#মনপ্যাথি
#পর্ব:১১
#অরিত্রিকা_আহানা
সাতদিনের মধ্যেই আমার বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেলো।বাবা,ইমতিয়াজ ভাইয়া,ভাইয়া,ইমু সবাই ভীষণ ব্যস্ত।শুধু নেই ইনায়াজ ভাই।ভাইয়ার কাছে শুনেছি উনি নাকি ছুটি পান নি।আমি মনে মনে সবই বুঝলাম,কিন্তু কাউকে কিছু বুঝতে দিলাম না।
নাফিস ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম,চোখেমুখে কি দারুণ প্রশান্তির ছাপ।খুশিতে চেহারাটা চকচক করছে।
এতকিছুর মাঝেও আমার মনের মধ্যে কি চলছে তা কাউকে বুঝতে দিলাম না।একমুহূর্তের জন্যেও ভাবতে পারি না আমি অন্য কারো হতে যাচ্ছি।আমার সমস্ত সত্তা শুধু একজনকেই মনে মনে চায়।
আর পারলাম না!!বারবার শুধু মনে হচ্ছে আমি নাফিস ভাইকে ঠকাচ্ছি।তাকে সবকিছু জানানো উচিৎ!এংগেইজম্যান্ট এর দিন রাতে আমি চুপিচুপি নাফিস ভাইকে ডেকে পাঠালাম।
নাফিস ভাই বেশ খুশিখুশি চেহারা নিয়ে আমার সাথে দেখা করতে এলেন।প্রায় দশমিনিট যাবত প্রস্তুতি নিয়ে শেষমেশ নিজেকে শক্ত করে বলেই ফেললাম, “আমি একজনকে ভালোবাসি নাফিস ভাই।”
মুহূর্তেই উনার মুখটা কালো মেঘে ঢেকে গেলো।যেন ঘোর অন্ধকার নেমেছে।যে ছাত্র গোল্ডেন প্রত্যাশা করে সে হঠাৎ ফেল করেছে শুনলে মুখটা যেমন হয় উনার মুখটাও ঠিক তেমন হয়ে গেলো।
উনি নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, “কে সে?”
আমি বললাম, “বলা যাবে না।”
উনি একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, “আমার কাছে তোমার ভয় নেই।আমি তোমাকে ভালোবাসি তনু!”
-“ইনায়াজ ভাই!”
উনি একটু অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।তারপর চোখেমুখে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলেন, “ডাক্তার সাহেব সেটা জানেন?”
আমি শুধু বললাম, “না।”
উনি এবার একটু বেশিই আশ্চর্য হলেন।তারপর মুখে হাসির রেখা টেনে বললেন, “আমি তাকে জানাবো?”
আমি আবারও বললাম, “না।”
উনি আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
আমি শুধু বললাম, “আমি তার যোগ্য নই।আমি শুধু আপনাকে জানিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম।আমার সমস্তটা শুধু তাকে ঘিরে।সেখানে আপনার কোন স্থান নেই।শুধু আপনি কেন তিনি ছাড়া দ্বিতীয় কোন পুরুষের কথা আমি কল্পনাও করতে পারি না।এরপরেও যদি আপনার মনে হয় আপনি আমাকে বিয়ে করবেন তবে করতে পারেন।তবে সেটা হবে শুধু আমার পরিবারের কথা ভেবে,আমার ইচ্ছেতে নয়।এবার বলুন আপনার কি সিদ্ধান্ত?..নিশ্চই না? ”
আমাকে অবাক করে দিয়ে নাফিস ভাই বললেন, “বেশ!আমি বরং একবার চেষ্টা করেই দেখি আমার জন্য কোন জায়গা করতে পারি কি না।”
আমি বললাম,”যদি ব্যর্থ হন?”
উনি একটুখানি হেসে বললেন, “ভয় নেই ব্যর্থ হলে শূনতাকে প্রাপ্তি বলে মেনে নেবো।তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।তোমার অনুমতি ছাড়া আমি কখনো তোমার কাছে স্বামীর অধিরকার দাবী করবো না।”
এরমাঝে একদিন ভাইয়া এসে জানালো ইনায়াজ ভাইয়ের এফসিপিএস হয়ে গেছে।বেস্ট ডক্টর এওয়ার্ড পাচ্ছেন উনি।টিভিতে উনার সাক্ষাতকার নেওয়া হবে।পত্রিকায় উনার ছবি ছাপা হয়েছে!
সেদিন রাতে টিভিতে উনাকে দেখে সারারাত শুধু চোখের পানি ফেলছিলাম।দুর্দান্ত সাক্ষাতকার দিয়েছেন।
বাবা,ভাইয়া আপু সবাই মুগ্ধ হয়ে উনার তারিফ করছিলো।আমি উঠে চলে এলাম।মনকে বোঝালাম,ইনায়াজ ভাই বহু দূরের মানুষ!তাকে ছোঁয়া আমার সাধ্যের মধ্যে নেই।মরীচিকা পেছনে দৌঁড়েছি এতদিন।কিন্তু বেহায়া মন সব যুক্তি মানতে নারাজ।কিছুতেই তার দিক থেকে মুখ ফেরাতে পারলাম না।হাজারবার নিজেকে নিজে বুঝাতে চাইলাম তিনি অহংকারী,নিষ্ঠুর!ভালোবাসার মূল্য দিতে জানে না,তাকে ভুলে গেলেই মঙ্গল! কিন্তু এতকিছুর পরেও তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বাড়লো বৈকি কমলো না।ভালোবাসা আর যাই হোক যুক্তি মানতে নারাজ।
দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো।ইনায়াজ ভাই বিয়েতে এলেন না।আমাকে বিয়ের আসরে নিয়ে আসতেই চারদিকে খুশির রোল,আর আমার বুকের ভেতর শুধু তীব্র যন্ত্রনা।মনে হচ্ছে হৃদপিন্ডটা যেন ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে।মাথার উত্তজনা ক্রমশ বাড়ছে।চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি।
অবশেষে ধুমধাম করে আমাদের বিয়েটা হয়ে গেলো।আমার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে আমি ইনায়াজ ভাইকে পেলাম না।সে আমাকে তার প্রনয়ের আগুনে পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে দিয়ে গেলো।
গাড়িতে উঠার সময় আমি আবার জ্ঞান হারালাম।জ্ঞান ফিরতেই দেখলাম নাফিস ভাই মানে যাকে আমি একটু আগে আমার স্বামী হিসেবে গ্রহন করেছি,যাকে আমার জীবন যৌবন, ভালোবাসা সবকিছুর অধিকার দেবো বলে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছি সেই মানুষটা আমার হাত শক্ত করে তার হাতের মুঠোয় চেপে ধরে গভীর স্নেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে আছে।
আমাকে চোখ মেলে তাকাতে দেখেই তার সেই সুন্দর মুখটা আবার হাস্যজ্জ্বল হয়ে উঠলো।আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না,চোখ সরিয়ে নিলাম।বারবার মনে হচ্ছে আমি ভুল করেছি।আমি তো মনে প্রানে আমি শুধু একজনকেই চেয়েছি,অথচ এই মানুষটা কত আশা নিয়ে আছে আমার কাছে।তাকে দেওয়ার মত যে আমার কিছু নেই।আমি তো আগেই সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে ভিখিরি হয়ে গেছি।
আমার চোখের পানি টুপটুপ করে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।আমার স্বামী সেটা যত্ন করে তার ডান হাত দিয়ে মুছে দিলেন।
নাফিসের ছুটি আর বেশিদিন নেই।সপ্তাহ খানেকের মত আছে।এই উপলক্ষে একটা পার্টির আয়োজন করলো সে।
এতদিনেও আমার আর নাফিসের মাঝে স্বামী স্ত্রীর কোন সম্পর্ক গড়ে ওঠে নি।নাফিসও জোর করে নি।আমি আমার মত থাকি।নাফিস তার মত।মাঝে মাঝে রাতে ঘুম ভাংলে দেখি সে সিগারেট ফুঁকছে।একদিন বারণ করলাম।
-“ইচ্ছে হলে আমাকে শাস্তি দাও।নিজেকে শেষ করে দিচ্ছো কেন?..সিগারেট ফেলে দাও।এত সিগারেট খেলে মরে যাবে।”
সে হেসে বলল,”সিগারেট না খেলে কি তোমার ঠোঁটে চুমু খেতে দিবে?”
তারপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।আমি চুপচাপ বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষন কাঁদলাম।নাফিসের সাথে অন্যায় করছি।তার প্রস্তাবে রাজী হওয়া ছিলো আমার লাইফের সবচেয়ে বড় ভুল।তার জন্য কষ্ট হয়!কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে তাকে কি করে কাছে টেনে নেই?
আমি নাফিসের দেওয়া শাড়ি পরে রেডি হয়ে নিলাম।মেহমানরা সবাই আসতে শুরু করেছে।নাফিস রিসিপশনে গেস্টদের রিসিভ করছে।আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।হঠাৎ গেস্টদের মাঝে একজনকে ঢুকতে দেখে হার্টবিট আটকে গেলো।ইনায়াজ ভাই হাসিমুখে ভেতরে ঢুকছেন,সাথে একটা মেয়ে!!ভাইয়া ইমু ওরাও আছে।ইনায়াজ ভাই আমাকে দেখে থমকে গেলেন,এবং বরাবরের মতই নিজেকে সামলে নিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।আমার মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠলো।আবার সেই আগের রোগ!!
ইনায়াজ ভাই,ভাইয়া,নাফিস ইমতিয়াজ ভাই সবাই আড্ডা দিচ্ছে।সাথে মেয়েটাও আছে।সেই লেভেলের সুন্দরী!দুধে আলতা গায়ের রঙ!নায়িকাদের মত স্লিম ফিগার!আর সুন্দর মুখশ্রী!আমি ধৈর্য রাখতে পারলাম না।ইমুকে ডেকে চুপিচুপি জিজ্ঞেস করলাম,”মেয়েটা কে রে ইমু?”
ইমু আগে থেকেই সব জানতো।
মলিন কন্ঠে বলল,”ইনায়াজ ভাইয়ের ফিয়ন্সে!”
-“ওহ!”
-“মন খারাপ করো না আপু।আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যেই করেন।”
-“ঠিক আছে তুই যা।”
পার্টির এক ফাঁকে দেখলাম ইনায়াজ ভাই উপরে যাচ্ছেন।আমি সবার অলক্ষে পা টিপেটিপে উনার পিছু নিলাম,সেই সাথে সর্বানাশের!উনি ওয়াশরুমে ঢুকলেন।ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই আমি উনার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।সবাই নিচে,আমরা দুজন ছাড়া ওপরে কেউ নেই।
ইনায়াজ ভাই আমাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন।পরোক্ষনেই মুখে হাসির রেখা টেনে জিজ্ঞেস করলেন,”কেমন আছো?”
-“কেন করলেন আমার সাথে এমন?”
-“এদিকে কেউ নেই।চলো নিচে চলো।”
-“কেন আপনার ফিয়ন্সে দেখে ফেলবে সেই জন্য?”
ইনায়াজ ভাই এবারও নিশ্চুপ।আমি চিৎকার দিয়ে বললাম,”আপনি অহংকারী,আপনার মন বলতে কিচ্ছু নেই।আমি আপনাকে ঘৃনা করি।আই জাস্ট হেইট ইউ মি.ইনায়াজ আহমেদ।”
ইনায়াজ আগের মত দাঁড়িয়ে আছেন।রাগের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলাম।সর্বনাশের তোয়াক্কা করলাম না।নিজেও মরবো এনাকেও মেরে যাবো।
হ্যাঁ!রাগ,অভিমান জেদের বশে দ্বিতীয় ভুলটা করতে বসেছিলাম আমি।ইনায়াজ ভাইকে আঁকড়ে ধরে পাগলের মত উনার ঠোঁট খুঁজছিলাম।কিন্তু ইনায়াজ ভাই আটকে দিলেন।আমি তখন উন্মাদ হয়ে গেছি।আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরতে লাগলাম।
ইনায়াজ ভাই অনেক কষ্টে আমাকে সরিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললেন,”পাগলামি করো না তনু।কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
এই প্রথম উনার চোখে আমি আমার জন্য কিছু দেখতে পাচ্ছি,নাহ!রাগ নয়!
তারপর ইনায়াজ ভাই আমাকে রেখে ধীরে পায়ে নিচে নেমে গেলেন।আমি সেখানে বসেই হাঁটুতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেললাম।
আমার মাথায় কারো হাত কোমল স্পর্শ পেতেই মুখ তুলে তাকালাম।
নাফিস হাটুমুড়ে আমার পাশে বসে আছে।দৃষ্টি ছলছল!নাফিসকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম।
নাফিস আমার মাথায় হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো।কিচ্ছু জিজ্ঞেস করলো না!সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আর তাকে কষ্ট দেবো না।নতুন করে নাফিসের সাথে শুরু করবো।যেভাবেই হোক আমাকে এই মেন্টাল ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।যার কাছে আমার ভালোবাসার কোন মূল্য নেই তাকে ভেবে আর সময় নষ্ট করবো না।হয়ত অনেক দেরী হয়ে গেছে,তবুও আমাকে নতুন করে শুরু করতে হবে।
আমি ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলাম।
পার্টি থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়ির কাছে গেলাম।ড্রাইভিং সীটে নাফিস বসে আছে।তার চোখদুটো অসম্ভব লাল।ভয় পেয়ে গেলাম।নাফিস কি ড্রিংক করেছে?.নাফিস আমাকে ইশারায় বসতে বললো।ভয়ে ভয়ে গাড়িতে বসলাম।কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল নাফিস গাড়ি নয়,রকেট চালাচ্ছিলো।
বাসায় এসেছি ঘন্টাদুয়েক হয়েছে।সবাই এখনো পার্টিতে পুরো বাসা ফাঁকা।আমি ফ্লোরে বসে কাঁদছি।নাফিস আমার ব্যাগ গোচাচ্ছে।তার যা করার সে করে ফেলেছে।আমার কোন কথাই শুনে নি।পাগলের মত আর্তনাদ করলাম কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অটল।ব্যাগ গোছানো শেষে আমার হাত ধরে টেনে বের করে নিয়ে চললো।আমি বুঝতে পারছিলাম সে নেশাগ্রস্ত তবুও বারবার মিনতি করলাম।কিন্তু সে শুনলো না।গাড়িতে বসিয়ে আবারও সেই রকেটের গতিতে গাড়ি ছোটালো!