#মন_নিয়ে_খেলা২৩
শেষ পর্ব
*********************
নীলোর্মি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, সাড়ে এগারোটা বাজে। ড্রইং শেষ করে ঘুমাতে প্রায় চারটা বেজে গিয়েছিল। আজ তার ক্লাস নেই বলে সকাল, সকাল ঘুম থেকে ওঠার তোড়জোড় ছিল না। নীলোর্মি বিছানায় শুয়ে মোবাইলটা তুলে নিয়ে ফেসবুকে ঢুকল। টাইমলাইনে ঘোরাঘুরি করল কিছুক্ষণ। দুইজন ফ্রেন্ডের আজ জন্মদিন। তাদেরকে উইশ করল সে। জমে থাকা ম্যাসেজগুলোর উত্তর দিল। মোবাইলটা সাইড টেবিলে রাখতেই আবারও ম্যাসেজের টুংটাং। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখল সাদমানের ম্যাসেজ, “হাই নীলোর্মি, অরণীর ফোনটা বন্ধ পাচ্ছি। একবার দেখবে, ফোনটা বন্ধ কেন?”
“ভাইয়া, আপনি কোথায়? আপুর সঙ্গে দেখা হয়নি?”
“আমি তো ক্যাম্পাসে। ও আজ ক্লাসে আসেনি কেন?”
“আপু যায়নি?”
“উঁহু। তুমি জানো না? তুমি কোথায়?”
“ক্লাসে যখন যায়নি, তাহলে হয়ত বাসায়ই আছে। আমি মাত্র ঘুম থেকে উঠলাম।”
“আহা কী আরামের জীবন! প্লিজ দেখো অরণী কোথায়? ও আমার ম্যাসেজ সিন করছে না।”
“হুম, আমি আপুকে বলছি। বাই।”
নীলোর্মি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে চুলগুলো আঁচড়ে নিল। তারপর রুম থেকে বের হয়ে অরণীর রুমে এসে দরজায় নক করল। কোনও সাড়া না পেয়ে নীলোর্মি দরজার হ্যান্ডেলের নব ঘুরিয়ে রুমের ভেতর ঢুকল। অরণী রুমে নেই। নীলোর্মি পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিল। বোনের রুমটা তার খুব ভালো লাগে, কারণ এই রুমটা সবসময় একদম গোছগাছ করা থাকে। সবসময়। কখনও একটা জিনিসও অগোছালো অবস্থায় থাকে না। নীলোর্মি, অরণীর ফোন নাম্বারে ফোন করে, নাম্বারটা বন্ধ পেল। নীলোর্মি রুম থেকে বেরিয়ে দোতলায় এসে পুতুলকে জিজ্ঞেস করল, আপু বাসায় নেই?
না মনে হয়।
সকালে নাস্তা খেতে আসেনি? বাবা আর আম্মু কোথায়?
স্যার আর বড়ো ম্যাডাম বাইরে গেছেন গা। অরণী ম্যাডাম তো নামেন নাই। কী জানি নামসিল কি না। আমি তো দেখিনাই। খালারে জিগামু?
না থাক। আমি দেখছি। ফুলবানু খালা কোথায়?
নীচে গেছে।
নীলোর্মি নীচতলায় নেমে এসে কাউকে না পেয়ে নিজের রুমে ফিরে এল। সাদমানকে ম্যাসেজ পাঠালো, “আপু ক্লাসে গিয়েছে নাকি?”
“না তো। কেন, ও বাসায় নেই?”
“না, আপু তো বাসায় নেই। আশপাশে কোথাও হয়ত গেছে। আপু ফিরলে আমি আপনাকে নক করতে বলছি।”
“ঠিক আছে।”
নীলোর্মির বন্ধু অদিত ফোন করল। হ্যালো নীলোর্মি…
হুম, বল।
তুই কখন বেরোবি?
নীলোর্মির আজ বন্ধুদের সঙ্গে অলিয়ঁস ফ্রঁসেজে যাওয়ার কথা; কিন্তু এখন কেন জানি তার আর যেতে ইচ্ছে করছে না। সে অদিতকে নিষেধ করে দিয়ে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ল। আজ কেন যেন কিছুই করতে ইচ্ছা করছে না। আজ সারাদিন সে তার রুম থেকে বের হবে না। বালিশটা টেনে নিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে চোখ বুঁজল নীলোর্মি। চোখ বুঁজে নিজের আগামী দিনের কথা ভাবতে লাগল সে। তাদের বাড়িটা তার বন্ধুবান্ধব, এমন কী আত্মীয়স্বজনের বাড়ির থেকেও একটু আলাদা। সবই আছে তাদের, অথচ তারপরও কী যেন একটা নেই! চাওয়ার আগেই তারা সবকিছু পেয়ে যায়, অথচ মনে হচ্ছে কী যেন একটা পাওয়া হয়নি এখনও। কোথায় যেন একটা সমন্বয়হীনতা আছে, কোথায় যেন একটা বিরাট ফাঁক তৈরি হয়েছে। সে এখন থেকে পালাতে চায় বহুদূর। এত অনুশাসন, এত মেকি হাসি-কান্না, লোক দেখানো সামাজিকতা পালন করতে তার একদম ভালো লাগে না। বাড়ির চেয়ে ক্যাম্পাসে গেলে বরং সে বেশি ভালো থাকে। এলোমেলো ভাবনাগুলো তার মেজাজটা খারাপ করে দিল। শুয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। একটু, একটু খিদেও পেয়েছে। নীলোর্মি অলসতা কাটিয়ে বিছানা থেকে উঠে পড়ল। একবারে শাওয়ার নিয়ে তারপর ডাইনিংয়ে যাবে।
শাওয়ার নেওয়া শেষ করে রুমে ঢুকে মোবাইলটা হাতে নিল নীলোর্মি। আবারও সাদমানের ম্যাসেজ, “নীলোর্মি তুমি কিছু জানালে না তো! অরণী ফেরেনি?”
নীলোর্মি ঘড়ি দেখল, প্রায় দুইটা বাজছে। অরণীর মোবাইলে ফোন করে এবারও নাম্বারটা বন্ধ পেল। এবার তার একটু টেনশন হল। এতক্ষণ ফোন বন্ধ থাকবে কেন? তাছাড়া ক্লাসে না গেলে আপুর তো বাসায় থাকার কথা। বাইরে কোথাও যদি যায়ও, ফোনটা তো বন্ধ থাকবে না। তাহলে? নীলোর্মি রুম থেকে বের হয়ে এল। বাড়িতে যাঁরা আছেন, তাঁরা কেউই অরণীর কথা বলতে পারল না। সকালে কেউই তাকে দেখেনি। দুইজন ড্রাইভার এবং অখিলও কিছু বলতে পারলেন না। নীলোর্মি, পূনমকে ফোন দিল। হ্যালো আম্মু…
বলো।
তুমি কোথায়?
ক্লাবে আছি। কেন?
আপু কোথায়?
কোথায় মানে? ক্লাসে হবে।
আপু ভার্সিটিতে যায়নি।
তাহলে ফোন করে জিজ্ঞেস করো।
ওর ফোন বন্ধ।
ফোন বন্ধ কেন?
আমি কী করে বলব! তুমি কখন ফিরবে?
এখনই বের হব।
ঠিক আছে।
মেয়ের ফোন রেখে পূনম মনে করতে চেষ্টা করলেন অরণীর সঙ্গে তাঁর শেষ কখন দেখা হয়েছে। রাতে চড় মারার পর অরণীকে তিনি আর
দেখেননি। সকালে বের হওয়ার সময় ভেবেছিলেন, মেয়েরা বোধহয় ক্লাসে চলে গেছে। তিনি মেয়ের নাম্বারে ডায়াল করে ফোন বন্ধ পেলেন। ভ্রুকুটি করে তিনি ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলেন। পাশ থেকে ক্লাবের সেক্রেটারী জেসমিন বললেন, কী হল পূনম আপু? কোনও সমস্যা?
হুম, না। সমস্যা না। আজকে তো মিটিং শেষ হলই। তুমি রুহুলকে লিফলেটগুলো ছাপাতে দিয়ে দিয়ো। আমি বাসায় গেলাম।
———————–
হ্যালো…
নীলোর্মি, অরণী কোথায়?
ভাইয়া, আপু তো বাসায় আসেনি।
অরণী কোথায় যেতে পারে, বলো তো? আমার তো মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে।
ভাইয়া আমাদের এখানে একটা ব্যাপার ঘটে গেছে।
কী হয়েছে?
কাল রাতে আম্মু, আপুকে চড় মেরেছিল।
কী! কেন? কী করেছিল অরণী?
আমি ঠিক জানি না। রাতে যখন আপুর সঙ্গে কথা হল, আপু আমাকে কিছুই বলেনি। আমি শুধু এটুকু জেনেছি, আম্মুর এক ফ্রেন্ডের ছেলের সঙ্গে আপুর বিয়ের কথা হচ্ছিল। এগুলো নিয়েই কথা কাটাকাটি হয়েছে হয়ত।
এই কারণে রাতে ওর মনটা ভীষণ খারাপ ছিল। আমি বারবার জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? অরণী বললই না কী ঘটেছে। তুমি এটা জানলে কী করে? অরণীর সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?
না। আম্মু কিছুক্ষণ আগে বাসায় ফিরেছেন৷ আম্মুর কাছেই শুনলাম। আমার এখন ভয় লাগছে। আমি বাবাকে ফোন করে জানিয়েছি। বাবা বাসায় আসছেন।
নীলোর্মি, আমি কী তোমাদের বাসায় আসতে পারি?
এখন না, ভাইয়া। আপনি, আপনাদের সব বন্ধুর কাছে ফোন করে খোঁজ নেন। আপু কারও সঙ্গে যোগাযোগ করল কি না।
ঠিক আছে। আমি দেখছি। তুমি ওর খোঁজ পাওয়া মাত্রই আমাকে জানাবে। আমি কিন্তু ভীষণ টেনশনে পড়ে গেলাম।
আমি জানাবো ভাইয়া।
নীলোর্মি ফোন রেখেই ফাহাদের গলার আওয়াজ শুনতে পেল। অখিলের সঙ্গে কী একটা কথা বলে উনি সরাসরি নীলোর্মির রুমে এসে ঢুকলেন। কী হয়েছে আম্মা, বলো তো? অরণী কোথায়?
আমি জানি না, বাবা। সাদমান ভাইয়া ফোন না করলে তো আমি এখনও জানতাম না বাসায় যে কিছু ঘটেছে।
তোমার আম্মু ফিরেছেন?
জি।
ফাহাদ মেয়ের রুমে থেকে বের হয়ে স্ত্রীর রুমে এসে ঢুকলেন। নীলোর্মি বাবার পিছে এসে দাঁড়াল। পূনম, ফাহাদকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এত তাড়াতাড়ি চলে এলে যে? খারাপ লাগছে নাকি?
তার আগে তুমি বলো, তুমি অরণীর গায়ে হাত তুলেছ কেন?
পূনম রাগী চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, গায়ে হাত তোলার মতো অপরাধ সে করেছিল। তাই আমি বাধ্য হয়েছি।
তাই নাকি? অরণী কী অপরাধ করেছিল, শুনি?
মেয়েকে একটা চড় মারলে যদি সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে তো বাচ্চাদের কিছু বলাই যাবে না।
পূনম, তুমি কী এর আগে কবে অরণীর গায়ে হাত তুলেছ?
না।
সারাজীবনে কখনও যার গায়ে হাত তোলোনি, আজ হঠাৎ তেমন একটা কান্ড করলে, মেয়ে তো রিয়েক্ট করবেই। মারার কারণটা কী?
তোমার ছোটো মেয়ে বলেনি?
বলেছে। আমি তোমার কাছ থেকে শুনতে চাই।
বারবার এই একই বিষয় নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না। আমার কাছে যেটা ভালো মনে হয়েছে, আমি সেটাই করেছি। আমি আমার মেয়ের ভালোটাই চিন্তা করেছিলাম। তারা যদি নিজের ভালো না বোঝে, তাহলে আমি আর কী করতে পারি?
তুমি অলরেডি করে ফেলেছ। সকাল থেকে মেয়েটা বাসায় নেই। সেই খোঁজটাও তুমি রাখোনি। এই বাড়ির লোকজন কেউই সকালে অরণীকে দেখেনি। তারমানে সে অনেক সকালে বের হয়ে গেছে। ড্রাইভাররা আসার আগেই। ড্রাইভাররা সাতটায় চলে আসে। অরণী তখন বের হলে, ওদের কেউ না কেউ তো দেখতই। নয়-দশ ঘন্টা ধরে মেয়ের কোনও খোঁজ নেই, তোমার কী সেই চিন্তা আছে?
যাবে কোথায়? কোনও বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে হয়ত। ঐ ছেলেকে ফোন করে দেখো। অরণী ওর সঙ্গেই আছে।
নীলোর্মি প্রতিবাদ করল, আপু সাদমান ভাইয়ার সঙ্গে নেই। ভাইয়া সকাল থেকে বারবার আমাকে নক করে যাচ্ছে।
ফাহাদ বললেন, তুমি এটা কেন করলে পূনম? তোমার পাগলামি তো আমরা সহ্য করছিলামই; কিন্তু এবার তুমি বড্ড বাড়াবাড়ি করে ফেললে। সীমা অতিক্রম করে ফেললে এবার।
তুমি শুধু আমার দোষই দেখতে পাও!
কারণ বেশিরভাগ ভুলগুলো তুমিই করো। তুমি অরণীকে শাসন করতে গিয়ে যে চড়টা মারলে, তোমার কী মনে হয়, এই এক চড়ে তাকে তুমি ঠিক করে ফেলতে পারতে?
আমার উচিত ছিল তাকে আরও আগেই শাসন করা। তাহলে আজ সে এতটা বেয়াদবি করতে পারত না।
এখন আমার মনে হচ্ছে, তোমার সব বেয়াদবি আর স্বেচ্ছাচারিতা সহ্য না করে, বহু আগেই আমারও এমন চড় কষানো উচিত ছিল। তাহলে আমার সংসারে আজকে এমন দিন আসত না।
পূনম অবাক হয়ে বললেন, কী বললে তুমি! তুমি আমাকে মারবে?
এখন আর মেরে কী হবে? এখন তো সব শেষ। মারলেই যদি সমাধান হয়, তাহলে আমার আরও বিশ-পঁচিশ বছর আগে মারা উচিত ছিল। তাই না?
নীলোর্মি এইসব কথার মধ্যে থাকতে চাচ্ছে না। সে রুম থেকে বের হয়ে দরজাটা টেনে দিল। ফাহাদ বললেন, আজ তোমাকে একটা কথা বলি, তুমি হয়ত কষ্ট পাবে, রাগও করতে পারো। তবুও বলি,
তোমাকে কখনও শাসন করতে পারিনি কেন জানো? কারণ তোমাকে তো আমি শাসন করতে চাইনি। আমি তো ভালোবেসেছিলাম। ভালোবাসার মানুষকে শাসন করে বশ করা যায়? আমি নিজের মতো কতবার চেষ্টা করেছি তোমাকে বোঝাতে। তুমি সুন্দর বুঝেও যেতে। তখন আমার মনে হত, এই তো, সবই তো ঠিক আছে। পূনমের মতো ভালো মানুষ আর একটাও আছে নাকি? আমার এই ভালো লাগার রেশ না কাটতেই, তুমি নিজেকে বদলে ফেলতে বারবার। কতবার মন চেয়েছে সম্পর্কটার ওখানেই দাঁড়ি টেনে দিই। পারলাম না তো। ভালোবাসলে এত সহজে দাঁড়ি টানা যায় না। আমার বারবার মনে হয়েছে, একটু চেষ্টা করলে, তোমার মানসিক সমস্যাগুলো দূর হবে। তুমি সবকিছুকেই স্বাভাবিকভাবে নেবে। আমি তো নিজের সাধ্যের পুরোটা দিয়ে চেষ্টা করেছি পূনম। অথচ তুমি নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার তেমন কোনও চেষ্টাই করোনি৷ সেদিনও তুমি বললে, তুমি তৃপ্তির সঙ্গে কথা বলবে। এরমধ্যে কী এমন হল যে তুমি মেয়েটাকে অন্য কারও সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্য আবার মরিয়া হয়ে উঠলে?
পূনম স্বামীর কথার উত্তর দিলেন না। ফাহাদ দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বললেন, আমার মেয়েটা এত অভিমানী। তুমি তাকে এভাবে আঘাত করলে কী করে পূনম? ওকে এখন আমি কোথায় খুঁজব? কোথায় যেতে পারে, আমার মাথায় তো কিছুই আসছে না। যাকেই ফোন করব, সে-ই জানতে চাইবে, ঘটনা কী?
জিজ্ঞেস করলেই বলতে হবে নাকি?
ফাহাদ, পূনমের কথার উত্তর না দিয়ে, পূনমের দুই বোন এবং তাঁর ভাইবোনের বাসায় ফোন করে খোঁজ নিলেন অরণী কারও বাসায় গিয়েছে কি না। চুপচাপ ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না।
পূনম বললেন, এর-তার বাসায় ফোন না করে, ঐ ছেলেকে চেপে ধরো। তোমার মেয়ে ঐ ছেলের সঙ্গেই আছে।
ফাহাদ এক দৃষ্টিতে পূনমের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন, তুমি… তুমি আসলেই অসম্ভব এক মানুষ। তোমার সঙ্গে কথা বলাই বৃথা। কথাটা বলে ফাহাদ রুম থেকে বের হয়ে নীলোর্মির রুমে এলেন। নীলোর্মি ফোনে কথা বলছিল। ফাহাদ জিজ্ঞেস করলেন, কার সঙ্গে কথা বলছে?
নীলোর্মি মোবাইলটা সরিয়ে বলল, সাদমান ভাইয়া।
ফোনটা দাও, আমি কথা বলব।
ফাহাদ ফোন নিলে সাদমান সালাম দিয়ে বলল, আংকেল ভালো আছেন?
ভালো আছি। তুমি আমাকে একবারে সত্যি কথাটা বলো সাদমান, অরণী তোমার সঙ্গে আছে?
না আংকেল। অরণী আমার সঙ্গে থাকলে আমি বারবার ফোন করব কেন?
ঠিক আছে।
ফাহাদ ফোনটা মেয়ের হাতে দিয়ে বাইরে চলে এলেন। ছেলেটা মিথ্যা বলছে না। অরণী ওর সঙ্গে নেই। তাহলে কোথায় গেল মেয়েটা? তিনি কী পুলিশকে জানাবেন? পুলিশ জানা মানেই তো পুরো শহর জেনে যাওয়া। কী যে একটা অবস্থা! আচমকা এ কোন বিপদ হল? পুরো শহর জেনে যাবে, এই ভয়ে তো তিনি মেয়ের সন্ধান বন্ধ করে বসে থাকতে পারেন না। ফাহাদের মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না। তিনি ঘড়িতে সময় দেখলেন, প্রায় পাঁচটা বাজছে। মোবাইল ফোনে তাঁর বন্ধু ডিআইজি আশরাফকে ফোন করে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বললেন; কিন্তু অরণীর কথাটা বলতে গিয়েও, শেষ পর্যন্ত বলতে পারলেন না ফাহাদ।
—————————
আত্মীয়স্বজন যাঁরাই শুনেছেন, তাঁরাই ফোন করে অরণী ফিরল কি না জানতে চাচ্ছেন। এতক্ষণ পর্যন্ত পূনম নিজের রাগ নিয়েই বসেছিলেন। তাঁর দুই বোন এসে চোখে আঙুল দিয়ে তাঁর ভুলগুলো ধরিয়ে দিলে, পূনমের মনে হল, তিনি সত্যি কাজটা ভালো করেননি৷ নিজের জেদ বজায় রাখতে গিয়ে, মেয়ের মতের বিরুদ্ধে তার বিয়ে দিতে চেয়েছেন। তারচেয়ে বড়ো ভুলটা করেছেন, অরণীকে চড় মেরে। এই প্রথম অরণীর জন্য তাঁর টেনশন হল। বোনদেরকে নিজের রুমে বসিয়ে রেখে পূনম, ফাহাদের রুমে এলেন। ফাহাদ রুমে নেই। পূনম ফোন করলে ফাহাদ জানালেন, তিনি অখিলকে নিয়ে বাইরে এসেছেন। অরণী থাকতে পারে, এমন জায়গাগুলোতে তিনি নিজে গিয়ে মেয়েকে খুঁজবেন। পূনম পুলিশকে জানানোর কথা বললে, ফাহাদ বললেন, পূনম যেন নিজ থেকে কাউকে ফোন না করে। যা করার তিনিই করবেন।
এদিকে টেনশনে পাগলপারা অবস্থায় সাদমান, নিয়নকে সাথে নিয়ে অরণীর বাসায় চলে এসেছে। বাড়ির সামনে থেকে নীলোর্মিকে ফোন দিলে, নীলোর্মি ওদেরকে নিয়ে এসে দোতলার ফ্যামিলি লিভিংয়ে বসাল। এই কয় ঘন্টার মধ্যেই সাদমানের চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। নীলোর্মি জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া আপনি কিছু খেয়েছেন?
নিয়ন বলল, দুপুরে এক কাপ চা ছাড়া ও আর কিছুই খায়নি৷ আমরা এত সাধাসাধি করলাম; কিন্তু সাদমানকে খাওয়াতে পারলাম না।
আপনারা বসেন৷ আমি খাওয়ার ব্যবস্থা করছি।
সাদমান বলল, এখন খাওয়ার সময় না, নীলোর্মি। আমার তো মাথা কাজ করছে না। অরণীকে আমি কোথায় খুঁজব? সারাদিন খুঁজেছি। আমাদের পরিচিত সব রেস্টুরেন্টে, বসার জায়গায় ওকে খুঁজলাম। অরণী কোথাও নেই। এখন তো রাত হয়ে যাচ্ছে। আমি এখন কী করব? আমি কী থানায় যাব? হসপিটালে দেখব একবার?
নিয়ন বলল, আরে ব্যাটা হসপিটালে যাবি কেন? অরণীর কী হয়েছে?
আমি কিছুই বুঝতে পারছি না নিয়ন। আমার মাথায় শুধু খারাপ চিন্তা ছোটাছুটি করছে। অরণীর নিশ্চয়ই কোনও বিপদ হয়েছে। নাহলে ও এভাবে নিশ্চুপ থাকতে পারেই না। অসম্ভব। সাদমানের গলার স্বর ভারী হয়ে এল। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। নীলোর্মি উঠে এসে সাদমানের কাঁধে হাত রেখে বলল, প্লিজ ভাইয়া, আপনি এমন করবেন না। আপুর কিছুই হয়নি। ও হয়ত আম্মুর ওপর রাগ করে কোথাও লুকিয়ে আছে। একটু পরে ঠিক চলে আসবে।
———————
সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজা শেষ করে ফাহাদ আবারও ডিআইজি আশরাফকে ফোন করলেন। আশরাফ ফোন ধরে বললেন, তোর কী হয়েছে, বল তো? সব ঠিক আছে তো? তোকে কেমন যেন উতলা লাগছে।
একটু ঝামেলায় আছি। তুই কোথায়?
আমি আছি মিন্টো রোডের দিকে। কেন তুই আসবি?
হুম। একবার দেখা করা দরকার।
তুই কোথায় আছিস?
বনানী ক্রস করছি।
তুই শেরাটনের কাছে এসে আমাকে ফোন দিস।
ঠিক আছে।
ডিআইজির ফোন রাখার পর ফাহাদের আম্মা আমেনা চৌধুরী ফোন দিলেন। ফাহাদ চিন্তিত মুখে ফোন রিসিভ করলেন। তাঁর আম্মা নিশ্চয়ই এতক্ষণে জেনে গেছেন। তাঁর কাছে বকা খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ফাহাদ বললেন, আম্মা কেমন আছ?
আমেনা বললেন, তুই কোথায়?
আমি বাইরে আছি আম্মা। একটু ব্যস্ত আছি। আমি তোমাকে একটু পরে ফোন দিচ্ছি।
কিসের এত ব্যস্ত তুই? কই যাস?
একটা মিটিং আছে, আম্মা।
আমার অরণী কই?
ফাহাদ এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন। আম্মা তাহলে ঘটনা জেনেই তাঁকে ফোনটা করেছেন। ফাহাদ বললেন, আম্মা, আমি হাতের কাজটা শেষ করে তোমাকে ফোন দিচ্ছি।
রাখ তোর ব্যস্ততা। আগে আমার কথার জবাব দে। অরণী কই?
অরণী আছে।
কোথায় আছে?
ফাহাদ কিছু চিন্তা না করে বললেন, বন্ধুর বাসায়।
কোন বন্ধু?
আম্মা, আমার সত্যি খুব তাড়া আছে।
তুই কী সুন্দর করে আমার সাথে মিথ্যা বলতে পারিস! কবে শিখলি এত সুন্দর মিথ্যা?
আম্মা, আম্মা…
কী আম্মা, আম্মা? অরণী কই ফাহাদ?
ফাহাদকে এবার আত্মসমর্পণ করতেই হল, আম্মা, তুমি টেনশনে থাকবে দেখে তোমাকে জানাইনি। অরণী ওর আম্মুর সঙ্গে রাগ করে সকালে বাসা থেকে বেরিয়ে গেছে।
ফ্লোরা আমাকে সব বলেছে। তোর পাগল বউ আর মানুষ হল না!
আম্মা!
কী আম্মা? তুই এখনই আমার বাসায় আসবি।
কেন আম্মা? কোনও কাজ ছিল?
আমার যা কাজ, তুই আসার পরই আমি বলব। তোর বউকে তো কোনোদিনও কোনও কথা শুনানো হয়নি৷ এবার আমি তারে কিছু কথা শুনাব। তুই এখনই আয়।
আম্মা, আমি এখন আশরাফের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি। রাত হয়ে যাচ্ছে। অরণীর খোঁজ পাওয়াটা খুব দরকার।
অরণী আমার কাছে। তুই এক্ষুণি আমার কাছে আসবি।
অরণী তোমার কাছে! ও তোমার কাছে কখন গেল?
শুধু বাপ-মা হলেই হয় না, ফাহাদ। সন্তানের ভালো-মন্দের খোঁজ রাখতে হয়। অরণী সাতটার আগে আমার এখানে চলে আসছে। অথচ সারাদিন তোরা একটা ফোনও দিলি না! তুই এখনই আয়।
আম্মা, তুমি সত্যি বলছ?
তোর কী মনে হয়, আমি তোর সঙ্গে ফাইজলামি করতেছি?
স্যরি আম্মা। আমি আসছি। ফোন রেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন ফাহাদ। অখিলকে নিয়ে তাঁর মা’র বাড়ির দিকে রওনা দিলেন। পূনমকে ফোন করতে গিয়েও অভিমানের কারণে করলেন না। আগে তিনি অরণীর কাছে যাবেন। তারপর অন্যকিছু।
ফাহাদ, মা’র কাছে পৌঁছে বললেন, আম্মা অরণী কোথায়?
আমেনা বললেন, অরণীকে আমি যেতে দেবো না। ঐ বাড়িতে অরণী যাবে না। আমি একবারে বিয়ে দিয়ে নাতনি বিদায় করব।
ফাহাদ সোফায় বসে বললেন, আম্মা, তুমি সারাটাদিন এভাবে ভয় দেখাতে পারলে!
চুপ কর। আমি কোথায় ভয় দেখালাম? তুই শুকরিয়া কর, যে অরণী অন্য কোথাও না গিয়ে আমার কাছে চলে আসছে।
আমি ভীষণ টেনশনে ছিলান, আম্মা।
মারপিটের সময় মনে ছিল না?
আমি কখন মারপিট করলাম!
আমেনা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন; কিন্তু তার আগে অরণী রুমে ঢুকল। ফাহাদ মেয়েকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। অরণী কাছে আসলে, ফাহাদ মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন৷ তাঁর মনে হচ্ছে, বহুদিন পর তিনি মেয়েকে দেখতে পেলেন। আলিঙ্গনবদ্ধ অবস্থায় বললেন, এভাবে ভয় দেখালে কেন আম্মা?
স্যরি বাবা।
আমেনা বললেন, কিসের স্যরি। আমি ওকে নিষেধ করেছি তোদেরকে ফোন করতে। এখন থেকে ও আমার কাছে থাকবে। তোরা থাক তোদের ইয়ার-দোস্ত নিয়ে। আমি অরণীকে বিয়ে দেবো। তোরা আসতে পারবি না বিয়েতে।
ফাহাদ তাঁর আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, বড্ড ভুল হয়ে গেছে আম্মা। অরণী থাকুক তোমার কাছে। পূনম যদি নিজের ভুল বুঝতে পেরে ওকে নিতে আসে, তাহলেই অরণী বাসায় যাবে।
অরণী, আমেনা চৌধুরীর হাত ধরে বলল, দাদু আমি বাবার সঙ্গে বাসায় যাই। পরে আরেকদিন আসব।
না, না। তুমি যেতে পারবা না।
আজকে থাকতে বলো না দাদু। আম্মু, নীলোর্মি ওরা সবাই টেনশন করছে। সারাদিন সবাইকে অনেক টেনশন দিয়েছি। আজকে আর খারাপ কিছু করতে চাই না। দাদু, আমার ফোনটা দাও, প্লিজ।
আমেনা তাঁর রুমে গিয়ে অরণীর ফোন এনে দিলেন। তাঁর জোরাজুরিতে ফাহাদ আর অরণী খাওয়াদাওয়া করে তারপর এই বাড়ি থেকে বের হতে পারল।
গাড়িতে উঠেই অরণী মোবাইল অন করল আর সাথে সাথে অসংখ্য ম্যাসেজ আসতে লাগল। ফাহাদ হেসে বললেন, এত টুংটাং হচ্ছে কেন? তুমি তো দেখছি ভিআইপি হয়ে গেছ।
অরণী সবার আগে সাদমানকে ম্যাসেজ করে, জানালো, সে বাড়িতে আসছে। রাতে কথা হবে। ম্যাসেজ পেয়েই সাদমান ফোন করল। অরণী ফোন রিসিভ করে নীচু স্বরে জানালো, তার বাবা পাশে আছে। বাসায় গিয়েই সে সাদমানকে ফোন করবে।
———————-
বাসায় আসার পর পূনম মেয়ের সঙ্গে কোনও কথা বলতে পারেননি। তার আগেই ফাহাদ তাঁর রুমে এলেন। ফাহাদ সোফায় বসে বললেন, কিছু জরুরি কথা বলব। তারপর চলে যাব। শোনা না শোনা তোমার ব্যাপার। তবে আজকের পরে আমি এই বিষয়ে আর কোনও কথা বলব না। আর ধৈর্য ধরে না পূনম। বয়স হচ্ছে তো, আমারও রাগ হয় মাঝেমধ্যে।
পূনম চুপ করে বসে আছেন কথা শোনার জন্য। ফাহাদ বললেন, এত বছরে তোমার অনেক আবদার মিটিয়েছি। তোমার অনেক পাগলামি, না পাগলামি বলব না, তোমার খেয়ালি মনের ইশারায় চলেছি; কিন্তু এবার মনে হয় ফাইনালি রাশ টানার সময় এসেছে। তুমি আমার সঙ্গে যা করার করেছ। ভালোবাসি বলে আমিও অনেক কিছু না দেখে পাশ কাটিয়ে গেছি; কিন্তু আমার মেয়েদের সঙ্গে তুমি তোমার খেয়ালি মনের চাল চালতে পারবে না পূনম। তোমার কাছে একটাই অনুরোধ, অন্যের মন নিয়ে না খেলে, নিজের মনের প্রতি যত্ন নাও। আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা না করে, নিজের মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ আনার চেষ্টা করো। আদতে তোমারই লাভ হবে। আজ একটা কথা বলতে চাই, এটা বলা হয়ত একটু কঠিন হয়ে যাবে, তবুও আজ বলতেই হবে। তুমি চাইলে নিজের মতো আলাদা হয়ে যেতে পারো। তোমার নিজের বাড়ি আছে, টাকাপয়সারও কোনও টেনশন করতে হবে না। তুমি তোমার খুশি মতো জীবনযাপন করতে পারবে পূনম। আমরা তিনজন কখনও তোমাকে বিরক্ত করতে আসব না; কিন্তু…
ফাহাদকে থামতে দেখে পূনম বললেন, কিন্তু কী?
কিন্তু যদি আমাদের সঙ্গে থাকতে হয়, মানে যদি তুমি থাকতে চাও, তোমাকে এই খেয়ালি পূনমের আবরণ ঝেড়ে ফেলতে হবে। আমি জানি তুমি পারবে না। এত বছরে যখন পারোনি, আজকেও পারবে না। তাই বলছি, তুমি একদম স্বাধীনভাবে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারো। সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে শুধু জানিয়ে দিয়ো। আমি সেইমতন সব ব্যবস্থা করে দেবো।
ফাহাদ রুম থেকে বের হয়েও আবার ফিরে এলেন, আরেকটা কথা, আমি দুই-একদিনের মধ্যে সাদমানের ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলব। দেখি তাঁরা কী বলেন। তাঁদের যদি কোনও আপত্তি না থাকে, তাহলে অরণী আর সাদমানের যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিয়ে দেবো। আশা করছি তুমি নতুন কোনও সিন ক্রিয়েট করার চেষ্টা করবে না।
পূনম বললেন, তুমি আমাকে এত কঠিনভাবে কথাগুলো বলতে পারলে? তুমি চাচ্ছ আমি এবাড়ি ছেড়ে চলে যাই?
আমি যদি সেটাই চাইতাম তাহলে তা অনেক আগেই করে ফেলতাম। ভালোবাসার পেছনে হন্যে হয়ে ঘুরে জীবনের সুন্দর সময়গুলো এভাবে হারিয়ে ফেলতাম না। আমি তোমাকে যতটা ভালোবেসেছি, তুমি হয়ত আমাকে সেভাবে ভালোবাসতে পারোনি। তাই তো এতগুলো বছর একসাথে থেকেও, এত ভালোবেসেও কোথায় যেন একটা ফাটল রয়ে গেছে। এই ফাটল হয়ত আর কখনও সারবে না। সত্যি বলতে, আমার এখন মন নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভয় লাগে। হুট করে কখন মরে যাব, ঠিক নেই। তোমার ভালোবাসা তো তোমার মর্জির ওপর নির্ভর করে। এই আছে, তো এই নেই। তাই বাকি সময়টাতে নিজেকে একবার ভালোবাসতে চাই। একটু নিজের মতো করে থাকতে চাই। তুমিও যেন তোমার নিজের ইচ্ছামতো সময়গুলো কাটাতে পারো, আমি এটাই চাই।
ফাহাদ রুম থেকে বেরিয়ে গেলে, পূনম চুপ করে বসে রইলেন। স্বামীর কথাগুলো তাঁর মাথার ভেতর অসম্ভব রকমের যন্ত্রণা দিচ্ছে। এত বছরের সংসার জীবনে ফাহাদ কোনোদিনও তাঁকে আলাদা হয়ে যেতে বলেননি। আজ তিনি এতবড়ো কথাটা কী অবলীলায় বলে ফেললেন! পূনম কী সত্যি অন্যদের জীবন এতটাই অতিষ্ট করে তুলেছেন? তাঁর স্বামী, দুই মেয়ের কেউই তাঁকে পছন্দ করে না। কেন পছন্দ করে না? পূনম কী খুব বেশি স্বেচ্ছাচারিতা করে ফেলেছেন সবার সঙ্গে? তিনি সবার ভালো চান বলেই তো তাঁর পছন্দমতো অন্যদের জীবনটা সাজাতে চেয়েছেন। এখন তো দেখছেন, তিনি শুধু অন্যদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছেন। স্বামী, সন্তানের জীবনে তাঁর কোনও মূল্য নেই, কোনও স্থান নেই। স্বামী আজ কতো সহজে তাঁর কাছ থেকে মুক্তি চাইছেন? মেয়েরা তাঁকে সহ্য করতে পারে না! পূনমের নিজেকে কেমন পগল, পাগল লাগছে। এ কেমন জীবন যাপন করছেন তিনি? এই জীবন তো তিনি চাননি। অথচ তিনি যেমন জীবন চেয়েছেন, সেই জীবন তাঁর কাছ থেকে প্রিয়জনদের দূরে সরিয়ে দিয়েছে। তিনি কী করবেন এখন? তিনি কী আলাদা হয়ে যাবেন? আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা তো তিনি কোনোদিনও ভাবেননি।
———————–
তিনদিন পার হয়ে গেলেও পূনম কারও সঙ্গে কথা বললেন না। নিজের রুম থেকেও বের হলেন না। ফোনের সুইচড্ অফ করে রাখলেন যাতে তাঁর সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করতে না পারে। অরণী আর নীলোর্মি একবার এসেছিল তাঁর রুমে খেতে ডাকার জন্য; কিন্তু পূনম খেতে যাননি। রুমে খাবার আনিয়ে নিয়েছেন। তিনি খুব আশা করছিলেন ফাহাদ একবার তাঁর রুমে আসবে; কিন্তু ফাহাদ একবারও রুমে উঁকি দেননি।
পূনম বিছানায় শুয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিলেন। দরজায় নক করে ফাহাদ রুমে ঢুকে বললেন, বসব?
এটা কেমন কথা? বসো।
একটা কথা বলতে আসলাম।
বলো।
সাদমানের বাবার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। এই শুক্রবার ওনাদেরকে আমাদের বাসায় ইনভাইট করেছি। কথাটা তোমাকে জানানো দরকার, তাই জানালাম। শুক্রবারে তুমি যদি বাসায় থাকো আর যদি তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে চাও, দেখা করতে পারো। আমি চাই না, আমাদের সংসারের জটিলতা আর ভঙ্গুর অবস্থাটা ওনারা এখনই জেনে যাক।
পূনম মাথা নীচু করে বসে আছেন। ফাহাদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ঠিক আছে আমি যাই।
পূনম ডুকরে কেঁদে উঠলেন। তাঁর অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে। ফাহাদ তাঁকে যেভাবে অবহেলা করছেন, জীবনে কেউ কখনও তাঁকে এতটা অবহেলা করেনি। তাঁর এখন মনে হচ্ছে এত অবহেলা পাওয়ার চেয়ে মরে যাওয়াটাই বেশি ভালো।
ফাহাদ পূনমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত রেখে বললেন, কাঁদছ কেন পূনম? তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। তুমি যেভাবে চাও, সেভাবেই সব হবে।
পূনম স্বামীর হাত ধরে বললেন, এভাবে বলো না প্লিজ আমি সহ্য করতে পারছি না।
তুমি কী চাও পূনম?
আমি জানি না আমি কী চাই। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। আমার আর বাঁচতে ইচ্ছা করছে না।
বাঁচতে ইচ্ছা করবে না কেন? কতো জাঁকজমকপূর্ণ জীবন তোমার!
এভাবে বলো না, আমি তোমার কথাগুলো নিতে পারছি না।
ফাহাদ মুখে হাত দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। পূনমকে আজকের আগে এমন ব্যাকূল হয়ে কখনও কাঁদতে দেখেননি তিনি। পূনমের কান্না থামার অপেক্ষা করছেন তিনি।
পূনম চোখ মুছে বললেন, আমি নিজেও জানি না, হঠাৎ আমার কী হয়ে যায়? আমি নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি না। আমার রাগ, আমার অহংবোধ আমাকে গ্রাস করে ফেলে। আমি কী করব বলো?
দাম্ভিক পূনমের চেহারাটা আজ বড্ড মলিন আর অসহায় দেখাচ্ছে। ফাহাদের খুব মায়া হল এমন চেহারা দেখে। তিনি জানেন, পূনম কখনও পালটাবে না, পূনমের মতো মানুষরা এত সহজে পালটায় না। কারণ তাঁরা নিজের কোনও ভুল ধরতে পারে না। তাই পালটানোর প্রশ্নই আসে না। ফাহাদ বললেন, কেঁদো না। রেস্ট নাও। আমি যাই।
শোনো।
ফাহাদ পিছে ফিরে তাকালেন। পূনম বললেন, সারাজীবন শুধু নিয়েছি তোমার কাছ থেকে। আজ আরেকবার আমাকে সুযোগ দাও।
কী চাও পূনম?
আমাকে তৃপ্তির কাছে নিয়ে যাবে?
আবার কেন? ফাহাদ হতাশ হয়ে বললেন।
সারাজীবন অন্যের মন নিয়ে খেলেছি। আজ মনে হচ্ছে নিজের মনের সাথে এবার বোঝাপড়াটা করতেই হবে। আমি তোমার কাছে আরেকবার হেল্প চাই, শেষবারের মতো।
বলো কী চাও।
আমি তৃপ্তির কাছে যাব। প্লিজ আমাকে নিয়ে চলো, প্লিজ।
ফাহাদ চশমাটা খুলে চোখ দুটো চেপে ধরলেন। হঠাৎ তাঁর চোখ জ্বালা করছে। পূনম কী সত্যি বদলাতে চায়? তাঁকে কী আরেকটা সুযোগ দেওয়া উচিত হবে? জীবনে বহুবার তিনি পূনমের কাছে হেরে গেছেন। আরও একবার না হয় হারলেন। তাঁর তো নতুন করে হারানোর কিছু নেই; কিন্তু পূনম যদি এবার সত্যি নিজেকে শুধরে নিতে পারেন, তখন ফাহাদের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবেন না। ভালোবাসার জন্য আরেকবার না হয় জীবনবাজি রাখবেন তিনি। ভালোবাসার মানুষের জন্য জীবনবাজি রাখাই যায়।