#মায়ার-সংসার (গল্প )
#পর্ব-৩,৪ (সমাপ্ত )

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি চৌধুরী বিছানায় নেই। মশারি ধলা পাকানো বালিশের কাছে রাখা। ভাবলাম বাথরুমে গেছে মনে হয়। খেয়াল করলাম বাথরুমের লাইটের সুইচ অন করা নেই। তাহলে গেল কোথায়? বাইরের দরজা খোলা কিন্তু ভেজানো। দরজা ঠেলে বাইরে উঁকি দিলাম। দেখি শুভর বাইকের সীটে বসে আছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,কিরে কখন উঠছিস? এখানে এভাবে বসে আছিস কেন? রাতে মশারি টানাইছিলি? পুরোনো অভ্যাস সেই চোখ মিটমিট করে প্রশ্নের জবাব দিল,রাইতে তো ঘুমাই নাই! মশারি টানাবো কি জন্য? আর মশারি ক্যামনে টানাইতে কইছেন তা মনে নাই। জানি ছেলেটা অন্য রকম। তাই কথা না বাড়িয়ে শুধু বলি, ভিতরে আয়! তোর বিছানাপত্র গুছিয়ে রাখ। কোনো কথা না বলে চুপ করে আছে।

পাঁচতলা বাসার নীচতলার এই ইউনিটটি সম্পূর্ণ আলাদা। বাড়িটি ঘেঁষে আরও একটি পাঁচতলা ভবন থাকায় আলো,বাতাস কিছুটা কমই পাওয়া যায়। বারান্দা থেকে আকাশের দিকে দৃষ্টি দিলাম। সামনে বিশাল প্রাচীর থাকায় চোখ আকাশ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে নি। দু’ মিনিট বারান্দায় পায়চারি করে ভিতরে এসে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলাম। শুভর আজ থেকে অফিস। আধ ঘন্টা পর ওকে ডেকে তুলবো। ভাবলাম আজ রুটি,পরোটা বাদ দিয়ে দুই পদ ডাল,চাল মিশিয়ে খিচুড়ি রান্না করি। সাথে ডিম ভুনা,গোল বেগুন ভাঁজা আর জলপাইয়ের আচার। আম্মা জানেন আচারের তেল দিয়ে খিচুড়ি খেতে খুব পছন্দ করি। কালকে আসার সময় সাথে কালোজিরে চাউল, ছোট্ট কাঁচের বয়ামে জলপাইয়ের আচার দিয়ে দিয়েছিলেন। চুলায় পানি ফুটতে দিয়ে সব গুছিয়ে খিচুড়ি বসিয়ে দিলাম। ডিম সেদ্ধ দিব ফ্রিজ খুলে দেখি আট ডিমের মধ্যে একটা আছে। সাতটি নাই। বুঝে গেছি ডিম উধাও হওয়ার কারণ। ফ্রিজ খুলতে দেখে চৌধুরি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। ঘুম থেকে উঠে ওর আচরণ দেখেই বুঝতে পারি কিছু একটা ঘটিয়েছে। রাগ সংযত করে ডিম সেদ্ধ রেখে বেগুন চাক ভাঁজা শুরু করি। রান্না শেষ করে শোবার ঘরে আসতেই দেখি শুভ খাট ছেড়ে মোবাইল চার্জার থেকে খুলে অন করে খাটের সাইট টেবিলে রাখে।
কপাল ছুঁয়ে বলল,
-শরীর কেমন? ব্যথা কমেছে? এত সকালে উঠলে কেন?
-তোমার না আজ থেকে অফিস? নাস্তা না খেয়ে অফিসে যাবে?
-চৌধুরীকে ডেকে রুটি বানাতে দিয়ে তুমি রেস্ট নিতে।
-অসুস্থ ছেলেটাকে নিয়ে কি করে এতদিন আছো?
-নিরুপায় হয়ে আছি। ছেলেটার মা খুব রিকোয়েস্ট করে বলেছে ওকে যেন বাড়িতে না পাঠাই। নিজেও তেমন
রান্না,ঘর সংসারের কাজ পারি না। যতটুকু পারি অফিস শেষে ক্লান্ত শরীরে বাসায় এসে আর করতে ইচ্ছে করে না। যেহেতু ব্যাচেলর থাকি কাজের মহিলা,মেয়ে রাখাও তো সম্ভব না। কি অঘটন ঘটাইছে আজ?
-ফ্রিজে আটটা ডিম ছিল। খুলে দেখি একটা আছে।
শুনেই শুভ হাসতে শুরু করলো।
-ওও এই কথা? যখন প্রথম বাসায় আনলাম তার দু’দিন পর রাতে দুই হালি ডিম সেদ্ধ করে খেয়ে নিয়েছে।
এক ডজন ডিম দু’জনের ছ’দিন যাওয়ার কথা। ডিম আনার দু’দিন পর বলে,মামা ডিম শেষ। টাকা দেন ডিম আনি। এক ডজন ডিম দু’দিনে কীভাবে শেষ হবে? হিসেবে মিলে না। বললাম,ফ্রিজে ডিম রাখার সময় কি হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গেছে? এত তাড়াতাড়ি ডিম শেষ হলো কি করে? চৌধুরী কাছ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে হেসে বলল,’না মামা,হাত থেকে পড়ে ভাঙে নাই। রাইতে সেদ্ধ করে খাইছি।’

শুনে রাগে শরীরের সব রক্ত মাথায় উঠে গেছে। হারামজাদা কয় কি? এতগুলো ডিম খেয়ে ফেলছে। এর মাথা তো আসলেই নষ্ট আছে। চড় দিতে গিয়েও দিতে পারলাম না। বিবেক বাঁধা দিল। বুঝিয়ে বললাম,মামাকে না জানিয়ে কিছু করবি না। যা খেতে মন চায় মামাকে বলবি। ওর মাথা ঠিক থাকলে তো কথাগুলো মনে রাখতো। আরও কতবার কত কাণ্ড করলো!
বিছানা ঠিক করতে করতে বলি,এই রকম করলে কি করে রাখবো?ওর মা’কে সব কিছু জানানো দরকার। ওর মায়ের ফোন নাম্বার আছে? শুভ বলল, হুমম,আছে। চৌধুরির মা নামে সেইভ করা।

শুভ ওয়াশরুমে চলে যাওয়ার পর ওর মোবাইল হাতে নিলাম। চৌধুরীর মায়ের নাম্বার নেওয়ার জন্য। কল
লিস্টে দেখি গতরাতে শেষ যে কল আসছিল সেটা
নিরার মা নামে। এরপর আর কোনো কল আসে নি।
নিরা মানে শুভর ঐ বান্ধবি যার সাথে শুভর স্টাডি ট্যুরের ছবি দেখেছি। বিয়ের পর আমেরিকা চলে গেছে।
কিন্তু এখন নিরার মায়ের সাথে শুভর কি সম্পর্ক?
এই কারণে মনে হয় শুভ রাতে ফোন নিয়ে বারান্দায় চলে আসছিল। জানি না কি ঘটতে যাচ্ছে? কৌতুহল হয়ে শুভর ইনবক্সে ঢুকলাম। গতরাতে যে মেসেজগুলি পড়েছি সেইগুলোই আছে। শুভ ডিলিটও করে নি। নতুন করে কোনো মেসেজ সেন্ড করে নি। আর ঘাঁটাঘাঁটি না করে ফোন নাম্বার বের করে নিজের মোবাইলে সেইভ করে নিলাম। বিছানার চাদর,বালিশ ঠিক ঠাক করতে করতে চৌধুরিকে ডাকলাম। ডাক শুনে নিঃশব্দে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো। ওকে দেখে রাগে শরীর শুধু জ্বলছে। রাগ সংযত করে শুধু বললাম, বারান্দায় দাঁড়িয়ে না থেকে রান্নাঘরে যা! টুকটাক যা কাজ আছে ঐগুলি শেষ কর।

শুভ বাথরুম থেকে বের হয়ে টাওয়েলে চুল মুছতে মুছতে বলল, মায়া,খিচুড়ি রান্না করছো? খুব সুন্দর ঘ্রাণ বের হয়েছে। আমার খুব পছন্দের খাবার গরম গরম খিচুড়ি সাথে ইলিশ ভাঁজা। বললাম,আমিও খুব পছন্দ করি। তবে যে কোনো আচারের তেল হলে খুব
তৃপ্তি নিয়ে খেতে পারি। শুভ টাওয়েল মেলতে বারান্দায় যাচ্ছে। দেখি পিঠ ভর্তি ফোঁটা ফোঁটা পানি। হাত থেকে টাওয়েল নিয়ে পিঠ ভালো করে মুছতে মুছতে বলি, পিঠে তো দুনিয়ার শিশির বিন্দু জমা। ঐগুলি না মুছেই টাওয়েল মেলতে যাচ্ছেন? বাচ্চাদের মতো গোসল করেছেন তাই না?
শুভ হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে দেখে চৌধুরি সামনে। কিছুটা সরে বলল,ভাইগ্না তোর বিচার অফিস থেকে এসে করবো। এখন সময় নেই। তোর মামিজানের কথা শুনে না চললে কিন্তু তোর ঠিকানা হবে ঢাকা থেকে বাড়ি।

বেশি করে পেঁয়াজ,কাঁচামরিচ কুঁচি করে ঝটপট ডিমটা ভেঁজে শুভকে নিয়ে নাস্তা করতে বসি। শুভর প্লেটে পুরো ডিম ভাঁজা তুলে দিয়ে বলি, আচারের তেল হলে খিচুড়িতে আর কিছু লাগে না আমার। শুভ অর্ধেক আমার প্লেটে তুলে দিল। তোমাকে না খাইয়ে আমার গলা দিয়ে কি করে নামবে বল তো? এ নিয়ে আর কোনো কথা না। শুভ দ্রুত খাওয়া শেষ করে চা না খেয়েই অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। দু’জনের চায়ের মগ নিয়ে শোবার ঘরে গেলাম। শুভকে চা দিয়ে জানালার দু’পাশের পর্দা সরিয়ে দিলাম। বললাম,বাসাটা মোটেও পছন্দ না। চারদিকে বাড়ি থাকায় রুম দুটো তেমন আলো বাতাস পায় না। শুভ চা শেষ করে বলল, এই তো ক’টা মাস গেলেই এ বছরটা শেষ হয়ে যাচ্ছে। জানুয়ারিতে তোমার পছন্দমতো বড় দেখে বাসা নিব, ইনশাআল্লাহ। জানোই তো ব্যাচেলর জীবন মানেই এলোমেলো জীবন। যেই বাসা আমি পছন্দ করি বাড়িওয়ালা আমাকে পছন্দ করেন না। দোষ একটাই
ব্যাচেলর। বান্ধবীর ছবি,ভাবির ছবি দেখিয়ে কতজনকে বলেছি বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখে জিজ্ঞেস করি,নিরার ছবি দেখিয়ে বলেছো বিয়ে ঠিক হয়ে আছে? শুভ দ্রুত আমার কাছে এসে কাঁধে হাত রাখলো। ওর দিকে ফিরতেই চোখে চোখ রাখলো।
যেমনটা ভেবেছো ঠিক তা না। এই বুকের গভীরে তেমন কেউ জায়গা করে নিতে পারে নি মায়া! এতদিন খালিই ছিল। তুমি এসে আমার সব কিছু পূর্ণ করে দিলে। কপালে আলতো করে অধর দুটো ছুঁয়ে বুকে টেনে নিল। আমিও নিঃশব্দে চোখ বুঁজে কিছু সময় গুটিসুটি মেরে রইলাম।

শুভ আমার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বলল, সাবধানে থেকো। মনে মনে আয়তুল কুরসি
পড়ছিলাম। তাই কথা না বলে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি দিলাম। আয়তুল কুরসি শেষ করে ওর গায়ে ফুঁ দিয়ে বললাম,তুমিও সাবধানে যাবে। ছোটবেলা থেকে মোটর সাইকেল খুব ভয় পাই। কেন ভয় পাই এখন তা বলছি না। অন্য সময় বলবো। শুভ মুচকি হেসে বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে গেল। গেইট লাগিয়ে আমি ভেতরে এসে
প্রথমে বাসায় ফোন করে আম্মা,আব্বার সাথে কথা বলে সবার খোঁজ খবর নিলাম। তারপর শ্বশুর বাড়িতে বড় জা’কে ফোন দিয়ে বাড়ির সবার কথা জানতে চাইলাম। অল্প একটু রান্না শেষ করে চৌধুরিকে নিয়ে ঘর গোছানোর কাজে হাত লাগালাম। ছেলেটার আজ কি হয়েছে জানি না। সব কাজেই তার উদ্ভট আচরণ অসহ্য লাগছে। লাঞ্চ আওয়ারে শুভ একবার ফোন দিয়ে বলল,
সময় মতো খেয়ে নিও মায়া! বিকেলে তোমার পছন্দের খাবার নিয়ে আসবো। তুমি শুধু চা করে রেখো।
চৌধুরির কাণ্ড কিছুই না জানিয়ে শান্তস্বরে শুধু বলি,
তুমিও খেয়ে নিও। সাবধানে এসো।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। শুভ এখনও বাসায় আসে নি।
রাস্তায় জ্যাম কিনা,কোন পর্যন্ত আসছে খবর নেওয়ার জন্য ফোন দিলে শুভর ফোন বিজি পাচ্ছি। আবার চেষ্টা করলাম। এবার কল কেটে দিল। খুব টেনশন হচ্ছে।
এদিকে চৌধুরির প্রতি রাগ,আর এখন টেনশন দুটো মিলে শরীর খুব দুর্বল লাগছে। আবার ফোন দিলে শুভ রিসিভ করে বলল,মায়া আমি ইউনাইটেড হসপিটালে আছি। টেনশন করো না। একটা জরুরি কাজে আসতে হয়েছে। ফোনে এতকিছু বলা যাচ্ছে না। এখনি চলে আসতেছি। আমি কিছু বলার আগেই শুভর কল কেটে গেল। কথা বলার জন্য আর চেষ্টা করি নি। লাইট অফ করে চুপচাপ শুয়ে আছি। মাথাটায় চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেছে। শুভ কি আড়াল করতে চাইছে জানি না। স্বামীর সবকিছু জানার অধিকার একমাত্র স্ত্রীর। শুভ কেন তার সবকিছু আমার কাছে শেয়ার করতে চায় না?
আমি চাই,দু’জনের ভিতর আলাদা জগত বলে কিছু থাকবে না,কোনো প্রাচীর থাকবে না। তার পুরানো ভালোবাসার মানুষের কথা জানাতে অসুবিধা কোথায়? সবার জীবনে প্রেম আসে। কেউ প্রেমে সফল হয়। বিয়েতে রূপ নিয়ে পরিণতি পায়। আবার কারোরটা ভেঙে যায়। আমার প্রতি তার কোনো অবহেলা,অযত্ন উদাসীনতাও তো দেখি না। শুভ কি লুকিয়ে রাখতে চাইছে? এলোমেলো ভাবনায় কখন এত সময় চলে যায় বুঝতে পারি নি। এশার নামাজের আযান দিচ্ছে। উঠে ঘরে আলো জ্বালিয়ে ওযু করে নামাজে দাঁড়ালাম। ফরজ নামাজ শেষ করতেই শুভ বাসায় আসলো। চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসতে আসতে নামাজ শেষ করে জায় নামাজ রাখলাম। শুভ হাত,মুখ মুছে সামনে এসে
অনুনয়ের স্বরে বলল,

-ক্ষমা করো মায়া! আমিই বলেছিলাম সন্ধ্যায় একসাথে নাস্তা করবো। সময়টুকু তোমার জন্য রাখতে পারি নি। অভিমান চেপে রান্নাঘরের ঘরের দিকে এগিয়ে বললাম,
-এতে ক্ষমা চাওয়ার কি আছে?তোমার ব্যস্ততা থাকতেই পারে। এক মিনিট বসো। চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে আসছি।
শুভ টেবিলে রাখা প্যাকেট থেকে খাবার বের করে রাখছে। চৌধুরীকে ডেকে ওর প্লেটে আগে দিয়ে বলল, -তুই আগে খেয়ে নে! ভাইগ্না,তোর মুখটা অমন করে রাখছিস কেন? আজ কোনো অঘটন ঘটাস নি তো? শুভর পাশের চেয়ারটায় বসে বললাম,
-চৌধুরিকে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। ওকে বাসায় রাখলে মান,সম্মান সব যাবে। সারাটাদিন খুব অশান্তিতে রেখেছে।
-তাই নাকি? ফোনে জানালে না কেন? কি করেছে বেয়াদবটা?
-কয়টা বলবো?নামাজে দাঁড়িয়েছি সামনে এসে দাঁত বের করে হাসে। নামাজ শেষে হাসির কারণ জানতে চাইলে বলে,মামা আপনেরে দেইখ্যা রাখতে বলছে। বাড়িওয়ালার ছেলের গায়ে পানি ছিটাইছে। টিভির সাউন্ড কমিয়ে দিতে বলছিল। শাওয়ার নিতে ওয়াশরুমে ঢুকেছি। তখন সে গেইট খুলে রিমোট হাতে জোরে সাউন্ড দিয়ে গান শুনে। বাড়িওয়ালার ছেলে ওর গালে দুটো চড় মেরে আমার কাছে দুনিয়ার বিচার দিয়ে গেল। এরপর ওর মায়ের সাথে মোবাইলে কথা বলি। জানালো,চৌধুরিকে যেন বাড়িতে না পাঠিয়ে যে করে হোক একটা চাকরি জোগাড় করে দেই। তারপর থেকে ভেবেচিন্তে একটা আইডিয়া বের করে রেখেছি। চৌধুরি সুস্থ থাকলেও ওকে কখনোই আমি বাসায় রাখতে রাজি না। কারণ, তুমি অফিসে যাওয়ার পর আমি একা। তাছাড়া ছেলে দিয়ে কাজ করানো আমার মোটেও পছন্দ না। যদি পারো ওকে এখনি তোমার পরিচিত কোনো হোটেল,রেস্তরাঁয় কাজের সুযোগ করে দাও। বেতনও বেশি পাবে। খাবারে কোনো সমস্যা হবে না। বেতনটা যাতে ওর মায়ের হাতে পৌঁছায় সেই ব্যবস্থাও করে দিও। ওর মায়ের আকুতি শুনে খুবই কষ্ট লেগেছে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে এতগুলো বাচ্চা নিয়ে সংসার চালায়।
-ভালো কথা মনে করে দিয়েছো! আমার ভার্সিটির বন্ধু সালামতের খাবার হোটেল,এজেন্সির ব্যবসা। অনেক লোক তার ঐখানে চাকরি করে।
সালামতকে এখনি ফোন দিয়ে ওর চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি। সাথে সাথেই ফোন করে শুভ বিস্তারিত কথা বলে নিল।

আজ শুভর অফিস বন্ধ তাই বিকেলে চৌধুরিকে সালামতের কাছে নিয়ে যাবে। যেহেতু বন্ধের দিন তাছাড়া ছেলেটা চলে যাবে। ভাবলাম ওর জন্য ভালো কিছু রান্না করি। খুব খুশি হবে। শুভকে বললে ও সকালে বাজার করতে চলে গেল। এইদিকে বাড়ি থেকে বড় ভাসুর ফোন দিয়ে বলেছেন দু’একদিনের মধ্যে বাড়িতে যেতেই হবে। ব্যাগ বের করে কাপড়,প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে রাখছি। খেয়াল করি নি শুভ মোবাইল চার্জ দিয়ে গেছে। মোবাইলের রিংটোন শুনে হাত বাড়িয়ে দেখি নিরা নামটি স্কিনে ঝলমল করছে। প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম। রিসিভ করবো কি করবো না ভাবতে ভাবতে চারবার রিং হয়ে লাইন কেটে গেল। কল ব্যাক করে কথা বলবো কিনা বুঝতে পারছি না। এখন আমার কাছে সবকিছু পরিস্কার। নিরার সাথে শুভর সম্পর্ক ছিল এবং এখনও আছে। সম্ভবত নিরার মা তাদের সম্পর্কের কথা খুব ভালো করে জানে। প্রাক্তন প্রেমকে জিইয়ে রেখে আমার সাথে ভালো স্বামী সেজে কি সুন্দর অভিনয় করে যাচ্ছে শুভ। ঠিক আছে তুমি তোমার মতো করে ভালো থেকো। তুমি নিরাকে নিয়েই থেকো। গ্রাম থেকে এসে সোজা মায়ের কাছে গিয়ে চাকরির জন্য লেখাপড়া শুরু করবো।

###পর্ব-৪

বিকেলে চৌধুরিকে সালামতের কাছে পৌঁছে দিয়ে পরদিন খুব ভোরে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম। গাড়িতে বসে শুভ ছোটবেলার অনেক স্মৃতিকথা বলে হাসছে। চুপ করে শুনে শুধু হু,হা করে যাচ্ছি। চাপা অভিমানে,কষ্টে শুভর সাথে তেমন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কথা না বললেও চোখ দুটো ওর মোবাইলের দিকে তীক্ষ্ম দৃষ্টি রাখছে।

প্রথমবার শ্বশুরবাড়িতে পৌঁছেই মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। গেইটের কাছে বাড়ির সব ছেলে-মেয়েরা দাঁড়িয়ে আছে দু’জনকে রিসিভ করে ভিতরে নেওয়ার জন্য। গাড়ির ডোর খুলে নামতেই মেজো জা’য়ের দুই মেয়ে দুই পাশে এসে দাঁড়ালো। দু’জন ওদের সাথে সাথে গেইট পার হয়ে আল্পনা আঁকা বিশাল উঠোনের মাঝ বরাবর হেঁটে বারান্দায় এসে চেয়ারে বসলাম। বড় ভাবী বরণ
ডালা হাতে একজন মুরুব্বি মহিলাকে সাথে করে
সামনে দাঁড়ালেন।
-মায়া,ওনি শাশুড়ি মায়ের বড় বোন।
সালাম দিয়ে চেয়ার ছেড়ে ওনার পা ছুঁয়ে দোয়া চাইতেই
আমার হাত দুটো ধরেন।
হেসে বললেন,
-পায়ে নয়, বউদের স্থান সব সময় শাশুড়িদের বুকে হওয়া উচিত। আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। আমার ছেলের বউদের আমি বুকেই জায়গা দিয়েছি।

ওনি আমাকে বরণ করে মুখে একটুখানি মিষ্টি পুরে ডানহাতের আঙুলে আংটি পরিয়ে দিলেন। নিজ হাতে ওনাকে মিষ্টি মুখে তুলে দিয়ে বড় জা’য়ের মুখে মিষ্টি দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করতে চাইলে ভাবি বুকে জড়িয়ে নিলেন। ঘরে যাবো দেখি দুই জা দরজার সামনে লাল ফিতে ধরে হাসছে। শুভ দু’জনকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে আমাকে নিয়ে ঘরে ঢুকলো।
গুটি কয়েক আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো পরিপাটি ঘরটি সুন্দর এবং ছিমছাম। হাতে কাজ করা ক্রিম
কালারের বিছানার চাদর আর পর্দার চমৎকার কালার কম্বিনেশন ঘরটিতে আলাদা সৌন্দর্য এনে দিয়েছে।
দেয়ালের অফ হোয়াইট রঙে সারা ঘরময় শুভ্রতার আবেশ ছড়ানো। শোবার খাটটিও গুটি কয়েক তাজা ফুল দিয়ে সাজানো। প্রাণভরে টাটকা ফুলের সুঘ্রাণ নিচ্ছি। আমার ভিতরে অদ্ভুত এক ভালো লাগার অনুভূতি তৈরি হয়েছে। কেমন শান্তি শান্তি লাগছে!
এমনটা পাবো কল্পনাও করি নি। এমন সুন্দর রিসেপশনের জন্য ইচ্ছে করছে শুভকে জড়িয়ে ধরে
ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি তা করবো না। শুভ আমার দিকে চেয়ে বলল,
-কি ভাবছেন মহারানি? জামাইয়ের ঘর পছন্দ হয়েছে? সবকিছুই তোমার শুভর উপার্জনের টাকায় হয়েছে।
ঐ যে দেখছো কাপড়ে পেঁচানো ঐটা মায়ের কোরআন শরীফ। মা’কে দেখতাম নামাজের পর প্রায়ই কোরআন তেলওয়াত করতেন। বাবা হজ্জে যাওয়ার আগে ভাবিরা তাদের ইচ্ছেগুলো বলছিল কার জন্য কি আনতে হবে। আমাকে ডেকে বললেন,শুভ তোর জন্য কি আনবো? তখন কি বলবো মাথায় আসছিল না। এত কিছু বুঝিও না। হুট করে বলে দিলাম,আমার জন্য একটা ক্যাসেট প্লেয়ার আনবেন। শুনে ঘরের সবাই সে কি হাসাহাসি। বাবা হেসে বললেন, মা মরা আমার পাগল ছেলেটা বলে কি? বাবা আমার কথা রেখেছিলেন। হজ্জ শেষে বাড়িতে আসার সময় ক্যাসেট প্লেয়ার এনেছিলেন। ঐ যে দেখতে পাচ্ছো পুরানো,নষ্ট ক্যাসেট প্লেয়ার। ঐটা আমার কাছে মহামূল্যবান। বাড়িতে এলে মুছে পরিষ্কার করে রাখি।

বাড়িতে নতুন ছোট বউ আসছে। উল্লাসমুখর পরিবেশ। সবার ভিতরে খুশির আমেজ। ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম
থেকে বের হয়ে দেখি ঘরভর্তি ছেলে-মেয়েরা। হাসিমুখে ওদের সাথে উঠোনে আসি। বাড়ির চারদিকে সবুজ গাছগাছালিতে ভরা রঙিন টিনের দুটো বড় ঘর,দুটো
একতলা বিশিষ্ট বাড়ি।উঠোনের এক কোণায় ঢেঁকিঘর। ঢেঁকি ঘরের সামনেই ডালা-পালা ছড়ানো বড় একটা বাতাবিলেবু গাছ।
চ্যাপ্টা সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে থোকায় থোকায়
লেবু ঝুলে আছে। গাছটার ঠিক নীচে সিলভার রঙের একটা দোলনায় বড় জা’য়ের দুই নাতনি দোল খাচ্ছে।
আমাকে দেখেই কাছে এসে মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বলল,তুমি কি ঢাকার নানু? তুমি খুব সুন্দর!
গালে আদর দিয়ে একটাকে কোলে নিয়ে হেসে বলি,
হুমম,আমি ঢাকার নানু। তুমিও দেখতে খুব সুন্দর!

সবার সাথে খাওয়া-দাওয়া,গল্পে কখন সময় চলে যায় বুঝতেই পারি নি। শুভও খাওয়া শেষ করে ছোটবেলার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে বাজারে চলে যায়।
ভাবলাম বিকেলের চা,নাস্তা কিছু আমিই তৈরি করি।
রান্নাঘরে ঢুকতেই মেজো ভাবি হেসে বলল,এই তো কেবল বাড়িতে পা রাখলে! ক’টা দিন সবার সাথে হাসি গল্পে কাটুক। মেহেদী রাঙা হাতটা দেবরের চোখ জুড়ে থাকুক। তোমাকে এখনি কিছু করতে হবে না বোন!
বাড়িভর্তি লোকজন। তুমি সেজেগুজে সবার সাথে হাসিমুখে কথা বলো। শ্বশুর,শাশুড়ির অনেক কাছের লোকজন আসছেন। কালকে আরও আসবেন। যারা
শুভর বিয়েতে ঢাকায় যেতে পারেন নি। তাদেরকে বড় ভাইজান দাওয়াত করেছেন। ওনারা কালকে দুপুরে আমাদের এখানে ডাল,ভাত খাবেন। ভাইজান সবাইকে
কোনো উপহার সামগ্রী আনতে নিষেধ করেছেন।

রাতে নিজের ঘরে এশার নামাজ শেষ করে শাশুড়ির কোরআন শরীফের দুই পৃষ্ঠা পড়ে দোয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াতেই শুভ উঠোন থেকে ঘরে আসে। ওর দিকে না
তাকিয়ে অন্যদিকে ফিরে শাড়ি ঠিক করে চুলে চিরুনি দিচ্ছি। শুভ পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ ঘষতে ঘষতে বলল,তোমার দীঘল চুল ছাড়া দেখলে আমার মাথা ঠিক থাকে না। কেমন জানি এলোমেলো হতে থাকি। কোনো কথা না বলে জোরেই ওর কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়াই। শুভ আবার কাছে এসে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। কারো পায়ের ধপধপ আওয়াজ শুনে দরজার দিকে ফিরতেই দেখি সেজো
জায়ের ছোট মেয়ে জুঁই বালিশ হাতে ঘরে ঢুকলো।
ছোট মা,আমি কিন্তু আজ এই সাজানো খাটে তোমার সাথে ঘুমাবো। আগেই বলে রাখছি। এইজন্যই বালিশ এনে আমার জায়গা আগেই ঠিক করে যাচ্ছি। টুম্পা,
মনি এরাও কিন্তু তোমার সাথে ঘুমাতে চাইছে।
শুভ জুঁইয়ের গাল টিপে আমার দিকে চেয়ে বলল,তোর ছোট মা’কে যে রাতে পেত্নি ধরে সে কথা জানিস?
শুভর কথা শুনে খুব হাসি পাচ্ছে। হাসি চেপে জুঁইকে আদর দিয়ে বললাম, মা তুমি আমার সাথেই ঘুমাবে।
জুঁইকে নিয়ে ঘর থেকে বের হবো শুভ বলল,
কালকে বাড়িতে কিছু কাছের লোকজন খাওয়া-দাওয়া করবে। পরদিন বাড়ির সবাই মিলে পুরান বাড়ি মানে গ্রামের বাড়িতে যাবো। খুব বেশি দূরে নয়। কাছেই গ্রামের বাড়ি। উদ্দেশ্য হলো গেট টু গেদার আর মা,বাবার কবর জেয়ারত করে ছোটখাটো দোয়ায় অংশ নেওয়া। সব ভাইয়েরা মিলে আগেই সব কিছু ঠিক করে রেখেছেন। এখন আমাকে জানানো হলো। তার একদিন পর দু’জনের টুনাটুনির মায়াঘেরা সংসারে ফিরে যাবো। আমি চুপ থেকে শুধু বললাম, খুব সুন্দর সিদ্ধান্ত ! তবে আমি এখান থেকে সোজা মায়ের বাসায় যেতে চাই।
কিছুদিন ঐখানেই থাকবো। শুভ হেসে বলল, পাগলি মেয়ে বলে কি? একটা দিনও তোমাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। দ্বিতীয়বার যেন আর না শুনি।

পরদিন উঠোনে বড় চুলায় রান্না-বান্নার বিশাল আয়োজন। দুপুরের আগেই সবাই চলে আসলো।
আমাকে বউ সাজে বারান্দায় সিঙ্গেল একটা সোফায় বসানো হলো। খাওয়ার পর্ব শেষ করে আমাকে দেখে
টুকটাক কথা বলে দোয়া করে সবাই চলে গেলেন।
পরদিন সকাল এগারোটায় বাড়ির সবাই মিলে গ্রামে চলে আসি। গ্রামের বাড়িটি শুভর দাদা করে গেলেও
বর্তমানে তার চাচাতো ভাইয়ের ছেলে থাকে। চাচারা কেউ বেঁচে নেই। বাড়ির সামনেই পারিবারিক কবরস্থান।
ওনারা আগেই জানতেন আমরা যাবো। তাই উঠোনে
চারটি চুলায় দ্রুতগতিতে রান্না চলছে। গ্রামে নতুন বউদের সব কিছু ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। ভাবি আমাকে উঠোনে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। সবার সাথে টুকটাক কথা বলছি। সবাই হাতে হাতে কাজ করছে। আবার হাসি ঠাট্টাও করছে।এমন খোলামেলা পরিবেশ,সহজ,সরল মানুষদের কাছে পেয়ে খুব ভালো লাগছে। উঠোনে বসেই বাড়িটির চারিদিক দেখছি। দুই কাজের ছেলে গাছ থেকে ডাব পেড়ে কেটে সবার হাতে হাতে দিচ্ছে। মনে মনে শুভকে খোঁজ করছি। কোথাও ওকে দেখি না। জুঁই বলল,
ছোট চাচ্চু কখন বাড়ির ছেলেদের নিয়ে বড়শি হাতে পুকুরপাড়ে চলে গেছে। খেয়াল করলাম খানিক দূরে একটা মেয়ে অনেকক্ষণ ধরে আমাকে দেখছে। আমি তাকাতেই হাসলো। কাছে ডাকলাম।
এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। জিজ্ঞেস করলাম,ভালো আছো? কিছুই বলে না। এক সময় ভাসুরের মেয়ে বলল,
চাচি মেয়েটি কথা বলতে না। মেয়েটির নাম বুলি। পাশের বাড়ির।দেখতে ছোট হলেও বয়স আমার সমান। সতেরো, আঠারো বছর হবে। শুনেই খুব কষ্ট লাগলো। বুলিকে খুব ভালো করে দেখছি। ইশারায় সে আমার সাথে অনেক কিছু বলছে। এক সময় দৌড়ে গিয়ে পুরানো জামা কাপড়,একটা ডেটল সাবান নিয়ে আমার কাছে এসে ঠোঁট আউড়ে কিছু একটা বলে ভেংচি কেটে পুকুরে গোসল করতে চলে গেল। কিছুই বুঝতে না পেরে
ভাসুরের মেয়ে জেবাকে জিজ্ঞেস করলাম,বুলি অমন করে মুখ ভেংচিয়ে কি বলে গেলো? জেবা টাকি মাছ থেকে কাঁটা ছাড়াচ্ছে আর আমার সাথে টুকটাক কথা বলছে। জেবা বলল,বুলির লাক্স সাবান খুব পছন্দের।
তার মা লাক্স সাবান কিনে দেয় না কারণ পুকুরপাড়ে বসে গায়ে ঘষতে ঘষতে একদিনেই শেষ করে ফেলে।
এইজন্য কম দামি সাবান ডেটল,আর না হয় লাইফবয় কিনে দেয়। বুলি ঐ কথাই আপনার কাছে বিচার দিয়ে গেল চাচি। বললাম, বুলিকে টাকা দিলে নিবে?
কেউ টাকা দিলে নিতে চায় না। টাকা নেওয়া তার মায়ের নিষেধ। টাকা হাতে পেলে যখন তখন দোকানে চলে যায়। বেলা গড়িয়ে দুপুর দুটো। জুঁইকে সাথে নিয়ে ধীরে ধীরে পুকুরপাড়ে গেলাম। শত বছরের পুরানো বিশাল পুকুর। পুকুরের ঠিক মাঝখানে লাল শাপলা,
পদ্ম ফোটে আছে। কিছু সময় বুলির গোসল দেখলাম।
কাজের ছেলেটাকে একা পেয়ে কিছু টাকা দিয়ে দোকানে পাঠিয়ে দিলাম।

যোহরের নামাজ শেষ করে সবাই খেতে বসে। ডাইনিং
টেবিলে, মেঝেতে পাটি বিছিয়ে,বিছানায় যে যেখানে জায়গা পাচ্ছে নিজ দায়িত্বে বসে খেয়ে নিচ্ছে। আমি পাটিতে বসে যাই। আমাকে দেখে শুভও টেবিল ছেড়ে
আমার সাথে পাটিতে বসে। আমি ওকে চিনি না এমন ভাব ধরে আছি। সেজো জা এসে শুভর কানে কানে বলল,বউকে আদর করে বেশি খাওয়ানোর জন্য পাশে বসা হয়েছে তাই না? সব বুঝি ভাই! আরও কিছু বলে দু’জনেই হাসলো।
মনে মনে খুব করে চাইছিলাম বুলিও আমাদের সাথে ভালো খাবার খেতে বসুক। পোলাও, রোস্ট, মুরগির ঝাল,গরুর রেজালা,খাসির মাথা দিয়ে বুটের ডাল,সাদা ভাত,শোল মাছ ভুনা,টাকি ভর্তা,দই,চমচম থাকলেও আমি সাদাভাতের সাথে টাকি মাছের ভর্তা দিয়ে খেতে শুরু করি তখনি দেখি বুলি আমার থেকে একটু দূরে বসে পোলাও,রোস্ট খাচ্ছে। ওকে দেখতে পেয়ে খুব শান্তি পাচ্ছি। যাক মনের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে।
আছরের নামাজের পর দোয়া শুরু হলো। দোয়া শেষ করে শুভ আমাকে নিয়ে মা,বাবার কবরের কাছে কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে থাকে। আমিও মনে মনে ওনাদের জন্য দোয়া,দুরুদ পড়ি। সন্ধ্যা হয়ে আসছে তাই তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। অনেকদিন পর আমার কারণে সবাই একসাথে হতে পেরে সবাই খুব মজা করছে। সেলফি তুলছে। আমাকে যখন যে ডাকছে তার সাথেই ছবি তুলছি। লক্ষ্য করলাম একটু দূরে হাত গুটিয়ে মুখটা ভার করে বুলি দাঁড়িয়ে আছে। সবার ছবি তুলা দেখছে,আনন্দ দেখছে। আমি বুলির কাছে গিয়ে ইশারায় বললাম,
ছবি তুলবে? একগাল হেসে সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল। বুলির সাথে নিজের মোবাইল দিয়ে অনেকগুলো সেলফি তুললাম। অল্পতে যে মানুষ এতটা তুষ্ট হতে পারে বুলিকে দেখে শিখলাম। মেয়েটা খুশিতে মোবাইল নিয়ে ঘুরে ঘুরে সবাইকে তার ছবি দেখাচ্ছে। একা একাই হাসছে,ঘুরছে,আনন্দ করছে। বাকশক্তি নেই তাই তার স্বপ্ন,শখ,ইচ্ছের কথা,আন্দের কথা, বিয়ের কথা, কাউকে জানাতে পারে না। ওকে একটুখানি সুখ দিতে পেরে নিজের কাছেও ভীষণ ভালো লাগছে। সবাই বিদায় নিয়ে গেইটের বাইরে আসলো। আমিও সবার কাছ থেকে দোয়া চেয়ে,সবার সুস্থ জীবন কামনা করে শুভর সাথে গেইটের কাছে আসি। বুলি মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটার গাল ছুঁয়ে দিতেই টপ করে ওর চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি পড়লো। চোখ দুটো মুছে নিজের ব্যাগ থেকে দুটো লাক্স সাবান,কিছু চকলেট দিতেই আমাকে ধরে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আমি কিছুতেই আমার চোখের পানি আটকাতে পারছি না। চোখ দুটো বারবার ঝাপসা হচ্ছে। কেন ওর জন্য খারাপ লাগছে? কেন কষ্ট হচ্ছে? ওর মায়া ছাড়িয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠার জন্য পা বাড়ালাম। কিছুতেই বুলি আমাকে আসতে দিবে না। ইশারায় জানালো তার সাথে তাদের ঘরে একরাত থাকতে হবে। মেয়েটা আমার হাত ধরে কেঁদেই যাচ্ছে। প্রতিবন্ধী মানুষগুলো সমাজের, পরিবারের সব ধরণের সুযোগ,সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়।
এরা কারো একটু আদর, ভালোবাসা, সহানুভূতি পেলে তার সান্নিধ্যই থাকতে চায়। বুলির মাথায় হাত বুলিয়ে দ্রুত শুভর সাথে গাড়িতে উঠলাম।

এশার নামাজের পরেই বাড়িতে চলে আসলাম। দু’দিনের মধ্যে দিনে একটুও বিশ্রাম নিতে পারিনি।
শরীরটা অনেকটা ক্লান্ত লাগছে। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ভালোবাসা, আত্মীয়-স্বজনের আপ্যায়ন,
গল্প,আড্ডা,খাওয়া-দাওয়া,আয়োজন,হৈচৈ এর মধ্যে
নিজের একান্ত রাগ,অভিমানগুলো চাপা পড়ে থাকে। ভাবনা রেখে বাথরুমে গিয়ে গা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসি। শুভ পাশের ঘরে দু’জন লোকের সাথে কথা বলছে। বালিশের কাছে শুভর মোবাইল বেজেই যাচ্ছে।
একবার ভাবলাম শুভকে মোবাইল দিয়ে আসি।
লাইন কেটে গেল। আবার রিং হতেই দেখি নিরার নাম্বার। ভাবলাম এবার নিরার সাথে কথা বলে কিছু জিজ্ঞেস করি। সাথে সাথেই কল রিসিভ করে মোবাইল কানে ধরলাম,
-শুভ তুই কি মানুষ বলতো? কতবার তোকে ফোনে ট্রাই করে যাচ্ছি। ফোন রিসিভও করিস না ব্যাকও করার প্রয়োজন মনে করিস না। এদিকে বেশ কয়েকদিন ধরে তুই নেটেও আসিস না। তোকে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে স্বস্তি পাচ্ছি না শুভ।
আল্লাহর অশেষ রহমতে আর তোর সহযোগিতায় আমার মা এ যাত্রায় বেঁচে গেছে। তুই ঐদিন রাতে না আসলে কি যে হতো। উফ্ ভাবতে পারছি না। ভাইয়া
ট্রেনিং এর কাজে ঢাকার বাইরে ছিল। রুবেল,শফিক,
তুহিন,দীপক সবাইকে ফোন করলাম। কেউ ফোন রিসিভ করে নি আবার কেউ ঢাকার বাইরে ছিল।
আবার তুহিন বলল,তার হাতে কাজ যেতে পারবে না।
বিপদে মানুষ চেনা যায় বন্ধু! পাথরের মতো চুপ করে আছিস কেন? কিছু বলছিস না কেন? এই শুভ তোর কি হয়েছে?
শান্তগলায় বললাম,
-আমি মায়া বলছি। শুভর স্ত্রী। শুভ মোবাইল রেখে বাইরে গিয়েছে।
হেসে বলল,
– ওও শুভ পাগলাটার লক্ষী বউ! পরিচয় দিচ্ছো না কেন ভাই? তোমার কথা শুনেছি। শুভকে ধন্যবাদ দেওয়ার জন্য কতদিন ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ওর পাত্তাই পাওয়া যায় না। তোমার জামাই সারাটা দিন করে কি? অফিস করে বাসায় এসে তোমার আঁচল ধরে শুয়ে থাকে তাই না? মায়া, তুমি খুব ভাগ্যবতী। শুভ খুবই ভালো মন মানসিকতার ছেলে। সবার বিপদে শুভকে পাওয়া যায়। ভার্সিটিতে পড়ার সময় তোমার জামাই আমাকে পুতুল বলে ডাকতো। আমি নাকি পুতুলের মতো দেখতে। শুভর সাথে অন্য বান্ধবীরা ছবি তুলতে চাইলে
শুভ বলতো আগে আমি একা পুতুলের সাথে ছবি তুলে নেই। যাই হোক দেখা হলে অনেক কথা হবে।
ছুটিতে দেশে আসলে অবশ্যই তোমার হাতের রান্না খেতে আসবো। আজ রাখছি মায়া। পরে একসময় ফোন করে অনেক কথা বলবো। ভালো থেকো।
-আপনিও সব সময় ভালো থাকবেন।
মুহূর্তের মধ্যে শুভর প্রতি জমানো সব রাগ,অভিমান গলে পানি হয়ে দু’চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

রাত বেড়ে প্রায় বারোটা। বাড়ির সবাই শুয়ে পড়েছে। চারিদিকে সুনসান নীরবতা। আমি জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে শুভকে বললাম, দেখো আজ মনে হয় পূর্ণিমা। কি সুন্দর ঝলমলে আকাশ! একটু বাইরে যেতে চাই। আজ দু’জনে চাঁদের আলো দেখবো।
দু’জনে দোলনায় বসলাম। শুভ বামহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে ডানহাতটা আমার ডানহাতের ভিতর রাখলো। দোলনায় আস্তে আস্তে দোল দিচ্ছে। সারা উঠোন চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। ওর কাঁধে মাথা রেখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মনে মনে বলছি,
আল্লাহ স্বামী হিসাবে যাকে তুমি আমার জীবনের সাথে বেঁধে দিয়েছো। কবুল বলে যে মানুষটার সাথে সংসার জীবন শুরু করেছি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সারাজীবন যেন সুখে,দুঃখে একসাথে পথ চলতে পারি। মায়া,মমতায় ঘেরা ভালোবাসার সংসারে দু’জনের বন্ধন,বিশ্বাস যেন
সব সময়ই মজবুত থাকে।
চুপ আছি দেখে শুভ হাত চেপে হেসে বলল,
-মনের ভিতর নিরাকে নিয়ে যে সন্দেহের ঢেউ উঠেছিল তা থেমেছে ? নিরার সাথে কথা হয়েছে?
আহ্লাদি গলায় বললাম,
-বলবো না। মনের ভিতরে এখন নতুন করে আর একটা ঝড় উঠেছে।
-এখনি থামাতে যাবো?
-না।
শুভ দোলনায় দোল দিয়ে গুনগুনিয়ে গাইছে,
যে হাতে রেখেছি হাত
তার কানেকানে বলবো কথা
কাটবে আঁধার রাত
ওগো মোর হৃদয়ের রানি
আমি যে শুধু তোমারে চিনি
যে হাতে রেখেছি হাত…..
———————–সমাপ্ত————

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here