গল্প:-মনের মহারাণী
লেখিকা:-Sohani_Simu
পর্ব:৩০

বাবা আসার পর থেকে দাদির বাসায় যাওয়ার জন্য আমি বাবার সাথে ঘ্যানঘ্যান করছি।বাবার এক কথা।ওখানে কিছুতেই যাবেনা।আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে সবাই বিরক্ত।উমানের ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে উনি সবচেয়ে বেশি বিরক্ত।উনি আমার দিকে যেমন করে তাকাচ্ছেন মনে হচ্ছে উনি বলছেন ‘তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না,গাধী একটা’।
সবাই ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছি।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে তাও বাবাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারছিনা।মনে মনে ভাবছি কি করা যায়।আমি আসলে সবাইকে দেখাতে চেয়েছিলাম যে আমি যদি বাবাকে কিছু বলি বাবা সেটা কখনও ফেলবেনা তাই উমানের শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো এখনও বাবাকে বলিনি।আমি এবার সেসব বলার আগেই উমান বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘দাদির জন্য হলেও তোমাকে এবার যেতে হবে।দাদি খুব অসুস্থ।’

বাবা গম্ভীর হয়ে উমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘আমি ছেলে হয়ে উনার সুস্থতা কামনা করছি। কিন্তু তুই আমাকে ওই বাসায় যেতে বলিস না প্লিজ,আমি যাবনা।’

উমান সামনের সোফা থেকে উঠে এসে বাবার অন্যপাশে বসলেন।একটু অশান্ত হয়ে বললেন,

‘দাদুর শেষ ইচ্ছা ছিল তোমাকে একবার চোখের দেখা দেখবে,দেখা হল না।দাদির অবস্থাও ভাল না।নানুও মুক্তি চায়।বয়স হয়ে গিয়েছে,আর কত?তুমি গিয়ে না বললে হয়তো চাকরি ছাড়বেনা।কোন একদিন দেখা যাবে দরজাতেই মরে পরে আছে।ওদেরকে একবার সুযোগ দাও।থাকতে হবেনা ঘুরে আসো গিয়ে একবার।’

এবার ইমরুল আঙ্কেলও কথা ধরলো।একে একে সাদ ভাইয়া,শিপন ভাইয়াও।বাবা আর না করলো না।যাওয়ার জন্য মত দিল।আমরা সবাই একটা স্বস্তির শ্বাস ফেললাম।বাবা পকেট থেকে ফোন বের করে আম্মুকে কল দিল।আম্মু কল রিসিভ করতেই বাবা গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘মোহনা,মিনিকে নিয়ে রেডি হয়ে থাকো আমরা আজই ঢাকায় যাব।’

আম্মু কি বলল শুনতে পেলাম না।বাবা কল কেঁটে উঠে দাঁড়ালো।কালো ব্লেজারটা হাতের ভাজে নিয়ে উমানের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘চল।’

সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে তাই আমরা দ্রুত ফুপ্পির বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলাম।গাড়িতে উমান আর সাদ ভাইয়া সামনে আর আমরা বাকিরা পেছনে বসেছি।দ্রুত ড্রাইভ করার জন্য আমরা অল্প সময়ের মধ্যেই দাদির বাসায় চলে আসলাম।গেইটে নানুকে দেখেই উমান গাড়ি থামিয়ে দিলেন।সবাই গাড়ি থেকে নেমে আসলাম।আমি দৌঁড়ে গিয়ে নানুর এক হাত ধরে দাঁড়িয়ে বাবার দিকে তাকালাম।বাবা শিপন ভাইয়ার হাতে ব্লেজারটা ধরিয়ে দিয়ে নানুর সামনে এসে দাঁড়ালো।নানুকে সালাম করে বলল,

‘কেমন আছো চাচা?’

নানু কাঁপা কাঁপা হাতে বাবার বুকে কাঁধে হাত বুলিয়ে সিক্ত কন্ঠে বললেন,

‘বুলবুল?এসেছিস?আমার ছোটন বাবা?আমার ছোটন?’

বলতে বলতে নানু কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন।বাবা সাদ ভাইয়াকে বলল নানুকে বাসায় দিয়ে আসতে।সাদ ভাইয়া গেটের পাশে দাঁড়ানো দুটো লোককে বলতেই উনারা এসে নানুকে ধরে নিয়ে গেলেন।নানুর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ডক্টর লাগানো লাগবে।গেইট থেকে বাসা প্রায় হাফ কি.মি. দূরের রাস্তা।আমরা বাকি পথ হেঁটেই গেলাম।বহু বছর পর বাবা নিজের বাসায় পা রাখলো কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে প্রতিদিন যাওয়া-আসা করে।দাদি,বড়াব্বু-বড়াম্মু,ফুপ্পি,আম্মু সবাই কান্না করছে কিন্তু বাবার চোখে এক ফোটাও পানি নেই।আমি আগেও কোনদিনও বাবার চোখে পানি দেখিনি।এতটা বছর আপনজন ফেলে বাবা ছিল কেমন করে!!আমি কখনও পারবোনা।

মিনি বাবার কোলে চড়ে আছে।বাবা দাঁড়িয়ে থেকে সবার সাথে কথা বলছে।আমি বাবার হাত ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে উমানের পাশে এসে দাঁড়ালাম।উমান দুইহাত পকেটে ঢুকিয়ে খুশি হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি উনার হাত ঝাকিয়ে বললাম,

‘দেখলেন তো বাবা চলে আসলো?’

উমান আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,

‘তোর বাবা যে কত বড় খেলোয়ার তুই জানিসনা।দেখ কখন যেন বেঁকে বসবে।’

বলতে বলতেই বাবা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘আমার কারও উপর কোন রাগ অভিমান নেই।আমি কোনদিন কাউকে ত্যাজ্য করিনি তাই আবার নতুন করে শুরু করারও কোন মানে নেই।আমি আগে যেমন মায়ের ছেলে ছিলাম এখনও তেমনই আছি আর ভবিষ্যতেও থাকবো।ভাই-বোনের সাথে আমার সম্পর্ক কোনদিন খারাপ ছিলনা,সামনের দিনগুলোতেও খারাপ থাকবেনা।আমি চাই সবকিছু যেমন চলছিল তেমনই চলুক।আমি আমার কাজের জায়গায় ফিরতে চাই।মেয়েটারও লেখাপড়ার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।আমাদের ঢাকায় ফিরতেই হবে।’

উমান আমার একহাত চেপে ধরে ব্যস্ত হয়ে বললেন,

‘তুই যাবি না বল।এখনই বল চাচ্চুকে।’

আমি ভ্রু কুচকে বললাম,

‘কেন বলব?আমি বাবার সাথে যাব।আপনিও যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু।’

উনি ভ্রু কুচকে বললেন,

‘তুই চাচ্চুকে আনতে পারিসনি।আমরা এনেছি।তোর কন্ডিশন কেন শুনবো?তুই আমার কথা না শুনলে আমি প্রীতিকেই বিয়ে করব। ‘

উমানের সাথে ঝগড়া শুরু করে দিলাম।অন্যদিকে আমাদের চলে যাওয়ার কথা শুনে বাবাকে সবাই আটকাচ্ছে।ওইদিকে হৈ চৈ ভালই হচ্ছে।উমান আমার কাঁধ জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে সামনের দিকে হাঁটা দিলেন।বাবার সামনে এসে থেমে আমাকে ছেড়ে দিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে কাঁচুমাচু করতে করতে বললেন,

‘চাচ্চু,আমি না তোমাকে না জানিয়ে একটা কাজ করে ফেলেছি।’

সাদ ভাইয়া ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলেন,

‘এই উম,না এখন নয়।’

উনি আমাদের বিয়ের কথা বলবেন মনে করে আমিও ভয় পেয়ে গিয়েছি।বাবা যদি অনেক রেগে যায় সেজন্য।বাবা মিনিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বলল,

‘কি কাজ?’

উমান কিছু বলার আগেই আমি গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম।সাদ ভাইয়া উমানের পাশে দাঁড়িয়ে উমানের একবাহুতে হাত রেখে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘তেমন কিছু নয়।ওই কানাডা যাওয়া নিয়ে,এখন নয় পরে তোমাকে সব বলব।’

উমান সাদ ভাইয়ার হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘আরে ইয়ার ভয় পাচ্ছিস কেন?চাচ্চু কিছু বলবেনা।চাচ্চু শোন,আমি না মিতিকে এখানকার স্কুলে টিসি করিয়ে নিয়েছি।’

চোখ খিঁচে বন্ধ করে ছিলাম উনার কথা শুনে ফট করে চোখ খুললাম।স্বস্তির শ্বাস ফেললাম আমি আর সাদ ভাইয়া।বাবা এখনও কিছু রিয়েকশন দেয়নি।আমি গিয়ে বাবার পাশে দাঁড়ালাম।বাবা আমাকে একপাশ থেকে জড়িয়ে ধরে আমার মাথায় চুৃুমু দিয়ে উমানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘টিসি ক্যান্সেল করিয়ে দে।আর কি করেছিস?আমার ল্যাব ঠিক আছে তো?’

উমান মুখ কাঁচুমাচু করে বললেন,

‘আরেকটা কাজও করেছি।’

বাবা ভ্রু কুচকে বলল,

‘আবার কি করেছিস?’

সাদ ভাইয়া আবার উমানের হাত ধরেছেন।আমি বাবার শার্ট খামচে ধরে ভীত চোখে উমানের দিকে তাকালাম।উনি মুচকি হেসে বললেন,

‘টরেন্টোর একটা স্কুলে মিতির জন্য এ্যাপল্পিকেশন করেছি।ওখানে এস.এস.সি সিস্টেম নেই।একদম ডিগ্রী নিয়ে বের হবে।’

বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘অহ ভয় পাইয়ে দিয়েছিস একদম।ভেবেছি ল্যাব উল্টে-পাল্টে ফেলেছিস।আমার প্রিন্সেস কে তো আমি এ্যাবরোড পাঠাবোই তবে এখন নয়,বড় হোক আগে।’

সাদ ভাইয়া বললেন,

‘মামা,উম তোমাকে না জানিয়ে এত বড় বড় কাজ করল তাও তুমি রেগে গেলেনা!’

বাবা আমার মাথা হাত বুলিয়ে সাদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘নিজের থেকে বেশি ভরসা করি তোদের।ভুল কিছু করবিনা জানি।এখানকার স্কুলে টিসি নেওয়ার কারন কি হতে পারে?উম মিতিকে রাজশাহীতে বিপদমুক্ত রাখতে চেয়েছিল।’

সাদ ভাইয়া ফট করে বললেন,

‘হ্যাঁ ঠিক ধরেছো।মাঝখানে সিচুয়েশন খারাপ দেখে উম মিতিকে বিয়েও করে নিয়েছে,তুমি প্লিজ ওকে কিছু বলনা।’

সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে আর উমান বিস্ফোরিত চোখে সাদ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন।উনি ধারণাও করতে পারেননি সাদ ভাইয়া বাবাকে বলে দিবেন।আমিও ধারণা করতে পারিনি কারন সাদ ভাইয়া নিজে এতক্ষণ উমানকে আটকাচ্ছিলেন।শুকনো মুখ করে একবার বাবার দিকে আরেকবার উমানের দিকে তাকাচ্ছি।চারপাশ কেমন থম মেরে আছে।কারো নিঃশ্বাসের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে।কেন এত নীরবতা!!তবে কি এটা ঝড় শুরুর পূর্ব লক্ষণ!!

চলবে……….

লিখতে ইচ্ছে করছিল না জোর করে লিখলাম।রি-চেইক করা হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here