#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
__________________________
কংলাক পাহাড়ের দিকে ছুটে চলেছে আভা এবং আহনাফরা। আভা চরম উত্তেজিত। এই প্রথম সাজেক ভ্রমন করতে এসেছে আভা। তাই সাজেকের সৌন্দর্য্য আভাকে ভীষন মুগ্ধ করে রাখছে।
–’ আমরা কি পৌঁছে গেছি? ‘

আভা প্রশ্ন করল। দিহান ডিএসলার ক্যামেরা এনেছে। তা দিয়ে অনরবত ক্লিক ক্লিক করে ছবি তুলছে। কামরুল হাত দিয়ে মাথার ঝাঁকড়া চুল সোজা করতে করতে বলল,
–’ আভা, তুমি এই প্রশ্ন এই নিয়ে মোট কতবার করলে? ‘
আভা লজ্জা পেল। বলল,
–’ আসলে তর সইছে না। কখন পৌঁছাব আমরা? ‘

কামরুল উত্তর দিল,
–’ আর মাত্র দশ মিনিট। চোখ বন্ধ করে একবার মুখ ভরে নিঃশ্বাস নাও দেখবে দশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। ‘
–’ একবার নিঃশ্বাস নিলে দশ মিনিট পেরিয়ে যাবে? ‘
আভা অবাক হল। বাঁধন চিপস খাচ্ছে। খেতে খেতে উত্তর দিল,
–’ হ্যাঁ, পেরিয়ে যাবে। সাজেকের আবহাওয়াটাই এমন। একবার নিঃশ্বাস নিয়ে দেখো না। আর নিঃশ্বাস ছাড়তে মন চাইবে না। সাজেকের ঠান্ডা বাতাস নাকে প্রবেশ করে দারুন আনন্দ দিবে। ভালো লাগবে। ট্রাই করে দেখো। ‘

আভা নড়েচড়ে বসল। সবার দিকে একবার চেয়ে গাড়ির জানালার বাইরে তাকাল। অতঃপর জোড়ালো ভাবে চোখ বন্ধ করল। লম্বা করে এক নিঃশ্বাস মুখের ভেতর পুড়ে নিল। চমকে উঠল আভা। এত ঠান্ডা বাতাস! মনে হচ্ছে, আভা তুলো মুখে পুড়ছে। আভার খিঁচে রাখা চোখ স্বাভাবিক হল। আভার চুল উড়ছে। রেশমী কেশ মুখে-চোখে লেপ্টে আছে। আভা চুল সরিয়ে আবার উপভোগ করছে তুলো ন্যায় বাতাস। হঠাৎ দিহান চিৎকার দিল,
–’ নড়বে না, আভা। স্ট্যাচু। ‘

আভা থমকে গেল। গা ছেড়ে বসে থাকল। উপভোগ করতে লাগল। দিহান চট করে আভার একটা ছবি তুলে নিল। আভা চোখ খুলল। দিহান তার ক্যামেরা আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
-‘ দেখো। ছবিটা সুন্দর এসেছে। ‘

আভা ডাগর ডাগর চোখে ক্যামেরার দিকে তাকাল। খোলা চুল আভার ঝাপটে পড়ছে মুখে, বন্ধ চোখ, সতেজ মন, কানের ঝুমকো। সব মিলিয়ে ভীষন সুন্দর দেখাচ্ছে আভাকে। আভা বলল,
–’ তুমি তো দারুন ছবি তুলতে পারো। ‘
দিহান গর্ব করে বলল,
–’ দেখতে হবে ছবির হাতটা কার? প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার আমি। ‘
আভা চোখ বড় করল। বলল,
–’ তুমি ফটোগ্রাফার? তবে তো এই ট্রিপে আমার সুন্দর সুন্দর ছবি তুলে দিতে পারবে। আমার ছবি তুলতে ভীষন ভালো লাগে। সাজেকের মত ভীষন সুন্দর জায়গায় যদি ছবি তোলার মত মানুষ পেয়ে যাই, তবে তো সোনায় সোহাগা। ‘

দিহান কলার ঝাঁকাল। বলল,
–’ আচ্ছা। ডিল ফাইনাল। ছবি তুলে দিব ভালো কথা। কিন্তু পারিশ্রমিক কি পাব? ‘
আভা চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,
–’ আমি তো অত টাকা আনিনি। হিসেবের টাকা এনেছি। কত দিতে হবে তোমায়? ‘
–’ কম না। এই ধরো কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে আমাকে জাম্বুরা খাওয়ালেই চলবে। ‘
আভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। বলল,
–’ এত কম পারিশ্রমিক? ঠিক আছে। খাওয়াব। ‘

আহনাফ বই পড়ছে। আভা ও তার বন্ধুদের কথা শুনে আড়চোখে দু একবার এদিকে তাকিয়েছে বটে। আভা মেয়েটাকে আহনাফের কাছে চূড়ান্ত আশ্চর্য্যজনক লাগছে। একদিনের পরিচয়ে একটা মেয়ে এত সহজে কারো সাথে মিশে যেতে পারে? অদ্ভুত বটে। আহনাফ বাইরে তাকালো। তারা প্রায় পৌঁছে গেছে। আর এক মিনিট লাগবে। তারপর গাড়ি পার্ক করলেই তারা গাড়ি থেকে নেমে যাবে। আহনাফ গলা ছাড়ল। বলল,
– ‘ পৌঁছে গেছি আমরা। বকবক থামিয়ে যার যা লাগবে তৈরী করো। আমরা গাড়ি থেকে নেমে যাব। ‘

আভা কথা চট করে থেমে যায়। তৎপর হয়ে উঠে নিজেকে গুছিয়ে নিতে। দিহান একটা ব্যাগ নিজের পিঠে তুলে সোজা হয়ে বসে। কামরুলের হাতে ফোন। বাকিদের কোনো ব্যাগ নেই। ওরা ইচ্ছে করেই অতিরিক্ত কিছু নিজেদের সাথে আনেনি। কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় ট্রেকিং করতে উঠতে হবে তাদের। অতিরিক্ত কিছু বহন করলে পাহাড়ে চড়তে কষ্ট হবে।

সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। আভার গাড়ি থেকে নেমে জ্যাকেট খামচে ধরে। ঠাণ্ডা বাতাসে গা শিরশির করছে আভার। আভা মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকায়। সাজেকের আকাশটাও কি সুন্দর। আভার ওই আকাশ খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। গপগপ করে।

সবাই সামনে হাঁটছে। কংলাক পাহাড়ের বেশ আগে গাড়ি পার্ক করা হয়েছে। কিছু পথ হেঁটে পাড়ি দিতে হবে। সাজেকের পথ ধরে হাঁটতে বেশ শান্তি। দু পাশে পাহাড়। মাথার উপর মস্ত বড় এক আকাশ ছায়া। আর সাজেকের সড়ক। এ যেন স্বর্গীয় এক শান্তি। আভা হাঁটছে। আকাশের দিকে হঠাৎ হঠাৎ চেয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইছে।
‘ সে যে বসে আছে একা একা
রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে ‘

কংলাক পাহাড়ের সামনে এসে গেছে সবাই। এবার লাঠি কেনার পালা। আভা প্রশ্ন করল,
–’ লাঠি কিনব কেন? ‘
লাঠি বিক্রেতা ফোকলা দাঁতে হেসে উত্তর দেয়,
–’ লাঠি না থাকলে পাহাড় চড়বেন কেমতে? গড়াইয়া পইড়া যাইবেন না? ‘
আভা মুচকি হাসল। বলল,
–’ আপনি দারুন করে কথা বলেন তো। ‘
বিক্রেতা হাসে। বলে,
–’ তুমিও মেলা মিষ্টি ছেরি। ‘
আভা লজ্জা পেয়ে যায়। ছোট্ট করে বলে,
–’ ধন্যবাদ, চাচা। ‘
অতঃপর সবাই লাঠি কিনে পাহাড়ের উঠার প্রস্তুতি নেয়।

পাহাড়ে চড়ার অভ্যাস না থাকায় অল্পতেই আভা হাঁপিয়ে উঠে। এক জায়গায় থম করে বসে পড়ে। আভাকে আটকে থাকতে দেখে সবাই থামে। দিহান এগিয়ে আসে।
–’ আভা? ক্লান্ত লাগছে? ‘
আভা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। আঙুল দিয়ে এক মিনিট দেখায়। দিহান বলে,
–’ ওকে। সময় নাও। আমাদের আরো কিছু সময় ট্রেকিং করতে হবে। ‘

বাঁধন দূর থেকে আভার দিকে চেয়ে আছে। আভাকে কষ্ট পেতে দেখে বাঁধন বুকে হাত চেপে বিড়বিড় করে,
–’ ইশ, যদি আমি ওকে কোলে তুলে পাহাড় চড়তে পারতাম।’
বাঁধনের কথা শুনে আহনাফ ভ্রু কুঁচকে চায়। বাঁধন সকল সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে। সবসময় মেয়েবাজি তার একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। আভার মত উচ্ছল মেয়েকেও ছাড়ল না। আহনাফ খচখচ পায়ে আভার দিকে এগিয়ে আসে। আভার হাত ধরে এক টান দিয়ে তাকে সোজা করে উঠায়। আভা থতমত হয়ে পড়ে। ফ্যালফ্যাল চোখে আহনাফের দিকে চেয়ে বলে,
–’ বিশ্রাম করছিলাম আমি। ‘
আহনাফ বলে,
–’ মাত্র আধা ঘন্টার পথে তুমি তিনবার রেস্ট নিয়েছ। আর কত? এমন হলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে। আমাদের আবার ফিরতে হবে। আর রেস্ট না। এখন চলো। কুইক। ‘

আভা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আহনাফের ধমক দিয়ে কথা বলা আভার পছন্দ হয়নি। সুন্দর করে বললেও তো পারত। এত কঠোর কেন সে? সুন্দর করে বললে আভা কি শুনত না? অবশ্যই শুনত।
–’ দাঁড়িয়ে আছো কেন? চলো। ‘
আভা লাঠি শব্দ করে নিচে রাখে। অতঃপর চড়তে থাকে উপরে। আহনাফ বুঝতে পারে আভার রাগ হয়েছে। হোক। এমন করে অল্পতেই হাপিয়ে উঠলে, শক্ত ট্রাভেলিং করতে পারবে না। কষ্ট হবে। হাল ছেড়ে দিবে। এর চেয়ে বরং একটু একটু করে কষ্ট পাক, শিখুক।

অতঃপর সকল কষ্টের অবসান হল। সবাই কংলাক পাহাড়ের চূড়ায় পা রাখল। সবার চোখে মুছে উচ্ছাস। আভা উত্তেজিত। মুখে হাত চেপে চেঁচিয়ে উঠে,
–’ আল্লাহ! এত সুন্দর কেন? ‘

আহনাফ আভাকে দেখে। মেয়েটা সুন্দর জায়গা দেখে একদম বাচ্চা হয়ে গেছে। আভা দৌঁড়ে আরো একটু সামনে এগিয়ে যায়। চোখের সামনে যেন মেঘের সমুদ্র বইছে। হাত বাড়ালেই যেন মেঘ ছোঁয়া যায়। মেঘেরা যেন সবার পোশাকে পরিণত হয়েছে। গা ছুঁয়ে যাচ্ছে মেঘের শীতল পরশ। দিহান ছবি তুলতে চাইছে। কিন্তু ঘন মেঘের কারণে ছবি তুলতে পারছে না। ঝাপসা আসছে। তবে কিছু ট্রিক খাটিয়ে অবশেষে দু একটা ছবি তুলতে সক্ষম হয়েছে।
আভা চিৎকার করল
–’ আমার মনে হচ্ছে, আমি এভারেস্ট জয় করে ফেলেছি। ইশ, ইশ। এত সুন্দর কেন? আমার সবকিছু খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। ‘

বাঁধন উত্তর দিল,
–’ এভারেস্ট নয়। আমরা কংলাক পাহাড় জয় করেছি। ‘

আভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। চিত্রা আহনাফের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। আভাকে দেখে অজানা এক কারণে তার ভীষন বিরক্ত লাগছে। সে মুখ ঝুঁকে আহনাফকে বলল,
– ‘ মেয়েটা এমন ন্যাকামো করছে কেন? তাকে আমার অসম্ভব বিরক্ত লাগছে। ‘
আহনাফ শুনল। তবে প্রত্যুত্তর করল না। বরং ভ্রু কুচকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকল আভা নামক এই অদ্ভুত মেয়ের মুখের দিকে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here