#মন_নিয়ে_খেলা(১০)
**********************

লেডিস ক্লাবের আজকের অনুষ্ঠানে, সবমিলিয়ে উপস্থিত আছেন মাত্র সাতচল্লিশ জন। অথচ ক্লাবের আগের মিটিংগুলোতে এবং আগের অন্য যে কোনও আয়োজনে এরচেয়ে অনেক বেশি সদস্য উপস্থিত থাকতেন। পূনম প্রসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে, সদস্যদের ভেতর অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। অথচ গত বছর এই সদস্যদের ভোটেই তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। পূনম সবসময় ক্লাবের যে কোনও কাজেই এক্টিভ থেকেছেন। ক্লাবের ডোনারদের মধ্যে তাঁর নাম সবসময়ই উপরের দিকে থাকে। তাছাড়া তাঁর নিজ উদ্যোগে, ক্লাবের সদস্যদের নিয়ে ছোটো-বড়ো বেশ কিছু অনুষ্ঠান হয়েছে। বাকপটু পূনম তাঁর কথার জাদুতে লোকজনকে, তাঁর প্রতি সহজেই আকৃষ্ট করতে পারেন। এসব কারণে ক্লাবে দিন, দিন তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। সেই জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করেই তিনি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন আর নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই তিনি স্বেচ্ছাচারিতা শুরু করে দিয়েছেন৷ দলের অন্য সদস্যদের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ যেন একটা নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। নিজের সংসার যেমন তাঁর হাতের ইশারায় চলে, এখানেও তিনি ঠিক তেমনটাই করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে, কিছুদিন আগে যাঁরা পূনমকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছিলেন, তাঁরা এবং নির্বাচিত অন্য সদস্যরাও এখন তাঁর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন।

কিছুক্ষণ আগে আলোচনা পর্ব শেষ হয়েছে। এখন সদস্যরা যে যাঁর মতো ছোটো, ছোটো ভাগে, ছড়িয়ে, ছিটিয়ে গল্প করছেন। কারও টেনশন সন্তান নিয়ে, তো কারও টেনশন স্বামী নিয়ে। কেউ বা অন্যের সাজপোশাককে খ্যাত আখ্যা দিয়ে, নিজেকে ফ্যাশন বোদ্ধা হিসেবে জাহির করছেন। দেশ রসাতলে যাচ্ছে বলে, কেউ, কেউ হা-হুতাশ করছেন। তাঁরা ছেলেমেয়েদের আগেই বিদেশ পাঠিয়ে দিয়েছেন; কিন্তু ব্যবসা ক্লোজ করতে পারেননি দেখে, নিজেরা এখনও যেতে পারছেন না। পূনম ঘুরে, ঘুরে সবার সঙ্গে কথা বলছিলেন। গেল বারের প্রেসিডেন্ট কানিজের সামনে যখন এলেন, কানিজ তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, পূনম ভাবী, আপনি নাকি গুলশানের শপটা ছেড়ে দিয়েছেন?

জি।

ছাড়লেন কেন?

এই তো, হঠাৎ আর ভালো লাগছিল না।

এত ভালো একটা লোকেশনে ছিল আপনার শপটা! তাছাড়া আপনার শপের কালেকশনগুলো খুব ভালো ছিল। আমার মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে ওখান থেকে অনেক শপিং করেছিল।

কানিজের পাশে দাঁড়ানো টিউলিপ বললেন, পূনম ভাবীর কী আর টাকার অভাব আছে? এত টাকা দিয়ে কী করবে, বলেন কাজিন আপা? আমাদের ফাহাদ ভাই টাকা ইনকাম করেন আর পূনম ভাবী ইচ্ছা মতো খরচ করেন। তাই তো, হুটহাট করে কোনোকিছু শুরু করে আবার মাঝপথে বন্ধ করে দিতে, পূনম ভাবীর গায়ে লাগে না।

পূনম বললেন, এটা আপনি কী বললেন, টিউলিপ? আমি কোন জিনিসটা শুরু করে, মাঝপথে বন্ধ করে দিয়েছি?

টিউলিপ বললেন, কেন, আপনার মনে নেই, কামাল আতাতুর্কের রুফ টপে রেস্তরাঁ চালু করার ছয়মাসের মধ্যে ওটা বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

রেস্তোরাঁটা ঠিকভাবে জমে ওঠেনি দেখে, ওটা বন্ধ করে দিয়েছিলাম।

ভাবী, মাত্র ছয়মাসের মধ্যে আপনি রেস্তরাঁ জমজমাট করতে চেয়েছিলেন! অন্তত একটা বছর দেখতে পারতেন। আপনার রেস্তোরাঁ এতটাও খারাপ চলছিল না। নতুন হিসেবে বেশ ভালোই পরিচিতি পেয়েছিল; কিন্তু আপনি তো আসল কারণটা চেপে গেলেন।

পূনম ভ্রু কুঁচকে বললেন, আসল কারণ মানে? আপনি কোন আসল কারণের কথা বলছেন, টিউলিপ?

আপনার ঐ রেস্তোরাঁর পার্টনার উসামা ছিল, তাই না? উসামা আমাকে বলেছে, শুরু থেকে আপনি কীভাবে তাকে ঠকিয়েছেন।

ওকে, আমি মোটেও ঠকাইনি। উসামা একটা মিথ্যুক আর লোভী।

রেস্তোরাঁর পুরো পরিকল্পনা উসামার ছিল। সে এত পরিশ্রম করে সমস্ত ইন্টেরিয়র ডিজাইন করল, তার লোক দিয়ে কাজ করাল, অথচ আপনি তাকে ডিজাইনের জন্য কোনও পেমেন্ট করেননি।

মিথ্যা কথা। আমি বললামই তো, সে একটা মহা মিথ্যুক।

না, ভাবী। রেস্তোরাঁ চালুর পর থেকে বন্ধ করে দেওয়া পর্যন্ত আপনি তাকে কোনও হিসাবই দেননি। বারবার একই কথা বলেছেন, লোকসান হচ্ছে। উসামা তো আপনাকে অফার করেছিল, রেস্তোরাঁ চালানোর দায়িত্ব ওর ওপর ছেড়ে দিতে। আপনি সেটা দেননি কেন?

পূনম বিরক্ত হয়ে বললেন, টিউলিপ শোনেন, পার্টিতে এসেছেন, পার্টি এনজয় করেন। সব বিষয়ে নাক গলাতে যাবেন না। অবশ্য অন্যের লাইফে কী চলছে, না চলছে, সেটা নিয়ে গসিপ করাই আপনার প্রধান কাজ। এটা কী আর কারও জানতে বাকি আছে?

আমি আর যা-ই করি না কেন, আপনার মতো লোক দেখানো কাজ করি না।

আমি লোক দেখানো কাজ করি!

অবশ্যই করেন। আপনি আমাদের ক্লাবের অন্যতম ডোনার। আপনার যখন, যাকে খুশি, আপনি মুঠো ভরে টাকা দেন, অথচ উসামার প্রাপ্য টাকাটা আপনি মেরে দিলেন!

‘মেরে দিলেন’ কথাটা পূনমের শরীরে যেন বিছুটি পাতার মতো লাগল! তিনি চিবিয়ে, চিবিয়ে বললেন, আপনি এই ক্লাবে কী করে থাকেন, সেটা আমি দেখে নেব।

টিউলিপ বললেন, আপনি আমার কিছুই করতে পারবেন না। পূনম ভাবী, আপনি এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। আমরাই আপনাকে এই পোস্টে বসিয়েছি। আপনার হুকুমে কিন্তু ক্লাব চলে না। কাজেই পরেরবার এমন কথা বলার আগে, ভেবেচিন্তে বলবেন। আমি আপনার মতো, স্বামীর পয়সা উড়িয়ে, লোক দেখানো শো-অফ করি না। কথাটা বলেই, টিউলিপ ওখান থেকে সরে গেলেন।

পূনম, টিউলিপের সাহস দেখে ভীষণ অবাক হলেন! গতবছর মিশর ট্যুরের সময়, এই টিউলিপকে, তিনি জোর করে ভ্রমণ টিমের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। তিনি জোরাজোরি না করলে, টিউলিপ কিছুতেই মিশর যেতে পারত না। পূনম অবাক হলেন, বেইমানে দুনিয়াটা ভরে যাচ্ছে। এখন থেকে আর এসব ফালতু লোকের জন্য কোনোকিছু করবেন না। এইসব লো-ক্লাস মহিলারা উপকার নেওয়ার সময় হাত-পা ধরে অনুনয়-বিনয় করে আর উপকার নেওয়া শেষ হলে, কৃতঘ্ন চোহারা দেখাতে এতটুকু কার্পণ্য করে না।

****************

বড়ো খালার মুখোমুখি হয়ে, অরণী চমকে গেল। যমুনা ফিউচার পার্কে এসে, কেনাকাটা শেষ করে সে আর সাদমান ফুড কোর্টে যাবে বলে লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিল। সিনথি যে ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, অরণী ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারেনি। লিফটে উঠে ঘুরে দাঁড়ানোর পর, সে আর সিনথি মুখোমুখি হয়ে গেল। বোনের মেয়েকে দেখে সিনথি বললেন, ওমা, ঐটা তুমি ছিলে? আমি তো বুঝতেই পারিনি। সারা অবশ্য আমাকে বলছিল, ‘আম্মু দেখো, মেয়েটাকে অরণী আপুর মতো লাগছে। ও কে, অরণী?’

সিনথিকে সালাম দিয়ে অরণী বলল, খালামনি ও আমার ফ্রেন্ড, সাদমান।

সাদমান সালাম দিলে, সিনথি সালামের উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি অরণীর সঙ্গে পড়ো?

জি।

বাসা কোথায়?

সেগুনবাগিচা।

ভাগ্যিস লিফট নির্দিষ্ট ফ্লোরে চলে এসেছে। লিফটের দরজা খুলে যাওয়ায়, অরণী হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। নতুবা বড়ো খালামনি আরও কী কী প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেন, কে জানে? লিফটে দাঁড়ানো অন্য লোকজন তাদের দিকে তাকিয়ে, কথা শুনছিল। লিফট থেকে বেরিয়ে অরণী পড়ল আরও বড়ো বিপদে। সিনথি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কী খাবে, বলো?

অরণী বলল, কিছু খাব না, খালামনি। আমি এখন বাসায় যাব।

খাবে না, তো ওপরে এলে কেন?

অরণী এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। তার ভীষণ নার্ভাস লাগছে। তার মনে হচ্ছে, সিনথি এখনই বুঝে ফেলবেন, তার আর সাদমানের ভেতর কী চলছে। সে সাদমানের দিকে তাকাতেই, সাদমান বলল, আমি তাহলে আজকে আসি।

সিনথি মৃদু ধমকের স্বরে বললেন, এই ছেলে, তুমি এখন যাবে না। আমাদের সঙ্গে চলো। আমরা এখন খাব। তোমরাও খাবে। চলো।

সাদমান আমতা, আমতা করছে দেখে, তিনি বললেন, তোমরা অন্য কোথাও খেতে চাচ্ছ?

অরণী বলল, খালামনি প্লিজ, আমরা এখন কিছু খাব না।

সিনথি, অরণীর কথা কানেই তুললেন না। বললেন, ঠিক আছে কেএফসিতে বসে কিছু অন্তত খাও। এই সাদমান তুমি ভেতরে এসো।

অগত্যা ওরা দুইজন, সিনথি আর সারা’র সঙ্গে কেএফসিতে ঢুকল।

সিনথি খুঁটিয়ে, খুটিয়ে সাদমানকে অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। আধঘন্টা পর, সিনথির কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে, ওরা দুইজন তাড়াতাড়ি ফুড কোর্ট থেকে নীচে নেমে এল। সাদমান জিজ্ঞেস করল, অরণী তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন?

আমাদের রিলেশনটা খালামনি মনেহয় বুঝে ফেলেছেন।

কী করে বুঝবে? আর বুঝলে, বুঝেছে। এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই।

বড়ো খালামনি আমার আম্মুকে বলে দেবেন, নির্ঘাত।

বলে দিলে তো আরও ভালো। দুইদিন পর তো সবাই এমনিতেও জানবে।

অরণী মনে মনে প্রার্থনা করল, বড়ো খালা যেন সাদমানের বিষয়টা নিয়ে তার মা’কে কিছু না জানায়।

**************

সিনথির ফোন এল রাত নয়টার দিকে। পূনম ফোন রিসিভ করার পর, দুই বোন নানা বিষয়ে, টুকটাক কথাবার্তা বললেন। হঠাৎ কথাটা মনে পড়েছে, এমন ভাব করে সিনথি বললেন, আজকে তো অরণীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। অরণী বলেনি তোমাকে?

না, বলেনি তো। কোথায় দেখা হয়েছিল?

যমুনায়। আমি সারা’র জন্য গাউন কিনতে গিয়েছিলাম। তখন দেখা হয়েছে।

ও আচ্ছা।

তখনই ওদেরকে দেখলাম।

ওরা দুই বোন এখন একসাথেই যাওয়া-আসা করে।

দুই বোন কোথায়? নীলোর্মি তো ছিল না। অরণীর সঙ্গে একটা ছেলে ছিল।

নীলোর্মি ছিল না? কী জানি, তাহলে বোধহয় দু’জনের আলাদা সময়ে ছুটি হয়েছে।

পূনম, তুমি ছেলেটাকে চেনো?

অরণীর কোনও ফ্রেন্ড হবে হয়ত। নিয়ন বা অন্য কেউ।

নিয়ন না। নাম হচ্ছে সাদমান।

সাদমান… নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে। ও আচ্ছা, হ্যাঁ বুঝেছি। ছেলেটা অরণীর ফ্রেন্ড। কিছুদিন আগে অরণী ওর বার্থডেতে গিয়েছিল।

আমার তো শুধু ফ্রেন্ড মনে হল না। শুধু ফ্রেন্ড হলে, ছেলেটা ওর ওড়না ঠিক করে দিত না।

ওড়না ঠিক করে দিত না, মানে? আপু তুমি কী বলো, ঠিক বুঝলাম না।

হুম। আমরা যখন লিফটের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, তখন দেখলাম, ছেলেটা অরণীর ওড়নাটা ঠিক করে কাঁধের ওপর দিয়ে দিল।

ওড়না যে পড়ে গিয়েছিল, অরণী হয়ত সেটা খেয়াল করেনি।

উহু। তুমি এত নিশ্চিন্ত মনে বসে থেকো না। জিনিসটা আমার ভালো লাগেনি, পূনম। শুধু সমাজসেবা করলে চলবে? নিজের সংসারের দিকে একটু নজর দাও।

আমার সংসারের ওপর, আমার পুরো নজর আছে, আপু। আমার মেয়েদের এসব প্রেম-ট্রেম করার সাহস হবে না। এসবে ওদের কোনও আগ্রহও নেই। ওরা নিজেদের লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

ওরা প্রেম করলে, তোমাকে বলে করবে? তুমি কী ভাবছ, আর সবকিছুর মতো, প্রেম করার সময়ও তোমার পারমিশন নেওয়ার জন্য, অ্যাপ্লিকেশন জমা দেবে? আমার চোখ ফাঁকি দেওয়া এত সহজ না। আমি অরণীর চোখ দেখেই বুঝেছি, সে আমার কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাচ্ছিল।

আপু, তুমি অকারণ দুশ্চিন্তা করছ। অরণীকে আমি খুব ভালো করে চিনি। ও প্রেম করার মেয়ে না।

না হলে ভালো। আমার দায়িত্ব ছিল তোমাকে সতর্ক করার, আমি আমার দায়িত্ব পালন করলাম। সময় থাকতে সাবধান হওয়া ভালো। শেষে দেখা যাবে, মেয়ে এমন কাউকে পছন্দ করে বসে আছে, যেখানে যাওয়ার কথা তোমরা কল্পনাও করতে পারবে না।

আপু তুমি খামোখা টেনশন করছ। বাদ দাও ঐ কথা। বুধবারে লাবনীর বাসায় যাবে তো?

হ্যাঁ যাব।

ঠিক আছে, বুধবারে দেখা হবে। এখন রাখছি, আপু। পরে কথা হবে।……………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here