#মন_নিয়ে_খেলা(১৭)
***********************
ফাহাদ যে ভেতরে, ভেতরে কখন এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছেন, এটা তিনি বুঝতেই পারেননি। বেশ কিছুদিন ধরেই তাঁর খারাপ লাগছিল; কিন্তু অত্যাধিক কাজের চাপে, তিনি অন্য কোনোদিকে লক্ষ্য করার সময়ই পাননি। ডাক্তাররা তাঁকে যেভাবে চলতে বলে দিয়েছিলেন, বেশিরভাগ সময়ই তিনি ঐ মোতাবেক চলেননি। তিনি কখনোই মাত্রাতিরিক্ত খাবার খান না। বরং মাঝেমধ্যে প্রয়োজনের তুলনায় একটু কমই খান। ক্লান্তির কারণে মাঝেমাঝে ঠিকমতো ব্যায়ামটাও করা হয়ে ওঠে না। এই বছরটায় তিনি ভালোই অনিয়ম করেছেন। এখন তাঁর কোম্পানি যে অবস্থানে আছে, তাতে তিনি একটু থিতু হয়ে বসতে পারেন; কিন্তু মানুষকে যখন সফল হওয়ার নেশা পেয়ে বসে, মানুষ তখন আরও সফল হওয়ার লক্ষ্যে কেবল ছুটতেই থাকেন।
ফাহাদ ভেবেছিলেন নরমাল চেক-আপ শেষ করে তিন-চারদিনের মধ্যে তাঁরা ঢাকা ফিরে আসবেন; কিন্তু সিঙ্গাপুর আসার পর দেখলেন, বিষয়টা তিন-চারদিনে শেষ হবার না। নানারকম টেস্ট আর চেক-আপের পর দেখা গেল, করোনারি ধমনীর মধ্যে ব্লকেজ ধরা পড়েছে। মোট তিনটা ব্লক তৈরি হয়েছে।
ফাহাদের ট্রিটমেন্ট শেষে পূনম যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরে যেতে চেয়েছিলেন; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অন্তত তিন সপ্তাহ তাঁদের এখানে থাকতে হবে। এখানে থাকাটা সমস্যা না, সমস্যা হচ্ছে তাঁর অনুপস্থিতিতে অরণী কী কী কান্ড করবে, এটা ভেবে তাঁর ভীষণ অস্থির লাগছে। তিনি ঠিক করলেন, দুই মেয়েকে এখানে চলে আসতে বলবেন। পূনম, মেয়েদের এখানে আসার কথাটা ফাহাদকে বললে, ফাহাদ বললেন, ওরা ক্লাস বাদ দিয়ে এতদিন এখানে থাকলে, লেখাপড়ার ক্ষতি হবে। ওদের আসার দরকার নেই।
পূনম গ্রীন টির কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, এতদিন ওরা একা একা কী করবে, না করবে তার কোনো ঠিক আছে? তারচেয়ে এখানে চলে আসুক।
কী করবে, মানে কী! ওরা কী এর আগে কখনও একা থাকেনি? তুমি যে বছরে কয়েকবার করে দেশের বাইরে যাও, এটা কী ভুলে গেলে? আমরা দুজনেই যখন বাসার বাইরে থাকি, তখন ওরা একা থাকে না?
তখন আর এখনকার মধ্যে পার্থক্য আছে।
কী পার্থক্য?
তুমি জানো না?
আমি তো কোনো পার্থক্য দেখি না।
তুমি কী তোমার বড়ো মেয়ের কান্ড-কারখানা ভুলে গেছ? তোমাকে যে অরণীর সঙ্গে কথা বলতে বলেছিলাম। অরণীর সঙ্গে কথা বলে, তুমি তো আমাকে কিছু জানালেই না!
অরণী, সাদমানকে পছন্দ করে। ওরা লেখাপড়া শেষ করুক। তারপর চিন্তা করে দেখব, কী করা যায়।
লেখাপড়া শেষ করলে, কী চিন্তা করবে? তুমি কী ঐ ছেলের সঙ্গে অরণীর বিয়ের চিন্তা করছ নাকি?
চিন্তা করলে দোষ কোথায়?
আমার দিকে তাকাও।
ফাহাদ চা’য়ে চুমুক দিয়ে পূনমের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, এত উত্তেজিত হয়ে কথা বলছ কেন পূনম? শেষে তো তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।
আমি এত সহজে অসুস্থ হই না। আমি কখনোই এই ছেলেকে বিয়ে করার জন্য অরণীকে পারমিশন দেবো না।
তুমি এমন করছ কেন পূনম? বিষয়টা আগে ভালোমতো বুঝে নাও। তুমি ছেলেকে দেখোনি, ওর ফ্যামিলি সম্পর্কেও কিছু জানো না। কোনোকিছু না জেনেশুনেই এমন হুট করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছ কেন?
অরণী যা বলবে, তা-ই হবে নাকি? সে যে ভালো-মন্দ কিছুই বেঝে না, তার প্রমান তো আমরা পেয়েই গেছি। সে যদি ঠিক করে থাকে, তার নিজের পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করবে, তাহলে তার পছন্দটাও তেমনই হওয়ার দরকার ছিল। সে এমন কারোকে পছন্দ করলেই পারত, যেখানে আমাদের না বলার মতো কোনো সুযোগ থাকত না।
কেমন ছেলে?
তুমি জানো না কেমন ছেলে? কেমন ছেলে হলে আমাদের সাথে সহজে অ্যাডজাস্ট করতে পারবে, সেটা তুমি বোঝো না?
আমি তো জীবনটাকে এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে দেখিনি। আমার কাছে মনে হয়, মানুষটা ভালো হওয়াটাই সবচেয়ে জরুরি বিষয়।
মানুষ ভালো হলেই হল, আর কিছু লাগে না জীবনে?
সেটাই তো জানতে চাই, আর কী লাগে?
তোমার সাথে তর্কে জড়িয়ে লাভ নেই। তুমি ইচ্ছে করে আমাকে রাগানোর চেষ্টা করছ। শোনো, দিনার ভাসুরের ছেলে, অর্ণব। ছেলেটা ডাক্তার। খুব ভালো ছেলে। চায়নাতে পিএইচডি করছে। ছেলেটা দুইমাস পর, একমাসের জন্য দেশে আসছে। আমি চাই ঐসময়ে ওদের বিয়েটা হয়ে যাক। অরণীর ছবি দেখে দিনারা সবাই খুব পছন্দ করেছে।
পূনম তুমি এইসব কী বলো?
তুমি অর্ণবের বাবাকে চিনবে তো। উনি হোটেল কাসাব্ল্যাংকার মালিক।
কোন কাসাব্ল্যাংকা, আমরা যেখানে দুইটা অনুষ্ঠান করলাম?
হুম। ভদ্রলোক দুইটা হোটেলের মালিক। চট্টগ্রামে ওনার একটা হোটেল আছে। হোটেল ব্লু মুন। বিশাল অবস্থা তাদের। কথাটা বলে অরণী মোবাইল থেকে অর্ণবের ছবি বের করে ফাহাদকে দেখালেন। ছবির দিকে তাকিয়ে ফাহাদ বললেন, এটা কে?
কে আবার? এটাই তো অর্ণব। দেখেছ কত সুন্দর দেখতে।
ফাহাদ ছবি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললেন, এইসব ছবিটবি আমাকে দেখিও না। অরণীর বিয়ে নিয়ে আমি এক্ষুনি কিছু ভাবছি না। তাছাড়া সাদমানের সঙ্গে যেখানে আরণীর সম্পর্ক আছে, সেখানে অন্যকিছু ভাবার মতো সুযোগ নেই।
তুমি পড়ে থাকো তোমার ভাবনা নিয়ে। তোমার কথা শুনছে কে? অর্ণব যখন আসবে, আমি তখনই ওদের দুইজনের আকদ্ করিয়ে রাখব। তখন অরণীরও পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবে। দিনার জা’র সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।
কথাও হয়ে গেছে!
হুম।
তুমি অরণীর পারমিশন নিয়ে কথা বলেছ?
অরণীর পারমিশন নিতে হবে কেন? আমি যা চাইব, তা-ই হবে।
ওহ, পূনম, আর কতদিন স্বেচ্ছাচারিতা করে যাবে? মেয়ে বড়ো হয়েছে। তার নিজের পছন্দ আছে। তুমি তাকে এভাবে জোর করতে পারো না। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।
ঠিক আছে, ঠিক আছে। এখন তো তুমি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ। এই সময়ে তোমার উত্তেজিত হওয়া ঠিক না।
তুমি থামো পূনম। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি। তুমি যা করছ, তাতে পরে গিয়ে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। একটা বিপদ হওয়ার আগে তুমি মানুষের মন নিয়ে খেলা বন্ধ করো।
আমি কারও মন নিয়ে খেলছি না। আমার কাছে যেটা ঠিক মনে হচ্ছে, আমি সেটাই করেছি এবং আগামীতেও করব।
এটাই তো সমস্যা। তুমি কোনোদিন অন্যের মন বোঝোনি৷ বুঝতে চাওনি। তোমার আছে শুধু তুমিময় পৃথিবী। সেখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তুমি আর তুমিই বিরাজ করো।
পূনম এখন আর কথা বাড়াতে চাচ্ছেন না। এই লোকের সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। করবেন তো তিনি সেটাই, যেটা তিনি ঠিক করে রেখেছেন।
ফাহাদ রেস্ট নেওয়ার জন্য শুয়েছিলেন। পূনম কেনাকাটার জন্য বাইরে এসেছেন। কেনাকাটা করতে যাওয়ার আগে, তিনি হসপিটালের লবিতে এসে অরণীর মোবাইলে ফোন দিলেন।
হ্যালো, আম্মু কেমন আছ?
ভালো। তোমরা কেমন আছ?
ভালো আছি। বাবা কেমন আছে?
আছে মোটামুটি। বুধবারে তোমার বাবার অপারেশন হবে। শোনো তোমরা দুইজন এখানে চলে এসো। আমি অখিলকে বলছি টিকিট কেটে আনতে।
আম্মু, আমরা এখন কেমন করে আসব? নীলোর্মির সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। আগামী সপ্তাহে আমার পরীক্ষা শুরু হবে। বাবা কী বেশি অসুস্থ? একটু আগেই তো বাবার সঙ্গে কথা বললাম। বাবা তো বললেন ঠিক আছেন।
তোমার বাবা তো সবসময়ই ঠিক থাকেন। ঠিক থাকলে কী অপারেশন করাতে হত?
আম্মু, আমরা তাহলে কী করব? পরীক্ষা দেবো নাকি….
পূনম একটু চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে, পরীক্ষা দাও। এক কাজ করো, তোমরা দুইজন বড়ো আপুর বাসায় চলে যাও। আমরা না আসা পর্যন্ত তোমরা ওখানে থাকবে।
বড়ো খালামনির বাসায়? আমরা ওখানে থাকব কেন!
কারণ আমরা বাসায় নেই। খালি বাসায় তোমাদের একা একা থাকার দরকার নেই।
খালি বাসা কোথায়! বাসায় এতজন মানুষ রয়েছে। তাছাড়া আমরা তো সবসময়ই এভাবেই থাকি। এটা কী আজকে প্রথম নাকি?
যা বলেছি তা-ই করো। এত কথা বলছ কেন?
পূনমের কথা শুনে অরণীর ভীষণ বিরক্ত লাগল। সে বলল, সবসময় তুমি যা বলছ, তা-ই কেন আমাদের করতে হবে? আমরা নিজের বাসা ছেড়ে, অন্যের বাসায় গিয়ে কেন থাকব?
কেন থাকবে, জানো না?
না জানি না। তুমি বলো কোন থাকতে হবে?
আমি নেই আর তুমি নিজের ইচ্ছামতো ঐ ছেলের সঙ্গে যা খুশি করে বেড়াবে, তা হবে না।
কোন ছেলে? তুমি কার কথা বলছ? সাদমান?
হ্যাঁ তার কথাই বলছি। আমি ঢাকায় নেই আর তুমি যা খুশি করে বেড়াচ্ছ।
আম্মু তুমি কী বলো এইসব!
তুমি প্রতিদিন ঐ ছেলের সঙ্গে দেখা করছ না? বাইরে যাচ্ছ না প্রতিদিন?
আম্মু, সাদমান আর আমি একসঙ্গে পড়ছি৷ ওর সাথে আমার এমনিতেও প্রতিদিন দেখা হয়। তুমি বোধহয় কথাটা ভুলে গেছ। আর বড়ো খালামনির কথা আসছে কেন? বড়ো খালামনি কী আমাকে পাহারা দিয়ে রাখবেন? আম্মু, তুমি কী আমাকে পাহারা দিয়ে রাখতে চাও? স্পষ্ট করে কথা বলো আমার সঙ্গে।
পূনম অবাক হলেন অরণীর সাহস দেখে। মেয়ে তো পুরোপুরি হাতের বাইরে চলে গেছে। প্রেম করে তার সাহসের সীমা কতদূর পৌঁছে গেছে! একে আসলেই আর ছাড় দেওয়া ঠিক হবে না। পূনম এবার নতুন চাল চাললেন, তোমার বাবা শুধুমাত্র তোমার কারণে এতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মানুষটাকে তুমি কতটা কষ্ট দিয়েছ, তুমি জানো সেটা?
বাবাকে আমি কখন কষ্ট দিলাম?
তোমার বাবার সঙ্গে তোমার কী কথা হয়েছে, আমি জানি না। জানতেও চাই না। তবে তোমার বাবা আমাকে বলেছেন, তোমার কাছ থেকে উনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন। তোমার বাবা তাঁর বন্ধুকে বলেছিলেন, তোমার সঙ্গে তাঁর ছেলের বিয়ে দেবেন৷ আমরা অনেকদূর কথা এগিয়েও রেখেছিলাম। অর্ণব এখন চায়নায় আছে। ওখানে পিএইচডি করছে। কিছুদিন পর ওর দেশে আসার কথা। তখনই…. কী আর বলব? তোমার বাবা তো আর জানতেন না, তাঁর মেয়ে যে এমন কিছু করে বসে থাকবে। তোমার ওপর তাঁর অন্ধবিশ্বাস ছিল। তুমি সেই বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছ। বন্ধুর কাছে মানুষটাকে তুমি ছোটো করেছ। এতসব প্রেসার, এত মানসিক যন্ত্রণা তিনি সহ্য করতে পারেননি। সরাসরি হার্টে গিয়ে অ্যাটাক করেছে।
অরণী, পূনমের কথা শুনে ভীষণ অবাক হল। ফাহাদ যখন তার সঙ্গে কথা বলেছিলেন, তখন তো তার এমন কিছু মনে হয়নি। বরং তখন বাবার আচরণ তার কাছে অনেক বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। তাহলে আম্মু এখন তাকে এমন কথা বলছেন কেন? অরণীর মনে হল পূনম তার সঙ্গে কোনও গেম খেলছেন। সে সরাসরি প্রশ্ন করেই ফেলল, আম্মু তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছ কেন?
পূনম রাগ হয়ে বললেন, কী বললে তুমি? আমি একটা অসুস্থ মানুষকে নিয়ে মিথ্যা বলছি? ভালো, খুব ভালো। খুব ভালোভাবে তোমাদের মানুষ করেছি আমরা। তোমরা এখন তার প্রতিদান দিতে শুরু করে দিয়েছ। এরকম সন্তান থাকলে মানুষের আর শত্রুর দরকার হয় না। বাবা-মাকে টেনশন দিয়ে মেরে ফেলার জন্য তোমার মতো মেয়েই যথেষ্ট।
এই কথার পর অরণী কী বলবে, বুঝতে পারছে না। সে চুপ করে রইল। পূনম বললেন, শোনো অরণী, তুমি তো আমাকে অনেক বড়ো বড়ো কথা শুনিয়ে দিলে। তোমার কাছে একটা রিকোয়েস্ট, তোমার বাবার সঙ্গে যখন কথা বলবে, তখন এই প্রসঙ্গটা তুমি তুলবে না। মানুষটা এমনিতেই ভীষণ কষ্টে আছেন। তুমি তাঁকে বাড়তি কষ্টটুকু দিও না।……………………