আমার একটা পোষা বিড়াল ছিল। লিউইশ নাম। অদ্ভুদ নাম। আমি দিয়েছি তো, তাই। সে প্রতিদিন আমার বারান্দা থেকে পাশের বারান্দার বাড়িওয়ালার ছেলের রুমে ঢুকে যেত। শুধু ঢুকেই ক্ষান্ত হতো না। রুমের কিছু না কিছু জিনিস ভেঙ্গে চলে আসতো। একদিন এমন করেই সকাল সকাল বারান্দা টপকে বাড়িওয়ালার ছেলের রুমে গিয়ে দামি কাঁচের মগ ভেঙ্গে ফেললো। একটা কাঁচের মগ! সামান্য একটা মগ! অনতত আমার কাছে তো সামান্যই মনে হয়। অথচ এই মগটার জন্য ছেলেটি আমার সঙ্গে যা তা ব্যবহার করলো। সে আমার নাম জানতো। আগেও কয়েকবার ঝগড়া হয়েছিল বিধায় সে তার ‘হেট লিস্টে’ আমার নাম সবার শীর্ষে চিহ্নিত করে রেখেছিল।
লিউইশের গলা ধরে তার বারান্দার একদম রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে, আমার নাম ধরে ডাকতে লাগলো, “এই ধিন্দি মেয়ে। কই তুমি? বারান্দায় আসো, বারান্দায় আসো বলছি।”

আমি শুনেও শুনলাম না যেন। পাত্তাই দিলাম না তাকে। সে এবার গলা উঁচিয়ে ডাকতে লাগলেন, “খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু ধিন্দি! এদিকে আসতে বলেছি তোমাকে। তুমি আসবে, নাকি আমি আঙ্কেলকে ডাকবো?”

ছোট থেকেই বাবাকে ভীষণ ভয় পাই আমি। ভয়াবহ ভয়। তাই এবার আর সারা না দিয়ে পারলাম না। পরে যদি এই কনক রাক্ষস সত্যিই বাবাকে নালিশ করে? পরে তো আমাকে মেরেই ফেলবেন আব্বা। বারান্দায় গিয়ে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললাম, “কি সমস্যা হয়েছে? এভাবে বান্দরের মতো চিল্লাচ্ছেন কেন?”
কথা বলবার উত্তেজনায় আমার বান্দর বলাটা হয়তো খেয়াল করেন নি উনি। নয়তো নিশ্চিত, এ নিয়ে একদফা চুলোচুলি হয়ে যেত আমাদের।
কনক ভাইয়া বললেন,
—“তোমাকে কতবার বলেছি এই লিউ-টিউ কে সাবধানে রাখতে? আমার কত পছন্দের একটা কাপ ভেঙ্গে ফেলেছে ও, জানো তুমি?”
দোষ যেহেতু আমার আর লিউইশের। তাই সামান্য কাপের পেছনে লাগলাম না। বরং ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, “তো কি হয়েছে? আপনি যে আমাদের নাম বিকৃতি করেন, আমরা কিছু বলেছি? আমার নাম ধারা, আপনি আমাকে কি ডাকেন? ধিন্দি! ওর নাম লিউইশ। ওকে কি ডাকেন? লিউ-টিউ। আপনি যেমন খাটাশ, আপনার বিকৃত নামগুলোও খাটাশ। ছি!”
কনক কপট রেগে তাকালেন। লিউইশকে এক ঝটকায় আমার বারান্দায় ছুঁড়ে মারলেন। যদিও ব্যথা পায়নি, তবুও তেঁতে উঠলাম আমি, “বেয়াদব ছেলে! রাক্ষস! এত সাহস কই পেলেন আমার লিউইশকে ছুঁড়ে মারার?”
মাথাটা একটু ঝুঁকালেন কনক। আমার বারান্দার খানিকটা কাছাকাছি চলে এলেন। ক্ষীপ্ত গলায় হিসহিসিয়ে বললেন, “মেয়ে, বেশি কথা বলছো তুমি। মার্ডার করে দিবো একদম।”
আমি মুখ ভেঙ্গালাম, “আমিও জেলে খাটাবো আপনাকে। কনইক্কা কোথার!”

সেদিন বিরাট ঝগড়া হলো। আমাদের ঝগড়ার আওয়াজে বিল্ডিংয়ের কেউ টিকতে পারছিল না। যে ভয় মনে দলা পাকিয়ে ছিল, এই বেয়াদব কনকের সঙ্গে ঝগড়ার কারণে সত্য হয়ে গেল। বাবা রুমে আসলেন। কনকের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখে উনার সামনেই বকলেন একচোট। লোকটার ঠোঁটে তখন হাসি একদম আঠার মতো লেগেছিল। সরছিলই না। আমিও মনে মনে প্রতিশোধ নেওয়ার পুরোদমে পরিকল্পনা করে নিলাম। কনক ভাইয়ার একটা বাইক আছে। ভীষণ প্রিয়। আমি সেটার দু,দুটো লুকিং গ্লাস ভেঙ্গে দিলাম। সে অবশ্য এটা দেখার পর খুব চেতেছিল। আমাকে হাতে নাতে ধরতে উঠে পরে লেগেছিল। কিন্তু আমিও বা কম কিসের? ধরা দেই নি। পুরো এক সপ্তাহ ঘরে চুপটি মেরে বসেছিলাম। বারান্দায়, ছাদে কোথাও এক মিনিটের জন্য দাঁড়াই নি। পাছে যদি কনক দেখে ফেলেন? তবে তো আস্ত রাখবেন না আমাকে। আমার ছোট ভাইকে দিয়ে আমাকে শাসিয়েও ছিলেন। হাতের কাছে পেলে নাকি চুল সবকটা ছিঁড়ে দিবেন। এত সহজ? জীবনেও না।

তার কয়েকদিন পর ঘটলো আরেক ঘটনা। কলেজে আমাকে একটা ছেলে পছন্দ করতো। খুব সুদর্শন। আমিও মনে মনে করতাম। প্রপোজ করতেই এক্সেপ্ট করে নিলাম। ওইদিনই কনক বান্দর আমাদের কলেজে কি কাজে যেন এসেছিলেন। এমন মুহুর্ত চোখের সামনে পেয়ে হাত ছাড়া করলেন না। ফটাফট ছবি তুলে নিলেন কয়েকটা। এরপর ক্লাস শেষে যখন কলেজ থেকে বের হলাম, দেখলাম কনক ভাইয়া বাইকে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই ভাবসাব। চোখে কালো রোদচশমা। তাকে দেখেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। আমি পালানোর পায়তারা খুঁজছিলাম। অথচ সে আমাকে অবাক করে দিয়ে মিষ্টি হেসে ডাকলো, “ধারা, এদিকে আসো।”

বিমূঢ় হলাম খুব। এই লোক আমাকে কখনোই এত সুন্দর করে ডাকে না। সব সময় ধিন্দি, ধিন্দি বলে কান পঁচিয়ে ফেলে। তার এত সুন্দর ডাক শুনে মনে কৌতুহল জাগলো। উপেক্ষা করতে পারলাম না। কাছাকাছি হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হইছে?”
সে মিটিমিটি হাসছেন,
—“একটা কিছু দেখবা?”
—“কি?”
—“ছবি।”
পকেট থেকে ফোন বের করে আমার প্রপোজ এক্সেপ্ট এর ছবিগুলো চোখের সামনে ধরলেন। নেত্রজোড়া বড়ো বড়ো হয়ে গেল আমার। হাত, পা কাঁপতে লাগলো আগাম টর্নেডোর কথা ভেবে। মুহুর্তেই নিজের রুপ পালটে ফেললাম। নিজের বিপরীতে গিয়ে এক অন্য আমি হয়ে অনুরোধ করলাম, “ভাইয়া? প্লিজ ডিলিট করে দিন ছবিগুলো। আমি আপনাকে আইসক্রিম খাওয়াবো। সত্যি।”
কনক শয়তানদের মতো হাসতে লাগলেন। কি বিশ্রী হাসি ছিল ওটা। গা জ্বালানো। ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন, “উহু! ডিলিট তো করা যাবে না ধিন্দি। যতই ঘুষ দাও, এটা এখন সরাসরি তোমার বাবার কাছে গিয়েই পৌঁছাবো।”

সেদিন খুব কান্নাকাটি, ধাপাধাপির পরও পাষাণটার মায়া হলো না। বাবাকে ছবি দেখিয়ে দিলেন। ভয়ংকর মার খেলাম বাবার হাতে। ভয়ংকর বলতে শুধু একটা থাপ্পড়। চোখ-মুখ ফুলিয়ে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিলাম।
এদিকে আবার অন্য এক ঘটনা ঘটে গেল। কনক ভাইয়ার পরিকল্পনায় বিশাল ক্রুটি দেখা দিলো। যে ক্রুটির জন্য হয়তো আমিও প্রস্তুত ছিলাম না।
আমার বাবা আর কনক ভাইয়ার বাবা মিলে আমাদের দুজনের বিয়ে ঠিক করেছেন। কথাটা কানে আসা মাত্রই অজ্ঞান হওয়ার জোগাড় আমার। ওই কনকের সাথে আমি বিয়ে করবো? মরলেও তো না। বাবা ড্রইংরুমে বসেই খবর পরছিলেন। রুম থেকে আমি তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম, “কনক ভাইয়াকে বিয়ে— অসম্ভব! ওই গন্ডারকে আমি কখনোই বিয়ে করবো না। দরকার হলে রিকশাচালককে বিয়ে করবো।”
বারান্দা থেকে তক্ষুণি আওয়াজ এলো, “তোমাকে বিয়ে করতে আমিও মরে যাচ্ছি না ধিন্দি।”

_________

ভাড়াটে
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা

চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here