#মন_তোমাকে_ছুঁয়ে_দিলাম – ১০
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
____________________________
অতঃপর দাদীর পদ্ধতি বেশ মনে ধরল আভার। আভার ঠোঁটের কোণে ছড়িয়ে পড়েছে অমায়িক হাস। আভা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। দাদীর নরম তুলতুলে গাল টেনে বলল,
–’ কি চালাক গো তুমি দাদী। ‘
দাদী ফোকলা দাঁতে হাসল। সুন্দর দেখাল বেশ। চেহারায় কিশোরীদের ন্যায় উচ্ছলতা। চোখ জোড়ায় আকাশসম আদর। মনে হচ্ছে আভার সামনে কোনো বৃদ্ধ নয় বরং এক কিশোরী বসে আছে। কিশোরীর হাসির ঝঙ্কারে চারপাশ ঝিলমিলিয়ে উঠছে। আভা হেসে ফেলল। দাদীর শরীরের সাথে ঘা ঘেঁষে বসল। টিপ্পনী কেটে বলল,
–’ কি গো দাদী। দাদু এখনো অনেক আদর করে, তাই না? ‘
দাদী হাসতে হাসতে ব্যাকুল হচ্ছেন। আভার গায়ে মৃদু থাপ্পড় দিয়ে সুধালেন,
–’ হর ত মাইয়া। খালি দুষ্টু দুষ্টু কথা। ‘
আভার ঠোঁটে হাস। হাসতে হাসতে দাদীর গায়ের উপর লেপ্টে যাচ্ছে সে। দাদী পান খাচ্ছেন। আভাকে সাধলেন,
–’ এই মেয়ে, পান খাবি? ‘
দাদীর কথা শুনে আভা মৃদু নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
–’ জর্দা বেশি করে দিবে। ‘
–’ হ। পরে মাথা ঘুরাইব। ‘
–’ ঘুরাক। একটু মাথা ঘুরালে কিছু হয় না। ‘
–’ হ। বিয়ের পর যখন ছেরি ছেমরা হইব, তখন বুঝবি। একটু মাথা ঘুরাইলে কেমনটা লাগে। ‘
আভা লজ্জা পেল। গাল দুটো কেমন যেন লাল টকটকে রং ধারণ করল। দাদীকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেল। দাদী হেসে উঠলেন। আভা মুচকি হেসে বলল,
–’ তুমি খুব ভালো, দাদী। পান দিবে না? ‘
দাদী পান সাজালেন। আভাকে পান এগিয়ে দিয়ে বললেন,
–’ জর্দা বেশি খাইস না। খাওয়া বালা না। মাথা ঘুরায়। বমি করবি শেষে। ‘
–’ আচ্ছা। কম করেই দাও।’
–’ নে। ধর। ‘
দাদী আভাকে পান মুখে তুলে দিলেন। আভা পান চিবিয়ে মুখ বাঁকিয়ে নিল। চোখ মুখ খিচে বলল,
–’ পানের কি তেজ গো দাদী। ‘
–’ পানের তো তেজ হই রে বোকা মেয়ে। ‘
–’ মজা আছে কিন্তু। ‘
আভা পান চিবিয়ে দাদীর সাথে গল্প করতে মন দিল। আহনাফের চিন্তা মস্তিষ্কের কোথাও উকিঝুঁকি দিতে চাইলে আভা ধূর ধূর করে তাড়িয়ে দিল। মানুষটাকে আর মনে করবে না আভা। এবার অন্য চাল চালবে সে। যে চালে বাঘ নিজে এসে ফাঁদে ধরা দিবে। প্রেম স্বীকার করবে।
বাস ঢাকার কাছাকাছি এসে গেছে। আহনাফের ঘুম ভেঙে যায় বেশ খানিক আগে। চিত্রার কাধে নিজেকে উপলদ্ধি করতে পেরে হকচকিয়ে উঠে সে।
–’ তুই? ‘
চিত্রা নিজের কাধ ঘষে। ব্যাথাতুর গলায় বলে,
–’ পুরো তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছিস। কাধ ব্যথা করে দিয়েছিস একদম। ‘
আহনাফ বোকা বনে যায়। সে তো সিটে ঘুমিয়েছিল। চিত্রার কাধে আসল কখন? উফ! মাথা ধরছে। আভা? আভা কোথায়?
আহনাফ সিট থেকে উঠে সামনে তাকায়। হাস্যরত আভাকে দেখে তার বুকে পানি আসে। আহনাফ ভ্রূ কুচকে আভার দিকে চায়। আভা আড়চোখে আহনাফের দিকে চায়। অতঃপর একটি সুন্দর হাসি। আহনাফের বুক ধড়াস করে উঠে। মেয়েটা এত সুন্দর করে হাসে কেন? আহনাফের মত গম্ভীরমুখো মানুষেরও এই হাসির তরে কুরবান হতে ইচ্ছে হয়। অদ্ভুত!
গাড়ি এক জায়গায় থামে। দিহান সামনে থেকে চিৎকার করে বলে,
–’ এই আহনাফ, তোরা কিছু নিবি? বাস কিন্তু আর থামবে না। ‘
আহনাফ মাথা নাড়ায়। বলে,
–’ লাগবে না। তোদের কিছু দরকার হলে আন। ‘
–’ আভা? তোমার কিছু লাগবে? ‘
–’ না। আমার কাছে খাবার আছে। ‘
–’ চিত্রা তুই? ‘
–’ বিস্কুট আনিস একটা। ক্ষুধা লেগেছে। ‘
–’ আচ্ছা। গেলাম আমি। ‘
দিহান নেমে পড়ে বাস থেকে। বাঁধন পেছনে ফেরে। আভার দিকে চেয়ে বলে,
–’ কোনো অসুবিধা হচ্ছে, আভা? ‘
আভা মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
–’ না। ঠিক আছি আমি। ‘
বাঁধন আবার সিটে বসে পড়ে। আভা দাদীর কাছে ঘেঁষে বসে। কানেকানে বলে,
–’ দেখেছ? তার বন্ধুরা ঠিকই আমার খোঁজ নিচ্ছে। অথচ সে? গুতুম পেঁচার ন্যায় হুব করে বসে আছে। খারাপ লোক।’
দাদী হাসল। আভার মত ফিসফিসিয়ে বলল,
–’ আরে বোকা মেয়ে। সে তোর খুঁজ না নিলেও ঘুরেফিরে তোরেই দেখে যাচ্ছে। পেছনে ফিরে দেখ একবার। তোর দিকেই কেমন করে চাইয়া আছে। সেও ভালোবাসে রে পাগল। ‘
আভা সোজা হয়ে বসে। মুখ গোমড়া করে বলে,
–’ হ্যাঁ। তুমি তো খুব জানো। ভালো টালো বাসে না গো। খারাপ লোক একটা। ‘
–’ বোকা মেয়ে। ‘
দাদী মৃদু হাসে। আভা সারাপথ গাল ফুলিয়ে পাড়ি দিল। দাদীর সাথেও একটা কথা বলল না। ভীষন মন খারাপ ঝেঁকে ধরেছে তাকে। কি করতে যে এই নিরামিষ লোকের প্রেমে পড়েছিল আভা। যার মুখ থেকে ভালোবাসি শব্দটা বের করতে এত কসরত করতে হচ্ছে। ভালোবাসি, শব্দটা বলা এত কি কঠিন? চট করে বলে ফেলা যায়। ‘ আমি তোমাকে ভালোবাসি ‘, এই ছোট্ট বাক্য বলতে কি কষ্ট হয় কারো? শুধু অনুভূতি থাকলেই বলা যায়। অথচ সে বলবে না। খারাপ, জঘন্য লোক। আভা আর তার পেছনে যাবে না। এখন এই গম্ভীরমুখোকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাবে। ভালোবাসি না বলে কোথাও যাবে? ফিরে তো তার কাছেই আসতে হবে।
অথচ আভা বুঝতে পারল না। হায় অবুঝ মন। ভালোবাসি, কথাটা কি তজবিহ পাঠের ন্যায় বলে কয়ে বেড়ানোর বিষয়? ভালোবাসা, অনুভবের বিষয়। যে মন থেকে প্রিয় মানুষকে যত অনুভব করতে পারে, সে তত ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসা বলার মধ্যে নয়, প্রকাশেই স্বার্থক। এই যে শাড়ীর কুচি সামলে দেওয়া, কপালে আদর করে ছোট্ট এক টিপ পড়িয়ে দেওয়া, রাস্তার পাশে অবহেলায় গজে উঠা বেলি ফুলের চারা থেকে বেলি ফুল ছিঁড়ে প্রেমিকার কানে গুঁজে দেওয়া, অবেলায় অভিমান করা প্রেমিকের অভিমান ভাঙ্গানো, অসুস্থ হলে দু একটা মিথ্যা রাগ দেখানো, একটু ছুঁয়ে দেখার জন্যে মিছামিছি বাহানা দেওয়া! এসব কি ভালোবাসা নয়?
প্রেমে পড়ার ন্যায় সুন্দর কিছু এই ধরনীতে আর কিছু নেই। প্রেম সুন্দর, প্রেমে পড়ার অনুভুতি তার চেয়েও ভয়ঙ্কর সুন্দর। আভা প্রেমে পড়েছে। তার সম্পূর্ন পৃথিবী একজনাতে আটকে আছে। সেই একজন ব্যতীত আভা আর কিছু দেখতে পারছে না। তাকে একনজর দেখতে না পেলে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। এ কি প্রেম নয়? প্রেমের অনলে ক্রমাগত দগ্ধ হওয়া অবুঝ সেই প্রেমিকা জানতে পারল না, ওপরপাশের মানুষটা তাকে নিয়ে নিজের সমগ্র ধরনী সাজিয়েছে। কলাপাতায় ঘেরা সুন্দর এক সংসারের স্বপ্ন দেখছে। আভা জানল না, তার প্রেমিক পুরুষও তাকে ভালোবাসে। বড্ড অধৈর্য্য সে।
বাস থেমেছে। ঢাকা পৌঁছে গেছে সবাই। আভা লাগেজ নিয়ে বাস থেকে নেমে দাড়াল। পেছনে রেখে গেল আহনাফের অবাক দৃষ্টি।
–’ তোমাদের ভীষন মনে পড়বে! ‘
আভা আহনাফের বন্ধুদের দিকে চেয়ে আছে। মন খারাপের গলা শুনে দিহান বলল,
–’ আবার দেখা হবে আমাদের। মন খারাপ করো না। ‘
–’ বারবার দেখা হোক। ‘
আভা আহনাফের বন্ধুদের সাথে কথা বলছে। আহনাফ পাশে দাঁড়িয়ে চুপচাপ দেখে যাচ্ছে আভার এই নতুন নাটক।
–’ আচ্ছা এখন যাই। বাবা বাইরে দাড়িয়ে আছেন। ‘
–’ গুড বাই। ‘
–’ শুভ বিদায়। ‘
আভা চলে যাচ্ছে। আহনাফের সাথে এখন অব্দি একটা কথা বলে নি আভা। আহনাফ বিস্মিত। আভার এই পরিবর্তন সে ভালো চোখে দেখল না। বন্ধুদের কাজের বাহানা দিয়ে সে ছুটে গেল আভার দিকে।
আহনাফ আভার হাত ধরল। আভা থেমে গেল। আহনাফের কড়া দৃষ্টি আভাকে যেন ছারখার করে দিবে। গভীর ওই দু চোখে আভা তার সর্বনাশ দেখতে পারছে। আভা নিজেকে সামলাল। বলল,
–’ হাত ছাড়ুন। দেরি হচ্ছে আমার। ‘
আহনাফ ছাড়ল না। বরং বলিষ্ট পেশীবহুল হাত ছুঁয়ে রাখল আভার হাতের কব্জিতে। যেন আভার হাত আজ মুচড়ে ভেঙে ফেলবে। আভা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠল। আহনাফ হিড়হিড় কণ্ঠে বলল,
–’ কি হয়েছে? এমন অদ্ভুত বিহেভ কেন করছ? হোয়াটস রং? ‘
আভা অবাক হওয়ার ভান করল। মুখের আকৃতি সামান্য হা করে বলল,
–’অদ্ভুত? কখন অদ্ভুত ব্যবহার করলাম? ‘