#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১৬
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
_________________________
আহনাফের পা চলছে। তাড়াহীন পায়ে এগিয়ে আসছে আভার পানে। আভার পা থেমে। বিস্ময়ে ডুবে যাওয়া চোখ দুখানা দিয়ে অপলক চেয়ে দেখছে আহনাফ নামক প্রেমিক পুরুষকে। আহনাফের গা আভার গায়ে ছুঁইছুঁই। আভা আহনাফের বুক বরাবর। আহনাফকে চেয়ে দেখতে আভাকে মাথা উচু করতে ইচ্ছে। আহনাফের মাথা ঝুঁকে আছে আভার দিকে।
হঠাৎ আকাশ ডেকে উঠল। আকাশের বুক চিড়ে দেখা গেল সুদীর্ঘ ফাটল। বিদ্যুৎ চমকে উঠল। ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টির ফোঁটা আকাশ নিংড়ে মাটিতে ঝড়তে লাগল।
দুজনের গা বৃষ্টিতে ভিজে ছুপছুপ। আহনাফের চুল থেকে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ছে আভার লাজুক লাজুক চেহারার উপর। আহনাফের চোয়াল বেয়ে নেমে আসা প্রতিটা বৃষ্টির ফোঁটা আভার বুকে ভূমিকম্পের ন্যায় কাপন ধরাচ্ছে। আভার ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে। নয়ন জুড়ে রয়েছে সে। আহনাফ আভার কোমড় টেনে ধরল। আভা মিশে গেল আহনাফের বলিষ্ট বুকের সাথে। আহনাফের ভেজা হাত আভার কোমড় স্পর্শ করলে আভার দেহ শিরশির করে উঠে। পেটের মধ্যে মোচড় অনুভব করে। আহনাফ আভার চোখে চোখ রাখে। চোখে চোখে হয় হাজার হাজার কথোপকথন। দৃষ্টি বিনিময় হয় দুজনের। আহনাফ কথা বলে। হুইস্কি কণ্ঠে সুধায়,
–’ আমার একটা গোলাপ আছে। যার সুগন্ধ, যার সৌন্দর্য্য শুধুমাত্র আমাকে মুগ্ধ করার জন্যে তৈরি হয়েছে। আমার সেই গোলাপ তুমি। আমার একান্ত গোলাপ। আমার একটা আকাশ আছে। সেই আকাশে ভিড় করে লক্ষ কোটি তারা। কিন্তু একটা তারা দিনে রাতে সবসময় জ্বলজ্বল করে। সমস্ত অন্ধকার এক হয়ে তাকে কালো করতে পারে না। সে মুক্তোর ন্যায় উজ্জ্বল সদা! আমার আকাশের সেই তারা তুমি। আমার একান্ত তারা। যার আলো শুধুমাত্র আমার জন্যে। আমার জীবনে দুজন নারী আছেন। যারা আমাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছেন, ভালো রাখতে জেনেছেন, আগলে রেখেছেন। মায়ের পর তুমি আমার জীবনের শ্রেষ্ট নারী। যে নারী আমার বুকের বাম পাজরের হাড়, আমার বুকের স্পন্দন, আমার হৃদপিণ্ডের তীব্র শিহরণ, আমার চন্দ্র, তারা, সূর্য, আকাশ সবকিছু। সেই নারী হলে তুমি, আভা। ‘

আভা চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। চোখ খুলে আহনাফের দিকে চেয়ে দেখবার সাহসটুকু কোথাও যেন হারিয়ে গেছে। আভার প্রাণ বোধহয় এখুনি বেরিয়ে আসবে। এই বুঝি সুখে আভার মরণ হল! আভার কান থেকে ধোঁয়া নির্গত হচ্ছে। দাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে রেখেছে। এতদিন আভা যা শুনতে চেয়েছে, আজ তাই আহনাফ তাই গভীর আবেগ দিয়ে আভাকে বলছে। আহনাফের আকাশের তারা আভা? ইশ, আভা আর কিছু ভাবতে পারছে না। হাঁটু ভেঙে আসছে। এই বুঝি মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।
আহনাফ আভার গালে হাত রাখল। দু হাতের আজলায় পুড়ল আভার নরম তুলতুলে গাল। আভার ভেজা চুল কানের পেছনে যত্নসহকারে গুঁজে দিয়ে সুধাল,
–’ তাকাবে না? ‘

আভা কথা বলতে পারছে না। গলায় কেউ যেন পাথর বসিয়ে রেখেছে। সে পাথর লোহা দিয়ে তৈরি নয়। এ পাথর প্রেমের পাথর। পাথরের গায়ে মুক্তোর ন্যায় জ্বলজ্বল করে প্রেমের উত্তপ্ত শিখা। পাথরের গায়ে একগুচ্ছ আদর দিয়ে লেখা,
‘ আভার অনুভূতি আরো একটু বেহায়া হোক
আরো একবার সে কণ্ঠে আদর ঢেলে ভালোবাসি বলুক
দেহমনে একটুখানি কাপন ধরাক
সুখে দিক, যত ইচ্ছে তত। ‘

–’ তাকাবে না? আচ্ছা, তাকিও না। শুনো। আজ আমার অনেককিছু বলার আছে। অনেকদিন কারো সাথে এভাবে মন খুলে কথা বলিনি। সবসময় নিজের অনুভূতি আটকে রাখতে পছন্দ করতাম। অথচ দেখো। তুমি এলে। এক কিশোরী মেয়ের কারণে চব্বিশ বছরের সকল নিয়ম কেমন উল্টেপাল্টে গেল। আমাকে কেড়ে নিলে আমার থেকে। গত এক সপ্তাহ শুধু নিজের সাথে যুদ্ধ করেছি। তুমি অনেক ছোট, অনুভূতি বুঝো না, নিজেকে এসব বলে বাঁধা দিতে চেয়েছি। আমি পারিনি। শত চেষ্টা করেও প্রেমে হোচট খাওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারিনি। আমি স্বইচ্ছায় আত্মসমর্পণ করছি। আমাকে আটক করো। মনে শেকল পড়াও। প্রেমের গুলিবর্ষণ করে মনটাকে ঝাঁজরা করে দাও। তবু আমার হয়ে যাও। আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু হবে? আমার একজন বউফ্রেন্ড হবে, আভা? ‘

আহনাফ আভার বন্ধ চোখের পাতায় চুমু খেল। আভার বোধ হল, চোখে যেন কেউ গোলাপের পাপড়ি ছিটিয়ে হয়েছে। তার স্পর্শে এত শান্তি কেন? আভা ক্রমশ চোখ খুলে চাইল। চোখ রাখল আহনাফের চোখে। আহনাফ একবুক আশা নিয়ে আভার দিকে চেয়ে আছে। আভা যে প্রেমের আগুনে এতদিন পুড়ে পুড়ে অঙ্গার হয়েছে, আজ আহনাফের চোখে সেই একই দহন লক্ষ্য করছে সে। আহনাফের ঘোলাটে চোখে কিসের যেন কাতরতা। আভাকে না পাওয়ার শঙ্কা। আভা ঢোক গলাধঃকরণ করল। আভা লালা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল। নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে আহনাফের গলা জড়িয়ে ধরল। আহনাফ আভার কোমড়ে হয় রেখে সামলালো আভাকে। আভা মুচকি হেসে পরিষ্কার কণ্ঠে বলল,
—’ আপনি যা বলবেন তাই হব আমি। আমাকে আপনার বানিয়ে নিন। সোনা যেভাবে পুড়িয়ে খাঁটি করে, আমাকে এভাবে খাঁটি করে তুলুন। তবুও আপনি আমার হয়ে যান। ‘

আজ দুজনের ঠোঁটে প্রাপ্তির হাস। দুজনেই যেন বিশ্ব জয় করেছে। সুখের হাসি দেখে রাতের বৃষ্টি হাসল। আকাশ গান গেয়ে উঠল। বাতাস নেচে উঠে শীতল হাওয়া ছুয়ে দিল দুজনের গা। আহনাফ আভার কপালে কপাল ঠেকাল। মৃদু কন্ঠে বলল,
–’ বৃষ্টি পড়ছে। ঠাণ্ডা লাগবে তোমার। ‘
–’ লাগুক। একটু ঠাণ্ডা লাগলে কিছু হয় না। ‘
–’ হাঁচি হবে। জ্বর হবে। ‘
–’ হোক। আপনাকে পেয়ে গেলে সব পালিয়ে যাবে। ‘
–’ আমি কি ঔষুধ? ‘
–’ উহু। আপনি আমার মনের ঔষুধ। ‘
আহনাফ মৃদু হাসে।
–’ এমনি এমনি বাচ্চা বলি না তোমাকে। তুমি আসলেই একটা বাচ্চা। কথাবার্তা এখনো বাচ্চাদের মত। ‘
–’ বাচ্চা নই। শুধু আপনি সামনে থাকলে বাচ্চা হয়ে যাই। ইচ্ছে করে নয়, কেমন করে যেন হয়ে যাই। ‘
–’ এই বাচ্চা মনে এত প্রেম আসে কোথা থেকে? ‘
–’ আপনি শিখিয়েছেন। ‘
–’ আমি নই। বরং তুমি আমাকে ভালবাসতে শিখিয়েছ। ‘
–’ আচ্ছা, আমরা দুজন দুজনকে শিখিয়েছি। ‘
–’ এবার ঠিক আছে। ‘

ঘড়ির কাঁটা আটটায় এসে থামলে আহনাফের ফোন আলার্ম বেজে উঠে। আভা আহনাফের থেকে সরে আসে। আহনাফ মোবাইল বের করে। ‘ ওহ, শিট। ‘ বৃষ্টিতে ভিজে মোবাইলের অবস্থা খুব নাজেহাল। ভিজে অর্ধেক ডিসপ্লে চলে গেছে। মোবাইল খুব কষ্টে এখনো কাজ করছে। অ্যালার্ম দিয়ে জানিয়ে দিচ্ছে, আহনাফের আগামীকাল আইটেম। এখন পড়তে না বস্পে নির্ঘাত কালকে পরীক্ষা খারাপ হবে। মেডিকেল আহনাফের রেজাল্ট বরাবরই প্রশংসনীয়। পড়াশোনা নিয়ে কম্প্রোমাইজ আহনাফ পছন্দ করে না। আহনাফ মোবাইলের পানি হাত দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করল। যেকোনো সময় মোবাইল বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
বৃষ্টি থেমে গেছে। আভা মন খারাপ করে বলল,
—’ মোবাইল তো নষ্ট হয়ে গেছে। এখন? ‘
আহনাফ সুন্দর হাসল। আভার দিকে চেয়ে বলল,
–” আরেকটা কিনে ফেলব। এটা বাদ দাও। চলো তোমায় বাসায় পৌছে দিয়ে আসি। অনেক রাত হয়ে গেছে।তোমার মা চিন্তা করবেন। কি বলে বেরিয়েছ? ‘
–’ বান্ধবীর বাসায় নোট আনতে গিয়েছি। ‘
আভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। যেন খুব মজার কথা বলেছে সে। আহনাফ ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
–’ চব্বিশ বছরের দামড়া ছেলে হয়ে এখনো লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করতে হচ্ছে। ব্যাড লাক। সমবয়সী হলে এত কষ্ট করতে হত না। দুজনেই ম্যাচিউর থাকতাম। ‘
আহনাফ একটু অন্যমনস্ক ছিল। তাই কথাটা খুব একটা ভেবে বলে নি। কিন্তু আহনাফের কথায় আভার দিলে মোচড় দিয়ে উঠল। আহনাফের কি এই সম্পর্ক নিয়ে আপসোস হচ্ছে। আভা আহনাফকে পিছু ফেলে হাঁটতে শুরু করল। আহনাফ বোকা বনে গেল। কি হয়েছে ধরতে পারল না। মস্তিষ্কে চাপ প্রদান করল। মনে পড়ল, সে একটু আগে কি বলেছে। মুচকি হাসল। পেছন থেকে চিৎকার করে জানাল,
–’ ওহে মেয়ে, আমার শুধু তোমাতেই চলবে। একবার তোমাতে আটকে গেছি। এখন সমবয়সী কেন, পৃথিবীর সবচে সুন্দর মেয়ে এনে দিলেও কাজ হবে না। আ’ম অল ইউরস। ‘

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here