#মন_নিয়ে_খেলা(১৫)
**********************
গত দুইদিন ধরে কাজের চাপে অরণীর ব্যাপারটা ফাহাদ প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন; কিন্তু আজ সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার পর, পূনম আবারও কথাটা তুললেন। তুমি অরণীর সঙ্গে কথা বলেছ?
কোন বিষয়ে?
কোন বিষয়ে মানে?
ফাহাদ মোবাইলটা কোলের ওপর রেখে বললেন, এবার বলো, কী হয়েছে?
মানে কী? তুমি কী আমার কথা শুনছ না? কী বললাম, তুমি শোনোনি?
স্যরি, একটা ম্যাসেজের রিপ্লাই দিচ্ছিলাম। বলো, কী বলছিলে।
অরণীর কথা বলেছি।
অরণীর কী কথা? ওহ, আচ্ছা। না কথা বলিনি। বলব। তুমি এত অস্থির হচ্ছ কেন?
এটা কী অস্থির হওয়ার মতো বিষয় না? তুমি এটাকে এত হালকাভাবে নিচ্ছ কেন?
হালকাভাবে নিচ্ছি না, আবার তোমার মত এত কঠিনভাবেও দেখতে চাচ্ছি না। অরণী স্মার্ট মেয়ে। ও এত সহজে ভুল করবে না।
তোমার মেয়ে ভুল করে বসে আছে। এখন তুমি আমাকে বলো, তুমি তার সঙ্গে কথা বলবে, নাকি আমি নিজের মতো করে ব্যবস্থা নেবো?
তুমি কী ব্যবস্থা নেবে? এমন হুকমি দিয়ে কথা বলছ কেন?
তোমার নির্লিপ্ততা দেখে বলতে বাধ্য হচ্ছি। অরণীকে ফোন করো। রুমে আসতে বলো।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি অরণীর সঙ্গে কথা বলছি। তুমি অকারণ বকাঝকা আর হৈচৈ করে বিষয়টাকে আরও পেঁচিয়ে ফেলবে।
স্বামীর কথা শুনে পূনমের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল; কিন্তু এখন তিনি রাগারাগি করতে চান না। পূনম, ফাহাদকে বললেন, আমি রুমে যাচ্ছি। তুমি এখনই অরণীর সঙ্গে কথা বলো।
পূনম তাঁর রুমে চলে গেলে, ফাহাদ মেয়ের রুমে আসলেন। রুমের দরজা বন্ধ ছিল। ফাহাদ দুইবার নক করার পরও দরজা খুলল না দেখে, নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলেন। অরণী রুমে নেই। ফাহাদ অরণীর মোবাইলে ফোন দিলেন।
হ্যালো বাবা….
অরণী, তুমি কোথায়?
আমি তো বাসায়। কেন বাবা? তুমি কোথায়?
আমি তোমার রুমে।
আচ্ছা, আমি আসছি।
ফাহাদ, অরণীর সঙ্গে কথা শেষ করে, অপেক্ষা করতে লাগলেন। পাঁচ মিনিট পর অরণী রুমে ঢুকে বলল, বাবা তুমি কখন এসেছ?
ঘন্টাখানেক হল। তুমি কোথায় ছিলে?
নীচতলায়। পুতুলের কাছে একটা রান্না শিখছিলাম।
কী রান্না?
আনারস দিয়ে ইলিশ। ও এই রান্নাটা খুব ভালো করে।
শিখতে পেরেছ? রান্না করেছ নাকি?
জি বাবা। পুতুল বলে দিচ্ছিল আর আমি সেভাবেই রান্না করলাম। তোমার কিন্তু খেতে হবে।
অবশ্যই খাবো। তুমি এখানে বসো।
অরণী, ফাহাদের মুখোমুখি বসার পর ফাহাদ বললেন, পড়ালেখার খবর বলো।
পড়ালেখা তো হচ্ছে। সেমিস্টার শেষ হলে, কিছুদিন ছুটি থাকবে। তারপর ইন্টার্নি শুরু হয়ে যাবে।
তোমার বন্ধুবান্ধবদের খবর বলো। তোমার বন্ধুদের তো আমি ঠিকমতো চিনিও না।
এবার অরণী বুঝতে পারল, তার বাবা কী বলতে চাচ্ছে। অরণী বলল, বাবা, তুমি সবসময় এত ব্যস্ত থাকো। তোমার সঙ্গে তো ওদের কখনও দেখাও হয় না।
দু-একবার দেখা হয়েছিল তো। তোমার স্কুল ফ্রেন্ড, কী যেন নাম ছিল ওদের? পুষ্পিতা না কী যেন…
জি বাবা, পুষ্পিতা, আভা।
হুম আভা। ওদের কথা মনে আছে। ওরা কোথায়?
পুষ্পিতা কানাডায় চলে গেছে আর আভা ব্র্যাকে পড়ছে।
বুয়েটের কাউকে দেখিনি আমি?
বাবা, তুমি কী সাদমানের কথা জানতে চাচ্ছ? আমি ওকে নিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
সাদমান তোমার বন্ধু?
জি বাবা।
কেমন বন্ধু?
বাবা, নীলোর্মি তোমাকে বলেছে। আম্মু কী তোমাকে কিছু বলেনি?
ফাহাদ এবার একটু সহজ হলেন। বললেন, ওরা দুইজনই আমাকে বলেছে। আমি তোমার কাছ থেকে শুনতে চাচ্ছি। তুমি আমাকে সবকিছু খুলে বলো তো আম্মা। তোমাদের কী সম্পর্ক, তুমি এই সম্পর্ক নিয়ে কী ভাবছ?
অরণীও জড়তা কাটিয়ে বলল, আমরা দুইজন, দুইজনকে ভালোবাসি।
তোমার আম্মু শুনে কী বলেছেন?
আম্মু আমার উপর রাগ করেছেন।
পূনম কী বলল?
আম্মু সাদমানকে রাস্তার ছেলে বলেছেন।
রাস্তার ছেলে বলার কারণটা কী? তুমি কী এমন কাউকে পছন্দ করেছ, যাকে এভাবে বলা যায়?
অরণী, ফাহাদের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর চোখ নামিয়ে নিল। ফাহাদ বললেন, ছেলের বাসা কোথায়? বাবা-মা কী করেন?
ওর বাবা সরকারি চাকরি করেন। আন্টি আগে চাকরি করতেন। এখন আর করেন না।
তুমি ছেলেটার বাসায়, কী নাম যেন বললে ছেলেটার….
সাদমান।
ওহ, সাদমান। তুমি ওর বাসায় কখনও গিয়েছ? কিংবা সে এসেছে আমাদের বাসায়?
আমি ওর জন্মদিনে ওদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওরা সেগুনবাগিচায় থাকে। ও কখনও আমাদের বাসায় আসেনি৷
ফাহাদ একটু সময় নিয়ে কী যেন ভাবলেন, তারপর বললেন, বাবা সরকারি চাকরি করেন। মা বাড়িতেই থাকেন। হিসেবে তাঁদের মধ্যবিত্ত হওয়ার কথা। তুমি তো তাঁদের বাড়িতে গিয়েছ। তোমার কাছে কী মনে হয়েছে?
জি বাবা। ওদের মধ্যবিত্ত পরিবার।
আমি তোমাকে একটা কথা বলি, আম্মা। মন দিয়ে শুনো। এখন তোমাদের কাছে সবকিছু অনেক রঙিন মনে হবে। যা দেখবে, সবই ভালো লাগবে। তুমি জানো, তুমি কোন ফ্যামিলিতে বড়ো হয়েছ। মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের সাথে আমাদের কিছুটা তো পার্থক্য আছে। আছে না?
অরণী কথার উত্তর দিল না। চুপ করে বসে থাকল।
কথা বলো। কথা বলতে হবে তো? আমার মেয়ে কোথায় যেতে চায়, ওখানে গিয়ে সে মানিয়ে নিয়ে চলতে পারবে কি না, এগুলো তো আমাকে চিন্তা করতে হবে। আমি তো তোমার আম্মুর মতো বলছি না, সাদমানকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না; কিন্তু আমাকে তো বুঝতে হবে, ওখানে গিয়ে আমার মেয়ে ভালো থাকতে পারবে, কী পারবে না।
আমি সাদমানের সঙ্গে অনেক ভালো থাকব, বাবা। ওদের বাসার সবাই অনেক ভালো। আন্টি অনেক ভালো।
আজকের ভালো আর আগামীর ভালোর মধ্যে কিন্তু একটা ফারাক আছে। আমি বুঝতে পারছি, সাদমান হয়তো সবদিক দিয়েই যোগ্য। বুয়েট থেকে বেরিয়ে সে ভালো কোথাও চাকরি করবে। বিসিএস এ টিকে গেলে, সরকারি চাকরি হয়ে যাবে। সবই ঠিক আছে; কিন্তু তুমি কী ঐ ফ্যামিলিতে অ্যাডযাস্ট করতে পারবে?
আমি পারব, বাবা।
“আমি পারব, বাবা” কথাটা অরণী এতটা আবেগ দিয়ে বলল, কথাটা শুনে ফাহাদের মনটা কেমন যেন করে উঠল! তাঁর এখন মনে হচ্ছে, যা হবে, সেসব পরে দেখা যাবে। মেয়ে যাকে ভালোবাসে, সেই ছেলের সঙ্গেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেবেন। পূনমের চোহারা মনে পড়ায়, ফাহাদ আবেগটাকে দমন করলেন। বললেন, তুমি আবারও ভালো করে ভেবে দেখো। তাড়াহুড়ার কিছু নাই। বাস্তব দিকটা মাথায় রেখে, সবদিক ভালোমতো ভেবে, তারপর আমাকে জানাও। আমি মোটেও ভালোবাসার বিপক্ষে না; কিন্তু আমার মেয়ে কতটুকু ভালো থাকতে পারবে, সেটা অবশ্যই আমাকে দেখতে হবে। তাছাড়া সাদমান তোমার সমবয়সী, এই কথাটাও মাথায় রেখো।
অরণীর মা-ও তাকে এই কথাটা বলেছে। সমবয়সী হলে সমস্যা কোথায়, এটাই তো অরণী বুঝতে পারছে না। সে শুধু জানে, সাদমানের সঙ্গে সে ভালো থাকবে। সাদমানকে ছাড়া সে এখন তার জীবন চিন্তাই করতে পারে না। অরণী বলল, বাবা একটা কথা বলব?
বলো।
তুমি একদিন সাদমানের সঙ্গে কথা বলবে? ও অনেক ভালো ছেলে, বাবা। কথাটা বলতে, বলতে অরণীর গলা ধরে এল। ফাহাদ মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন, তাকাও আমার দিকে।
অরণী ছলছল চোখে তাকালে, ফাহাদ বললেন, তোমার চোখে পানি কেন! আমি কী তোমাকে না করেছি? আমি কী বলেছি, এই সম্পর্ক রাখা যাবে না? প্রয়োজন হলে আমি অবশ্যই সাদমানের সঙ্গে, ওর ফ্যামিলির সঙ্গে কথা বলব। আগে তুমি নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নাও। সবকিছু ভালোভাবে চিন্তা করার পরও যদি তোমার মনে হয়, তুমি সাদমানের সঙ্গে, ওর ফ্যামিলির সঙ্গে ভালো থাকবে, তাহলেই আমাকে জানিয়ো। নিজের বাড়িতেই কিন্তু জলজ্যান্ত উদাহরণ রয়েছে। তোমার আম্মু কিন্তু শুধু আমাকে নিয়েই থাকতে চেয়েছিল। আমার ফ্যামিলির কারও সঙ্গেই কিন্তু সে মানিয়ে নিতে পারেনি। পারেনি, মানে মানিয়ে নিতে চায়নি। পূনম হয়তো ওর ফ্যামিলি, বন্ধুবান্ধব নিয়ে অনেক ভালো আছে; কিন্তু আমার মাঝে মধ্যে মন খারাপ হয়। ফ্যামিলি গেটটুগেদারে যখন পূনমকে ছাড়া যাই, কিছুটা খারাপ তো লাগেই। সেই কারণেই বলছি, আবেগটাকে পাশে সরিয়ে রেখে, বাস্তবতা দিয়ে একবার চিন্তা করে দেখো। তোমাকে কিন্তু একটা পরিবারকে নিয়ে চলতে হবে। তুমি যদি চিন্তা করো, ছেলেটাকে আলগোছে তুলে নিয়ে আলাদা সংসার করবে….
আমি এমনটা কখনও ভাবি না, বাবা। আমি আম্মুর মতো করে কখনও চিন্তা করি না। ওরা সবাই অনেক ভালো। তুমি সাদমানের সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবে। বাবা, প্লিজ….
ফাহাদ মেয়ের মনের অবস্থাটা বুঝতে চেষ্টা করছেন। তিনি নিজেও একটু সময় নিয়ে পরিস্থিতি বুঝতে চান। হুট করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া তাঁর কখনোই পছন্দ না। সেটা ছোটো-বড়ো যে কোনও কাজই হোক না কেন। তিনি অরণীকে বললেন, তুমি ভালো করে চিন্তাভাবনা করো। তারপর আমরা কথা বলব। ঠিক আছে?
জি, বাবা।…………………….