#মনোপ্যাথি
#পর্ব:১২
#অরিত্রিকা_আহানা
বুঝতে পারলাম একূল ওকূল দুইকূলই গেছে আমার।নাফিস হয়ত আমাকে রাখবে না।কিন্তু চারদিন পর যখন আমার জ্ঞান ফিরলো তখন আমি চোখ খুলেই আপুকে জিজ্ঞেস করলাম, “নাফিস কোথায়?”
আপু আমার কথার জবাবে শুধু বললো, “ও ভালো আছে।”
আমি পুরো রুমটা চোখ বুলিয়ে দেখলাম সবাই আছে শুধু নাফিস ছাড়া।রুমের দরজায় হেলান দিয়ে ইনায়াজ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন।
একি অবস্থা হয়েছে উনার?চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে।চুল উসকোখুসকো, খোঁচাখোঁচা দাড়িগুলোও বেশ বড় হয়ে গেছে।ভীষণ ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত লাগছে মনে হচ্ছে যেন অনেকদিনের অনিদ্রায়,অনাহারে ভূক্ত একজন মানুষ।
আমি তাড়াতাড়ি উনার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম।মাথায় অসহ্য যন্ত্রনা হচ্ছে,বুকের ভেতরটা চিনচিন করে উঠলো।
আমি উঠে বসার চেষ্টা করে আপুকে আবারও জিজ্ঞেস করলাম নাফিস কোথায়?
আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম আপু চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছে।সবার চোখেমুখে কেমন যেনো একটা আতঙ্কের ছাপ।আমি ভয় পেয়ে গেলাম।নাফিসের কিছু হয় নি তো?
সেদিন রাতে পার্টি থেকে নাফিস আমাকে তার বাসায় নিয়ে যায়।তারপর সেখান থেকে প্রচন্ড রাগে আমাকে আমাদের বাসায় দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়।আমার শত আকুতি ওর কানে পৌঁছায় নি।পৌঁছাবে কি করে?সম্পূর্ণ মাতাল ছিলো সে।মাতাল অবস্থায় ড্রাইভ করায় আমাদের গাড়ি এক্সিডেন্ট করলো।বারবার তাকে বলেছিলাম এই অবস্থায় গাড়ি না চালাতে কিন্তু আমার একটা কথাও সে শোনে নি।এক্সিডেন্টের চারদিন পর আজকে আমার জ্ঞান ফিরেছে।
অজানা আশংকায় আমার বুক কেঁপে উঠলো।সৃষ্টিকর্তা কি আমাকে ভুল গুলো শুধরে নেওয়ার সুযোগও দেবেন না?আমি তো নাফিসের সাথে আবার নতুন করে শুরু করতে চাই।আমি আর ধৈর্য রাখতে পারলাম না।বারবার চিৎকার দিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলাম নাফিসের কি হয়েছে?
কিন্তু কেউ আমাকে কোন জবাব দিচ্ছে না।
আমার চিৎকার চেঁচামেচি আরো বেড়ে গেলো।
আমাকে উত্তেজিত হতে দেখে ইনায়াজ ভাই দৌঁড়ে এগিয়ে এসে চোখেমুখে উৎকন্ঠা নিয়ে বললেন, “নাফিস ঠিক আছে।তুমি প্লিজ শান্ত হও।এমন করলে তোমার জন্যই রিস্ক হয়ে যাবে। ”
উনি আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করতেই আমি চিৎকার দিয়ে বললাম, “আপনি সরে যান আমার কাছ থেকে।সরে যান!সরে যান বলছি!”
আমার এমন ব্যবহারে উনি অবাক হলেন না।আমি তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি।আমার মাথায় কিচ্ছু কাজ করছিলো না।আমি ক্রমাগত চিৎকার করে উনাকে বেরিয়ে যেতে বলছি।
উনি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখলেন তারপর আর একসেকেন্ডও দেরী করলেন না।বেরিয়ে গেলেন।
উনি বেরিয়ে গেলে আমি ইমতিয়াজ ভাইয়ার হাত চেপে ধরে বললাম, “প্লিজ আমাকে বলুন ভাইয়া,নাফিসের কি হয়েছে? প্লিজ!আমি আর সহ্য করতে পারছি না।”
ইমতিয়াজ ভাইয়া শুধু বললেন, “ওকে আইসিউতে রাখা হয়েছে।তুমি প্লিজ শান্ত হও।তুমি এখনো সুস্থ নও।”
উনার কথা শুনে আমার পায়ের তলার মাটি সরে গেলো।আমি হঠাৎ ঝরেপড়া পাতার মত নিজেকে ছেড়ে দিয়ে বললাম, “সব আমার জন্য হয়েছে ইমতিয়াজ ভাই।সব আমার জন্য।”
আমার চিৎকার চেঁচামেঁচি ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলো। আমার ক্রমাগত চিৎকারে ভাইয়া আমাকে সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।
তিনদিন বাদে যখন আমি কিছুটা সুস্থ হলাম তখন আমি নাফিসকে দেখতে চাইলাম।সবাই আমাকে জানালো যে ও সুস্থ আছে।কিন্তু আমি নিজেকে শান্ত রাখতে পারলাম না।
নার্সকে চুপিচুপি ডেকে বললাম আমার একটা খবর জোগাড় করে দিতে।অনেক অনুনয় বিনয় এর পর নার্স রাজি হলো।অবশেষে নার্স এসে যখন জানালো হস্পিটালে নাফিস ফারহান নামের কোন পেশেন্ট আইসিউতে নেই তখন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।
তারমানে সবাই মিলে আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে!এবার আর কিছুতেই আমাকে শান্ত করতে পারলো না।পুরো হস্পিটাল জুড়ে শুধু আমার চিৎকার চেঁচামেচি।আমাকে কিছুতেই শান্ত করতে না পেরে শেষে মা চাপাকান্নার স্বরে বললেন, “নাফিস আর নেই তনু!”
মুহূর্তেই আমার পুরো পৃথিবীটা যেন থমকে গেলো।চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।আমার সমস্ত শরীর যেনো অসাড় হয়ে গেলো।মনে হচ্ছে মস্তিষ্ক বিকল হয়ে যাচ্ছে।আমি আবার জ্ঞান হারালাম।
হস্পিটাল থেকে আমাকে বাসায় নিয়ে আসা হলো।বাবা,ইমু,ভাইয়া,ইমতিয়াজ ভাইয়া সবাই কাজকর্ম ফেলে রেখে আমার সাথে পড়ে আছে।ইনায়াজ ভাই আমার জ্ঞান ফেরার দিনই বিদেশে চলে গেছে।উনার নাকি কি ট্রেনিং আছে।সবার একটাই চেষ্টা আমাকে স্বাভাবিক করতে হবে।
হ্যাঁ ওদের চেষ্টায় আমি অনেকটা স্বাভাবিক হতে পেরেছি।তখনও আমার পৃথিবীটা স্নেহ মায়া মমতা দিয়ে জড়ানো ছিলো।বাস্তবতার কিছুই দেখি নি।
আমি গলা থেকে নাফিসের দেওয়া চেইন,নাকের নাকফুল কানের দুল সব খুলে ফেলে একটা সাদা শাড়ি পরে নিলাম।আমার মাইন্ড রিফ্রেশের জন্য সবাই মিলে ট্যুরে যাওয়ার প্ল্যান করলো।বাবা ড্রয়িংরুমে বসে গলা ছেড়ে আমাকে ডাক দিলেন।
আমি যখন বেরোলাম আপু দৌঁড়ে এসে বললো, “পাগল হয়ে গেছিস নাকি?”
আমি ওর কথার জবাবে শুধু বললাম, “নাফিস মারা গেছে আপু!”
-“কতটুকু বয়স তোর?এইবয়সে এসব পাগলামি কেন করছিস?”
আমি আপুর কথা শুনে ডুঁকরে কেঁদে উঠে বললাম, “সব আমার জন্য হয়েছে আপু।আমি উনাকে চাই নি বলেই উনি অভিমানে আমার কাছ থেকে দূরে সরে গেছে।আমি উনার সাথে ছলনা করেছি।”
আপু আমাকে ধমক দিয়ে বললো, “তুই না এইযুগের মেয়ে?এসব কথা তোর মুখে মানায় না।দুর্ঘটনা যে কারো জীবনেই ঘটতে পারে,তাই বলে মানুষের জীবন কখনো থেমে থাকে না।আয় আমার সাথে এক্ষুনি শাড়িটা বদলাবি।”
আমি অনড়!আপু চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে অনুরোধের সুরে আমাকে বললো, “দোহাই তোর, আয় আমার সাথে।”
আমি দৃঢ়কন্ঠে বললাম, “না!”
এবার বাবা নিজে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে কান্নাভেজা গলায় বললেন, “মা আমার।বাবার কথা শুনবি না তুই?যা আপুর সাথে যা!শাড়িটা বদলে আয় বাবা! ”
কিন্তু আমি নড়লাম না।বাবা আমার হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় চেপে ধরে ডুঁকেরে কেঁদে উঠলেন।তারপর কাদঁতেই বললেন, “তোর চোখের পানি দেখার আগে কেন খোদা আমাকে তুলেন নিলেন না। চোখের সামনে আমার ছোট্ট আদরের মেয়ের এমন বেশ আমি দেখবো কি করে?বাবার কথা শোন মা শাড়িটা বদলে আয়।”
আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললাম, “বেশভূষা দিয়ে কি হবে বাবা!আমার জীবনটাই তো পুরো এলোমেলো হয়ে গেছে।”
বাবা আমাকে শক্ত করে তার বুকের ভেতর এমন ভাবে চেপে ধরলেন যেন সমস্ত কিছু থেকে আমাকে আড়াল করার এক অপরিসীম চেষ্টা করছেন। আমি বাবাকে জড়িয়ে ধরেই কেঁদেই চলেছি।
তবে এখানেই শেষ নয়।জীবনের আসল রূপ শুরু হলো নাফিসের মৃত্যুর পরে।যেই নির্মম অধ্যায়ের কথা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবি নি।
নাফিসের বাসায় আমার ঠাঁই হলো না।নিজের বাসায় আমি এখন চূড়ান্ত অবহেলিত।এইবার সবকূলই হারালাম আমি।
নাফিসের ডাইরীতে সবঘটনা লিখে গেছে নাফিস।সেখানে আমি একজনকে ভালোবাসতাম,বাধ্য হয়ে বিয়েটা করেছি এবং আমার ও নাফিসের মাঝে কোন শারীরিক সম্পর্ক তৈরী হয় নি এসবের উল্লেখ ছিলো।তাই আমার গর্ভের সন্তান অবৈধ বলে প্রমাণিত হলো। পরিবারের সবাই আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো।আমি লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে সত্যিটা বলে দিলাম।বারবার করে বললাম,এক্সিডেন্টের দিন রাতে নাফিস আমার সাথে জোরপূর্বক মিলিত হয়েছিলো।আমি সেদিন ওকে আটকানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলাম।কারণ ও মাতাল ছিলো।আমি চেয়েছিলাম একসাথে দুজনে নতুন করে শুরু করবো।কিন্তু তাকে আটকাতে পারি নি।মাতাল অবস্থায় সে স্বামী অধিকার প্রয়োগ করেছিলো।কিন্তু কেউ আমার কথা বিশ্বাস করে করে নি।মৃত নাফিসের ডাইরীই সবার কাছে সত্যি প্রমাণিত হলো।আমার শ্বাশুড়ি ননদ আত্মীয় স্বজন সবার কাছে ছড়ালো আমার গর্ভে অবৈধ সন্তান।এই সন্তান নাফিসের নয়!
তারপর শুরু হলো আমার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় অধ্যায়!বাস্তবতার আসল রূপ দেখলাম এতদিনে।হয়ত নাফিসের সাথে করা অন্যায়ের শাস্তি দিচ্ছেন খোদা আমাকে।আমার চরিত্রে সবাই মিলে ইচ্ছেমত কালিমা লেপন করলো।লজ্জা সইতে না পেরে বাবা হার্ট এটাক করলেন।হুইচেয়ারে চলাফেরা করেন।মায়ের চোখের বিষ হয়ে গেলাম।আপু ভাইয়া কেউ ঠিকমত কথা বলে না আমার সাথে।শুধুমাত্র ইমু ছাড়া!ও বারবার করে বলল ইনায়াজ ভাইয়ের কথা বাসার সবাইকে জানিয়ে দিতে,কিন্তু আমি না করলাম।
কার সাথে আমার সম্পর্ক সেটা জানার জন্য মা,আপু প্রথম প্রথম নরমে গরমে জোর চেষ্টা চালালেন।কিন্তু আমি কি বলবো?আদৌ কি কোন সম্পর্ক ছিলো? আমার নিরুত্তর মনোভাব দেখে তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে নিলেন আমার সন্তান অবৈধ!!আমার গলা ফাটানো চিৎকার,বারবার করে বলা ‘এই সন্তানের বাবা’ নাফিস তাদের কানে গেলো না।
রাতে খেতে বসে অসহায়ভাবে সবার দিকে তাকালাম।সবাই নিজের মত খাচ্ছে।কেউ আমাকে খেতে ডাকে নি।নিজেই এসেছি।কিন্তু টেবিলে কুমড়ো ভাজি,পটল আর করলাভাজি দেখে মায়ের দিকে তাকালাম।তিনটেই আমার সবচেয়ে অপছন্দের!যেদিন এসবের কোনটা রান্না করা হয় সেদিন মা আমার জন্য আলাদা করে কিছু না কিছু রান্না করতেন।কিন্তু আজকে কিছুই নেই।আমি চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছি।কেউ ফিরেও তাকালো না।অবশেষে নিজেই বসে গেলাম।কিন্তু খাবার গলা নিয়ে নামছে না।প্রেগন্যান্সির কারনে এমনতেই খাবারে রুচি নেই তারওপর এসব!
ইমু খাবার টেবিলে বসে আমার দিকে তাকালো।তারপর মাকে বলল,”ছোট আপুর জন্য কিছু রান্না করো নি?”
মায়ের কাঁটাকাঁটা জবাব,” না।”
ইমু রাগে টেবিল ছেড়ে উঠে গেলো।ওঠার সময় চেয়ারে সজোরে লাথি মেরে গেলো।কিন্তু আমি উঠলাম না।বেহায়ার মত বসে বসে করলাভাজি দিয়ে ভাত খেলাম।ভাতের সাথে চোখের পানিও গিলে গেলাম!
খাবার শেষে,নিজের ঘরে শুয়ে আছি।ইমু এসে পাশে বসে বলল,”আমি শুধু পাশ করে নেই আপু।তোমাকে আমি এখান থেকে নিয়ে যাবো।”
ইমুর চোখের পানি টুপটুপ করে আমার কপালে গড়িয়ে পড়লো।ওকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলাম।এত অবহেলা সহ্য করার চেয়ে সেদিন নাফিসের জায়গায় আমি মরে গেলেই বোধহয় ভালো হতো!!আমার এই ভাইটা না থাকলে বোধহয় মরে যেতাম আমি।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে ইমু বলল,
-“বাবা তোমাকে ডাকছে আপু।যেতে পারবে?”
আমার শরীরে শক্তি নেই।তবুও এতদিন পর বাবা ডাকছে শুনে নিজেকে জোরপূর্বক টেনে তুললাম।ইমুও আমাকে ধরে ধরে বাবার ঘরে নিয়ে গেলো।বাবা বিছানায় শুয়ে আছেন।মা তার পাশে শুয়ে ছিলেন।আমাকে দেখে উঠে বসলেন।আমি বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।কিন্তু আগের মত ‘আয় কাছে আয়’ বলে বাবা ডাকলো না।বাবার নিজেই অচল আমাকে কি দেখবে? শুধু জিজ্ঞেস করলেন,”খেয়েছিস?”
খাওয়ার কথা শুনে বুক চেপে কান্না এলো।যেই আমি ঠিকমত খেতাম না বলে সবার অভিযোগ ছিলো,মা আপু খাবার নিয়ে পেছন পেছন ছুটতো সেই আমি দিনের পর দিন না খেয়ে থাকলেও কেউ খোঁজ করে না।খাবারের জন্য অস্থির লাগে,অথচ কেউ এখন খাবার সাধে না।কুকুর বেড়ালের মত খেতে বসি।।চোখের পানি আটকে ঢোক গিলে বললাম,”হুম!”
-“শরীর ঠিক আছে?”
-“আছে।”
মা তিরিক্ষি মেজাজে বললেন,”তোমার এসব নাটক রাখো!আমি কথা বলবো ওর সাথে।” বাবা চুপ করে গেলেন।আসামীর পক্ষে কথা বলার জন্য জোরালো কোন যুক্তি নেই উনার কাছে।ইমু রাগে ফেটে যাচ্ছে।মায়ের এমন নিষ্ঠুর আচরণ সহ্য হচ্ছে না ওর।এই শরীর নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছি।
মা গম্ভীর গলায় সেই একই প্রশ্ন করলেন,
-“সত্যি করে বল বাচ্চাটা কার?”
-“নাফিসের।”
-“তাহলে তোর সাথে কার সম্পর্কে ছিলো?”
-“কারো সাথে সম্পর্ক ছিলো না।আমি একজনকে ভালোবাসতাম।”
-“সে বাসতো না?”
আমি দুদিকে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালাম।
-“না বাসলে এই কুকীর্তি ঘটালি কি করে?
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা।মা ধমক দিয়ে বললেন,
-“কে সে?”
আমি চুপ করে রইলাম।ইমু জবাব দিতে চাইলো কিন্তু আমি হাত চেপে আটকালাম।কি হবে বলে?শুধু শুধু ঝামেলা বাড়বে।মায়ের চেহারা ইতিমধ্যে কালো হয়ে গেছে।
আরো কয়েকবার জিজ্ঞেস করলেন কিন্তু কিছুতেই আমার মুখ দিয়ে তার নাম বের করতে পারলেন না।রাগে ঠাস করে আমার গালে কয়েক চড় বসিয়ে দিলেন।থামলো না!মায়ের অনবরত থাপ্পড়ের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ইমু আমাকে টেনে বের করে নিয়ে গেলো।বাবার চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।ডুঁকরে উঠে বললেন,”এভাবে তিল তিল করে না মেরে একবারে মেরে ফেলো!মরে যাক!সবার শান্তি হোক!
থাপ্পড় খেয়ে যতটা না কষ্ট হয়েছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে শুধু এই ভেবে যে আমার সেই মমতাময়ী মা আর নেই!প্রায় ধাক্কা মেরে আমাকে বের করে দিলেন।ইমুর চেহারা আমার চেয়েও বেশি অসহায়!না পারছে সইতে না পারছে কিছু করতে।
বিসিএস এর রেজাল্ট বেরোলো,আমার হয় নি।প্রতিদিন চাকরীর খোঁজে বের হই।কিন্তু প্রতিবারই ইন্টার্ভিউ দিয়ে এসে হতাশ হই।আজকের বাজারে চাকরী পাওয়াটা তো মায়ের হাতের মোয়া না,যে চাইলেই পেয়ে যাবো।অবশ্য আমার জন্য মায়ের হাতের মোয়াও এখন দুর্লভ বস্তু!
যেখানে ব্রিলিয়ান্ট ব্রিলিয়ান্ট ছাত্ররা সার্টিফিকেট হাতে নিয়ে চাকরী জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে সেখানে আমার মত একজন এভারেজ টাইপ স্টুডেন্ট এর কাছে চাকরী আর সোনার হরিণ দুটোই একই।মামা চাচার জোরও নেই।থাকলেও এইমুহূর্তে কেউ আমার পরিচয় দেবে না।পরিবার পরিজন আত্মীয় স্বজন সবার কাছে পরিত্যক্তা আমি।
রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম আর ভাবছিলাম নাফিস থাকলে বোধহয় এমনটা হতো না।তার ঔরষজাত সন্তানকে নিশ্চই সে ফেলে দিতো না।আমাকে তো সে ভালোবাসতো।আমার এত কষ্ট নিশ্চই ওর সহ্য হতো না? সে আমাকে কি শাস্তি দিয়ে গেলো?জোর করে আমার ওপর অধিকার খাটালো।আমি যখন সবটা মেনে নিয়ে নতুন করে শুরু করতে চাইলাম তখন সে আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেলো।একবারও ভাবলো না আমার কি হবে? যাবেই যখন কেন আমাকে এই ছোট্টপ্রানটার সাথে বেধে দিয়ে গেলো।সে তো আমাকে ওয়াদা করেছিলো আমার অনুমতি ছাড়া আমার কাছে স্বামীর অধিকার দাবী করবে না?তবে কেন এমনটা হলো? এই ছোটপ্রানটা না থাকলে আরো আগেই সবাইকে মুক্ত করে দিতাম।আমার অন্যায়ের শাস্তি এই নির্দোষ প্রানটা কেন পাচ্ছে?
এসব ভাবছি আর হাঁটছি।আমার চোখের পানি টুপটুপ করে পড়ছে।প্রচন্ড রোদে মাথা ঝিমঝিম করছে।রিক্সাভাড়ার টাকা পর্যন্ত নেই।একটা চাকরী হলে নিজের আর সন্তানের জন্য একটা ভরসা হতো।কিন্তু সেই আশাও দিনদিন ম্লান হয়ে যাচ্ছে।