#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

২৬.
আহনাফের বাবা আরহাম শেখ পালঙে ঠেস দিয়ে বসে আছেন মেঝেতে। ধবধবে সাদা রঙের লুঙ্গি আর ফতুয়া পড়ে লেবুর শরবত খাচ্ছেন। আহনাফ স্থবির পায়ে এসে বসে বাবার পাশে। গায়ের এপ্রোন খুলে পালঙ্গের উপর আলগোছে রেখে দেয়। আরহাম শেখের দিকে ক্ষণিককাল চেয়ে থেকে ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়ে। হাঁটু ভেঙে মাটিতে বসে নত মুখে বলে,
‘ মা জমি চাইছেন। ‘
আহনাফের বাবা তাচ্ছিল্যভরা হাসেন। পুনরায় লেবুর শরবতে চুমুক দিয়ে বলেন,’ কেন? ‘
‘ মায়ের ইচ্ছা তার কবর পরিবারিক কবরস্থানে হবে। ‘
‘ আমাকে কবরে দিকে ছুঁড়ে ফেলে তোর মায়ের এখন কবরে যেতে ইচ্ছে করছে। হাও রাবিশ! ‘
আহনাফ চোখ তুলে বাবার দিকে চায়। বাবার চোখে বাঁধভাঙা কষ্ট দেখতে পারছে সে। বাবা সেই কষ্টে ক্রমাগত নীল হয়ে যাচ্ছেন। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বাবার জীবন! বাবা মায়ের সম্পর্কের এই করুন অবনতি আহনাফ চুপ করে দেখে যাচ্ছে। কিছু করতে পারছে না। আহনাফ আবার হাঁটুতে মুখ গুজে। মৃদু স্বরে বলে,
‘ সেদিন মাকে কেন আটকালে না, বাবা? তাহলে আজ আমাদের জীবন অন্যরকম হতে পারত। ‘
আহনাফের কন্ঠনালী কাঁপছে। শব্দগুচ্ছ কম্পিত হচ্ছে। ঠোঁটের আগা তরতর করে নড়ছে। আহনাফের বাবা ছেলের বাহুতে হাত রাখেন। আহনাফ এখনো হাঁটুতে মুখ গুঁজে। মৃদু স্বরে বলে,
‘ তুমি ছাড়া আমরা ভালো নেই, বাবা। মাকে নিয়ে আসো। একসঙ্গে থাকব আমরা। আমাদের সুখী সংসার হবে। ‘
‘ কতবার গেলাম তোর মায়ের কাছে। কি লাভ হল? বারবার ফিরিয়ে দিল। আর যেতে ইচ্ছে করে না। বারবার হারতে ইচ্ছে করে না। ‘
‘ দোষটা তোমার বলে মায়ের অনেক কষ্ট। ‘
‘ আমি জানি দোষ আমার। সেদিন নিজের মায়ের কথা না শুনে তোর মায়ের কথা শুনলে আজ বোধহয় দৃশ্যটা অন্যরকম হত। ‘
‘ দাদিমা কেমন আছে?
‘ জানিনা। আমি যাই না তার কাছে। মাসশেষে টাকা পাঠিয়ে দেই। তোর ছোট চাচা খেয়াল রাখেন। ‘
‘ দাদিমা বুঝতে পারেনি, উনার জন্যে তোমার সংসারটা এমন এলোমেলো হয়ে যাবে। ‘
‘ জানি। তবুও মনকে বাঁধা দিতে পারিনা। রাগ চলে আসে। আমি চাইনা আমার রাগের জন্যে আম্মা অসম্মানিত হোন। ‘
‘ মাকে আরো একবার অনুরোধ করবে, বাবা? মা ভালো নেই। ডায়াবেটিস বেড়েছে, হার্টে সমস্যা দেখা গেছে, আজকাল মনে কিছু রাখতে পারছে না, সব ভুলে যাচ্ছে,আমি নিজ হাতে না খাওয়ালে ঔষধ ঠিকমত খান না। আমি একা একা হাঁপিয়ে উঠেছি বাবা। এবার একটা কাঁধের খুব প্রয়োজন। ‘
আহনাফের বাবা ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছাড়েন। বিড়বিড় করে আওড়ান,
‘ নিজে ভালো থাকবে না আর আমাকেও ভালো রাখবে না। ‘
আহনাফের বাবা শরবতের গ্লাসটা টি-টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ান। ফতুয়া টেনেটুনে ঠিক করে আহনাফের দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন,,
‘ উঠ। ‘
আহনাফ মাথা তুলে তাকায়। বলে,
‘ কেন?
‘ খাবি না কিছু? তুই আসবি বলে আজ ইলিশ মাছ রান্না করিয়েছি। চিংড়ি মাছ ভাজানো হয়েছে। চল, আজ বাপ-ব্যাটা মিলে কব্জি ডুবিয়ে খাব। ‘
আহনাফ বাবার হাতে হাত রাখে। আহনাফের বাবা চট করে ছেলেকে টান দিয়ে উঠান। আহনাফের বুক বাবার বুকে ধাক্কা খায়। আহনাফের বাবা ছেলের কাধে চাপড় দিয়ে শব্দ করে হেসে বুক ফুলিয়ে বলেন,
‘ আমার ছেলে, আমার রাজা ছেলে। ‘
আহনাফ মৃদু হাসে। বাবার হাতে হাত রেখে খাবার ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
খাবার টেবিলে চেয়ার পেতে বসে আহনাফ ও তার বাবা। আহনাফের বাবা এ কথা-সে কথা বলছেন। আহনাফ খাবার খেতে খেতে মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনছে। বাড়ির দুজন কর্মচারী মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাবা ছেলের মধ্যকার সম্পর্ক দেখছে। আহনাফ বাবার প্লেটে ইলিশ মাছের মাথা তুলে দিল। আহনাফের বাবা মানা করলেন। নিজের পাতের ইলিশের মাথা জোড়পূর্বক ছেলের পাতে তুলে দিলেন। আহনাফ ফিরিয়ে দিতে চাইলে তিনি নিলেন না। বরং বললেন, ‘ কামড়ে কামড়ে মাছের মাথা খাবি। ডাক্তার হচ্ছিস। আমার মত মেধাওয়ালা ডাক্তার হতে হবে তোকে। আমার ছেলেকে পুরো বাংলাদেশ চিনবে। কার ছেলে দেখতে হবে না? ‘
আহনাফ হেসে উঠে। আহনাফ সপ্তাহে একবার বাবার বাসায় আসে। আহনাফ বাসায় এলে আরহাম শেখ বোধ করেন, তিনি আকাশের চাঁদ পেয়ে গেছেন। সেই চাঁদ তার হাতে লুটোপুটি খাচ্ছে। তিনি অবাক হয়ে ছেলেকে দেখেন। যতবার ছেলেকে চোখ ভরে দেখেন, আনন্দে তার গা কেঁপে উঠে। চোখ উজ্জ্বল রঙে ছেয়ে যায়। চোখের পাতা আন্দোলিত হয়ে উঠে। আহনাফের চেহারায় মায়ের গঠন স্পষ্ট। সেই খাড়া নাক, পুরু ঠোঁট, বাঁকানো ভ্রু। সবই মায়ের পেয়েছে। স্ত্রীকে দেখতে পারছেন না আজ প্রায় দু বছর। তাই ছেলেকে দেখেই নিজের আঁশ মেটান আহনাফের বাবা। আহনাফ তার কাছে এলে তার খুশির অন্ত থাকে না। কি করবেন, কি করবেন না ভেবে দিশেহারা হয়ে পড়েন। আহনাফ যখন চলে যাওয়ার জন্যে পা বাড়ায়, তার বুক মোচড় দিয়ে উঠে। আবার এক সপ্তাহের অপেক্ষা! ভেবে মন খারাপ হয় উনার। ছেলেকে বিদায় দেওয়ার বেলায়, মনেমনে হাজারবার স্ত্রীকে কি’ডন্যাপ করার কথা ভেবে ফেলেন। আহনাফের মায়ের জেদ অসামান্য। হতে পারে কিডন্যাপ করলে নিজেই নিজের নার্ভ কে’টে বসে। স্ত্রীকে হাড়ে হাড়ে চেনেন আহনাফের বাবা। নার্ভ কা’টা তার জন্যে মামুলি ব্যাপার। বয়স যত বাড়ছে, দিনদিন জেদের মাত্রা যেন তরতর করে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

খাবার পর্ব শেষ করে আহনাফ চেয়ার ছেড়ে উঠে। টিস্যু দিয়ে হাত মুছে বাবার দিকে চেয়ে বলে, ‘ যেতে হচ্ছে বাবা। মা অপেক্ষা করছে।’
আরহাম শেখের আবার মন খারাপ করে। চুপ করে কিছুক্ষণ তরকারি ভাতে মাখাতে থাকেন। আহনাফ বুঝতে পারে বাবার মনের কথা। সে বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘ আবার আসব। মন খারাপ করো না। ‘
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আহনাফের বাবা গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করেন,
‘ তুই আমার এখানে আসলে তোর মা খুব চেঁচামেচি করে। তাইনা, আহনাফ? ‘
আহনাফের কণ্ঠনালি কেঁপে উঠে। বাবাকে কি উত্তর দিবে সে? মা চেঁচামেচি করেন আবার টানা দুইদিন কথা বলা বন্ধ করে দেন। অতঃপর অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মায়ের রাগ ভাঙাতে হয়। আহনাফ মৃদু হেসে বাবার কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘ মা এ বাড়িতে একেবারে চলে এলে আর চেঁচামেচি করবে না। ‘
আহনাফের বাবা তাচ্ছিল্যভরা হাসেন। কর্মচারী শহীবকে ডাকেন। শহীব কাছে এলে বলেন,
‘ ইলিশ মাছের ঝোল আর ছোট মাছের তরকারিটা টিফিনে ভরে দিয়ে দাও তো। আহনাফ বাড়িতে নিয়ে যাবে। ‘
আহনাফ চমকে উঠে। দ্রুত হাত দিয়ে মানা করে বলে,
‘ না, না,দিও না। মা অনেক রাগ করবে। ‘
‘ আরে নিয়ে যা, নিয়ে যা। তোর মায়ের তোর মতোই ইলিশ আর ছোটমাছের তরকারি খুব পছন্দের। যদি জিজ্ঞেস করে বলবি তুই কি যেন নাম, ওহ…নুর দাদুর হোটেল থেকে আনিয়েছিস। ‘
আহনাফ তীক্ষ্ম চোখে বাবার দিকে চায়। অতঃপর ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
‘ তুমি খুব চালাক হয়ে যাচ্ছ দিনদিন। ‘
‘ তোর মায়ের জেদের কাছে আমার চালাক হওয়া অতি সামান্য। ‘
আহনাফ হেসে উঠে। বাবার কাঁধে হাত রেখে পুনরায় সুধায়,
‘ আসছি। ভালো থেকো। দরকার পড়লে ফোন করবে। ‘
‘ তুই আবার আসবি তো? ‘
‘ সামনের শনিবার আসব। ‘
‘ পুরো এক সপ্তাহ? ‘
‘ মাকে এখানে নিয়ে আসার চেষ্টা করো। তাহলে সারাজীবন তোমার সাথে মা-ছেলে একসঙ্গে থাকব। ‘
আহনাফের বাবা আর কথা বাড়ান না। তিনি তো কম চেষ্টা করেন নি। নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্ত্রীর জেদের কাছে হার মানতে হয়েছে তাকে বারবার। আহনাফের মায়ের আর কি দোষ! নিজের দোষেই স্ত্রী-সন্তান হারিয়েছেন। এখন ভুগো সাজা!

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here