#মন_নিয়ে_খেলা(১৩)
**********************
মা’র রুম থেকে বের হয়ে, অরণী এসে বোনের রুমে ঢুকল। নীলোর্মি, অরণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল আপু, সাইক্লোন বয়ে গেল নাকি? কোনও ভাঙচুরের আওয়াজ পেলাম না তো!
তুমি এখানে বসে, আম্মুর রুমে কী হচ্ছে, সেটা কীভাবে শুনতে পাবে?
আমি কিছুক্ষণ আম্মুর রুমের দরজায় কান পেতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুই শুনতে পাইনি, তাই চলে এসেছি।
অরণী, নীলোর্মির পাশে বসে বলল, আম্মু সাদমানের কথা জিজ্ঞেস করতেই ডেকেছিলেন৷
জানতাম। আমি সারা আপুকে ফোন করেছিলাম। সারা আপু বলল, বড়ো খালামনি যেদিন তোমাদেরকে যমুনায় দেখেছিলেন, সেদিনই ফোন করে আম্মুকে জানিয়ে দিয়েছেন৷
সেদিনই বলেছেন?
হুম। আমি ভাবছি, আম্মু তাহলে এতদিন চুপ করে বসে ছিলেন কেন? আম্মুর মাথায় নিশ্চয়ই কোনও প্ল্যান কাজ করছে। আম্মু এখন তোমাকে কী বলল, সেটা বলো। তোমার প্রেমের ঘুড়ির নাটাই কেড়ে নিতে চাচ্ছে নাকি সুতো কেটে দেবে?
আম্মু, সাদমানকে রাস্তার ছেলে বলেছে।
কোন রাস্তার?
নীলোর্মি! তুমি আমার এমন বিপদের সময় মজা করছ?
সরি আপু। শোনো, বিপদ ভাবলেই বিপদ। প্রেমে পড়া বিপদ হবে কেন? সাদমান ভাইয়াকে রাস্তার ছেলে বললেই তো হবে না। কেন রাস্তার ছেলে বলা হচ্ছে, আম্মু সেটা তোমাকে বুঝিয়ে বলুক। বাংলা সিনেমার ডায়ালগ দিলেই হয়ে গেল নাকি? এই আপু এমন চেহারা করে বসে থাকবে না। হাসো। এই নাও চকলেট খাও।
অরণী চকলেট হাতে নিয়ে বলল, দাদি নাকি চাচ্ছেন, এখনই যেন আমার বিয়ে হয়ে যায়।
দাদির সঙ্গে আম্মুর এত খাতির কবে হল! দাদির তো আম্মুর সঙ্গে তোমার বিয়ে নিয়ে কথা বলার কথা না।
দাদি, আম্মুকে বলেননি। বাবাকে বলেছেন।
তুমি আম্মুকে কী বলেছ, সেটা বলো? নাকি কিছুই বলতে পারনি?
বলেছি।
কী বলেছ?
বলেছি, আমি সাদমানকে ছাড়া থাকতে পারব না।
ব্যস, তাহলে হয়েই গেল। এখন তাহলে চেহারায় এমন আতংকের ছাপ ধরে রেখেছ কেন? আম্মু এতদিন জানতেন না, সেটা একরকম ভয় ছিল। এখন তো আম্মু জেনেই গেলেন। তুমিও নিজের কথাটা বলে ফেলেছ। কাজেই এখন আর কোনও টেনশন নেই।
তুমি আম্মুকে এত সহজভাবে নিচ্ছ কেন?
কারণ, আম্মুকে কঠিনভাবে নেওয়ার দিন শেষ। আমি এখন আর আম্মুকে ভয় পাই না। তুমিও পেয়ো না। ভয়ে পেলেই, আম্মু আরও ভয় দেখাবেন।
নিজের জন্য ভয় পাচ্ছি না। আমার ভয় হচ্ছে সাদমানের জন্য। আম্মু যদি ওকে কিছু করে, তখন?
আম্মু, সাদমান ভাইয়াকে কী করবে? বাসায় ডেকে পাঠাবে? গুন্ডা দিয়ে মার খাওয়াবে? তুমি কোনটা ভেবে ভয় পাচ্ছ?
আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আমার, সাদমানকে সতর্ক করা উচিত।
সতর্ক করে দাও। তারপর এই টেনশন মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। জীবনের বড়ো একটা সময়, আমরা মাথায় টেনশন নিয়ে পার করেছি, আপু। আমি যদি কোনও ভুল বা অন্যায় না করি, তাহলে এখন থেকে কোনও টেনশন করব না। তুমিও করবে না, ঠিক আছে?
নীলোর্মির কথায় অরণী সত্যি, সত্যিই মনোবল ফিরে পেল। সে নীলোর্মিকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমাকে দেখলে, আমি সাহস ফিরে পাই।
নীলোর্মি মনে মনে বলল, তুমি তো আমাকে দেখে সাহস পাচ্ছ আপু; কিন্তু আমি জানি আম্মু সাদমান ভাইয়াকে কিছুতেই মেনে নেবেন না। কোনোদিনও না। মধ্যবিত্তদের প্রতি আম্মুর মাত্রাতিরিক্ত বিদ্বেষ কাজ করে। নীলোর্মি, অরণীর কাঁধে মাথা রেখে বলল, তোমার ভালোবাসা কখনও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে না। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি, আপু।
**************
অরণী বলল, আম্মু গতকাল তোমাকে নিয়ে কথা বলেছে।
আমাকে নিয়ে! কী কথা?
বড়ো খালামনি আম্মুকে সব বলে দিয়েছে।
আন্টি কী বললেন?
অরণী চুপ করে বসে থাকল। সাদমানের কথার উত্তর দিল না। সাদমান, অরণীর মুখের দিকে তাকিয়ে তার মনে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। বেচারির মুখটা বড্ড মলিন দেখাচ্ছে। সাদমান, অরণীর হাত ধরে বলল, আন্টি কী বেশি বকাঝকা করেছে?
না। বকা দেয়নি।
তাহলে?
তাঁরা হয়ত অন্য কারও সাথে আমার বিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছেন। কথাটা বলে, অরণী সাদমানের চোখের দিকে তাকাল। তাকিয়ে থাকতে, থাকতে ওর চোখ জলে ভরে উঠল। সাদমান মলিন হেসে বলল, চোখে পানি এল কেন? বিয়ে বললেই কী বিয়ে হয়ে যায় নাকি?
তুমি আমার আম্মুকে চেনো না।
আমি কী আন্টির সঙ্গে কথা বলব?
না, না।
তাহলে আমার মা’কে বলি, আন্টির সঙ্গে কথা বলতে।
না। আম্মু আন্টিকে অপমান করতে পারেন।
এবার সাদমানও চুপ হয়ে গেল। সে এখন কী বলবে, বুঝতে পারছে না। তার বাসায় যত সহজে অরণীর ব্যাপারটা মেনে নিয়েছে, অরণীর পরিবার বোধহয় ঠিক ততটাই কঠোর হবে তাদের সম্পর্কের বেলায়৷ হয়ত কখনও ওদের সম্পর্কটা মেনেই নেবে না। অরণী কী তাহলে শেষ পর্যন্ত হারিয়ে যাবে তার জীবন থেকে? কথাটা ভাবতেই, সাদমানের মাথার ভেতর জট পাকিয়ে যেতে লাগল। সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী চাও অরণী?
আমি কী চাই সেটা অনেকবার বলেছি।
হুম বলেছ; কিন্তু তখন তোমাকে আন্টির মুখোমুখি হতে হয়নি৷
আম্মুর মুখোমুখি হওয়ার পরও আমি, আমার জায়গাতেই আছি। শুধু একটা কথা ভেবে মন খারাপ হচ্ছে, এবারে আমাকে হয়ত বাবা আর আম্মুর অবাধ্যতা করতেই হবে। আমি আর কোনও পথ দেখছি না।
তুমি শুরুতেই এত নেগেটিভ ভাবছ কেন? তুমি কী আংকেলের সঙ্গে কথা বলেছ?
বাবা এখনও ফেরেনি৷ রাতে ফিরবে।
সাদমান উঠে দাঁড়িয়ে, অরণীর হাত ধরে বলল, ওঠো তো, চলো চা খেয়ে আসি। কী আছে জীবনে? যা হবে, পরে দেখা যাবে। আমার ভাগ্যে তুমি আর তোমার ভাগ্যে আমি লেখা থাকলে, কারও সাধ্য আছে আমাদের আলাদা করার? চলো, চলো। এইসব মন-টন খারাপ একদম ভালো লাগছে না।
**************
ফাহাদ ঘন্টাখানেক আগে বাসায় এসেছেন। পূনম লেডিস ক্লাবে গিয়েছেন, এখনও ফেরেননি। নীলোর্মি, ফাহাদের রুমে এসে বলল, বাবা কেমন আছ?
এই তো, ভালো আছি। আমি এসেই তোমাদের দুইবোনের রুমে গিয়েছিলাম। তুমি ঘুমিয়েছিলে। তুমি কেমন আছ, আম্মা?
খুব ভালো আছি। বাবা, আমি যে ড্রেসের ক্যাটালগগুলো পাঠিয়েছিলাম, ওগুলো কী পেয়েছিলে?
হুম, পেয়েছি। সবগুলোই নিয়ে এসেছি।
বাবা, তুমি চা খাবে?
এখন আর খাব না। আজ এমনিতেই দুইবার কফি খাওয়া হয়েছে।
আম্মুর সঙ্গে তোমার কথা হয়েছে?
হুম, কথা হয়েছে। বাসায় আসার পর কথা বললাম।
আম্মু তোমাকে কিছু বলেছে?
কিসের কথা?
কোনও ছেলের কথা?
ফাহাদ হাত থেকে পত্রিকা নামিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ছেলে?
নীলোর্মি, ফাহাদের মুখোমুখি বসে বলল, সাদমান ভাইয়ার কথা।
সাদমান কে?
আপুর বন্ধু।
কী হয়েছে সাদমানের? কোনও সমস্যা?
আম্মুর কাছে সমস্যা। আমাদের কাছে সমস্যা না।
ঠিক করে বলো তো আম্মা, কী হয়েছে?
আপু আর সাদমান ভাইয়ার মধ্যে রিলেশন চলছে।
কিসের রিলেশন?
প্রেম। ওরা দু’জন, দু’জনকে ভালোবাসে।
যদিও দুই মেয়ের সঙ্গে ফাহাদের চমৎকার সম্পর্ক; কিন্তু তিনি মেয়েদের সঙ্গে এই বিষয়গুলো নিয়ে আগে সেভাবে কথা বলেননি। বলার প্রয়োজন পড়েনি। ছোটো মেয়ের মুখে হঠাৎ প্রেমের কথা শুনে ফাহাদ কী বলবেন, বুঝতে পারছেন না। নীলোর্মি বলল, বাবা শুনছ?
হ্যাঁ, বলো।
আমি তো বললামই। এবার তুমি বলো। আম্মু তোমাকে কিছুই বলেনি?
না। পূনমকে কে জানিয়েছে এই কথা, নাকি পূনম আগে থেকেই জানে?
আগে থেকে জানে না। বড়ো খালামনি ওদের দুইজনকে দেখে, আম্মুকে বলে দিয়েছে। আম্মু কাল রাতে আপুকে ওয়ার্নিং দিয়েছে।
কিসের ওয়ার্নিং?
আচ্ছা বাবা, দাদি কী তোমাকে আপুর বিয়ের কথা বলেছে?
আম্মা? কই না তো। আমাকে তো কিছু বলেননি। কেন কী হয়েছে?
না কিছু না। বাবা শোনো, সাদমান ভাইয়া অনেক ভালো ছেলে। আপু ওকে খুব ভালোবাসে; কিন্তু আম্মু সাদমান ভাইয়াকে হয়ত, হয়ত বলছি কেন? আম্মু সাদমান ভাইয়াকে কখনও মেনে নেবেন না।
কেন?
অনেক কারণ থাকতে পারে। আম্মু তোমার সঙ্গে ওদের বিষয়টা নিয়ে কথা বলবেই। তুমি কিন্তু তখন আম্মুর কথা রাজি হয়ে যেয়ো না। তুমি ওদের দু’জনকে আলাদা হতে দিয়ো না বাবা, প্লিজ।
আমি তো কোনোকিছু বুঝতেই পারছি না। আমাকে ব্যাপারটা আগে ভালোমতো বুঝতে দাও। কোথাকার ছেলে, কেমন ছেলে, এসব তো আগে জানতে হবে।
সবকিছু জানতে পারবে, বাবা। তুমি শুধু আম্মুকে ম্যানেজ করো। আম্মু কিন্তু হুটহাট উলটোপালটা, যা খুশি ডিসিশন নিয়ে নেয়। তুমি আম্মুকে থামিয়ো।
আমি আগে অরণীর সঙ্গে কথা বলে নিই। আমাকে আগে পরিস্থিতি বুঝতে দাও। তারপর চিন্তা করব, কী করা যায়।……………………