#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_______________________________
রাতের অন্ধকারে সাজেক ডুবে। মেঘলা আকাশ, দমকা হাওয়া, পাহাড়ের নিস্তব্ধতায় সাজেক যেন মুখরিত। এখন সবাই যাবে হ্যালিপ্যাডে। উদ্দেশ্য গান করা, বার্বিকিউ বানানো। আভা হোটেলে ফিরে ঘুমাচ্ছিল। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আভার গা ম্যাজম্যাজ করছে। পায়ের ব্যথাও বেড়েছে। তবে ঘুম আর হলো কই? আহনাফের বন্ধুরা আভাকে ফোন কলে অতিষ্ট করে জাগিয়ে তুললো। অগ্যতা ঘুমঘুম চোখ নিয়ে গায়ে শাল পেঁচিয়ে হোটেল ছেড়ে বের হল আভা।
হ্যালিপ্যাডে সবাই বসে আছে। আহনাফের হাতে গিটার। বাঁধনের হাতে ইলেকট্রিক বাঁশি। কামরুল নাকি বিশেষ ট্রিক খাটিয়ে মুখ দিয়ে গানের সুর তুলবে। দিহান ছবি তুলবে। চিত্রা অবশ্য চুপচাপ। চিত্রার এই অন্যরূপ সবার কাছে সন্দেহজনক ঠেকছে। মন খারাপ কি না, জানতে চেয়েছিল সবাই। উত্তরে চিত্রা শুধু এড়িয়েই গেছে।
‘ কি হয়েছে তোর? এমন অদ্ভুত বিহেভ করছিস কেন?’
আহনাফের শীতল কণ্ঠ। চিত্রা আর যাই পারুক, আহনাফের রাগ সহ্য করতে পারে না। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব হল না চিত্রার।
কাতর চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে বলল,
‘ যা পাইনি, তা নিয়ে আফসোস হচ্ছে। যে পেয়েছে তাকে হিংসে হচ্ছে। সে খুব অদ্ভুত যন্ত্রণা। ক্রমাগত দগ্ধ হচ্ছি আমি। ‘
আহনাফের অবাক চোখ। চিত্রার কথা বুঝতে তার দু মিনিট সময় লাগল। চিত্রা আহনাফকে পছন্দ করে। আহনাফ জানে তা। কিন্তু আহনাফ বরাবরই বন্ধুত্বের বেলায় সৎ। বন্ধুত্বের মধ্যে ভালোবাসা তার কাছে বেমানান মনে হয়। তাই সে চিত্রার অনুভূতিসমূহ দেখেও না দেখার ভান করে যাচ্ছে। অথচ চিত্রা বারবার আহনাফের দিকেই এগিয়ে আসছে। কি করবে আহনাফ? চিত্রাকে সে অনেকবার বুঝিয়েছে। অথচ মেয়েটা বুঝতে নারাজ। পাগলামী দিনদিন বেড়েই যাচ্ছে তার। বন্ধু বলে কিছু বলা যাচ্ছে না। অগ্যতা আহনাফ চুপচাপ সয়ে নিচ্ছে।
‘ এদিকে আয়। ‘
আহনাফ আলতো কণ্ঠে চিত্রাকে ডাকে। অভিমানী চিত্রা গাল ফুলিয়ে আহনাফের দিকে এগিয়ে আসে। আহনাফ চিত্রাকে নিজের পাশে বসায়। অতঃপর বলে,
‘ আমাদের বন্ধুত্বকে পবিত্র রাখার চেষ্টা কর চিত্রা। নিজের অনুভূতি সামলে রাখ। তুই খুব ভালো মেয়ে। তোর জন্যে আরো বেটার কেউ আসবে। শুধু একটু অপেক্ষা কর। ‘

চিত্রার ব্যথিত চোখে আহনাফের দিকে চায়। বলে,
‘ যদি বলি আমার তোকে চাই? দিবি আমায়? ‘
‘ দিয়েছি ত। এই যে তুই আমার প্রিয় বন্ধু। এটা কি যথেষ্ট নয়?’
চিত্রার মন খারাপ হয়। হু হু করে কান্না পায়। সবার সামনে কাদতে লজ্জা লাগছে। ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে বলে,
‘ আমায় একটু ভালোবাসলে কি হয়, আহনাফ? আমি কি খুব খারাপ? ‘
আহনাফ মৃদু হাসে। চিত্রার গাল টেনে বলে,
‘ না। তুই খুব ভালো। তোর প্রেমিক খুন লাকি যে তোকে পাবে। আমাকে ছাড়। আমি মানুষটা ভালো নই। নিরামিষ, ভালোবাসতে জানিনা। কিন্তু তুই ভালোবাসতে জানিস। আগলে রাখতে জানিস। খামোকা কেন আমার কাছে বাঁধা পড়ে নিজের জীবন নষ্ট করবি? ‘

চিত্রা আর কথা বলে না। আহনাফ বলে,
‘ এবার অন্তত হাস একটু। আর কত মন খারাপ করে থাকবি? এত সুন্দর জায়গায় কেউ মন খারাপ করে? ‘
চিত্রা মুচকি হাসে। আহনাফ হাসে। চিত্রার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে,
‘ এইতো ভালো মেয়ে। এখন চল। গান করবি। ‘
আহনাফ চিত্রাকে নিয়ে গানের আসরে বসে।
দূর থেকে আভা আহনাফ আর চিত্রার কথা শুনছিল। আহনাফের শীতল কণ্ঠের বুলি শুনে আভা বিমোহিত। একটা মানুষ কি করে এতটা ঠান্ডা মাথায় কারো মন খারাপ দূর করে ফেলতে পারে? আহনাফ বলে আহনাফের কোনো গুন নেই। এই যে, কারো মন খারাপ নিমিষেই দূর করে ফেলার গুন? এটাই বা ক জনের আছে? সবাই শুধু মন খারাপের কারণ হয়। মন খারাপ দূর করার কারণ কজনই বা হতে পারে?
চিত্রা মেয়েটা আহনাফকে ভালোবাসে। বিষয়টা আভার মাথায় আসতে মন খারাপ হল। সেও তো আহনাফকে পছন্দ করে। তবে কি আহনাফ তাকেও মন খারাপ দূর করার ঔষধ দিয়ে ত্যাগ করবে? না, না। আহনাফ আভাকে ভুলে গেলে আভা মরেই যাবে। বেচে থাকতে পারবে না।

আভার ধ্যান ভাঙে আহনাফের গানের সুরে।
‘ আমার ভেতরে বাহির অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
ভালো আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো ‘

আহনাফ যতক্ষণ গান গেয়েছে, আভা স্থির চোখে আহনাফের দিকে চেয়েছিল। আহনাফও তাকিয়ে ছিল। মনের অজান্তেই আভার চোখে জল এসেছে। আহনাফ চোখ দিয়ে ইশারা করলে আভা মুচকি হেসে চোখের জল মুছে নেয়। আহনাফ চেয়ে থাকে। আভার কান্না করার অর্থ তার বোধগম্য হয় না। আভা মেয়েটা কি ভীষন অদ্ভুত। এই ভালো ত এই খারাপ। এই হাসি তো এই কান্না। এই খুশি তো এই দুঃখ। মেয়েটা এমন কেন? আহনাফ কি করে সামলাবে এই অদ্ভুত মেয়েটিকে?
বার্বিকিউ রান্না করা হয়েছে। সবাই খাবার খেতে বসেছে। খুব মজা হয়েছে বার্বিকিউ। সবাই রীতিমত কব্জি ডুবিয়ে খাচ্ছে।
খাওয়া শেষ করে সবাই যার যার জায়গায় পৌঁছে ঘুমিয়ে গেছে। শুধু আভা জেগে আছে। ঘুম আসছে না আভার। কেন যেন মন খারাপের মাত্রাটা বেড়েই যাচ্ছে। থামছে না।
আভা শাল চেপে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বারান্দা থেকে মনে হচ্ছে আভা যেন মেঘের সমুদ্রে পা ভিজিয়েছে। যেদিকে চোখ যায়, ভেসে বেড়ানো মেঘ চোখে পড়ে। হা করলে যেন মেঘ খেয়ে ফেলা যায়। চোখ খুললে মেঘেরা চোখের ভেতর ঢুকে পড়তে চায়। নিঃশ্বাস নিলে বুকের ভেতর মেঘেরা দৌঁড়ে বেড়ায়। সে কি অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি। আভা মুগ্ধ হয়ে আছে। সাজেকে আভা বারবার আসতে চায়। বারবার সাজেকের এই অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি প্রেমে পড়তে চায়। আমাদের একটি সাজেক আছে, চিৎকার করে পুরো পৃথিবীকে জানাতে চায়।

হঠাৎ বারান্দা থেকে নিচে তাকায় আভা। চোখ ভুল দেখে যেন। আহনাফ নিচে দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি আভার পানে আটকে। আভা অবাক হয়। চোখ মুছে পুনরায় চেয়ে দেখে। না, আহনাফই। আভা চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে,
‘ এখানে কেন? ‘
আহনাফ আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে নিচে নামতে। আভা কিছুক্ষণ ভাবে। অতঃপর মুচকি হেসে বলে,
‘ আসব না। ‘
আহনাফের মুখশ্রী গম্ভীর থেকে গম্ভীর হল। সে চুপচাপ সেখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। আভা বারান্দা থেকে চলে আসে। ঠোঁটে লিপগ্লোস এবং চোখে কাজলের রেখা টেনে নিচে নেমে আসে।

ঠাণ্ডায় তিরতির করে কাপছে আভা। আহনাফের কাছাকাছি দাড়িয়ে বলে,
‘ কেন ডেকেছেন? ‘
আহনাফ গম্ভীর চোখে আভাকে আপাদমস্তক জরিপ করে। অতঃপর প্রশ্ন করে,
‘ সেজেছ? ‘
আভা বোকা বনে। পরক্ষণেই লজ্জায় পড়ে যায়। মিনমিন করে বলে,
‘ আব…একটু। ‘
আহনাফ মৃদু হাসে। আর কথা পেঁচায় না। বরং অন্য প্রশ্ন করে, ‘ ঘুম আসছিল না। ভাবছি সাজেকের রাস্তায় হাঁটবো কিছুক্ষণ। তুমি সাথে যাবে? না গেলে চলে যেতে পারো। ‘
আভার যেন বিশ্ব জয় করে নেয়। আহনাফের সাথে রাতের আকাশের নিচে হাঁটবে। আভার মন খুশিতে রীতিমত নেচে বেড়ায়। মনেমনে বলে, আপনার সাথে পা মিলিয়ে আজীবন হাঁটার পণ করেছি। একটুতে মন ভরবে?
তবে মুখে আভা নিজের খুশি প্রকাশ করে না। বরং বলে,
‘ বেশিক্ষণ হাঁটতে পারব না। আধা ঘন্টা? ‘
‘ চলো তবে। ‘

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here