#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ২২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
___________________________________
কলিং বেলের তীব্র শব্দে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন মিসেস শেখ। কোমড়ের বাঁকে গুঁজে রাখা শাড়ির আঁচল মাথায় তুলেন। হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা কপালের ঘাম মুছে নিলেও সারা অঙ্গে ঘামে জুবজুব অবস্থা। পরনের সুতি শাড়ি ঘামে লেপ্টে আছে গায়ের সহিত। মিসেস শেখ লুকিং গ্লাসে ছেলেকে দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাক হন। এই অসময়ে আহনাফ ঘরে আসার ছেলে নয়। ক্লাস দুপুর দুইটায় সমাপ্ত হলেও বন্ধুদের সাথে ঘুরেফিরে বিকেলের দিকে বাড়ি ফেরে সে। তবে আজ এত দ্রুত এসেছে কেন? মিসেস শেখ দরজা খুলেন। আহনাফ মায়ের দিকে ক্লান্ত চোখ নিক্ষেপ করে মুচকি হাসে। মিসেস শেখ ছেলেকে ঘরে প্রবেশ করান। রান্নাঘরে পানি আনতে যেতে যেতে বলেন,
‘ আজ এত দ্রুত এলি যে? ‘
আহনাফ এপ্রোন ছুঁড়ে ফেলে সোফার উপর। রাগটা বোধহয় এখনো কমে নি। সময়ের তালে ক্রমশ বৃদ্ধি পেয়েছে হয়ত। হাতের ঘড়ি খুলে বলে,
‘ ভালো লাগছিল না, তাই। ‘
মিসেস শেখ ঠান্ডা পানির গ্লাস এগিয়ে দেন ছেলের দিকে। আহনাফ এক ঢোকে সবটুকু পানি পান করে। গ্লাস সোফা সংলগ্ন টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায়। মায়ের দিকে চেয়ে বলে,
‘ রান্না হয়েছে, মা? ‘
‘ হ্যাঁ, শুধু চুলো থেকে নামাব। তুই গোসল সেরে আয়। আমি ভাত বাড়ছি। ‘
আহনাফ আর কথা বাড়ায় না। সোফা থেকে এপ্রোন হাতে তুলে নেয়। পানির গ্লাস নিয়ে রান্নাঘরের বেসিনে রেখে চলে আসে নিজের ঘরে। আহনাফ সর্বদা নিজের কাজ নিজে করতে ভালোবাসে। মা আর আহনাফ মিলে তাদের ছোট্ট পরিবার। মায়ের বয়স হচ্ছে। গায়ের শক্তি ক্রমশ নিচে নামছে। সারা ঘর সামলে মাঝেমধ্যে মা হাপিয়ে উঠেন। তাই মায়ের কাজ কমিয়ে আনতে আহনাফ নিজের কাজ নিজেই করে। ছুটির দিনে ঘর পরিষ্কার করতে মাকে সাহায্য করে। মা বারবার মানা করেন। পুরুষ মানুষ হয়ে ঘরের কাজ করছে, ভাবলে মিসেস শেখের কেমন যেন লজ্জা লাগে। আহনাফকে কাজ থেকে সরাতে চান। সরে না আহনাফ। বরং মায়ের হাত থেকে ন্যাকড়া নিজের হাতে নিয়ে বলে,
‘ ঘরের কাজ পুরুষরা করলে জাত যাবে কেন, মা? আমি আমার মাকে সাহায্য করছি। আমার মা ছেলের এই সাহায্যেটুকু পাওয়ার অধিকার কি রাখেন না? ‘
মিসেস শেখ কথা বলতে ভুলে যান। ছেলের এই অপরিসীম মমতায় চোখে জল জমে। মুখে না প্রকাশ করলেও অন্তর থেকে ছেলের জন্যে মায়ের দোয়া করেন। ছেলে যেন বড় হয়, সুখ যেন তার ঝুলিতে উপড়ে পড়ে, দুঃখ যেন না ছুয়।
আহনাফ নিজের কক্ষে আসে। গায়ের শুভ্র রঙের শার্ট খুলে বাথরুমে চলে যায়। শাওয়ার ছেড়ে অনেকসময় দাড়িয়ে থাকে চুপচাপ। মাথা ঠাণ্ডা রাখা এই মুহূর্তে খুব প্রয়োজন। বাঁধনকে কি বলবে আহনাফ, আভার পিছু ছেড়ে দেয়ার জন্যে? বাঁধনকে বললে কি ছেড়ে দেবে? প্রশ্ন করবে হাজারটা। কি উত্তর দেবে আহনাফ? বাঁধনের অনুভূতি জানার পরেও সে আভার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। ছিঃ, ছিঃ! স্বার্থপর ভাববে। কি করার ছিল আহনাফের। সে তো আভাকে দূরে দূরেই রেখেছে। অথচ আভা কাছে এসেছে। আহনাফ দু পা পিছিয়ে গেলে, আভা স্বতস্ফর্তভাবে তিন পা এগিয়ে এসেছে। আভার চোখের কাতরতা, ভালোবাসা আহনাফ চেয়েও উপেক্ষা করতে পারেনি। হেরে গেছে সে। নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করেও টিকে থাকতে পারেনি। হার মেনেছে আভার প্রেমে। কি করত সে? আহনাফের দোষ কি এতে? বাঁধন আভাকে ভালোবাসে, জেনেও সে এগিয়েছে। এগুতে হয়েছে তাকে। এতে তার দোষ কি? মনের ফাঁদে পা দিয়েছে সে। এখন সে ফাঁদে নিজে আটকে ছটফট করতে হচ্ছে তাকে।
‘ আহনাফ, গোসল শেষ হয়েছে তোর? ‘
দরজায় করাঘাত এবং মায়ের কণ্ঠস্বর শুনে আহনাফের ধ্যান ভেঙে যায়। আহনাফ মাকে ‘হু” বলে। মিসেস শেখ চলে গেলে আহনাফ দুহাতে নিজের মুখ ঘষে। উজ্জ্বল মুখ ঘষে লাল করে ফেলে। আর না! যা হয়েছে হয়েছে। যা হবে, তা দেখা যাবে।
আহনাফ নিজের পরনের কাপড় ধুয়ে কোমড়ে তোয়ালে পেঁচিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়।
কাপড়গুলো বারান্দায় মেলে নিজের কক্ষে এসে টিশার্ট প্যান্ট পড়ে কক্ষ ছেড়ে বের হয়। মা নিশ্চয়ই খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন।
আহনাফ খাবার টেবিলের সামনে চেয়ার টেনে বসে। আহনাফের মা ছেলের প্লেটে ভাত ও সবজি তুলে দেন। আহনাফ খেতে খেতে মায়ের দিকে চায়। মা খাচ্ছে না। বসে আছেন। আহনাফের খাবার খাওয়া শেষ হলে তিনি খাবেন। আহনাফ বলল,
‘ খাচ্ছ না কেন? আমার সাথে খেয়ে নাও। ‘
‘ তোর শেষ হলে খাব। ‘
‘ সবসময় তোমার জেদ। হা করো। ‘
আহনাফ মায়ের মুখে খাবার তুলে দেয়। আহনাফের মা এই বুঝি কেঁদে দেবেন। নিজের জীবনে স্বামী সোহাগ পান নি তিনি। কিন্তু তার স্বামী আহনাফের ন্যায় এক ছেলে তাকে দিয়েছে। রাজার মত এক ছেলে। আহনাফের মা হা করেন। আহনাফ নিজে খেতে খেতে মাকেও খাইয়ে দিচ্ছে। আহনাফ মায়ের সাথে আনুসঙ্গিক কথা বলছে। বাড়ির পারিবারিক কবরস্থানের জমিটা বাবার দখলে। আহনাফের মায়ের মতে, তিনি সেখান থেকে জমি নিজের জন্যে কিনতে চান। তিনি মরে গেলে যেন তাকে তার আত্মীয়ের সাথে দাফন করা হয়। আহনাফ মায়ের কথা শুনে চুপ করে থাকে। আহনাফের মা বলেন,
‘ আমি জানি, তুই এখনো তোর বাবার সাথে যোগাযোগ রেখেছিস। তাকে বল, আমাকে জমি দিতে। টাকা দিয়ে কিনতে চাই আমি কিছু জমি। ‘
আহনাফ মায়ের মুখে আরো একবার ভাত তুলে দেই। বলে,
‘ তুমি বললে বাবা দিয়ে দেবে। ‘
‘ না, আমি ওই মানুষটার সাথে কথা বলতে চাইছি না। ‘
‘ তাহলে কি আর করা যাবে। ‘
‘ আহনাফ, তুই কি কোনোভাবে চাইছিস, আমি তোর বাবার কাছে ফিরে যাই? ‘
‘ হ্যাঁ, চাইছি। ‘
আহনাফের নির্লিপ্ত উত্তর। আহনাফের মা অবাক হন না। গত এক বছর ধরে আহনাফের সকল কার্যকলাপ তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে, আহনাফ তার মা বাবার মিল চাইছে। কিন্তু মিসেস শেখ তা হতে দেবেন না। কম অপদস্ত হয়ে তিনি ও বাড়ি ছাড়েন নি। সহ্য সীমা অতিক্রম করেছিল বিধায় তিনি তার স্বামী সংসার ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
আহনাফ মা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়েন। আহনাফের দিকে চেয়ে কড়া কণ্ঠে জানান,
‘ আমি যাব না ও বাড়ি। আমি মরে লাশ হব, তাও ওই মানুষটার মুখ আমি দেখব না। তুই আমাকে এই নিয়ে আর কখনো জোর করবি না। নাহলে আমি বিষ খাব। ‘
আহনাফের মা শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে হনহন করে নিজের কক্ষে চলে যান। আহনাফ জানে, মা এখন কাদবে। কাদতে কাদতে বালিশের কোণ ভেজাবেন। মায়ের অনেক দুঃখ! এই দুঃখগুলো আহনাফ শুষে নিতে চায়। চেষ্টা করে। অথচ মায়ের মন অনেক কঠিন। হার মানতে চান না। আগে মা এমন ছিলেন না। বাবার ঘর ছেড়ে আসার পর মা ধীরে ধীরে কেমন যেন হয়ে গেছেন।