#মুনিয়ার_পৃথিবী
বড় গল্প (পর্ব ১)
নাহিদ ফারজানা সোমা
সায়মা বৌ এর কাণ্ড কারখানা দেখেন আর নিজের সাথে মেলান।মাঝে মধ্যে ভালো লাগে,মাঝে মাঝে মেজাজ তেতো হয়ে যায়। কখনো কখনো মিষ্টি কথা বলেন,আবার প্রায়ই খোঁটা দিয়ে কথা বলতে ছাড়েন না,বিশেষ করে মেয়েরা বেড়াতে এলে।
মুনিয়া তার নিজের মতোই চলে। শাশুড়ির আহ্লাদ পেলে সেও আহ্লাদ করে,শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে, সেদিন তার গুণগুণ করে
গান গাওয়া, কথা বলা, কথায় কথায় হাসা বেশি বেড়ে যায়,আবার যেদিন অপ্রীতিকর কিছু ঘটে, ওইদিনও তার মুখ হাসি হাসি থাকে, কথাবার্তাও স্বাভাবিক, শুধু পাখির মতো ছটফটানি একটু কম থাকে।
দুই ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে আবরার সবার বড়। তার বৌ এই মুনিয়া। এরপর দুই মেয়ে,শায়লা আর নায়লা। সবার ছোট আশরাফ। সায়মার দুই ছেলে ইন্জিনিয়ার,দুই মেয়ে ডাক্তার। জামাই দুজনও ডাক্তার। সায়মা-মোর্শেদ দম্পতির বড় ইচ্ছা ছিল, বৌমারা ইন্জিনিয়ার হবে। সেই স্বপ্ন ভেঙে দিয়ে আবরার বিয়ে করলো সাধারণ কলেজ থেকে বি.এ, এম.এ পাশ করা মুনিয়াকে। পরিবারটাও সাধারণ। মুনিয়ার বাবা মাঝারি পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা, মা সাধারণ গৃহিণী, চার মেয়ের মধ্যে মুনিয়াই ছোট। তেমন বলার মতো কেউ বা কিছু নেই মুনিয়ার পরিবারে। কিসে যে আবরার মজলো! এমনই পছন্দ করেছিল যে সেক্রেটারি বাবার ক্রোধ, ঢাকা ভার্সিটির গোল্ড
মেডেলিস্ট মায়ের কান্না ও অনশন, দুই ডাক্তার বোনের বিস্ময় আর তাচ্ছিল্য, ডাক্তার ভগ্নিপতিদের অনবরত বুঝানো সবকিছু উপেক্ষা করে আবরার তার সিদ্ধান্তেই অটল থাকলো। হয় মুনিয়াকে বিয়ে করবে নতুবা কখনোই সে বিয়ে করবেনা।
বিয়ের পরপর শ্বশুর বাড়িতে মুনিয়া বাঁকা কথার বন্যার মধ্যেই
বাস করতো। তবে ও ভেসে থাকতো,বানের জলে ডুবে যেতোনা। সায়মার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি, তারপরে দুই ননদিনী, খালা শাশুড়ি, মামী শাশুড়ি, ফুপু শাশুড়ি, মাঝে মাঝে
শ্বশুরও। একদিন খালাতো ননদ বললো,”কি যাদু দিয়ে বশ করলে আমাদের এতো হ্যান্ডসাম ভাইকে?আমাদের একটু শিখিয়ে দাও।আমরাও বড়শিতে রুই-কাতলা গাঁথতে শিখি।”
ননদের সাথে ঝগড়া করেনি মুনিয়া, মুখ অন্ধকারও করেনি।শুধু মুচকি একটা হাসি দিয়েছে। তারপরে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।
আরেকদিনের কথা। ফুপু শাশুড়ি বেড়াতে এসেছিলেন। মুনিয়াকে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার দুলাভাইরা যেন কে কি করেন?”
“বড় দুলাভাই কলেজের লেকচারার, মেজ দুলাভাই থানা কৃষি কর্মকর্তা, ছোট দুলাভাইও কলেজ টিচার।”
“তোমার বোনরাও প্রেম করে ছেলে ধরেছে নাকি?”
“জ্বীনা ফুপু,ওরা ছেলেধরা না। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে।”
“তা তুমি ছেলেধরা কেমন করে হলে শুনি?”
“আমার গায়ে বোধ হয় স্পেশাল কোন চুম্বক আছে ফুপু,ছেলেরা ওটার টানে ধরা পড়ে যায়।”
“কয়টাকে ধরেছো এ যাবৎ?”
“” আমি তো ধরিনা ফুপু,ওরাই ধরা দেয়।”
“কেন,তুমি খুব সুন্দরী? নিজেকে ডানাকাটা পরী ভাবো? পরীর সৌন্দর্যে ছেলেরা মুগ্ধ হয়ে যায়?আয়নায় নিজের চেহারা দেখো?”
“দেখি ফুপু।চুল আঁচড়াতে গেলে তো আয়নার সামনে দাঁড়াতে হয়।”
“খুব বেয়াদব মেয়ে তুমি। রূপের মতোই স্বভাব। তা নিজেই বলো,কি দেখো আয়নায়?”
“মোটামুটি চেহারার একটা মেয়েকে দেখি। শ্যামলা রং, ঘন চুল, পাতলা মুখ, কালো চোখ, চোখে অনেক পাপড়ি। সবচেয়ে সুন্দর লাগে মেয়েটার নিস্পাপ,সরল কিন্তু আত্মবিশ্বাসী দু’টি চোখ। ফুপু, পুডিংটা মনে হয় হয়ে গেছে। দেখে আসি।”
সায়মা ননদকে বললেন,”মহা চাল্লু মেয়ে। মুখ মিষ্টি মিষ্টি করে রাখবে,এদিকে পেট ভরা চালাকি। গুষ্টি ধরে চালাক। মেয়েকে
লেলিয়ে দিয়েছে আমার ছেলেটার মাথা চিবাতে। স্নিগ্ধা, আমি কিছুতেই বুঝতে পারিনা, আবরার কি দেখলো ঐ মেয়ের মধ্যে? না আছে রূপ, না কোন গুণ, না কোন ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড। স্বপ্নেও ভাবিনি, এ জাতীয় মেয়ে আমার বৌ হবে।ছোটোটা কি খেল্ দেখাবে,তা কে জানে?”
“ভাবী, এখন থেকেই আশরাফের জন্য মেয়ে খুঁজতে থাকো।আমি খবর নিয়েছি, ওর পছন্দের কেউ নেই। পছন্দের কেউ হোক তার আগেই সমান ঘরের মেয়ে দেখো। নইলে আবার বিপদে পড়বে।”
আবরারের সাথে সায়মা বহুদিন ভালো করে কথা বলেননি।এখন একটু একটু করে স্বাভাবিক হওয়া শুরু করেছেন।
আবরারের সামনে কেউ অপমান করেনা মেয়েটাকে। কিন্তু মুনিয়া কি স্বামীর কানে বিষ ঢালেনা?নিশ্চয় ঢালে। তাকে প্রতিদিন যে যা বলে,নিশ্চয় সে স্বামীর কানে লাগায়। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আবরারের আচরণে তো কিছু বুঝা যায়না।
মুনিয়ার বাড়ির লোকজন বেড়াতে এলে খুব নিস্পৃহ আপ্যায়ন করেন সায়মা -মোর্শেদ। তাতেও মুনিয়ার মুখ গোমড়া হয়না। সে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বাপের বাড়ির লোকদের জন্য নানা পদের খাবারের ব্যবস্থা করে, বাপের গায়ে ঢলে পড়ে,মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে, ভাগ্নে-ভাগ্নীদের বুকের সাথে জাপটে ধরে, বোনদের সাথে নানারকম আহলাদ করে। তবে ওর বাপের বাড়ির লোক এখন আসেনা বললেই চলে,মুখ ফুটে স্পষ্ট করে
কিছু বলা লাগেনি। আবরারকে অবশ্য বিয়ের পরদিনই কঠিন ভাবে বলে দিয়েছিলেন সায়মা,তার শ্বশুর বাড়িকে নিয়ে তাঁরা
আদিখ্যেতা করতে পারবেন না।
তাও মেয়ের মুখে কালি নেই। সারাক্ষণ হাসি,সারাক্ষণ ছোটাছুটি, গুণগুণিয়ে গান,শ্বশুর -শাশুড়ির সাথে গল্প জমানোর বৃথা এবং বারবার চেষ্টা, দুইদিন পরপর আসা ননদ-নন্দাইদের সমাদর, দেবরের সাথে মধুমাখা সম্পর্ক গড়ার নানা প্রয়াস। আশরাফ ভাবীকে কটু কথাও শোনায় না, আবার আপনজনের মতোও ব্যবহার করেনা। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেই চলে।
আগামীকাল সায়মার জন্মদিন। আজ রাতেই বাসায় জড়ো হয়েছে সবাই, মেয়ে -জামাইরা, আবরারের দুই খালা আর এক ফুপু পুরো পরিবার নিয়ে। মুনিয়া প্রচুর রান্নাবান্না করেছিল।
রাতে খেতে বসে সবাই মনে মনে স্বীকার করলো,মেয়ের রান্নার হাত আছে বটে। নায়লার স্বামী বলেও ফেললো,” আপনার রান্না আসলেই খুব ভালো,ভাবী।যতোবার খেয়েছি, মনে মনে বলেছি।”
নায়লার ভুরু কুঁচকে উঠলো, শুধু নায়লার নয়,বলতে গেলে প্রায় সবারই। সায়মা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন,” লেখাপড়া করে নাই, এগুলো শিখেছে। কিছু একটা তো জানতে হবে,তাইনা?আর ওদের মতো ফ্যামিলিতে ছোটবেলা হতেই মেয়েদের রান্নার ট্রেনিং দেয়। ওটাই ওদের কাছে মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট। ”
আবরার ঐ সময় ছিলোনা,তার ফোন আসায় একটু দূরে যেয়ে কথা বলছিলো। ছোট জামাই চুপ হয়ে গেলো, অন্যদের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, মুনিয়ার মুখ এক মুহূর্তের জন্য মলিন হয়ে যেয়ে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলো।
রাত বারোটায় কেক কাটা। মানুষ অনেক,কেকও কতোগুলো। মোর্শেদ আনিয়েছেন, আবরারের মেজ খালা এনেছেন, শায়লা এনেছে। এসময় মুনিয়া “সারপ্রাইজ ” বলে চিৎকার করে নিজের বানানো কেক এনে টেবিলে বসালো। আর সেই তিনতলা অপূর্ব কেকের সৌন্দর্যে বাকি তিনটি কেকের সৌন্দর্য অনেকটাই মলিন হয়ে গেলো।
পার্টির ধুম ধাড়াক্কা শেষ হলে আবরার আচমকা ঘোষণা করলো,”মামনির জন্মদিন উপলক্ষে এখন মুনিয়া গান গাইবে।ও কিন্তু খুব ভাল গান গায়। ”
মুনিয়া সবার থেকে একটু দূরে বসেছিল। প্রথমে সে একটু থতমত খেয়ে গেলো। তারপর আবরার আর নন্দাইদের অনুরোধে পরপর পাঁচটা গান গেয়ে সে থামলো। সে যখন তার অসাধারণ গলায় অসাধারণ ভঙ্গিতে গাইছিল, তখন মোর্শেদের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল, সায়মা অপলক চেয়েছিলেন পুত্রবধূর দিকে, বাকি শ্রোতারাও স্তব্ধ হয়ে শুনছিলো। যেন হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা তার বাঁশিতে সুর তুলেছে,আর সবাই সবকিছু ভুলে তন্ময় হয়ে শুনছে সেই সুর।
******************************************************************
সায়মার মনে হয় মেয়েটি কি সত্যি ভালো নাকি সবই তার অভিনয়? এতোমাস অভিনয় চালিয়ে যাওয়া সম্ভব? সায়মা ধীরে ধীরে বৌএর প্রতি দুর্বল হতে থাকেন। মাঝে মাঝে
খুব খুঁটিয়ে মুনিয়ার চেহারা খেয়াল করেন।পানপাতা মুখ, হালকা পাতলা গড়ন, শ্যামলা,মুখখানা ভারি মিষ্টি। সবচেয়ে সুন্দর চোখ দুটো। এতো কালো,এতো গভীর, বড় বড় ঘন পাপড়ি। মুনিয়ার চোখ দুটো দেখলে সায়মার একটা কথাই মনে হয়,”Angel’s eye.”
সায়মা আয়নায় নিজের চোখ দুটো দেখেন। কাঠিন্য আছে, অহংকারও। মোর্শেদ সাহেবের চোখ শীতল। শায়লা-নায়লার চোখে অহংকার, কখনো রাগের ঝিলিক,কখনো ঘৃণা, কখনো বা ভালোবাসা। মানুষের চোখ লক্ষ্য করা সায়মার একটা রোগের মতো হয়ে গেলো। নিজের স্বজনদের মধ্যে ই কতো রকমের চোখ, নিষ্ঠুর চোখ, লোভী চোখ, ধূর্ত চোখ। মুনিয়ার মতো এতো সুন্দর, উজ্জ্বল, মায়াভরা,নিষ্পাপ চোখের দেখা কোথাও পেলেন না সায়মা। মেয়েটার চোখগুলো কথাও বলে,তাও মমতা আর ভালোবাসার কথা,সহানুভূতি আর সহমর্মিতার কথা।
সেদিন হাসপাতাল থেকে নায়লা সরাসরি বাপের বাড়ি এলো। মোর্শেদ সাহেব ড্রইং রুমেই বসেছিলেন। মেয়েকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন আনন্দে। কথাবার্তার আওয়াজে সায়মা এসে মেয়েকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। বাপ-মা মেয়েকে নিয়ে এমন করতে লাগলেন যেন বহুকাল পরে নায়লাকে দেখছেন। যদিও মেয়েরা সপ্তাহে একবার-দুইবার বাবা-মায়ের আদর খেয়ে যায়।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে সায়মার হঠাৎ মনে হলো, মুনিয়ার সাথে বেশ কিছুদিন তার বাপ-মায়ের দেখা সাক্ষাৎ হয়নি। উনারা পারতপক্ষে আসেন না, আর মুনিয়াকে তিনি স্পষ্ট বলে দিয়েছিলেন, “মাসে একবারের বেশি বাপের বাড়ি যাওয়ার দরকার নেই। ” মুনিয়া অবশ্য নরম করে বলেছে,”একবার বেশি কম হয়ে যায় মামনি, তিন-চারদিন পরপরই যাবো।”
“তোমার বাপ-মায়ের দেখভালতো তোমার মেজ বোনই বেশি করে, বাসার সাথে বাসা,তা তোমার অতো চিন্তা কি?”
“চিন্তা না মামনি, কিন্তু আব্বু-আম্মুকে খুব দেখতে ইচ্ছা করে,সবসময়ই ইচ্ছা করে। আপুরা অস্থির হয়ে আপনাদের দেখতে আসে না? আমারও তো একই ফিলিং হয় মামনি। ”
সায়মার মুখে প্রায় চলে এসেছিল, “আমাদের ফ্যামিলি আর তোমাদের ফ্যামিলি? কিসের সাথে কিসের তুলনা?”
তবে তিনি বললেন না। মনে মনে তাঁকে চমকে দিয়ে মুনিয়াই বললো,”ভালোবাসাতো ধনী-গরিব, অভিজাত-অনভিজাত মানেনা,মামনি।”
নায়লাকে দেখে মুনিয়া এসে জড়িয়ে ধরলো,”ছোট আপি,কখন এসেছো?”
নায়লা নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। ঠান্ডা গলায় বললো,”আপনাকে আগেও বলেছি,আজ আবার এবং শেষ বারের মতো বলছি,এই জড়াজড়ি আমার পছন্দ না। আমাকে জড়িয়ে ধরার এখতিয়ার কয়েকজনের আছে। আপনাকে আমি এই এখতিয়ার দিইনি।”
মুনিয়া হাসিমুখে বললো,”ঠিক আছে,আর ধরবোনা তোমার পারমিশন না পাওয়া পর্যন্ত। এখন খেতে চলো। চোখের তলায় কালি পড়েছে কেন?”
সায়মা বললেন,”ডাক্তারি করাতো সহজ ব্যাপার না। চাকরি করছে,প্র্যাকটিস করছে,বাচ্চা সামলাচ্ছে, তোমার মতো তো
আরাম আয়েশে দিন পার করছে না। যাও,কথা না বাড়িয়ে টেবিলে খাবার ঠিকঠাক মতো দেওয়া হয়েছে কিনা দেখোগে।”
“যাচ্ছি, মামনি।”
মুনিয়া চোখের আড়াল হওয়া মাত্র নায়লা বললো,”একেবারে কানকাটা! কোন অপমান গায়ে লাগেনা। ”
সায়মা মেয়ের চোখের দিকে তাকালেন। বিষাক্ত দৃষ্টি।
মোর্শেদ সাহেব বললেন,”এই ক্লাসটা এমনই মা।এরা বেশি কথা বলে আর মনে করে আদিখ্যেতা করে সবার মন জয় করে নেওয়া যাবে। এই মেয়ের বিয়ে যদি ওদের লেভেলে হতো,তখন এসব খাতিরদারির ছিটেফোঁটাও ওর মধ্যে থাকতো না। ননদ বেড়াতে আসলে বরং মুখ বেঁকিয়ে দশটা কথা শুনিয়ে দিত।”
খাওয়ার টেবিলে নির্বিকার ভাবে মুনিয়াও বসলো। একেবার স্বাভাবিক। ননদের প্লেটে ভাত উঠিয়ে দিতে গেলে নায়লা কঠিন গলায় বললো, “আপনি কি একটু শান্তিতে আমার বাপ-মার সাথে আমাকে খেতে দিবেন,প্লিজ? আমার হাত আছে,নিজের ভাত নিজে তুলে নিতে পারি।আপনি আমাকে নিয়ে যদি মাথাটা একটু কম ঘামান,তাহলে স্বস্তি পাই।”
মোর্শেদ সাহেবও চড়া গলায় বললেন, ” তুমি আমাদের সব ব্যাপারে নাক গলিও না তো। হয় শান্ত হয়ে থাকো,নইলে খাবার নিয়ে নিজের ঘরে যাও।”
মুনিয়া মৃদুস্বরে বললো,”স্যরি বাপি।”
কিছুই হয়নি এমন ভাবে বাপ-মা-মেয়ে গল্প করতে করতে খেতে লাগলো। মিনারা আর বানু খাবার -পানি এগিয়ে দিতে লাগলো। সায়মা আড়চোখে মুনিয়ার চোখের দিকে তাকালেন। মুনিয়া ভাত মাখছে চুপচাপ, চোখের পাতা ভেজা, একবার চোখাচোখি হলো, নিষ্পাপ সরল চোখদুটোতে গভীর বেদনা। কিন্তু কোন রাগ,ঘৃণার এতোটুকু ছাপ নেই।
নায়লা রাতে খেয়ে গেলো। কি কারণে যেন সেদিন তার চেম্বার বন্ধ। মুনিয়া নিজেই ননদের পছন্দের খাবারগুলো বানালো। বিকেলে শাশুড়ির ঘরে শুয়ে থাকা নায়লাকে বললো,”ছোট আপি,চেম্বারে যখন যাচ্ছোনা, তখন ভাইয়া আর বাচ্চাদের চলে আসতে বলি?খুব মজা হবে।”
নায়লা চাপা স্বরে বললো,”ডিজগাস্টিং। ”
সায়মা কঠিন গলায় বললেন,”শোন মেয়ে,এতো কথা বলো কেন তুমি? তোমাকে যা বলা হবে,যতোটুকু বলা হবে,তুমি শুধু ততোটুকুই করবে। বাড়ির পলিসি মেকার সাজতে যেওনা। আর তোমাকে আমরা পছন্দ করে আনিনি। পছন্দ করার কোন কারণ নেই। যে তোমাকে পছন্দ করে এনে আমাদের মুখে কালি দিয়েছে, তার সাথে বকবক করো যতো খুশি।আমাদের সাথে দহরম মহরম করতে এসোনা। আর কতোবার বললে বুঝবে তুমি?”
আবার দীঘির গভীর জলে মেঘের ছায়া। বেদনার্ত দুটি চোখ।
“মামনি,তাহলে একটু আব্বু-আম্মুকে দেখে আসি? রাতে খাওয়ার আগেই চলে আসবো।”
“কি চমৎকার! আমার মেয়ে এসেছে বাড়িতে আর তুমি যাবে তোমার বাপের বাড়ি। ভালো সহবৎ জানো তো। কোথাও যাওয়া চলবেনা। আমার মেয়ে এসেছে, তার সম্মানে কোথাও যাওয়া চলবেনা। আর তোমার স্বামীকে ফোন করে বলো আজ একটু সকাল সকাল আসতে,তার বোন এসেছে। ”
নায়লা হাসি হাসি গলায় বললো,”মামনি,উনি বাপের বাড়ি যেয়ে রাতে খাওয়ার আগেই চলে আসবেন? খেয়ে আসবেন না? এমনই বাপের বাড়ি?”
” তার বাপের বাড়ির হাল কি,তা জানিস না তুই? ”
আবরার-আশরাফ চলে এলে ফ্যামিলি লিভিং রুমে জম্পেশ আড্ডা বসলো। মোর্শেদ সাহেব বললেন,”ইস্,আমার বড় আম্মিটাকে মিস করছি। শায়লাকে একটা ফোন করে দিই।”
“শায়লাকে ফোন করেছিলাম তো।ওর কয়েকটা ওটি আছে। আসতে পারবে না। এই শুক্রবারে হাতে কেউ কাজকর্ম রাখবিনা, সবাই জামাই -বাচ্চাকাচ্চাসহ সকাল-সকাল চলে আসবি। বেয়াই-বেয়ানদেরও দাওয়াত দিব।”
শায়লার শ্বশুর রিটায়ার্ড আইজি, নায়লার শ্বশুর সরকারি ভার্সিটির সাবেক ভিসি। দুইবোনের শাশুড়ি ই বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা।
নায়লা তীব্র গলায় বললো,”উনাদের দাওয়াত দিতে হবেনা। একদিন একটু নিজেরা নিজেরা থাকি। রোজইতো ওই মুখগুলো দেখতে হয়।”
“তা ঠিক, তা ঠিক।”
আবরার শান্ত গলায় বললো,”এভাবে রিঅ্যাক্ট করলি কেন?ওই মুখগুলো আছে বলেইতো বাচ্চাদের রেখে নিশ্চিন্তে বাইরের কাজ করতে পারছিস।”
সায়মা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললেন,”কেন,আমরাও ওদের যত্ন নিতে পারি। দাদার বাড়ি থাকে,তাই নাক গলাই না।”
এরপর শুরু হলো গীবত পর্ব। শায়লার শাশুড়ি কেমন দজ্জাল,শ্বশুর পুলিশে থাকতে কতো ঘুষ খেতেন, জা টা কেমন ঢঙি, নায়লার শাশুড়ির মুখে মিষ্টি কিন্তু পেটে বিষ ইত্যাদি বহুল চর্চিত বিষয়। মা-মেয়ে গল্প করছে, মোর্শেদ সাহেব টিভি দেখছেন,আশরাফ মোবাইল টিপে যাচ্ছে, মুনিয়া চুপ করে আবরারের পাশে বসে আছে। আবরার হঠাৎ বলে উঠলো,”এসব কথাতো অনেক হয়েছে। এখন বরং মুনিয়ার গান শোনা যাক।”
প্রথমে ঘরে পিনপতন নীরবতা। তারপর সায়মা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “বৌএর গান শুনতে হলে নিজের ঘরে যাও। বৌএর গান শোন,নাচ দেখো,নাটকীয় সংলাপ শোন। মা-বোনের কথাতো এখন সত্যি তোমার ভালো লাগবেনা।”
“দাদা অনেক পাল্টে গেছিস। নিজের কষ্ট -অসুবিধার কথা মানুষ মা-বাবার কাছে এসেই বলে,নিজেকে হালকা করে। তোর দেখি সেটা সহ্য হচ্ছে না। তোর বৌ তোর কাছে কথা লাগায় না? বাপি-মামনি-আমাদের বাকি তিন ভাই বোনের নামে তোর কাছে বস্তা বস্তা অভিযোগ করে না?”
“না,করেনা। এ পর্যন্ত করেনি। ও আমার দেখা সবার থেকে আলাদা। আর তাই ওকে বিয়ে করেছি।”
“বাবারে বাবা! তোর বৌ ছাড়া সবাই খারাপ? সবাই নীচ? আজ নিজের রক্তের লোকজন সবাই খারাপ হয়ে গেল? আমিওতো খুব খারাপ মহিলা,তাই না রে আবরার? নয় মাস পেটে ধরে, বুক দিয়ে আগলে মানুষ করে আজ নিজের ছেলের কাছ থেকে এই কথা শুনতে হলো?”
“মামনি,পৃথিবীতে তোমার থেকে ভালো আমি কাউকে বাসিনা,ভালো করে জানো তুমি। কিন্তু তোমরা এইযে অন্যদের বদনাম করো, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করো, নায়লা-শায়লা অনেক সময় মনগড়া অনেক কথা বলে,বেশির ভাগ মানুষই এমন করে,এটা আমার ভালো লাগে না মামনি।তোমরা যাদের নামে এতো খারাপ কথা বলছো,তাদের সামনে গেলে সম্পূর্ণ
বিপরীত ব্যবহার করবে, এই হিপোক্রেসি জিনিসটা বড় খারাপ লাগে। আর আমাদের মধ্যে দোষ কম?আমরা নিজেদের দোষ না খুঁজে সারাক্ষণ পরের দোষ খুঁজে বেড়াই,এটা ঠিক না।এই যে নায়লা এসেছে, আমরা সবাই মিলে মজা করবো,ছোটবেলার গল্প করবো, হাসাহাসি করবো, খাবো-দাবো,তা না ঘুরে ফিরে একই কথা। ”
“সবাই তোর বউএর মতো শ্বশুরবাড়ি পায় না দাদা। বোনদের কষ্ট তোর গায়ে লাগছে না।”
“আমার বোনদের আমি ভালো করেই চিনি।ছোটবেলা থেকেই। তখন মামনি দাদা-দাদুকে নিয়ে যেসব ডায়লগ দিতো,আমার বোনরাও আজ তাদের শ্বশুর বাড়ি নিয়ে সেই সব ডায়লগ ই দিচ্ছে, আরও কদর্য ভাষায়।”
এতোক্ষণে মোর্শেদ সাহেব মুখ খুললেন, “আবরার,তোমার বৌএর সামনে নিজের মা-বোনকে ইচ্ছা মতো কথা শোনাচ্ছ তুমি। পুরো পরিবারকে অপমান করছো। তোমার বৌ বসে বসে সব শুনছে আর মজা লুটছে। কোন সাহসে আমারই সামনে আমার স্ত্রী আর মেয়েকে অপমান করলে তুমি?সাহসটা যোগাচ্ছে কে? তুমি বরং বাবা আলাদা হয়ে যাও।তোমরাও ভালো থাকবে,আমরাও।
চলবে।