#মন_নিয়ে_খেলা(৭)
********************

পার্টি শেষে রুমে ফিরে, কাপড় চেঞ্জ করলেন, পূনম। এরপর ওয়াশরুমে গিয়ে টোনার দিয়ে মুখের মেক-আপ তুললেন। হঠাৎ কী মনে হতে, শাওয়ারও নিয়ে নিলেন। এরপর রুমে এসে, রুম সার্ভিসে ফোন করে, কফি আনিয়ে নিলেন। কফির মগ হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে, আকাশের দিকে তাকালেন। কী ঝকঝকে আকাশ! মিটিমিটি অসংখ্য তারা মুক্তোদানার মতো ছড়িয়ে আছে আকাশজুড়ে। পূনম মনে করতে চেষ্টা করলেন, ঢাকার আকাশে এখন কী এভাবে আর তারা দেখা যায়? যাওয়ার তো কথা না। অবশ্য বহুদিন হল আকাশ দেখা হয় না। ছোটোবেলায় বাড়ির ছাদে শুয়ে তারা গোনার চেষ্টা করতেন তাঁরা চার ভাইবোন। আকাশ ভরা তারার ঝিলিকে, সেই চেষ্টা কোনোদিনই সফল হত না; কিন্তু তারা গোনার এই খেলা, তাঁরা সবাই খুব উপভোগ করতেন। আজ হঠাৎ ছোটোবেলার সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে পড়ল। যান্ত্রিক জীবন তাঁর কাছ থেকে আনন্দের উপলক্ষ্যগুলো কেড়ে নিয়েছে। এখন আর কোনোকিছুতেই তেমন আনন্দ পান না তিনি। করতে হবে, তাই কাজগুলো করে যান। দায়িত্ব পালনের তাড়া হয়ত আছে; কিন্তু আন্তরিকতা বা ভালোলাগা, কোনোটাই সেভাবে কাজ করে না। মেয়েদের সঙ্গে আজ একবারও কথা বলা হয়নি। ফোন করার কথা মনে করতেই, ফোনে রিং বেজে উঠল। পূনম টি টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে দেখলেন, ফাহাদ ফোন করেছেন। হ্যালো…

হ্যাঁ পূনম, কোথায় ছিলে? আরও দু’বার ফোন করেছিলাম।

পার্টি ছিল। সকালে বলেছিলাম তো।

ওহ, সরি৷ ভুলে গেছি।

তুমি কেমন আছ?

খুব ভালো আছি। কন্ট্রাকটা সাইন করে ফেললাম। তুমি ডিনার করেছ?

হুম। এখন কফি খাচ্ছিলাম।

আমরাও ডিনার শেষ করে কিছুক্ষণ আগে হোটেলে ফিরেছি। আচ্ছা তুমি ‘সরি’ লিখেছ কেন? কিছুই তো বুঝলাম না? কোন কাজের জন্য সরি বললে?

এমনিতেই লিখলাম। অনেক সময় হালকা কথা-কাটাকাটি হয়। তুমি মন খারাপ করে থাকো। সবকিছু মিলিয়েই আমি সরি।

উহু, কিছু তো একটা ঝামেলা আছে? কোথাও কিছু ভেজাল করেছ?

ফাহাদের কথা শুনে পূনমের মাথায় রক্ত উঠে গেল। তিনি কেমন আছেন, ফাহাদ ঐ কথা একবারও তো জিজ্ঞেস করলই না, এখন আবার ‘সরি’ বলার কারণ খুঁজতে লেগে গেছেন? বলে কি না ভেজাল আছে। তিনি যেন ভেজাল ছাড়া কোনও কাজ করেনই না! পূনম বিরক্ত হয়ে বললেন, ফোন রাখছি।

ফোন রাখবে কেন! তোমার সঙ্গে কথাই তো হল না।

কোন ও প্রয়োজন নেই আমার সঙ্গে কথা বলার। ঝাঁঝের সঙ্গে কথাটা বললেন পূনম।

কী হল বলো তো? যখন ফোন করলাম, ভালোভাবে কথা বলছিলে। হঠাৎ এমন রেগে গেলে কেন, পূনম?

আমার ইচ্ছা হয়েছে, তাই রেগে গেছি। আমি ফোন রাখছি।

প্লিজ পূনম, এমন বাচ্চাদের মতো করো না। আমার যদি কোনও ভুল হয়ে থাকে, আমি সরি বলছি।

বললাম তো কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। আমি এখন কথা বলব না। ফোন রাখছি। তুমি আমাকে আজ আর ফোন করবে না। আমি ফোন রিসিভ করব না, বলে দিলাম।

হ্যালো, পূনম শোনো…. হ্যালো…. মোবাইলের স্ক্রীণে তাকিয়ে ফাহাদ দেখলেন, ইতোমধ্যেই লাইন কেটে গেছে। মোবাইলটা বেড সাইড টেবিলে রেখে দিলেন তিনি। এখন আর ফোন করে কোনও লাভ হবে না। দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে গেলেও, পূনম আজ আর ফোন ধরবেন না। পূনমের এই জেদ আর রাগকে ফাহাদ ভীষণ ভয় পান। তিনি মনে করতে চেষ্টা করলেন, তিনি কী এমন কোনও বেফাঁস কথা বলেছেন, যাতে পূনম এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারেন? নাহ, এমন কিছুই তো তিনি বলেননি। কথা তো কেবল শুরুই করেছিলেন, এর মধ্যে কী থেকে কী হয়ে গেল! ডিল ফাইনাল হওয়ায়, মনটা খুব ভালো ছিল এতক্ষণ। আজ তিনি স্ত্রী আর কন্যাদের জন্য গোল্ড আর পার্ল দিয়ে তৈরি খুব সুন্দর ডিজাইনের তিন সেট গয়না কিনেছেন। ভিডিয়ো কলে গয়না দেখে, দুই মেয়ে খুব পছন্দ করেছে। পূনমকে গয়নার কথাটা বলার সুযোগই পেলেন না। গ্লাসে পানি ঢালতে, ঢালতে ফাহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পূনমের সঙ্গে কথা বলার পর, তাঁর সারাদিনের সব আনন্দ, সব আর্জন যেন নিমেষেই ফিকে হয়ে গেল। ল্যাপটপ অন করেছিলেন, কয়েকটা মেইল করার জন্য। এখন আর কাজ করার মতো মন নেই। ল্যাপটপ বন্ধ করে, গ্লাসের পানিটুকু শেষ করলেন। তারপর বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লেন ফাহাদ।

***********

শুধু সেদিনই না, দেশে ফিরে আসা পর্যন্ত পূনম, ফাহাদের সঙ্গে কোনও কথা বলেননি। ফাহাদ গতকাল দেশে ফিরেছেন। পূনম কিছুক্ষণ আগে ফিরলেন। অখিল তাঁকে আনতে এয়ারপোর্টে গিয়েছিল। ফাহাদের ওপর রাগ করে থাকলেও, পূনম মনে মনে আশা করেছিলেন, ফাহাদ তাঁকে নিতে এয়ারপোর্টে আসবেন। ফাহাদের জায়গায় অখিলকে দেখে তাঁর মন খারাপ হয়ে গিয়েছে। অখিলের কাছেই শুনলেন, ফাহাদ এখন গাজিপুরে ফ্যাক্টরীতে আছে। একবার হঠাৎ মনে হল, গাজিপুর গিয়ে ফাহাদকে সারপ্রাইজ দেবেন; কিন্তু ভাবনাটা সাথে, সাথে নাকচ করে দিলেন। এমন সারপ্রাইজ দেওয়ার কাজ তিনি পনেরো বছর আগে করতেন। এখন এসবে তাঁকে মানায় না।

বাসায় পৌঁছে মেয়েদের কাউকেই পেলেন না পূনম। অখিলের কাছে শুনলেন নীলোর্মি, অরণীর সঙ্গে ভার্সিটিতে গিয়েছে। অখিল তার কাজে চলে গেলে, কুলসুম আর পুতুল এসে পূনমের লাগেজগুলো তাঁর রুমে রেখে গেল। দু’টো ফোন রিসিভ করে, কথা বলা শেষ করলেন পূনম। তারপর নিজের রুমে এসে ঢুকলেন। আহ, শান্তি! দুনিয়ার যত দামি হোটেল আর সুন্দর জায়গাতেই যান না কেন, এই রুমটার মতো শান্তি আর কোথাও পান না তিনি।

গলা আর কান থেকে গয়নাগুলো খুলে রেখে বিছানায় শুয়ে চোখ বুঁজে রাখলেন পূনম। দশ মিনিট শুয়ে থেকে নিজের জায়গায় ফিরে আসার আনন্দটা মন ভরে উপভোগ করলেন। দরজায় টোকা পড়তেই, উঠে গিয়ে দরজাটা খুললেন। কুলসুম বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। টক দই দিয়ে মাখানো ফলের বাটিটা হাতে নিয়ে দরজা বন্ধ করতে যাবেন, তখন কুলসুম বলল, ম্যাডাম, বড়ো খালাম্মা আইসে৷

আপু? কোথায়?

গাড়ি ঢুকতাছে বাসার মধ্যে।

ঠিক আছে। ওপরে আসতে বলিস।

কুলসুম চলে গেলে, পূনম এসে রকিং চেয়ারে বসল। সিনথী কী যেন জরুরি কথা বলার জন্য বারবার ফোন করছিলেন। ফোনে বলতে চাননি। কাল রাতেও ফোন করে জেনে নিয়েছেন, পূনম কখন ফিরবেন। কী এত জরুরি বিষয় হতে পারে, পূনম আন্দাজ করতে পারছেন না। দেখা যাক, সিনথী কী বলেন। পূনম কাঁটা চামচে গেঁথে ফল খেতে লাগলেন।

পাঁচ মিনিট পর সিনথী এসে রুমে ঢুকে বললেন, আসল মাতৃভান্ডারের রসমালাই আর বগুড়ার দই এনেছি। ফুলবানুকে দিয়ে ফ্রিজে রাখালাম। খেয়ে দেখো।

আচ্ছা। আপু কেমন আছ?

ভালো। তোমার কী খবর বলো? খুব তো বেড়ালে। কেমন লাগল?

খুব ভালো লেগেছে। বাসায় সবাই ভালো আছে তো?

হুম, সবাই ভালো। কী খাও।

ফলাহার। খাবে?

না, না। এসব আমার চলে না। তুমিই খাও। আমি কুলসুমকে চা দিতে বলে আসলাম।

আপু, কী এত জরুরি কথা ছিল তোমার, বলো তো?

বলছি। এতগুলো লাগেজ তোমার! কী এত কেনাকাটা করলে?

কেনাকাটা তো আমি সবসময়ই করি। কোনোকিছু ভালো লাগলে কিনে ফেলি। তুমি আগেরবার আমার যে গয়নার সেটটা পছন্দ করেছিলে, তেমন একটা সেট তোমার জন্য এনেছি।

কোনটা, ইস্তাম্বুল থেকে যেটা এনেছিলে?

হুম। ওটার কাছাকাছি ডিজাইনের একটা পেয়ে গেলাম, তাই নিয়ে নিলাম।

সিনথী খুশি হয়ে গেলেন কথাটা শুনে। সবুজ পাথরের সেটটা এখনও তাঁর চোখে লেগে আছে।
পূনমকে ধন্যবাদ দিয়ে সিনথী বললেন, জোবাইদা সেদিন বাসায় এসেছিল। তোমার কথা জিজ্ঞেস করল।

জোবাইদা আপুর সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা হয়েছিল। জোবাইদা আপু কেমন আছে?

ভালোই আছে। তোমাকে যে কথাটা বলতে চাচ্ছিলাম। জোবাইদা ওর ছেলের বিয়ের জন্য ভালো একজন মেয়ে খুঁজছে।

ওনার ছেলে কী করে যেন?

ছেলে তো পাইলট। বিমানে আছে। শাবাব ডমেস্টিকে ফ্লাইং করে। কিছুদিনের মধ্যে অবশ্য ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট পেয়ে যাবে। খুব ভালো ছেলে।

আপু, তুমি আামাকে ওনার ছেলের বিয়ের কথা বলার জন্য বারবার ফোন করছিলে! আমি কী কোনোভাবে হেল্প করতে পারি ওনাকে?

জোবাইদা আমাদের অরণীর কথা বলছিল।

অরণীর কী কথা?

অরণীর সাথে ওর ছেলের বিয়ের কথা বলছিল।

পূনম খাওয়া থামিয়ে বললেন, উনি কী অরণীকে দেখেছেন?

অরণীকে তো দেখেছেই। অবশ্য কয়েক বছর আগে। এখন তো আমরা সারাক্ষণ ফেসবুকে ছবি দিই। জোবাইদা ওর ছবি দেখেছে।

তুমি ওনাকে কী বলেছ?

আমি বলেছি, তুমি দেশে ফিরলে দেখাদেখির একটা ব্যবস্থা করব।

পূনম অবাক হয়ে বললেন, আমি যে এখন আমার মেয়ের বিয়ে দেবো না, এটা কী তুমি জানো না, আপু?

মেয়ে বড়ো হচ্ছে না? বিয়ে তো দিতেই হবে। আজকাল অজানা কারও সঙ্গে সম্পর্ক করাও তো বিপদ। এডজাস্টমেন্টের সমস্যা হয়। জোবাইদাদের সম্পর্কে তো আমরা সবই জানি। ওর ছেলেটাও খুব ভালো। ছোটোবেলা থেকেই তো দেখছি ওকে। আমার মনে হয়, এই ছেলেকে হাতছাড়া করা উচিত হবে না।

আপু প্লিজ থামো। আমার মেয়ের বিয়ে নিয়ে আমি এখন কোনও কথা বলতে চাচ্ছি না। অরণী আগে পড়ালেখা শেষ করবে, চাকরিতে জয়েন করবে। তারপর বিয়ের চিন্তা করব। তুমি জোবাইদা আপুকে নিষেধ করে দিও।

আমি এত বড়ো মুখ করে বললাম ওকে… তুমি একবার জোবাইদার সঙ্গে কথা বলবে, পূনম?

আমি কেন ওনার সঙ্গে কথা বলব?

না মানে, ওর এত আগ্রহ দেখে, আমি ওকে বলেছিলাম, তোমাকে আমি রাজি করিয়ে ফেলব।

তুমি আমাকে হাসালে আপু। এত বছরেও তুমি আমাকে চিনতে পারলে না? এই প্রসঙ্গ বাদ দাও। মাত্র বাড়িতে ফিরেছি। এখন এইসব অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। ভেজাল তুমি লাগিয়েছ। এই ভেজাল তুমিই মেটাবে। আমাকে কোনোভাবেই এসবের মধ্যে জড়াবে না, প্লিজ।

সিনথী বুঝতে পারলেন, পূনম রেগে গেছেন। তিনি বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি রাগ করো না। আমি জোবাইদাকে বুঝিয়ে বলব।

আশিক আর তাজরীন ভালো আছে?

হুম, ভালো। আশিক আগামী মাসে আসছে। এবার আসলে ওর বিয়েটা করিয়ে দেবো।

উহ, আবারও বিয়ে! পূনম তাঁর বোনকে থামাতে গিয়েও থামালেন না। বলুক বেচারি। এই বিষয়ে কথা বলে সিনথী খুব আনন্দ পান। তাঁর এই বোনের মাথায় বিয়ে ছাড়া অন্য বিষয় যেন ঢোকেই না। হোক সেটা নিজেদের কারও বিয়ে বা পরিচিত অন্য কারও। পূনম ধৈর্য ধরে বোনের ছেলের বিয়ের পরিকল্পনা শুনলেন।

*************

পূনম, সিনথীকে খাওয়াদাওয়া করে বিকেলে যেতে বলেছিলেন; কিন্তু ননদের বাসায় যেতে হবে দেখে, সিনথী দুপুরে থাকলেন না। পূনম একটা লাগেজ ভর্তি শুধু গিফট এনেছেন। সিনথী চলে যাওয়ার পর, ঐ লাগেজটা খুলে গিফটগুলো বের করে রাখলেন। সময় করে অখিলকে দিয়ে যাঁর, যাঁর গিফটগুলো পৌঁছে দিতে হবে। ডিভানের পাশের টেবিলে চোখ পড়তে দেখলেন, ওখানে একটা কাগজের ব্যাগ রাখা। ওটা আবার কে রাখল? পূনম এগিয়ে গিয়ে ব্যাগটা তুলে নিলেন। ভেতরে একটা কাঠের অর্নামেন্ট বক্স রাখা। বক্সটা বের করে এনে, কিছুক্ষণ বক্সটার দিকে তাকিয়ে রইল। সুক্ষ হাতের কাজ করা কী সুন্দর একটা বক্স! দেখেই বুঝা যাচ্ছে, এটা চায়নিজদেরই কাজ। বক্সটা খুললে, ভেতর থেকে সুন্দর একটা নেকলেস আর এক জোড়া কানের দুল বেরিয়ে এল। নেকলেসের নীচে চাপা দেওয়া একটা চিরকুট। চিরকুটটা বের করে খুলে লেখাটা পড়লেন, ‘জানি না কী অপরাধ করেছি। তবুও সরি বলছি। তোমাকে ভালোবাসি।’

স্বামীর কাছ থেকে বহুদিন পর এমন হাতে লেখা চিরকুট পেলেন পূনম। গয়নার চেয়েও চিরকুটটা পেয়ে তাঁর মনটা বেশি ভালো হয়ে গেল। ইশ এখন ভীষণ আফসোস হচ্ছে। এয়ারপোর্ট থেকে গাজিপুর যাওয়ার চিন্তা করেও, কেন যে গেলেন না! এই ছোটো ছোটো আফসোসগুলো তাঁকে ভীষণ বিরক্ত করে। জীবনে এমন ছোটো, ছোটো আফসোসের সংখ্যা কেবল বাড়ছেই। ধ্যাত, তাঁর ভালো মেজাজটা হঠাৎ করেই আবার খারাপ হয়ে গেল।………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here