#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ২৩
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
__________________________________
পূর্ব দিকে ঝলমলে এক সূর্য উদিত হয়েছে। আকাশ নিংড়ে লাজুক কিছু আলো ঝড়ছে। ফকফকা ঝরঝরে দিনে আভা বসে আছে পার্কের একটি বেঞ্চে। অপেক্ষা প্রিয় মানুষের। চোখের সামনে পার্কময় হেঁটে বেড়াচ্ছে কপোত কপোতীরা। চায়ের ফ্লাস্ক নিয়ে ইতি ওতি দৌঁড়ে যাচ্ছে ছোট কিশোর কিশোরী। আভা চা খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আহনাফের সাথে চা খাবে বলে ইচ্ছেটা নিজের মধ্যে একপ্রকার দমিয়ে রাখল। আহনাফকে কল করেছিল। বলেছে, মাত্র মেডিকেল থেকে বেরিয়েছে। আর মাত্র পাঁচ মিনিট লাগবে। আভা সুন্দর করে হেসে বলেছে, দ্রুত আসুন। আমি অপেক্ষা করছি।
প্রিয় মানুষের জন্য পাঁচ মিনিট কেন, আজন্ম অপেক্ষা করা যায়। আভার চোখ পড়ল সম্মুখে। ওই যে, আহনাফ এগিয়ে আসছে। গায়ে এপ্রোন জড়ান, কাঁধে ছোট আকারের একটি ব্যাগ, হাতে কালো রঙের ঘড়ি। আহনাফ দূর হতে আভাকে দেখে ক্লান্তিমাখা মৃদু হাসল। এগিয়ে এসে বসল আভার ডান পাশে। আহনাফের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোঁটা ছুঁয়ে আছে। গলায়ও ঘাম লেগে আছে। আভা শাড়ির আঁচল দিয়ে আহনাফের ঘামটুকু মুছে দিয়ে বলল,
‘ এত দেরি হল! ‘
আহনাফ আভার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঘষল। পুনরায় শাড়ির আঁচল আভার কোলে রেখে বলল,
‘ ওয়ার্ড ছিল। ‘
আভা মিহি হাসল। আজ অযথাই আভা হাসছে। আহনাফের সম্মুখে থাকলে, পাশাপাশি বসলে আভা খুশিতে শুধু হাসতে থাকে। আহনাফের ছোট্ট স্পর্শে বুকের ভেতরে বাস করা হৃদপিন্ড যখন তিরিংবিড়িং কর লাফিয়ে উঠে আভা সেই চেনা অনুভূতিকে ভীষন উপভোগ করে। আহনাফ জিজ্ঞেস করল,
‘ আজ শাড়ি পড়লে যে? ‘
‘ মায়ের শাড়ি। পড়তে ইচ্ছে করছিল। পড়েছি। এখন পড়ার পর আপনাকে শাড়ি পড়ে দেখাতে ইচ্ছে করছিল। কেমন লাগছে আমাকে শাড়িতে? ‘
আহনাফ সবার অলক্ষ্যে শাড়ির ভাজ ভেদ করে আভার কোমড় চেপে ধরল। আভা শিহরণে চোখ খানিক বুজে নিল। আহনাফ গভীর স্বরে বলল,
‘ সুন্দরীতমা আমার। ‘
ইশ, আভা যে কেঁপে উঠল। কানের কাছটায় আহনাফের গরম নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে। গা মৃদুমন্দ কেপে উঠছে। এ কেমন অসহ্যকর অনুভূতি। আহনাফের বেহেয়া হাতের স্পর্শ আভা আর সহ্য করতে পারছে না। এই বুঝি জ্ঞ্যান হারাল! আভা গহীন সুরে বলল,
‘ ছা-ড়ুন। মরে যাব আমি। ! ‘
আহনাফ আভার অস্বস্তি বুঝে ছেড়ে দিল তাকে। সোজা হয়ে বসল বেঞ্চে। আভা লজ্জায় আর তাকাতে পারছে না। হালকা লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁট তিরতির করে কাপছে। আভার শাড়ির আঁচল মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আহনাফ তা দেখতে পেরে কোমড় কিছুটা ঝুঁকিয়ে শাড়ির আঁচল মাটি থেকে তুলে আভার কোলে বিছিয়ে দিল। আভা অবাক হল। আহনাফ বলল,
‘ ময়লা হচ্ছে আঁচল। খেয়াল রাখো। ‘
আভার চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু জল জমে! পরিবারের পর এই প্রথম কেউ আভার এতটা যত্ন করছে। বাবার ন্যায় আগলে রাখছে। বাবা সবসময় বলেছে, মা দুনিয়াটা বড্ড স্বার্থপর। এখানে সবাই ভালোবাসার নামে স্বার্থ দেখে। ভালোবাসাটা বড্ড অমূল্য অনুভূতি নিজের পছন্দকে পছন্দ করার আগে তাকে যাচাই করে নিবে। দেখবে সে আদৌ তোমার মূল্যবান ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য কি না!
আজ আভা বাবাকে নিয়ে পুরো পৃথিবীকে চিৎকার করে জানাতে চায়, বাবা আমি আমার জীবনে সেরা মানুষটাকে পছন্দ করেছি। সে আমার যত্ন করে যেমন তুমি করো, সে আমায় ভালোবাসে যেমন তুমি আমায় ভালোবেসেছ।
আহনাফের নিজের হাতে চেপে ধরলো আভার নরম তুলতুলে হাত। হাত উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। যেন এ এক মজাদার খেলা। আভা আহনাফের কাধে মাথা রেখে বলল,
‘ আপনার মা কেমন আছেন? ‘
‘ ভালো। ‘
‘ সেদিন আমি আপনার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনেছি। ‘
আহনাফ অবাক হল না। বরং বলল,
‘ ফোনে? ‘
‘ হ্যাঁ। আপনি কি করে জানলেন? ‘
‘ জেনেছি একভাবে। তা মা কি বলল? ‘
‘ আপনার নামে অভিযোগ করেছে। এত্ত এত্ত অভিযোগ। ‘
আভা হাত দিয়ে অভিযোগের পরিমাণটা দেখিয়ে দিল। কথা বলতে বলতে আভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। আভার হাসির শব্দ শুনে আহনাফের মাথা ঝিম ধরে গেল। সে ভ্রু কুচকে নির্নিমেষ চেয়ে রুল আভার পানে। আহনাফের এমন বেপরোয়া চেয়ে থাকা দেখে আভা কেসে উঠল। মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বলল,
‘ দয়া করে আমার দিকে এভাবে চেয়ে থাকবেন না প্লিজ। আমার বুকে ব্যথা করে। ‘
আহনাফ মুচকি হাসল। আভার চুলের খোঁপা খুলে দিল। সঙ্গেসঙ্গে ঝরঝর করে এক ফালি চুল ছিটকে পড়ল আভার পিঠে। আহনাফ অবাক হয়ে গেল। খোলা চুলে আভাকে সুন্দর লাগবে ভেবেছিল। কিন্তু এত সুন্দর লাগবে কল্পনা করে নি। আভা থেমে গেল। ‘
‘ এমন কেন করলেন আপনি? এখন আবার খোঁপা বাঁধতে হবে। আমি এখন আয়না পাবো কোথায়?! ‘
আহনাফের কাধে থাকা মাথা তুলে হাত দিয়ে খোঁপা করতে চেষ্টা করল। আহনাফ আভার হাত আটকে দিল। মৃদু স্বরে বলল,
‘ খোলা চুলে ভালো লাগছে। ‘
আভার হাত আটকে গেল। আপনাআপনি চুল থেকে হাত নেমে এল নিচে। আহনাফের কণ্ঠে কিছু একটা ছিল? কি? শীতলতা? গভীর প্রেম, নাকি অন্য? আভা মুচকি হাসল। বলল,
‘ তাহলে থাক। ‘
আভা আহনাফের কাধে পুনরায় মাথা রাখল। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে। দুপুরের খাবারের সময় আরো কিছুক্ষণ আগে পেরিয়ে গেছে। আহনাফ বলল,
‘ খাবে না? চলো, উঠো। ‘
আভা উঠে সোজা হয়ে বসল। বেঞ্চের একপাশ থেকে একটা ছোট টিফিন বের করে আহনাফের সামনে নিয়ে এল। আভা বলল,
‘ আমি আজ রেধে এনেছি। আজ দুজন একসাথে খাবো। ‘
আহনাফ বিস্ময় নিয়ে চাইল। সেদিন আভার হাতের রান্না খেয়ে আহনাফের বড্ড লোভ জেগেছে। ইচ্ছে করেছে, প্রিয়তমার হাতের তৈরি আরো রান্না খেতে। আভা টিফিন খুলল। একে একে শুটকির ভর্তা, আলু ভর্তা আর মাছের ভর্তা প্লেটে নিয়ে বেঞ্চে সাজিয়ে রাখল। তারপর আরো একটা প্লেটে কাতলা মাছের ঝোল রাখল। একটা প্লেট ধুতে সেটায় ভাত নিয়ে আহনাফের দিকে এগিয়ে দিল।
‘ ভর্তা দিব না মাছ? ‘
আহনাফের বুকে প্রশান্তির ফোয়ারা বয়ে বেড়াচ্ছে। কথা বলতে পারছে না। গলা কাপছে। এমন একটা মেয়েকে কি ভালো না হেসে থাকা যায়? এত আদুরে মেয়ে এক বুক ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য। আভাকে ভালো না বাসলে আহনাফ এত আদর, এত ভালোবাসা সব মিস করে যেত। আহনাফ যে বড্ড লোভী। আভাকে ভালোবাসার লোভ যে সে সামলাতে পারেনি।
‘ বললেন না যে, কি খাবেন? ‘
আহনাফ নিজের হাতে আলু ভর্তা নিয়ে ভাতের সাথে মাখাল। প্রথম লোকমা আভার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘ হা করো। ‘
আভা মুচকি হেসে হা করল। আহনাফ আভাকে খাইয়ে দিল। নিজেও খেতে থাকল। আভা বলল,
‘ মাছের তরকারি দেই? ‘
আহনাফ হাত দিয়ে মানা করল। বরং নিজে মাছের ভর্তা নিয়ে প্রথম লোকমা আভাকে খাইয়ে দিল। আভা খেতে খেতে বলল,
‘ শুধু আমাকে খাওয়াচ্ছেন। নিজে তো কিছু খাচ্ছেন না। ‘
আহনাফ খাবার মুখে দিল। বলল,
‘ শরীরের দিকে একবার চেয়ে দেখেছ? দিনদিন শুকিয়ে কাঠ হচ্ছ। বেশিবেশি খাও।নাহলে দেখা যাবে, বিয়ের পর আমাদের বাচ্চাকাচ্চাও তোমার মত শুকনো হচ্ছে। ‘
বলতে বলতে আরো দু লোকমা ভাত আভার মুখে তুলে দিল আহনাফ। আভা গাল ফুলালো। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,
‘ হ্যাহ! সবাই বলে আমার শরীর ক্যাটরিনা কাইফের মত। চিকনে চামিলি। ‘
আহনাফ কেশে উঠল। আভার মাথায় ছোট্ট করে এক টোকা দিয়ে বলল,
‘ তোমার সিনেমার নায়িকা হতে হবে না। তুমি আমার জীবনের নায়িকা। তাই তোমায় আমার মত হতে হবে। বুঝেছ? ‘

আভা শুনে। মুগ্ধ হয়। গা কেপে উঠে। শিউরে উঠে মন। এত ভালো লাগল কেন কথাগুলো। সে এমন করে? আভাকে এত ভালোবাসে কেন? এই যে এত ভালোবাসা পেয়ে আভা সুখে মরে যেতে ইচ্ছে হয়। উড়ে ভেসে যেতে ইচ্ছে হয়! তা ত এই পাশে বসে থাকা লোক জানতেই পারল না।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here