#মনের_মানুষ
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী
#ষষ্ঠ_পর্ব
— ‘অ্যাই মেয়ে,কোন স্বপ্নের জগতে হারিয়ে গেছিস বল্ দেখি!’ সুমিত্রার ডাকে সম্বিৎ ফেরে অস্মিতার।সুমিত্রা হেসে বললেন,’বাব্বা,নিজেই নিজেকে দেখে যদি এভাবে মুগ্ধ হোস,না জানি তোর বরের কি দশা হবে তোকে এভাবে দেখলে!যাক গে ছাড়,এখন তোর বাবার কাছে যাবি চল,মানুষটা বড়ো খুশি হবেন তুই এই হারটা পরে আছিস দেখলে।’
সুমিত্রা ভাবলেশহীন অস্মিতার হাত ধরে নিয়ে গেলেন প্রতীকবাবুর ঘরে।
কেটে গেছে চার মাস।প্রতীকবাবু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন এক মাস হল।অস্মিতা অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছে সুমিত্রাকে হেমন্ত আর স্বরলিপির সম্পর্কটা মেনে নিতে।সুমিত্রা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছেন ঠিকই,তবে তিনি বলেছেন, ‘বেশ,তুই,হেমু,তোরা অ্যাডাল্ট,তোদের সিদ্ধান্তে আমি বাধা দেব না,কিন্তু আমারও একটা শর্ত আছে অস্মি।’
— ‘কি শর্ত আন্টি?’
— ‘হেমু যাকেই বিয়ে করে আনুক,তুই এই বাড়ি ছেড়ে কোত্থাও যাচ্ছিস না,ব্যস!তোকে আমি কোনোদিন হেমুর চেয়ে আলাদা করে দেখিনি,তোকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
— ‘বেশ,তাই হবে আন্টি!’ ভাবলেশহীন মুখে সায় দিয়েছিল অস্মিতা।
কেটে গেল আরও দু’মাস।হেমন্ত আর অস্মিতার ডিভোর্স হয়ে গেছে,অস্মিতা আজ সকলের সামনে সিঁদুর পরে ঘুরে বেড়ায় না ঠিকই,তবু সিঁথিতে এক চিলতে সিঁদুর সে লাগায় সকলের অলক্ষ্যে,সিঁথি পালটে চুল আঁচড়ায় বলে কেউ দেখতে পায় না সে সিঁদুর।শাঁখা-পলাও সে আলমারিতে তুলে রেখেছে পরম যত্নে।
অন্যদিকে হেমন্ত আর স্বরলিপির বিয়ের মাত্র আর তিন মাস বাকি,তাই দুই বাড়িতেই লেগেছে কেনাকাটার হিড়িক।এদিকে অস্মিতার দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা এগিয়ে এল,যে কলেজে সিট পড়ল তার,সেই কলেজটা হেমন্তর অফিস যাওয়ার রাস্তাতেই পড়ে,তাই সুমিত্রা হেমন্তকে অফিস যাওয়ার পথে অস্মিতাকে পৌঁছে দিতে বললেন।
অন্যদিকে হেমন্তর এক ক্লাসমেট প্রাঞ্জল,কলেজ জীবন থেকেই ভালোবাসে স্বরলিপিকে,স্বরলিপির কাছে পাত্তা না পেয়ে বরাবরই হেমন্তর ওপর আক্রোশ ছিল তার,যদিও হেমন্তর কোনো ক্ষতি করার সাহস বা ক্ষমতা কোনোটাই ছিল না তার কলেজ জীবনে।কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পরেও স্বরলিপির প্রতি একইরকম আকর্ষণ ছিল তার,ছিল তাকে পাওয়ার অদম্য ইচ্ছা।অস্মিতার সাথে হেমন্তর বিয়ের খবর শুনে হেমন্তর প্রতি আক্রোশে অনেকটাই ভাঁটা পড়েছিল তার,কিন্তু অস্মিতার সাথে তার ডিভোর্স আর স্বরলিপির সাথে বিয়ে ঠিক হওয়ার খবর শুনে পুরোনো রাগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে আবার তার।
প্রাঞ্জল তাই কিছু গুন্ডা ভাড়া করেছে হেমন্তকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার জন্য।ওর ভাড়া করা লোকেরা হেমন্তকে ফলো করে,সুযোগের অপেক্ষায় আছে ওরা।ওকে শেষ করে দেওয়ার উপযুক্ত দিন হিসেবে আজকের দিনটাই বেছেছে ওরা।
হেমন্ত আর অস্মিতা একটা ক্যাব বুক করল।গাড়িতে উঠে বসতেই হেমন্তর মোবাইলে স্বরলিপির মেসেজ ঢুকল, ‘আমি আসছি হেমন্ত।’
আসলে আজ হেমন্তর অফিসে কাজ তেমন নেই,আর স্বরলিপিও ফ্রি আছে,তাই দুজনে ঠিক করেছে,যে কলেজে সিট পড়েছে অস্মিতার,সেই কলেজে অস্মিতাকে নামিয়ে দিয়েই স্বরলিপিকে ক্যাবে তুলে নেবে হেমন্ত,তারপর অফিসের কাছাকাছি কোথাও একটা ঘুরে আসবে দুজনে,তারপর স্বরলিপিকে বাড়ি ফেরার বাসে তুলে দিয়ে অফিসে যাবে বেলার দিকে।
হেমন্ত রিপ্লাই করল,’এসো লিপি,আমি তোমার জন্য ওয়েট করব।’
এসে গেল সেই নির্ধারিত কলেজ।অস্মিতা আর হেমন্ত নামল গাড়ি থেকে।স্বরলিপি ওদের আগেই পৌঁছে গিয়েছিল কলেজের সামনে।
অস্মিতা কলেজে ঢোকার আগে বলল, ‘হেমন্তদা,আসি।’
— ‘বেস্ট অফ লাক অস্মি।’
— ‘থ্যাঙ্ক ইউ হেমন্তদা।আর ফেরার সময় তোমায় আসতে হবে না,আমি নিজেই চলে যেতে পারব।’
— ‘কিন্তু অস্মি,মা যে বলল….’
— ‘আন্টির কথা ছাড়ো তো!’ স্মিত হেসে অস্মিতা বলল, ‘আন্টি ভাবে আমি আজও সেদিনের অস্মি ই আছি, মাঝে মাঝে ভুলে যায় যে আমি অ্যাডাল্ট,কলেজে পড়ি!’
— ‘কিন্তু অস্মি এখানে তুমি আগে কখনো আসোনি,তাই বলছিলাম…..’
— ‘উফ হেমন্ত!’ বিরক্তির সুরে বলে ওঠে বলে ওঠে স্বরলিপি, ‘ও তো বলছে যে ও একা যেতে পারবে!শি ইজ অ্যাডাল্ট নাও,তাছাড়া সারাটাজীবন ওকে একাই চলতে হবে,তুমি সবসময় থাকবে না ওকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য!আর তাছাড়া ও যে আগে কখনো এখানে আসেনি তাই বা জানলে কি করে তুমি?হতেও তো পারে হয়ত স্পেশাল কারোর সাথে…..’
— ‘ঠিকই তো,স্বরলিপি তো ঠিকই বলেছে হেমন্তদা।জীবনের বাকি বিস্তীর্ণ রাস্তাটা যখন একা একাই চলব আমি,এটুকু রাস্তা না হয় একা চলতে দিলে!’
স্বরলিপি একেবারেই পছন্দ করে না অস্মিতাকে।হেমন্তর সাথে অস্মিতা কথাটুকু বলুক এটাও খুব অপছন্দের স্বরলিপির।হেমন্তকে ও মাঝেমধ্যেই বলে,’ওর নাম অস্মিতা,পুরো নাম ধরে ডাকলেই তো হয়!অস্মি অস্মি করে ডাকার কি আছে!’
— ‘লিপি তুমি প্লিজ রাগ কোরো না।বাবা ওকে ভালোবেসে অস্মি বলে ডাকতেন,মা ও অস্মি বলেই ওকে ডাকেন,তাই আমিও ওকে ওই নামে ডাকতেই অভ্যস্ত।এতদিনের অভ্যেস কিভাবে পাল্টাই বলো তো?’
— ‘বেশ সে না হয় বুঝলাম,কিন্তু ওকে নিয়ে সবসময় এত বাড়াবাড়ি করারই বা কি আছে?তুমি আর তোমার মা এমন ভাব করো যেন ও কোলের শিশু!’
— ‘লিপি তুমি প্লিজ এভাবে বোলো না।শি ইজ মাই রেসপনসেবলিটি,বাবা মৃত্যুশয্যায় ওর সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমার হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন,আর তাছাড়া মেয়েটা সারাজীবনে শুধু অপমান আর কষ্ট ছাড়া আর কি পেয়েছে বলো তো?এখন যদি আমিও ওর প্রতি মিনিমান দায়িত্বটুকু পালন করা থেকে সরে আসি,সেটা কি ভালো দেখায় লিপি?’
ক্যাবটা যেখানে পার্কিং করা হয়েছিল,সেখান থেকে কলেজের গেটটা বেশ খানিকটা দূরে।অস্মিতা হেঁটে আসছিল গেটের দিকে,হঠাৎই একটা গোলমালের শব্দে ও ঘুরে দেখে,কিছু গুন্ডা টাইপের লোক এগিয়ে আসছে হেমন্তর দিকে,তাদের হাতে বন্দুক-পিস্তল রয়েছে।অস্মিতা তাড়াতাড়ি ছুটল হেমন্তর দিকে।হঠাৎই গুন্ডাগুলোর মধ্যে একজন বলে উঠল,ওই তো মালটা দাঁড়িয়ে আছে ওখানে,মার,মার শালাকে!
(ক্রমশ)
(সপ্তম পর্ব আসবে আগামীকাল এই পেজে)