#মনের_মানুষ
#প্রথম_পর্ব
#সুচন্দ্রা_চক্রবর্তী

চোখের জল মুছে ক্ষীণকন্ঠে অস্মিতা বলল,’দীনেশ দা,দিদিভাই,একটু জল দেবে কেউ?বড্ড গলাটা শুকিয়ে গেছে,আর পারছি না!’
উর্মিলা আশেপাশেই কোথাও ছিল,দরজাটা গায়ের জোরে খুলেই ঘরের মেঝেতে এক গ্লাস জল রেখে দিয়ে গেল,তারপর রুক্ষভাবে বলল,’নিন মহারাণী,খেয়ে ধন্য করুন আমাদের!না খেয়েদেয়ে মরলে তো আবার আমাদের কোমরে দড়ি পড়বে!’
অস্মিতা পড়ে ক্লাস টেনে।গতবছর বাবা গত হয়েছেন ওর,আর মাকে তো ও হারিয়েছে অনেক ছোটবেলাতেই।অস্মিতার বাবা রজনীকান্তবাবুর বড়ো মেয়ে উর্মিলার যখন নয়-দশ বছর বয়স,তখনই রজনীকান্তবাবুর স্ত্রী গত হন মারণরোগে।মাতৃশোক যাতে স্পর্শ না করে মেয়েকে,তাই রজনীকান্তবাবু দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সীমন্তিনীদেবীকে।সীমন্তিনীদেবী যেন সংসারকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন আবার,উর্মিলাকে বুকে আগলে রাখতেন তিনি আপন সন্তানের মতোই,কিন্তু উর্মিলা কোনোদিনই সীমন্তিনীদেবীকে পছন্দ করত না,মায়ের স্থান দেওয়া তো দূরের কথা।সীমন্তিনীদেবী তার এই ব্যবহারে কষ্ট পেলেও কোনোদিনও অভিযোগ করেননি রজনীকান্ত বাবুর কাছে,বরং রজনীকান্তবাবু মেয়েকে বকাবকি করলে সীমন্তিনীদেবী বলতেন,’আহা রে,অতটুকু মেয়ে মা কে হারিয়েছে,তার জায়গায় অন্য কাউকে সে মেনে নিতে পারে কখনো?ওর জায়গায় আমি থাকলেও তো এমনই করতুম।’
এই ঘটনার বছর চারেক পর সীমন্তিনী দেবীর কোল আলো করে জন্ম নিল অস্মিতা।সীমন্তিনী দেবী বললেন,’আজ থেকে আমার দুটো মেয়ে দুই চোখের মণি।’
কিন্তু উর্মিলা সীমন্তিনী দেবীর সাথে শিশু অস্মিতাকেও দু চক্ষে দেখতে পারত না,মা-মেয়েকে বাড়ির বোঝা বলে মনে হত তার।সীমন্তিনী দেবীও তিনবছরের অস্মিতাকে রেখে চলে গেলেন পরপারে,দুই মেয়েকে রজনীকান্তবাবু মানুষ করতে লাগলেন একা হাতে,তবে সীমন্তিনী দেবীর মৃত্যুটা তিনি সহ্য করতে পারলেন না,দ্বিতীয় চরম শোকটা তাঁকে শেষ করে দিল ভেতর থেকে,আর বাধিয়ে ফেললেন হার্টের অসুখ।চোদ্দো বছরের অস্মিতাকে রেখে তিনিও চলে গেলেন তাঁর দুই স্ত্রীর কাছে।উর্মিলার ততদিনে বিয়ে হয়ে গেছে দীনেশ বর্মনের সাথে,মৃত্যুসজ্জায় রজনীকান্তবাবু নাবালিকা অস্মিতার সব দায়িত্ব সঁপে গেলেন উর্মিলার হাতে।উর্মিলা বাবাকে বড়ো ভালোবাসে,তাই দীনেশের আপত্তি থাকা সত্ত্বেও সে বোনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে এল।তিন-চার মাস কেটে গেল নির্বিঘ্নেই,কিন্তু সমস্যা হল যখন অস্মিতা ক্লাস নাইন পাশ করে টেনে উঠল।দীনেশের একেবারেই অস্মিতার তাদের বাড়িতে থাকাটা পছন্দ ছিল না,সেই নিয়ে উর্মিলার সাথে ঝামেলাও বাধত তার মাঝে মাঝেই।উর্মিলা বলত,’দেখো আমিও ওকে আমার বোন বলে মনে করিনি কোনোদিনই,কিন্তু হাজার হোক একটা স্কুলে পড়া মেয়ে,সে কার কাছে যাবে বলো?আর বাবাকে আমি কথা দিয়েছিলাম যে ওকে দেখে রাখব আমি!’
কিন্তু এসব কথা দীনেশকে যে বিশেষ খুশি করত না,তা বিলক্ষণ জানত উর্মিলা,আর দাম্পত্য কলহের রাগটা গিয়ে পড়ত অসহায় অস্মিতার ওপর।উঠতে বসতে খাওয়ার খোঁটা,পড়ার খরচের খোঁটা এসব সহ্য করা যেন নিত্যদিনের অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল অস্মিতার,কিন্তু তবু সে প্রতিবাদ করত না,চোখের জলটুকু গিলে নিয়ে সে পড়তে বসত।
দীনেশ যে অফিসে চাকরি করে,সেই অফিসের বসের স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তাঁর হঠাৎ ইচ্ছে হয়,তিনি আবার বিয়ে করবেন।দীনেশের বাড়িতে তিনি একবার এসেছিলেন,আর অস্মিতাকে দেখেওছিলেন।তাঁর ইচ্ছে হল অস্মিতাকে বিয়ে করবেন তিনি,সেই মতো দীনেশকে একদিন সবটা জানালেন তিনি।
দীনেশ কথাটা শুনে আকাশ থেকে পড়ল।চল্লিশ বছরের পাত্র আর পনেরো বছরের পাত্রী?দীনেশ বলেছিল,’কিন্তু স্যার,আমার শ্যালিকাটি যে সাবালিকা হয়নি এখনো!’
— ‘আহ,এখন পবিত্র আছে,গার্লস স্কুলে পড়ে,কচি মাংস,কোনো কালি টালি লাগেনি গায়ে,কলেজে গেলেই আবার না জানি!বুঝতেই পারছ তো দীনেশ কি বলতে চাইছি আমি!মানে যা দিনকাল পড়েছে,রাস্তাঘাটে ওপেনলি যেভাবে বেলেল্লাপনা চলে দেখেছ তো!আর তাছাড়া ও যতদূর পড়তে চায়,পড়াব আমি।’
দীনেশের বস অরবিন্দ ধর লোকটির চরিত্র আর দৃষ্টি অফিসে কারোরই অজানা নয়।অনেক মেয়ে এই অফিস ছেড়ে চলে গেছে ওঁর কুদৃষ্টির কারণে,আবার কিছু মেয়ে তাঁর ওই চরিত্রকেই কাজে লাগিয়ে ওপরে উঠেছে তরতরিয়ে।
অরবিন্দ অস্মিতাকে বিয়ে করার জন্য কন্যাপণ হিসেবে মোটা টাকার চেক ধরিয়ে দিলেন দীনেশের হাতে,আর সেই সাথে প্রোমোশনও হয়ে গেল দীনেশের।মহাখুশি হয়ে দীনেশ বিয়েতে হ্যাঁ বলে দিল।
উর্মিলা প্রথমে এই বিয়েটা মনে মনে ঠিক মানতে পারেনি,কিন্তু দীনেশই তাকে বোঝাল,যে বাপ-মা মরা অনাথ অস্মিতাকে ভালো কোনো পাত্র বিয়ে করবে না,আর অরবিন্দবাবুর অর্থের কোনো অভাব নেই,অস্মিতা দিব্যি থাকবে বিয়ের পর।তাছাড়া অস্মিতার পড়ার খরচ,খাইখরচ যেভাবে বাড়ছে তাতে দীনেশের ওপর যথেষ্ট প্রেসার পড়ে যাচ্ছে।স্বার্থপর উর্মিলা এসব শুনে আর মোটা টাকা পেয়ে হাসতে হাসতে রাজি হয়ে গেল বিয়েতে।
অস্মিতা এই বিয়ের খবর পেয়েই কেঁদে পড়ল দিদি-জামাইবাবুর পায়ে,কাতরকন্ঠে বলল,’আমি বিয়ে করতে চাই না!’
কিন্তু ওর কথা শোনার কেউ প্রয়োজনবোধই করল না,উলটে উর্মিলা ওর গালে চড় মেরে টানতে টানতে ঘরে নিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল,বলল,’থাক শয়তান মেয়ে এখানে বন্ধ হয়ে!কাল থেকে তোর স্কুল,টিউশন সব বন্ধ!হাড়মাস জ্বালিয়ে খেল মুখপুড়ি!’ বলেই দুমদাম শব্দ করে হেঁটে চলে গেল উর্মিলা।
এই ঘরে একটা ল্যান্ডফোন ছিল,দিদি-জামাইবাবু সবাই যখন রাতদুপুরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে,তখন অস্মিতা খুব সাবধানে ফোনটা থেকে ফোন করল প্রতীক স্যারকে।প্রতীক স্যার অস্মিতাকে বড্ড স্নেহ করেন তার মিষ্টি আর শান্ত স্বভাবের জন্য।আগের দিন ক্লাসেই স্যার বলছিলেন,’আমাদের দেশে আঠারো বছরে মেয়েরা আর একুশ বছরে ছেলেরা সাবালক হয়।নাবালকদের বিয়ে দেওয়া আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।’ আর এই অপরাধই করছে ওর দিদি-জামাইবাবু।
কিন্তু ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল,কেউ রিসিভ করল না ফোনটা।তখন ও স্কুলের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী ত্রিয়াকে ফোন করল।ত্রিয়া ফোনটা ধরে ঘুম জড়ানো গলায় বলল,’আজ স্কুল এলি না কেন?প্রতীক স্যার জিজ্ঞেস করছিলেন তোর কথা।’
অস্মিতার মনে ভীষণ ভয় কাজ করছিল,নার্ভাস গলায় কোনোরকমে ও বলল,’কাল আমার বিয়ে ত্রিয়া,প্লিজ কিছু একটা কর!’
ত্রিয়া চমকে উঠে বলল, ‘মানে?কি বলছিস টা কি!’
হঠাৎই অস্মিতা পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল,মনে হল কে যেন এদিকেই আসছে!তাড়াতাড়ি ফোনটা রেখে দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল ও চোখ বুজে।
(ক্রমশ)
(দ্বিতীয় পর্ব আসবে আগামীকাল এই পেজে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here