো আরেকবার ছোট মামার কোলে, বানু আপু-মিনারা আপু-সখিনা খালাও যে কত্ত আদর করে! আর মামী? মামীর কথা ভাবতেই সিনথির ভ্যাঁ ভ্যাঁ কান্না।
খাওয়া,ঘুম,গোসল,টয়লেট, কাগজের নৌকা বানানো, মজার মজার ছড়া শেখা, নিত্য নতুন খেলা আবিষ্কার,গান গাওয়া সব মামীর কাছে।
“কাল সকালেইতো তোমাকে আবার নানুবাড়িতে দিয়ে যাবো,মামনি,তাহলে এতো কাঁদছো কেন মা?” মন্জুর জিজ্ঞেস করলো মেয়েকে।
“রাতে তো আবার নিয়ে যাবে বাপি।”
“আবার তো তারপরদিন সকালে চলে আসবে। প্রতিদিন চলে আসবে,সারাদিন থাকবে,আম্মু।”
“আমি রাতেও এখানে থাকবো,বাপি। আমি সবসময় মামীর সাথে থাকবো।”
“ওদিকে তোমার মামনি যে কাঁদছে তোমার জন্য? ”
“আমি মামনিকে ভালোবাসিনা।”
মুনিয়া সায়মাকে বললো,”মামনি, আপনি আর বাপি সিনথিকে দিয়ে আসুন। আপনার ছেলেও যাক। সিনথিরও জান ঠাণ্ডা হবে,আপিরও মান ভাঙানো হবে। আপি মন খারাপ করে অনেকদিন আসেননি।”
“তুমিও চলো।”
“আমি গেলে ফেরার সময় সিনথি আবার কান্নাকাটি করবে।”
অগত্যা সিনথিয়াকে নিয়ে একটা বড় দল রওনা হলো। মোর্শেদ সাহেব,সায়মা,আবরার,মন্জুর। ঠিক হলো,পরদিন সকাল নয়টার মধ্যে সিনথিয়া আবার চলে আসবে। আর প্রতি মাসে সাতদিন সিনথিয়া নানার বাড়িতে থাকবে।
শায়লা-সিনথিয়ার মধ্যে কয়েকদিন পর দেখা। শায়লা নিরুত্তাপ। হয়তো বাবা-মা-ভাই না আসলে সে মেয়েকে জড়িয়ে আদর করতো, কিন্তু এখন আবেগ প্রকাশের প্রশ্নই আসেনা। একটা বিলো কোয়ালিটির মেয়ের জন্য কি অপমানটাই না করেছে এরা।
মেয়েদের দোষ মোর্শেদ সাহেব কখনো তেমন করে দেখেন নি,বলা ভালো,দেখার চেষ্টা করেন নি। শায়লা-নায়লা ছোটবেলা হতে দাদা-দাদির সাথে বিশ্রী আচরণ করেছে,চামড়া ঝুলে পড়া বৃদ্ধ -বৃদ্ধা চারজনকে রীতিমতো অ্যাভয়েড করে চলেছে। নানা-নানি বা দাদা-দাদি আসবে শুনলেই দুই বোনের মাথা খারাপ হয়ে যেতো। গ্রামের কোন আত্মীয় এলেতো কথাই নেই। দুই বোনের
দুই ঘরের দরজাগুলো ছিলো আনকালচার্ড,গাঁইয়াদের জন্য বন্ধ। এমনকি নানা-নানি বা দাদা-দাদির সাথে এক টেবিলে বসে ভাত খেতেও তাদের ঘেন্না লাগতো। চোখে ক্যাতর জমে থাকে, মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ে,কেউ আবার পান চিবায়,ছিঃ! মোর্শেদ -সায়মা দম্পতির বাবা-মায়েদের তাঁদের বাড়িতে ঠাঁই না হওয়ার অন্যতম প্রভাবক হিসেবে শায়লা-নায়লা কাজ করেছে।
কাজের মানুষগুলোকে বেধড়ক পেটানোর ক্ষেত্রেও দুই বোনের
জুড়ি ছিলোনা। হাত দিয়ে,স্যান্ডেল দিয়ে,এমনকি কখনো লাঠি দিয়ে। নায়লাতো একবার সরকারি পিওনকে লাঠি দিয়ে দুটো বাড়ি দিয়েছিলো। দুই বোনই নিজেদের সম্পর্কে শুনতে ভালোবাসতো “তাদের খুব রাগ”, ” মেয়ে দুটো খুব জেদি”, “শায়লা-নায়লা ভীষণ মুডি” ইত্যাদি। বাবা ডেপুটি সেক্রেটারি, বাবা জয়েন সেক্রেটারি, বাবা অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি,বাবা সেক্রেটারি, মা ঢাকা ভার্সিটির গোল্ড মেডেলিস্ট, এই পরিচয়গুলো তারা মুহূর্তের জন্য ভুলতোনা,কাউকে ভুলতেও দিতো না। কিন্তু দাদা প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার, দাদি ক্লাস টু পাশ,নানা তহসিলদার, নানি ফাইভ পাশ,এসব কথা তারা মনেও আনতে চাইতো না।
এখন মোর্শেদ -সায়মা উপলব্ধি করতে পারছেন,তাঁরা বিরাট ভুল করেছেন,শায়লা-নায়লাকে মানুষ করতে পারেন নি।ছেলে দুটো যে এতো ভালো হয়েছে,তা বোধহয় দাদা-দাদি আর নানা-নানির জিনের গুণে, ওদের ভালো মানুষ হওয়ার পিছনে মোর্শেদ -সায়মার কোন অবদান নেই।
“কি বড় আম্মি,রাগ কমেনি এখনও? ”
” আমার রাগ নিয়ে তোমাদের ভাবতে হবেনা। হঠাৎ এই বাসায়
তোমরা?”
“সিনথিকে দিতে এলাম। মেয়েটাকে একটু আদর করে দে।”
“আমি আদিখ্যেতা জিনিসটা পারিনা।”
সিনথিয়ার মুখ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। মন্জুর তাড়াতাড়ি মেয়ের হাত ধরে বললো,”চলোতো মামনি,দাদা-দাদু-চাচা-চাচিকে ডেকে আনি। সবাই কতো কেঁদেছে সিনথি সোনার জন্য। ”
“খামোখা মিথ্যা বলছো কেন?তোমার বাপ-মা-ভাই-ভাবি হাত -পা ছড়িয়ে বিলাপ করেছে তোমার মেয়ের জন্য? ”
মন্জুর বললো,”বাপি-মামনি, বড় ভাইয়া,আপনারা বরং সিনথিকে নিয়েই যান। এই মহিলা আমার মেয়েকে সুস্থ হতে
দিবেনা। আর আমিও এর সাথে সংসার করতে পারবো না।”
মোর্শেদ -সায়মা আর আবরারও চরম বিরক্ত হচ্ছিল শায়লার উপর, আবরার কিছু একটা বলতেও যাচ্ছিলো, এমন সময় সিনথির দাদা-দাদি চলে আসলেন,তার প্রায় সাথে সাথেই মন্জুরের ভাবী।
“ও মা,কে এসেছে,আমাদের প্রিন্সেস চলে এসেছে, আমাদের সিনথি সোনা এসেছে,ময়না পাখি কৈ রে? দাঁড়িয়ে আছেন কেন বেয়াই সাহেব,বেয়ান সাহেবা,কতোদিন পরে এলেন! আবরার বাবা,আছো কেমন? বৌকে আনোনি?”
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলো কিছুক্ষণের জন্য।
” নীরা,টেবিলে খাবার দিতে বলো।” শায়লার শাশুড়ি তাঁর বড় বৌমাকে বললেন।
“না,না,বেয়ান,আমরা খেয়ে এসেছি। সিনথিয়াও খেয়ে এসেছে। রাতে ঘুমানোর আগে শুধু এক গ্লাস দুধ খাবে।ডাক্তার আবার চার্ট করে দিয়েছেন। সেটা মেনে চলতে হবে খুব টাইট করে। আর দরকার খুব আদর যত্ন। মন্জুরতো বাসায় মেয়েকে সময় দেয়,কিন্তু আমার মেয়েটা যদি সিনথিকে একটু কোয়ালিটিফুল টাইম দিতো…. ”
এটা-সেটা বলার পরে শায়লার শ্বশুর দরাজ গলায় বললেন,”আবরার আমাদের একেবারে রাজপুত্র, এখনতো দেখি আরও হ্যান্ডসাম হয়েছো ,কিন্তু বাবা, বৌ আমার একদম পছন্দ হয়নি। কোথায় তুমি,আর কোথায় সে। কোনদিক দিয়েই তোমার যোগ্য না। ”
আবরারের মুখ শক্ত হয়ে গেলো। মন্জুর ঐ সময়ে ছিলোনা,দোতলায় সিনথিকে নিয়ে গিয়েছিল সিনথির ঘুমন্ত ভাইকে দেখাতে।
সেই সুযোগে শায়লার শাশুড়িও স্নেহার্দ্র গলায় বলে উঠলেন,”একথা তোমার খালু একদম ঠিক বলেছেন আবরার। বেয়াই-বেয়ানের প্রথম সন্তান তুমি,তোমাকে নিয়ে তাঁদের কত স্বপ্ন ছিলো, আমাদেরও কতো আশা ছিলো, আমিতো আমার সব আত্মীয়-বন্ধুদের বলি,ছেলের মতো ছেলে হলো আবরার,এমন ছেলে লাখেও একটা মেলেনা,সে করলো এমন বিয়ে? চেহারা সুরত ব্যাপার না,আবার ব্যাপারও। নেক্সট জেনারেশনের কথা ভেবেও সুন্দর কাউকে বিয়ে করতে হয়। তোমার বাবা কেবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন, তাঁর ছেলের শ্বশুর সমান সমান না হলেও কাছাকাছি তো কিছু হবে? ফ্যামিলি স্ট্যাটাস মাথায় রাখতে হয় সবসময়। ”
শায়লার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। সে মৃদু গলায় বললো,”এসব কথা দুনিয়ার সবাই বুঝে মা,শুধু যাদের বুঝা উচিৎ, তারাই বুঝেনা। আপনি-আমি বাইরের মানুষ, আমাদের এসব নিয়ে কথা বলার দরকার নেই। ”
মোর্শেদ সাহেব উঠতে উঠতে বললেন,” আমার ছেলেকে নিয়ে দুঃখ করেন না বেয়াই-বেয়ান। মুনিয়াকে নিয়ে আমার ছেলে যেমন খুশি,আমরা বুড়া-বুড়ি তেমন খুশি। আমাদের দুঃখ আপনাদের ছেলেকে নিয়ে,মন্জুরের কথা বলছি,ওর স্ত্রী ভাগ্য ভাবলে আমাদের বড় কষ্ট হয়। আপনারা আমাদের কথা না ভেবে বরং অসুস্থ নাতনিটার কথা ভাবুন। আমরা আল্লাহর রহমতে আর আপনাদের দোয়াই খুব ভাল আছি।”
পরদিন মন্জুর এলো থমথমে মুখে।সাথে সিনথিয়া নেই। সায়মা আদর করে বড় জামাইকে বসালেন। মোর্শেদ সাহেবের মর্নিং ওয়াক শেষ। আবরার-আশরাফ অফিসে বেরোনোর জন্য প্রস্তুত। মুনিয়া সিনথিয়ার, শ্বশুর-শাশুড়ি আর নিজের নাস্তা টেবিলে গুছিয়ে বানুদের নাস্তা বাড়ছিল। বানুদের খাবার না দেওয়া পর্যন্ত মুনিয়া চারবেলার একবেলাও দাঁতে খাবার কাটেনা, বিয়ের পর হতেই সায়মার হাত-পা ধরে সে সারভ্যান্ট রুম ও বাথরুমগুলো ঠিক করিয়েছে। প্রত্যেকের জন্য চৌকি, শত বছরের পুরানো তোষক-কাঁথা ফেলে দিয়ে নতুন তোষক, বালিশ,দুইটা করে বালিশের ওয়াড়, দুইটা করে বিছানার চাদর, একটা করে কাঁথা, একটা করে লেপ,একটা করে মশারির ব্যবস্থা করেছে।মাথার উপরে ফ্যান। নতুন ট্রাংক।
মন্জুর জানালো,গতকাল সবাই চলে আসার পরে ঐ বাসায় তুফান হয়ে গেছে। সিনথিয়াকে আর এই বাড়িতে পাঠানো হবেনা এ ব্যাপারে সিনথিয়ার দাদা-দাদি ও মা একমত।
মন্জুর তিক্ত গলায় বললো,”এমনিতে আপনাদের মেয়ে সারাক্ষণ আমার বাপ-মার মুণ্ডপাত করে,আড়ালে।আবার আমার বাপ-মা শায়লাকে সহ্যই করতে পারেনা। কিন্তু কাল থেকে সবার কঠিন মিল।সিনথিয়া ওই বাড়িতেই থাকবে।”
মুনিয়াকে কেউ গত রাতের ঘটনা বলেনি। তাকে নিয়ে যে বেয়াই-বেয়াইন লেভেলেও যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে,সে ব্যাপারে সে ছিলো সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। এখন সে আর্ত গলায় বললো,”মন্জুর ভাই, সিনথি সোনা অনেক ভালো হয়ে গেছে,সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যাবে, ওর আমাকে এখন খুবই দরকার।ওকে এনে দিন।আপি ছুটি নিয়েছে?নেয়নি?খালাম্মা-খালু -নীরা ভাবীতো নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন,তার উপরে তাঁরা ট্রেইনড না যে কিভাবে সিনথিকে ম্যানেজ করতে হবে। আজ বাসায় থাকলে থাক,এতোদিন ছিলোনা দেখে কারোর হয়তো ওকে ছাড়তে ইচ্ছা হচ্ছে না,কিন্তু কাল থেকে ওকে এনে দিতে হবে।”
সায়মা মুনিয়াকে নরম গলায় বললেন,”ঠিক আছে, সিনথি আবার আসবে। মা, মন্জুরের জন্য একটু ভারি নাস্তা টেবিলে দাওতো। ও মনে হয় না খেয়ে এসেছে।”
আসলেও মন্জুর না খেয়ে এসেছে। এখান থেকে অফিস চলে যাবে। ফিরতে ফিরতে রাত। তাও শায়লাতো দূরের কথা, মা ও বলেনি,”নাস্তা খেয়ে যা।” অবশ্য মন্জুর একাই নাস্তা খায়। শায়লা তার মতো খেয়ে নেয়,কখনো মন্জুরের আগে,কখনো পরে,ব্যস্ত জীবনে এটাই স্বাভাবিক। বাবা-মায়ের বয়স হয়েছে।যদিও খুব বেশি বলা যায়না। এসময় তাঁরা প্রায় ঘুমান। সিনথি ওই বাসায় কিছুতেই খেতে চায়না, একবারে মামীর কাছে এসে খায়। কিন্তু আজকের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আজ সবাই জেগেছিল। নাস্তার টেবিলেই গম্ভীর মুখে বসেছিল। কেবল ভাবী বললো,”মন্জুর, না খেয়ে যাচ্ছ কেন? প্লিজ, খেয়ে যাও ভাই। ”
নীরা ভাবীও খুব ভাল। তবে মুনিয়া ভাবী অতুলনীয়।
আজ যে মেয়েটা কি করবে সারাদিন! কতোটা উন্নতি হয়েছিল
মানসিক ভাবে ইমব্যালান্সড মেয়েটার।
মন্জুর বললো,”মামনি,বাপি,ভাইয়ারা, কখনো আমি শায়লার সম্পর্কে কটু কথা কাউকে বলিনি, আপনাদেরও নয়,কিন্তু ওর সাথে সংসার করা আর দোজখে বাস করার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। জানিনা, একজন ডাক্তার কিভাবে এতোটা অশিক্ষিত, নিচ মানসিকতার হতে পারে। বাচ্চা দুটোর মুখের দিকে চেয়ে সব সহ্য করি,কিন্তু আর পারছি না।”
মোর্শেদ সাহেব বললেন,”এগুলো আমাদের মানুষ করার দোষ, বাবা। আর আমি তোমাদের মধ্যে অশান্তি আরও উসকে দিয়ে আসলাম। আমার অসম্ভব খারাপ লাগছে। কাল তোমাদের বাসায় ওসব কথা বলার জন্য আর অভদ্র, অসভ্য একটা মেয়েকে তোমার উপরে চাপিয়ে দেয়ার জন্য আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাচ্ছি, মন্জুর। ”
“বাপি,প্লিজ, এসব কথা বলবেন না। আমাকে আর অপরাধী করবেন না।”
“তোমার শ্বশুর ঠিক বলেছেন মন্জুর। আমরা ছেলে-মেয়েকে মানুষ করা বলতে বুঝেছি,তাদের বেস্ট ইনস্টিটিউটগুলোতে ভর্তি করানো,তাদের বেস্ট টিউটর দিয়ে পড়ানো, ফার্স্ট নিদেন পক্ষে সেকেন্ড না হতে পারলে পিটিয়ে আধমরা করে ফেলা,তাদের জন্য সবচেয়ে ভাল খাবার,ভালো ড্রেসের ব্যবস্থা করা, তাদের জন্য পৃথিবীর আর সবার হক নষ্ট করা,এমনকি বাপ-মা’র ও। আমাদের নিচ চিন্তা -ভাবনা,নিচ মেন্টালিটি, অনুদার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির জন্য মেয়ে দুটোর আজ এই অবস্থা। আমরা শিক্ষা বলতে শুধু পুঁথিগত বিদ্যা এবং সেটাকে গিলে হজম করা বুঝেছি। পুঁথিতে যা লেখা থাকে সেটাকে যদি কেউ বুঝে আত্মস্হ করে, তাও কিন্তু তার মানসিকতা, চিন্তা ভাবনা অনেক স্বচ্ছ হয়। শুকরিয়া, অন্তত ছেলেদুটো মানুষ হয়েছে, শিক্ষিত বলতে যা বোঝায়,তা হয়েছে। তবে সেখানে আমাদের কোন কৃতিত্ব নেই। ”
পাঁচ দিন কেটে গেল,সিনথিয়াকে ওরা পাঠালোনা। মুনিয়া যেতে চাইলো,মোর্শেদ -সায়মা কিছুতেই যেতে দিলেন না। জানেনতো,মুনিয়াকে নাগালে পেলে কি করবে শায়লা, কি শোনাবেন সিনথিয়ার দাদা-দাদি। নাতনির জন্য বুক ফাটছে ঠিকই, কিন্তু বৌকেতো নিদারুণ অপমানের মধ্যে ঠেলে দিতে পারেন না। নিজেরা যেতে পারতেন,কিন্তু সিনথিয়াকে জোর করে তাঁরা নিয়ে আসতে পারবেন না,নিজেদের মেয়েই সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। আরও কতো নাটক করবে,তার সম্পর্কেও ধারণা আছে তাঁদের। মা নামের কলংক। অসুস্হ মেয়েকে ডাক্তার দেখিয়ে দায়িত্ব শেষ।সারাদিন নাম, খ্যাতি আর টাকার পেছনে ছোটা। তার জিদের জন্য সিনথির সর্বনাশ হতে পারে,সেটা কি সে জানে না? অমানুষ একটা।মন্জুর, নীরার কাছ থেকে সিনথিয়ার নিয়মিত খবর পান তাঁরা। ভালো নেই সিনথি। খেতে চায়না, বেলা এগারোটা-বারোটা পর্যন্ত বিছানায়
পড়ে থাকে, চেঁচামেচি করে খুব, পাঁচ দিনে গোসল হয়নি একবারও, খেলাধূলার প্রশ্নই উঠে না, নীরা-নীরার স্বামী আর মন্জুরের কথা একটু আধটু শুনে। শায়লাকে সহ্য করতে পারেনা সিনথিয়া, সকাল আটটায় বের হয়ে চেম্বার করে রাত দশটায় বাসায় ফেরে শায়লা, ওটি থাকলে আরও দেরি হয়।
এসে ফ্রেশ হয়ে ডিনার সেরে বাচ্চাদের আদর। সিনথিয়া সেই সময়ে বিকট চিৎকার, হৈচৈ শুরু করে দেয়। শায়লা বড়জোর মিনিট পাঁচেক সহ্য করে,তারপরে সেও শুরু করে এলোপাথাড়ি চড়-থাপ্পড়,কান ফাটানো চিৎকার, সেইসাথে সিনথিয়ার মৃত্যু কামনা।
আবরার মন্জুরকে বলে,” শায়লাকে ডিভোর্স দাও। যে মা এতোটা নিষ্ঠুর,দায়িত্বজ্ঞানহীন,তাকে বাচ্চার কাস্টডি কোর্ট দেবেনা। আমরা পুরো পরিবার কোর্টে শায়লার বিপক্ষে থাকবো, তার স্বেচ্ছাচারিতা-স্বার্থপরতার অন্তত একশোটা উদাহরণ দিতে পারবো। তারপর তোমার দুই বাচ্চা আমাদের সাথে থাকবে।চাইলে তুমিও থাকবে,আমাদের আরেকটা ভাই হয়ে। কিন্তু শায়লার জায়গা এখানে হবেনা। ওর ভাগ ওকে বুঝিয়ে দিয়ে দিব,ব্যাস,দায়িত্ব শেষ। বাপি-মামনির একই মত।সিনথিয়ার ফিউচার চিন্তা করে আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি। ”
দশদিন পরে এক সকালে মন্জুর কোলে করে সিনথিয়াকে নিয়ে এলো,সাথে আলুথালু শায়লা, নীরা, সিনথির বড় চাচা।সিনথির অবস্থা ভয়ংকর, চোখ লাল,মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে, ছোট্ট শরীরটা ঝাঁকি খাচ্ছে একটু পরপর।
চলবে।