গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani Simu
পর্ব:-০৮

চোখ খুলে দেখি দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে তাই রুমের মধ্যে অন্ধকার অন্ধকার ভাব।উঠে বসার চেষ্টা করতেই খেয়াল করলাম হাতে স্যালাইন লাগানো।ডানহাতটা নড়াতেই পারছিনা।এমনিতেই কাটা ছিল তারউপর দেখছি কব্জির কাছে ফুলে উঠেছে।ব্যথা করছে অনেক।শুয়ে থাকতে একটুও ইচ্ছে করছেনা তাই অনেক কষ্টে উঠে বসলাম।দরজার দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে কয়েকবার উমান ভাইয়াকে ডাকলাম।কোনো সাড়াশব্দ নেই।কিছুক্ষণ থমথমে মুখ করে বসে থেকেই কান্না করতে লাগলাম।কিছু ভাল লাগছেনা।বাবা-মা কোথায় আছে,কি হচ্ছে এসব আমাদের সাথে কিছুই বুঝতে পারছিনা।মিনির সাথেও তিনদিন ধরে কথা নেই।ছোট বোনটা উমান ভাইয়াদের বাসায় অতগুলো অপরিচিত মানুষের সাথে একা আছে।খুব কাঁদছে হয়তো।এসব ভেবে নিজেকে খুব অসহায় লাগছে।

চোখ মুছে হাত থেকে স্যালাইন খুলবো তখনই উমান ভাইয়া রুমে আসলেন।উনার হাতে একবক্স চকলেট।উনি মুখ মলিন করে আমার পাশে এসে বসে আমার হাতে চকলেটের বক্স দিয়ে বললেন,

‘রাতে কি খাবি?’

আমি নাক টেনে বললাম,

‘বাবা কথা বলেছিল তখন।’

উনি ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে।আমি উনাকে সব খুলে বললাম।উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার কাছে আর একটু এগিয়ে এসে আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

‘তুই এত চাপ কেন নিচ্ছিস বলতো?কেন বুঝতে পারছিস না।’

আমি রেগে চেঁচিয়ে বললাম,

‘বুঝিয়ে বলছেন না কেন?না বললে বুঝবো কি করে?’

উনি একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।হঠাৎ এভাবে জড়িয়ে ধরায় আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছি।উনি আমার কাঁধে থুতনি রেখে বিরবির করে বললেন,

‘বলতে হবে কেন?তোর অনুভূতি নেই?কি করে থাকবে, তুই তো ভালোবাসতে শিখিসনি।একটা কথা জানিস?দ্যা মোর বিলিভ,দ্যা মোর লাভ।একটু বিলিভ করে দ্যাখ সব বুঝতে পারবি।ভালোবাসায় জীবন ভরে যাবে।’

আমি উনার কথা কিছুই বুঝতে পারলাম না।উনার পিঠে হাত রেখে ভ্রু কুচকে বললাম,

‘আমি কিছু বুঝতে পারছিনা উম ভাইয়া।বাবা মারা যায়নি আমি জানি,আমাকে সব খুলে বলছেননা কেন?’

উনি আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানে কানে বললেন,

‘তোর পেটে তো কথা থাকেনা।এসব বললে নিশ্চয় বাইরে গিয়ে ঢোল পিটিয়ে সবাইকে জানাবি।সবার আগে ব্যালকনিতে যেয়ে বলবি শান্ত ভাইয়া জানো?আমার বাবা বেঁচে আছে।তুই তো কথাটা বলে হালকা হবি আর আমরা ফেসে যাব।’

আমি চেঁচিয়ে বললাম,

‘উফ্ বলুন না,কাউকে বলবোনা।’

উনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে ভ্রু কুচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘সত্যি তো?প্রমিস?’

আমি কৌতূহলি হয়ে বললাম,

‘হুম হুম প্রমিস বলুন তাড়াতাড়ি।’

উনি আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরলেন।সূচ ফুটানো হাতটা উনার বুকের উপর নিয়ে বললেন,

‘বেশি প্যাচের কথা আমার ভাল লাগেনা।সোজাভাবে বলছি ওকে?’

আমি আগ্রহী হয়ে বললাম,
‘ওকে।’

উনি মুচকি হেসে আমার হাত বুকে চেপে ধরে বললেন,

‘আমি তোকে ভালোবাসি।বুঝেছিস?’

আমার গাল লাল হয়ে গেল।এই লোক বলে কি!আমি একটু নড়ে চড়ে উঠতেই উনি আমার নাক টেনে মুচকি হেসে বললেন,

‘আমার লাইফে একটাই মোটিভ।তোকে ভালোবাসা।বাট আমি তো বেশিদিন বাঁচবোনা।এখন আছি কয়েকমিনিট পর নাও থাকতে পারি।’

ভেতরে ধক করে উঠলো।মুখ কালো করে কিছু বলব উনি দুই আঙুল দিয়ে আমার ঠোঁট চেপে ধরে বললেন,

‘চুপ থাক।আমি আগে গল্পটা সাজিয়ে বলি।তুই এখন কথা বললে সব উল্টা পাল্টা হয়ে যাবে।’

আমি ভ্রু কুচকে উনার দিকে তাকিয়ে আছি।উনি আমার বাম হাত টেনে নিয়ে নিজের মাথায় রেখে বললেন,

‘কানাডা থাকতে আমি,সাদ আর শিপন ল্যাবে প্রাকটিস করতে করতে একেবারে ফালতু একটা গমের বীজ আবিষ্কার করলাম।ফর্মুলা টুকে নেওয়া হয়নি।তিনজনার কারোই তেমনভাবে মনে ছিলনা।ব্যস পাঠিয়ে দিলাম চাচ্চুর কাছে।চাচ্চু দেড় বছর পরিশ্রম করে বের করলো আরো উন্নত বীজ।আমরা তো চাচ্চুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।ঢোল পিটিয়ে সবাইকে বলে দিলাম।শত্রুরা জেনে গেল।ওরা দেশে এসে চাচ্চুকে খুঁজতে লাগলো।পড়াশুনা শেষ করে আমরাও চলে আসলাম।চাচ্চুর সাথে মিটিং করে গমের বীজ গুলো এক কোটি টাকা দিয়ে আফ্রিকানদের কাছে বেচে দিলাম।ওরা হাভাতা মানুষ,সারাবছর অভাব অনটনে থাকে তাই ওরাই নিল।কথা হল গম তো শীতকালীন ফসল তাহলে ওরা মরুভূমিতে কিভাবে চাস করবে?বল?’

আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,

‘তাই তো।ওরা ওটা কেন নিল?আফ্রিকাতে তো মরুভূমি আর গরম।ওখানে গম চাষ কিভাবে হবে?’

উমান ভাইয়া আমার নাক টেনে আমার মাথা নিচে নিয়ে এসে শব্দ করে আমার গালে কিস করলেন।তারপর আমার নাক ছেড়ে দিয়ে হুহা করে হেসে বললেন,

‘মরুভূমিতে রাতের বেলা অনেক শীত পরে।একদম হার কাঁপানো।দিনে গ্রীন হাউজের ব্যবস্থা করলেই হয়ে যাবে।’

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

‘কাচের ঘর বানাতে হবে?’

উমান ভাইয়া চোখবন্ধ করে বললেন,

‘সেটা ওদের ব্যাপার।আগে আমার কথা শোন।আমরা ওটা বিক্রি করে দিয়েছি কারন বড় একটা এনিমি হয়ে গিয়েছে।বিক্রি করে দেওয়ার পর ছয়মাস খুব ভাল গিয়েছে।তারপর হঠাৎ একদিন আমেরিকান কিছু লোক আসলো।ওদের দেশে ওটার চাষ আরো ভাল হবে।ওরা এসে ঝামেলা করতে লাগলো।চাচ্চু ইচ্ছে করলে নতুন বীজ ওদের দিতে পারবে কিন্তু এটা করলে আফ্রিকানরা এসে আবার ঝামেলা করবে।ওরা তো বিজনেসের জন্য এত টাকা দিয়ে ওটা নিয়েছে।আমেরিকানরা আমাদের ধুয়ে দিয়েছে একদম তারপর আফ্রিকানদের সাথেও লেগেছে।এরমধ্যে আমি আবার ব্লান্ডার করে বসে আছি।মানে নকল বীজগুলো বিক্রি করে আসল গুলো তোদের বাসার ছাদে রোপণ করেছি।সফল হলে বাংলাদেশ হবে।জয় বাংলা।ওই বেটা আফ্রিকানটাকে ঠকাতাম না বাট ওতো আমেরিকানদের সাথে হাত মিলিয়ে চাচ্চুকে আর আমাদের সবাইকে মেরে ফেলার প্ল্যান করেছে যাতে আর কেউ কোনদিন ওই বীজ তৈরী করতে না পারে।ওরা চায় সবাই জানুক এটা ওদের আবিষ্কার।ওদের চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে আমরা পরে গিয়েছি উভয় সংকটে।জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ।আমাদের উপর যে কতবার এ্যাটাক হয়েছে তার কোন হিসেব নেই।তুই যেদিন লাস্ট স্কুলে গিয়েছিস সেদিন তোদের স্কুলের বাইরে ঝামেলা হয়েছিল।তুই তো কিছুই জানিস না।তোকে বাঁচাতে গিয়ে সাদ ফেসে গেল।মেরে দিল ওরা ওকে।’

উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘সাদ ইমরুল আঙ্কেলের ছেলে ছিল।ইমরুল আঙ্কেল কে জানিস?’

আমি মাথা নাড়ালাম।উনি সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘আমাদের একমাত্র ফুফা।শিপন,সাদ আর প্রীতি তিন ভাইবোন আর রাজশাহীতে যেই ফুফা আছে ওটা কেউনা।ওটাকে কেউ চিনেও না।কেউ কখনও দেখেওনি।’

আমি চিন্তিত হয়ে বললাম,

‘তাহলে রাতে ওই লোকটা কে এসেছিল?’

উমান ভাইয়া মুচকি হেসে বললেন,

‘সাদের ভূত।ওরা আমার সোনা বন্ধুটাকে ভূত বানিয়ে দিয়েছে।’

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

‘আমি এখনও কিছু বুঝতে পারছিনা।মানুষ মারা গেলে ভূত হয়?সাদ ভাইয়া আমাকে এভাবে মারতে পারলো?সাদ ভাইয়া সত্যি মারা গেছে?’

উমান ভাইয়া উঠে বসলেন রহস্য হেসে বললেন,

‘চাচ্চুর মারা যাওয়া আর সাদের বেঁচে থাকা ওরা খুব সিরিয়াসলি নিয়েছে।সত্যিটা তো ভিন্ন।যাইহোক সব ক্লিয়ার করে বলেছি।আর কোন চাপ নিবিনা।এখন রেস্ট নে আমি কিচেনে আছি।’

আমি উমান ভাইয়ার একহাত ধরে বললাম,

‘এই না দাঁড়াও,আমি কিছু বুঝিনি,তুমি এত মিথ্যে কথা বলছো কেন?’

উনি খুশি হয়ে বললেন,

‘বাহ! তুমিটা অনেক সুন্দর লাগছে।তুই এখন থেকে আমাকে তুমি আর উম বলে ডাকবি,ওকে?’

আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
‘না মানে সরি,ভুল করে বলে ফেলেছি।কিন্তু আপনি আগে বলুন এসব মিথ্যে কথা বলছেন কেন?’সাদ ভাইয়া বেঁচে আছে আমি জানি।রাতে যেই লোকটা এসেছিল সেটা অন্য লোক।আপনি কিছুই বলছেননা আমাকে।’

উমান ভাইয়া হতাশ হয়ে আমার হাত থেকে স্যালাইন খুলতে খুলতে বললেন,

‘যা শুনেছিস এসবই বিশ্বাস করে নে,এটাই তোর জন্য ভাল হবে।’

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

‘তারমানে এসব সত্যি নয়?’

উমান ভাইয়া ফাঁকা স্যালাইনেরর বোতল নিয়ে গিয়ে রুমের ঝুড়িতে রেখে দিয়ে আমার কাছে এসে বসলেন।কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে আমার হাত নাড়াচারা করে বললেন,

‘সব সত্যি নয়।আমি তোকে ভালোবাসি এটা সত্যি।আর বাকি গুলো সাজানো সত্যি।ওটা মিথ্যে হলেও সবাই বিশ্বাস করে,তুইও বিশ্বাস করে নে।’

আমি বিছানায় হেলান দিয়ে ক্লান্ত আর অসহায় মুখ করে বললাম,

‘এসব আর ভাল লাগছেনা।আপনি পেপার রেডি করুন,সবকিছু কিছু আপনার নামে করে দিয়ে চলে যাব কোথাও।’

উমান ভাইয়া রাগী কন্ঠে বললেন,

‘আমাকে কি তোর ভিক্ষারি মনে হয়?কি করে দিবি আমার নামে?কি আছে তোর?শুনেছিস টাকা আছে কিন্তু দেখেছিস কখনও চোখে?তোর শুধু তুই ছিলি সেটা আমি আমার নামে করে নিয়েছি।তুই আমার,বুঝেছিস?’

আমিও রেগে বললাম,

‘হ্যা বুঝেছি,পাগল আপনি একটা।’

‘তোর মাথা,ডাফার কোথাকার!’

বলে উনি হন হন করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলেন।আমি অনুভূতি শূন্য হয়ে বিছানায় শুয়ে আছি।বাইরে অন্ধকার হয়ে গিয়েছে।জানালা গুলো এখনও খুলে রাখা আছে।কিছুক্ষণ জানালার দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থেকে উমান ভাইয়ার দেওয়া চকলেটের বক্স খুলে চকলেট খেতে শুরু করলাম।খেতে খেতে হঠাৎ খেয়াল করলাম আমি অন্য টিশার্ট পরে আছি।অ্যাশ কালার টিশার্ট আর গোলাপি প্লাজু পরে ছিলাম এখন দেখছি কালো গ্যাবাডিং আর সাদা টিশার্ট পরে আছি।টিশার্ট তুলে দেখি পেটেও নতুন গজ পেচানো।সব দেখে ফেলেছে ওই গ্রীডিম্যানটা…এ্যা এ্যা।

মাথা আমার পুরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে গিয়েছি।মহারাণী থেকে ডিরেক্ট পাগল রাণী।না না,মহারাণী নই।আমি আনম্যারিড,বাবার দ্যা প্রিন্সেস হু।আই হেট উম পাগল!ওই পাগলের বউ আমি কখনও হবনা।এসব ভেবেই আমি মনে মনে হাসলাম।

চলবে………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here