#মনোপ্যাথি
#পর্ব:৪
#অরিত্রিকা_আহানা

সেন্টারে পৌঁছালাম আধঘন্টা পর।বর এসে গেছে।ইমতিয়াজ ভাইয়াকে আপুর পাশে বসানো হলো। বাবা এসে আমাকে, ভাইয়াকে আর ইমুকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেলেন।বাবার চোখমুখ কেমন যেন শুকনো লাগছে।
ভাইয়া বাবাকে বললো, “তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে নাকি বাবা?চোখমুখ এমন শুকনো লাগছে কেন?”

বাবা কিছু বললেন না। ইমু আর ভাইয়া মিলে বাবাকে প্রায় জোর করে একপাশে নিয়ে গিয়ে প্রেসার চেক করলো।ভাইয়া তাড়াতাড়ি বাবাকে প্রেসারের ওষুধ দিয়ে আমাকে বললো,”বাবাকে শোয়াতে হবে।বিপি মারাত্মক হাই!

আমাদেরকে এদিকে ব্যস্ত দেখে ইনায়াজ ভাই এগিয়ে এসে ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলো,” কি হলো আঙ্কেলের শরীর খারাপ নাকি?” ইমু উনাকে জানালো যে বাবার প্রেসার বেড়ে গিয়েছে।

আমাদের কথা বলার মাঝখানেই বাবা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন।বাবাকে আর কখনো এমন অসহায় লাগে নি।তারপর চট করে আবার চোখের পানি মুছে বললেন,”তাফসিটা চলে গেলে পুরো ঘর ঠান্ডা হয়ে যাবে, আমার মেয়ে একা একা সব সামলাবে কি করে?”

এতক্ষনে বুঝতে পারলাম বাবার মুখটা এত মলিন দেখাচ্ছিলো কেন?ইনায়াজ ভাই বাবার পাশে বসলেন। বাবার হাত চেপে ধরে সান্ত্বনার সুরে বললো,”তাসফি খুবই বুদ্ধিমতী মেয়ে।আপনি শুধুশুধু ওকে নিয়ে টেনশন করছেন আঙ্কেল।”

বাবা উনার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন।উনি বাবার দিকে তাকিয়ে মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে বললেন,”আমি জানি তাসফিকে নিয়ে আপনার টেনশন হচ্ছে।নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ খাপ খাওয়াতে পারবে কি না।আসলে মেয়েরা হচ্ছে বাবার প্রিন্সেস।ছোটবেলা থেকে সংসার জীবনের আগ পর্যন্ত একটা মেয়ে তার সকল লড়াই বাবার হাত ধরেই পার করে।তারপর যখন একটা নির্দিষ্ট বয়স হয় এতবছরের চেনা জগৎ ছেড়ে একটা মেয়েকে সম্পূর্ণ নতুন একটা পরিবেশের সাথে নিজেক মানিয়ে নিতে হয়।এটাই প্রকৃতির নিয়ম।কিন্তু এই সময় প্রতিটা মেয়েই মনে মনে এমন একজন মানুষকে চায় যে তার বাবার মত,তার বড় ভাইয়ের মত তাকে সব বিপদ থেকে আগলে রাখবে।আর সেই মানুষটাকে খুঁজে দেওয়ার দায়িত্ব হচ্ছে তার পরিবারের লোকজনকে।একবার ইমতিয়াজ কে দেখুন তো?আপনার কি মনে হয় ইমতিয়াজ তাসফির জন্য সেই মানুষ, যার মাঝে আপনি আপনার ছায়া দেখতে পান?”

বাবা ইমতিয়াজ ভাইর দিকে একনজর তাকিয়ে বললো,”ইমতিয়াজের ওপর আমার সেই ভরসা আছে।”

ইনায়াজ ভাই এবার হেসে উঠে বললেন,”তাহলে শুধু শুধু টেনশন করছেন কেন? আপনি যদি এমনভাবে ভেঙ্গে পড়েন তাসফি ভরসা পাবে কার কাছ থেকে ? এখন তো আপনাদের সবার দায়িত্ব ওকে ভরসা দেওয়া যে এতদিন ধরে ও যাদের ওপর ভরসা করে এসেছে এখন থেকে ইমতিয়াজই ওর জন্য সেই ভরসার জায়গা।”

বাবা নরম গলায় বললেন,”আসলে মেয়ের বাবা তো তাই না চাইতেও অনেক চিন্তা মাথায় চলে আসে।”

বাবা কিছুটা শান্ত হতেই আমার মনটাও বেশ হালকা হয়ে গেলো।ছোটবেলা থেকেই বাবা মা দুজনই আমাদের ব্যাপারে বেশ সেন্সিটিভ।তবে বাবা একটু বেশি,এত বড় হয়েছি তবুও সেই ছোট্টটির মত এখনো আগলে রাখার চেষ্টা করে।

ঠিক আড়াইটায় বিয়ে পড়ানো হয়ে গেলো।এরপর শুরু হলো খাওয়া দাওয়ার পর্ব।ভাইয়া,ইমু,ইনায়াজ ভাই,বাবা,চাচুরা সবাই ব্যস্ত।আমি আপুর পাশে বসে আছি।ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধুরা আপুকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।

আমি আপুকে ফিসফিস করে বললাম,”আপু তোমার কি ক্ষিদে পেয়েছে?”
-“উহু!”
ইমতিয়াজ ভাইয়া সবার অলক্ষে ফিসফিস করে বললো,” না খেলে তো দুর্বল হয়ে পড়বে,সারারাত জাগবে কি করে?”

আমি না শোনার ভান করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছি।সত্যি ইমতিয়াজ ভাইয়া পারেও বটে, লাজলজ্জা কিচ্ছু নেই।আশেপাশে কত লোকজন তবুও নির্লজ্জের মত আপুর দিকে তাকিয়ে হাসছে।আপু চোখ গরম করে উনার দিকে তাকাতেই উনি আবারও উনার সেই মিষ্টি হাসিটা দিলেন।
আমি খেয়াল করে দেখলাম ইমতিয়াজ ভাইয়ার হাসিটা অনেকটা ইনায়াজ ভাইয়ের হাসির মত,বেশ পবিত্র।একেবারে নিখাদ হাসি!!বাবার কাছে শুনেছি যাদের হাসি সুন্দর তাদের মন নাকি ভীষন ভালো হয়।

একটুপর ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধুরা আমাকে নিয়েও হাসাহাসি শুরু করে দিলো।আমি মাঝেমাঝে দুএকটার জবাব দিলাম।

খাওয়াদাওয়া শেষে কথা উঠলো আপুর সাথে যাবে কে কে?
আমি বললাম আমি যাবো।রুহিও আমার সাথে যাবে বায়না ধরেছে,কিন্তু মামি ছাড়তে নারাজ।ও এমনিতেই ভীষণ দুষ্টু।মামি বললো আমরা সামলাতে পারবো না।অবশেষে ইনায়াজ ভাই বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে শান্ত করলো।

শেষমেশ ঠিক হলো আপুর সাথে, আমি, তিথী(বড়ফুফুর মেয়ে) আর তিশা(আমার খালাত বোন)যাবো।

গাড়িতে আমি আপুর পাশে বসে আছি।অন্যপাশে ইমতিয়াজ ভাইয়া।ইমতিয়াজ ভাইয়া আপুর হাতদুটো শক্ত করে ধরে রেখেছে।আপু একটু পর পরই ডুঁকরে কেঁদে উঠছে।আমি নিজেও কান্না চেপে রাখতে পারছি না।গাড়িতে উঠার সময় বাবা,মা,ভাইয়া,ইমু সবার কান্নাভেজা মুখগুলো বারবার ভেসে উঠছে।ইমতিয়াজ ভাইয়া যথাসাধ্য চেষ্টা করছে আপুকে ভুলিয়ে রাখার জন্য।

ওখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় রাত হয়ে এলো।বেশ ক্লান্ত লাগছে।আপুকে ইমতিয়াজ ভাইয়ার ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো।

আমি ফ্রেশ হয়ে আপুর কাছে যেতেই দেখলাম ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধুরা আপুর সাথে দুষ্টুমি করছে। তারওপর বাসাভর্তি মেহমান সব বউ দেখতে এসেছে।আমি ভালো করে আপুর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ওর খারাপ লাগছে কি না।আপুকে কিছুটা স্বাভাবিক দেখে স্বস্তি পেলাম।একটু পর মুক্তা আপু এসে সবাইকে আপুর রুম থেকে বের করে দিলেন।মনে মনে খুশিই হলাম।আপু কিছুটা রিলেক্স হতে পারবে।

এমনিতেই সারাদিন অনেক ধকল গেছে।একটু পরেই বাবা ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলো আপু কি করছে,এখন আর কান্নাকাটি করছে কি না।আমি বাবাকে আশ্বস্ত করে বললাম আপু এখন কিছুটা শান্ত আছে।

রাতে খাওয়াদাওয়া শেষে আমাদের তিনজনের জন্য আলাদা একটা রুম ছেড়ে দেওয়া হলো।আপুর শ্বাশুড়ি, মুক্তা আপু এসে বারবার বলে গেলো কোন সমস্যা হলে উনারদেরকে জানানোর জন্য।আমি মনে মনে বেশ স্বস্তি পেলাম যাক আপুর কোন অযত্ন হবে না ইমতিয়াজ ভাইয়ার ফ্যামিলিতে।আপুর শ্বাশুড়ি,মুক্তা আপু এনারা অসম্ভব ভালো মানুষ।

আমি শুয়ে সবে চোখ বন্ধ করেছি এমন সময় তিশা আমাকে বললো,”এই তনু!একটা ব্যাপার খেয়াল করেছিস?”
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকালাম।ও দুষ্টুভাবে হাসতে হাসতে বললো,” ইমতিয়াজ ভাইয়ার বন্ধু নাফিস ভাই তোর দিকে তাকিয়ে কেমন মিটমিট করে হাসে? মনে হয় তোকে মনে ধরেছে।”
তিশার কথা শুনে আমি কিছুটা বিরক্ত হলাম।কই আমি তো একবারও খেয়াল করি নি!
আমাকে অবাক করে দিয়ে তিথীও তিশার সাথে সুর মিলিয়ে বললো, “আমিও খেয়াল করেছি।খেতে বসেও উনি আড়চোখে বারবার তনুর দিকে তাকাচ্ছিলো।”
আমি ওদের কথায় পাত্তা না দেওয়ার ভান করে বললাম, “সকালে আবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।তাড়াতাড়ি ঘুমা এখন।”
তিথী আমার কথায় গা না করে বললো,”যাই বলিস দেখতে কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম!আমি তো ক্রাশড!গায়ের রংটা একটু চাপা আর কি।অবশ্য ছেলেরা একটু শ্যামলা হলেই দেখতে ভালো লাগে।”

তিশা বলল,”তারওপর শুনেছি মেরিন অফিসার,তোর সাথে বেশ মানাবে।তাসফির আপুর বান্ধবীরা উনাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলো।অনেকেই নাকি ক্রাশ খেয়েছে!”

আমি ওদেরকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু মাথা থেকে ব্যাপারটা সরাতে পারলাম না।তবে একটা কথা ওরা সত্যি বলেছে নাফিস ভাই ইজ কোয়াইট আ হ্যান্ডসাম গাই।ইমতিয়াজ ভাইয়া,ইনায়াজ ভাই এদের থেকে কোন অংশে কম যায় না।চেহারা মায়াময় কাঠিন্যভাব আছে।চোখেমুখে বুদ্ধিমত্তা আর দৃঢ় ব্যক্তিত্বের ছাপ।কিন্তু উনি আমাকে?..নাহ্!আর কিচ্ছু ভাবলাম না।চোখ বন্ধ করে ঘুমের দেশে পাড়ি দিলাম।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here