#ভালোবাসি_প্রিয়
(রিপোস্ট)
#পর্ব_১৯
©জারিন তামান্ন
ক্রিং ক্রিং শব্দে ধ্যান ভাংলো পলকের। অবরুদ্ধ অতীতের চৌকাঠ পেরিয়ে ফিরে এলো বাস্তবের দোরগোড়ায়। সামনে একটা রিক্সা দাঁড়ানো। সেটাই হর্ণ দিয়ে ডাকছে পলককে। পলক রিক্সাওয়ালার দিকে তাকাতেই রিক্সাওয়ালা বললো,
_যাইবেন নাকি আপা?
_হু.? অন্যমনস্কভাবে বললো পলক।
_তা কই যাইবেন?
_মিরপুর এগা..বলতে গিয়েই থেমে গেল পলক। চকিতেই মনে পড়ে গেল এখন তো তারা মিরপুর থাকে না। বড় বোন অন্তরার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর পাড়া প্রতিবেশিদের কথায় ওখানে স্বাভাবিকভাবে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে গেছিল। তাই বছর ৩ আগেই ওই এলাকাটা ছেড়ে এসেছিল তারা। এখন শান্তিনগরের একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকা ওরা। এটা খেয়াল হতেই পুনঃরায় রিক্সাওয়ার মুখের দিকে তাকালো সে। রিক্সাওয়ার কপাল কুচকে আছে। সম্ভবত পলকের কথাটা না বুঝতে পেরে কিংবা বাকিটা শুনতে চাওয়ার তাগিদে। রিক্সাওয়ার ভাব দেখে এবার চট করেই বললো পলক,
_শান্তিনগর। ভাড়া কত?
_৫০ টাকা।
_আচ্ছা,চলেন। বলেই রিক্সায় উঠে গেল পলক। চোখজোড়া বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিল একটা। তারপর,সযত্নে আবার তালা ঝুলিয়ে বন্ধ করে দিল অতীতের দরজাটা। এখন অনাগত নতুন জীবন নিয়ে ভাবা উচিৎ তার। অতীত যতই ঘাটবে ততোই রক্তক্ষরণ ঘটবে কেবল। আর ফলাফল, সে আবার ভেঙে পড়বে।দুর্বল হয়ে যাবে আরও বেশি। তিন -তিনটা বছর সময় লেগেছে তার এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে।এখন নতুন করে আর দুর্বল হবে না সে। কিছুতেই না।-নিজের মনে নিজেই প্রতিজ্ঞা করলো পলক।
___________________________________
বুবু,,দেখ.. এই পাঞ্জাবিটা বেশি সুন্দর না? ধবধবে সাদা রঙের মাঝে সাদা সুতোর কাজ করা একটা পাঞ্জাবি দেখিয়ে বললো নিশাত।
_ধুর….হলুদে কেউ এমন সাদা পাঞ্জাবি পড়ে নাকি রে নিশু। তুই হলুদের মাঝে কিছু দেখ। আর তাড়াতাড়ি কর। শেরওয়ানি আর স্যুটের কাপড়গুলাও তো এখনো কেনা বাকি। আর বাদ বাকি জিনিসের তো এখনো খবরই নাই। ও.. আল্লাহ এত এত জিনিস কেনা বাকি.. কখন কিভাবে সব হবে কে জানে! -নিশাতের হাতে সাদা পাঞ্জাবিটা দেখে বিরক্তির সুরে সেটা নাকচ করে দিয়ে কথাগুলো বললেন শাহনাজ বানু।
_ওও হো, মা! আজকাল হলুদে হলুদ রংই পড়তে হবে এমন কোন নিয়ম নাই। নিউ ট্রেন্ডে তো নীল, সবুজ,সাদা, সিলভার গোল্ডেন সব ধরণের রঙ চলে। আর তুমি কি না সেই মান্ধাতালের ট্রেন্ড নিয়া পইড়া আছো!
_তুই চুপ কর তো,,সব কিছুতেই বেশি বুঝিস দুই আঙুল। যেটা বলছি কর। আর এই সাজি, তুই হাত পা গোটায়া বসে আছিস ক্যান…দেখ দেখ… পাঞ্জাবি পছন্দ কর জলদি।_কপট রাগ দেখিয়ে বললেন শাহনাজ বানু।
শাহনাজ বানুর এহেন অস্থিরতা দেখে মুচকি হাসলো পলক। তারপর বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল দোকানে এক সাইডে থাকা ছেলেদের পাঞ্জাবীর কালেশনের দিকটায়। ঘুরে ঘুরে পাঞ্জাবি দেখছিল সে সিফাতের গায়ে হলুদের জন্য। হঠাৎই কুসুম হলুদ রঙের একটা পাঞ্জাবিতে চোখ আটকে গেল পলকের। পাঞ্জাবীর সাথে সাদা রঙের ধুতি পায়জামা। সাদা হলুদ,গোল্ডেন কালারের সুতোর কাজ করা বেশ সুন্দর পাঞ্জাবিটা। সিফাত লম্বাচওড়া মানুষ। সু-স্বাস্থ্যের অধীকারী। তার শরীরে বেশ মানাবে পাঞ্জাবীটা। এই ভেবেই মুচকি হেসে হাতে নিল পাঞ্জাবিটা। ওটা নিয়ে মা আর নিশাতের কাছে যেতে যেতেই সবুজ রঙের আরেকটা পাঞ্জাবিটা তে নজর গেল পলকের। ওটা দেখেই মনে পড়ে গেল পলাশের কথা। সবুজ রঙ পলাশের খুব প্রিয়। পলকের বিয়ে অথচ পলাশ নেই। আজ তার ভাইটা কাছে থাকলে নিশ্চয় নিজ হাতে বোনের বিয়ের একেকটা আয়োজন করতো। কিন্তু,এই পলকের বিয়ের জের ধরেই ভাইটা আজ তাদের থেকে আলাদা হয়ে গেছে। ৩ বছর হয়ে গেছে ভাইকে দেখেনি সে। কোন যোগাযোগ নেই তার সাথে। এসব ভাবতে ভাবতেই চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো পলকের। চট করেই একহাতে চেপে মুছে নিল উপচে পড়তে চাওয়া কষ্টগুলোকে।মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিল সে। তারপর এগিয়ে গেল পাঞ্জাবিটার কাছে। চুপচাপ পাঞ্জাবিটা হাতে নিয়ে দেখলো পাঞ্জাবিটা পলাশের সাইজের কিনা। বর্তমানে ভাই তার কোন মাপের জামা কাপড় পড়ে জানা নেই পলকের। তাই আগের মাপের আন্দাজেই নিয়ে নিল পাঞ্জাবিটা। ক্যাশ কাউন্টারে গিয়ে আলাদাভাবে প্যাক করালো ওটাকে। বিলটাও পে করলো নিজ নামে। তারপর, ওখানকার লোকগুলোকে অনুরোধ করে আলাদা রাখার ব্যবস্থা করলো ওটাকে। বললো,যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে।
তারপর সিফাতের জন্য পছন্দ করা পাঞ্জাবীটা নিয়ে ফিরে গেল নিশাত আর শাহনাজ বানুর কাছে।
পাঞ্জাবিটা বেশ পছন্দ হলো নিশাত আর শাহনাজ বানুর।তারপর ঘুরে ঘুরে সিফাতের জন্য শেরওয়ানি আর স্যুটের কাপড়ও কেনা হয়ে গেল। কিন্তু বিপত্তি বাধলো স্যুট বানাতে গিয়ে। সিফাতের শরীরের মাপ লাগবে। আর জুতোটাও কেনা বাকি। তাই ঠিক হলো সিফাত দেশে ফিরলে এই কাজ দুটো করা হবে। এছাড়াও সিফাতের জন্য বেশ দামী একটা ঘড়ি আর কয়েকটা শার্ট প্যান্ট এর কাপড় কেনা হলো। এরপর রুকু, সারা, রেহনুমা, রেহানা আর সিফাতের মামী দিলারার জন্যও পছন্দ করে শাড়ি কেনা হলো। আর তাদের পরিবারের ছেলেদের জন্য পাঞ্জাবী। এরপর, টুকটাক শপিং শেষ করে বাড়ি ফিরে এলো তারা।
____________________________________
রাতে খাওয়ার পর্বশেষে বাবার ঘরে একবার উঁকি দিল পলক। বাবা বিছানায় বসে খাতা কলম আর ক্যালকুলেটর নিয়ে কি যে হিসাব করছে।কিন্তু এত রাতে কিসের হিসেব নিকেশ করতে বসেছেন তিনি দূর থেকে দেখে বোঝা গেল না সেটা। দরজায় টোকা দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিল পলক। হিসেবের খাতা থেকে দরজার দিকে একবার চোখ তুলে তাকালেন আমজাদ আলী। এক পলক দেখেই পুনঃরায় চোখ রাখলেন হিসেবের খাতাটায়। পলক এবার খানিক কেশে গলা ঝেড়ে বললো,
_বাবা আসবো?
_এসো।-কাঠকাঠ গলায় বললেন তিনি। আসলে তিনি আগে থেকেই চুপচাপ স্বভাবের। সবার সাথে কথাও কম বলেন। মেয়েদের মধ্যে অন্তরা ছিল তার ভীষণ আদরের।কিন্তু সেই মেয়েটাই সমাজের কাছে তার মাথা নিচু করে দিয়ে পালিয়ে গেল বাড়ি ছেড়ে। আর অন্তরার ওমন কাজের ফল সরূপ পলকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওই এইট পাস ক্রিমিনাল ছেলেটার সাথে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলেন তিনি । এই ঘটনার কারণে সে মনে মনে বেশ লজ্জিত। আজও অপরাধবোধে ভোগেন এই নিয়ে।সেদিনের পর থেকে পলকের সাথে কথা বলতে গেলেই লজ্জা, অনুশোচনা,অপরাধবোধ এসে ঘিরে ধরে তাকে। কিন্তু বাবা হয়ে সন্তানের সামনে নতজাত হতেও বাঁধে তার। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না তিনি পলকের সাথে। তাই, তার এই রাগ অনুশোচনা অপরাধবোধকে তিনি রুক্ষতার আড়ালে লুকাতেই এমন কাঠকাঠভাবে কথা বলেন পলকের সাথে।
বাবার অনুমতি পেয়ে ধীর পায় ঘরে প্রবেশ করলো পলক।কিন্তু যেটা বলতে এসেছে সাহস করে সেটা বলতে পারছে না সে। তাই বাবার মুখোমুখি হয়ে খাটের এক কোণায় গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। মেয়েকে কিছুক্ষণ ধরে একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খাতায় চোখ রেখেই আমজাদ আলী জিজ্ঞেস করলেন,
_কিছু বলবে? -শান্ত এবং বেশ গম্ভীর শোনালো তার কণ্ঠস্বর।
বাবার এহেন কথায় তটস্থ হয়ে গেল পলক। কিছুটা ঘাবড়েও গেল সে। তারপর খানিক ইতস্তত করে বললো,
_হ্য..এ্যা..হ্যাঁ। একটা কথা বলার ছিল তোমাকে। না আসলে একটা অনুরোধ ছিল তোমার কাছে।
মেয়ের এহেন কথা আর বলার ভাবে এবারে মেয়ের দিকে চোখ তুলে চাইলেন আমজাদ আলী। কিচ্ছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভালোভাবে লক্ষ্য করলেন মেয়েকে। তারপর, অতিব শান্ত কন্ঠে বললেন,
_বলো।
বাবার এহেন শান্তভাবও যে ভীষণ ভয়ংকর লাগলো পলকের কাছে। নিষিদ্ধ কোন কিছু চাইবার আগে যেমন আড়ষ্টতা আর ভয় কাজ করে পলকেরও ঠিক তেমনটাই অনুভব হলো সেই মূহুর্তে। তারপরেও মনে সাহস জুগিয়ে মুখ খুললো সে।
_আ…আ..মি বলছিলাম কি প…অ..অ..প..
_এত আমতা আমতা করছো কেন, যা বলবে সোজাসুজি বলো। বেশ বিরক্তির স্বরে বললেন আমজাদ আলী।
_হ্যাঁ…বলছি। বলছিলাম যে..
মেয়ের এমন হাবভাব দেখে তার দিকে এবার কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টিতে চাইলেন তিনি। বাবার এহেন দৃষ্টি আরও ভয় পাইয়ে দিল পলককে। তাই এবার একটানে কথাটা বলে ফেলবে বলে মনে মনে ঠিক করলো সে। তাই পুনঃরায় নিজের কথাটা বাবাকে বলার জন্য লম্বা একটা শ্বাস নিল। নিজেকে প্রস্তুত করলো। তারপর বললো,
_বলছিলাম যে…পলা…এটুকু বলেই বাবার মুখের দিকে চাইলো পলক। আমজাদ আলী গম্ভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পলকের মুখের দিকে।সে কি বলবে সেটা শোনার জন্য অপেক্ষা করছেন তিনি। কিন্তু, বাবার এহেন চাহনী দেখে এবার হড়বড়িয়ে খুব দ্রুত বেগে পলক বললো,
_পলাশীর যুদ্ধ কবে যেন হয়েছিল বাবা?
পলকের প্রশ্নটা শুনে বেশ অবাক হলেন আমজাদ আলী। মনে মনে চমাকালেও খানিক। তার মনে হচ্ছে পলক এ কথা বলতে আসেনি। কিন্তু এখন সে অন্য কথাই বা কেন বলছে? মনে মনে এসব ভাবলেও মুখে তার ছাপ পড়তে দিলেন না।পলকের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুনরায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেন হিসেবের খাতায়।এবং বরাবরের মতোই গম্ভীর আর কাঠকাঠ গলায় বললেন,
_১৭৫৭ সালে।
_অহ…আচ্ছা। থ্যাংক ইউ। তুমি কাজ করো বরং। আমি আসছি।
পলকের কথার প্রত্যুত্তরে কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না আমজাদ আলী।কিন্তু পলক ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে তিনি বললেন,
_পলাশের নাম নেওয়াও বারণ এ বাসায়। তাই বিয়েতেও তার বা তার পরিবারের কারোর আসারও প্রশ্নই উঠো না। এই নিয়ে আর কখনো কিছু বলতে এসো না।
পলক স্তব্ধ। বিস্ময়ে হতবিহ্বল। সেই সাথে এইভাবে ধরা পড়ে যাওয়ায় কিছুটা ভয়ও হলো মনে। কিছুক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো পলক। তারপর এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিলো সে মনে মনে। যা হওয়ার হোক…কথাটা যখন বাবা বুঝতে পেরেই গেছে, তাহলে তাকে রাজি করানোর একটা চেষ্টা এবার না করলেই নয়। দরজার মুখে দাঁড়িয়ে ছিল পলক। এবারে পেছন ঘুরে দেখলো তার বাবা আগের মতোই হিসাব কষতে ব্যস্ত।ক্যালকুলেটরে অনবরত আঙুল চলছে তার। হতাশ হয়ে একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেল বাবার দিকে। খাটের কাছে গিয়ে আরও একটা দুঃসাহসিক কাজ করলো সে।
____________________________
এক পা বাইরে ঝুলিয়ে খাটে বসে কাজ করছিলেন আমজাদ আলী। পলক সেখানে বসে আস্তে করে সরাসরি তার পা জড়িয়ে ধরলো। আচমকা এমন আলতো হাতের স্পর্শে হকচকিয়ে গেলেন তিনি। দ্রুত খাতা থেকে চোখ সরিয়ে নিচে তাকাতেই সেখানে পলককে আবিষ্কার করলেন তিনি।অন্তরা আর পলাশের অধিক নৈকট্যের কারণে পলক আর নিশাতের সাথে বরারই বেশ কিছুটা স্নেহের দূরত্ব ছিল তার। স্ত্রীসহ চার চারটে সন্তানের ভরণ পোষণের দায়ভার নিয়ে মধ্যবিত্তের সংসার চালানোর চিন্তা আর আয় রোজগারের ব্যবস্থাতেই দিন গেছে তার। পলক আর নিশাত খুব বেশি কাছে পায়নি বাবাকে। আর অন্তরা আর পলাশের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরে যাবতীয় ঘটনায় তিনি আরও বেশি গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে।তাই তাদের সম্পর্কের মাঝে আড়ষ্টতার একটা অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয়ে গেছে। যে দেয়াল টপকে যাওয়ার সাহস না পলক বা নিশাত কেউ কখনো করেছে আর না আমজাদ আলী নিজে সে দেয়াল ভেঙে মেয়েদের সাথে এই দূরত্ব কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছেন। তাই আচমকা এসে পলকের এভাবে পা জড়িয়ে ধরায় বেশ অপ্রস্তুত হয়ে গেছেন তিনি। তবুও গলায় যথেষ্ট কাঠিন্য রেখে তিনি বললেন,
_আহ…সাজি! কি করছো তুমি? উঠো এখনি।
পলক তার জায়গায় অনড়। বাবার কথা যেন তার কানেই গেল না। জড়তা আর বিরক্তিতে এবার তিনি ধমকে উঠলে মেয়েকে।
_আহ…সাজিই! উঠো বলছি। এসব কি ধরণের আচরণ।পা ছাড়ো। উঠো তুমি!
_বাবা,প্লিইইইইজজ!!
পলকের কন্ঠ শুনে থমকে গেলেন তিনি। পলকের কন্ঠ ভেজা। তার মেয়েটা কাঁদছে। তারপরেও, গলায় গম্ভীর্য ধরে রেখেই তিনি মেয়েকে থামানোর চেষ্টা করলেন।
_সাজিইই!
বাবার এহেন গম্ভীর কন্ঠের আদেশও পলককে থামাতে পারলো না।কাঁদতে কাঁদতেই সে বলতে লাগলো,
_বাবা, প্লিজ! তুমি আর রাগ করে থেকো না। মাফ করে দাও ভাইয়াকে। বাড়ি ফিরে আসতে বলো । প্লিজ বাবা!তুমি একবার বললেই চলে আসবে ভাইয়া। তুমি শুধু একবার বলো,,,প্লিজ বাবা…একটা সুযোগ দাও ভাইয়াকে। মানুষ ভুল করলেও তাকে একটা সুযোগ দেয়া হয়, সেখানে ভাইয়া তো নিরুপায় ছিল। তুমি তাকে ফিরিয়ে আনো না বাবা। আমার বিয়ে অথচ আমার একমাত্র ভাইটাই থাকবে না…এমন কি করে হয় বাবা…? তুমি তাকে একটা সুযোগ দাও দেখবে…
_তাকে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সাজি। কিন্তু সে সেটা…
_ভাইয়া নিরুপায় ছিল বাবা। তুমি জানো ভাইয়ার একটা মেয়ে আছে। ২ বছর বয়স। সেই মেয়েটাকে বাঁচানোর জন্যই সেদিন আমাদের ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল সে। তুমিই বলো বাবা…কোন বাবা কি পারে নিজের সন্তানকে মরে যেতে দিতে? আর ওই মেয়েটাতো পৃথিবীর আলো অবদি দেখেনি তখন। তাকে সুস্থভাবে এই পৃথিবীর আলো দেখানোর জন্যই সেদিন বাধ্য হয়েছিল আমাদের ছাড়তে। আর তুমিই বলো ভাইয়া তখন কি করতো? ভাবীর গর্ভে অনিশ্চিত একটা জীবনের পথে ছেড়ে দিত তার সন্তানকে? তুমি হলে পারতে? কোন বাবা কি পারবে সেটা? বাবা তুমি প্লিজ..
এবারে আর সহ্য করতে পারলেন না তিনি পলকের এসব কথা। তাই রাগে বিরক্তিতে চিৎকার করে ডাকলেন তার স্ত্রীকে।
_শানু….শানু….
রান্নাঘরে গোছগাছ করছিলেন শাহনাজ বানু। আচমকা স্বামীর এহেন ডাকে হন্তদন্ত হয়ে নিজের ঘরে ছুটে এলেন তিনি। ঘরে পা রাখতেই থমকে গেলেন তিনিও। পলকে এভাবে বাবার পা জড়িয়ে ধরে কাঁদতে দেখে হতবাক হয়ে গেলেন তিনি। বাবার এমন প্রলয়ঙ্কারী ডাকে এতক্ষণে ছুটে এসেছে নিশাতও। পলক আর বাবার এহেন অবস্থা দেখে সেও ভড়কে গেছে রীতিমত। ব্যাপারটা ঠিক কি ঘটেছে বুঝে উঠতে পারলো কেউই। হতবিহ্বল নয়নে তাকিয়ে দেখছে আমজাদ আলী আর পলককে। এদিকে শাহনাজ বানুকে ঘরে দেখতে পেয়েই কঠিন গলায় তিনি আদেশ করলেন স্ত্রীকে।
_তোমার মেয়েকে এখান থেকে নিয়ে যাও শানু। এসব নাটক আর ভালো লাগছে না আমার।
মাকে দেখতে পেয়ে পলকের কান্না, আহাজারি এবার বিলাপে রূপ নিল। কান্নার মাত্রাও বেড়ে গেল তার। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
_মা…ও..মা। তুমি বোঝাও না একটু বাবাকে। বলো না বাবাকে ভাইয়াকে যেন ফিরিয়ে আনে। অনেক তো হলো মা…৩ টা বছর হয়ে গেছে এখন তো ফিরিয়ে আনতে বলো ভাইয়াকে। ক’দিন পরেই আমার বিয়ে। চলে যাবো তো এই বাড়ি ছেড়ে আমি। আমার শেষ চাওয়া হিসেবেই তোমরা ফিরিয়ে আনতে বলো না ভাইয়াকে। বলো না মা প্লিজ..
এবারে আমজাদ আলীর ধৈর্য্যের সীমা পুরোপুরিভাবে অতিক্রম করে গেল। ধমকে উঠলেন তিনি স্ত্রীকে।
_কি হলো? কি বললাম তোমাকে? নিয়ে যাও নিজের মেয়েকে। আমার আর সহ্য হচ্ছে না এসব।
স্বামীর এহেন হুংকারে কেঁপে উঠলেন শাহনাজ বানু। স্বামীকে তিনি যেমন ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন তেমনি তার রাগকেও ভীষণ ভয় হয় তার। শান্তশিষ্ট মানুষের রাগ বরাবরই ভয়ংকর। তার স্বামীর বেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। তাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে পলককে ধরলেন তিনি।
_সাজি…কিসব পাগলামি করতেছিস..উঠো।
_মা প্লিইইজ..
_সাজি…উঠ বলতেছি।
কিন্তু পলক তার জায়গায় অনড়। কিছুতেই সেখান থেকে সড়ানো যাচ্ছে না তাকে। শাহনাজ বানু বকে ধমকেও তাকে উঠাতে পাড়ছেন না।মায়ের এমন অবস্থা দেখে এগিয়ে এলো নিশাত। তারপর একরকম টেনে হিচড়েই তুলে নিয়ে তাকে বের করে নিয়ে গেল ঘর থেকে।
আমজাদ আলী ওভাবেই কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে রইলে ওখানে। মন মস্তিষ্কে হাজারো চিন্তা,অতীতের কথা, ভুল ঠিকের হিসেব এসে উঁকি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। পলকের সাথে তার কিছুটা দূরত্ব থাকলেও সন্তান হিসেবে তাকেও কম ভালোবাসেন না তিনি। হয় তো প্রকাশ করেন না সেভাবে। কিন্তু পলকের প্রতিও তার স্নেহ কাজ করে। ছোট থেকেই বেশ শান্তশিষ্ট তার এই মেয়েটি। নিশাত কিছুটা চটপটে হলেও পলক একদম চুপচাপ স্বভাবের। কখনো কোন কিছুর জন্য আবদার করেনি।জেদ করেনি। অন্তরাকে তার তুলনায় বেশি আদর স্নেহ করেছেন তিনি। এ কথা নিজেও স্বীকার করেন।তারপরেও কখনো এতটুকু অভিযোগ সে করেনি।অথচ এই মেয়েটার সাথেই তিনি বরাবর অন্যায় করে এসেছেন।
প্রথম বিয়ের সময় বিয়ে করতে না চেয়ে এভাবেই মায়ের পা জড়িয়ে কাঁদতে দেখেছিলেন তিনি পলককে। প্রথমবারের মত ওভাবে হাউমাউ কেঁদেছিল মেয়েটা তার। কিন্তু তার মন গলেনি। ক’দিন পরেই আবার বিয়ে এই মেয়েটার। এবারে তিনি কোন অবিচার করেননি মেয়ের সাথে। কিন্তু, সারাজীবন তার কাছে কোন কিছুর আবদার না করা মেয়েটাই চলে যাওয়ার আগে এমন এক আবদার করলো।এভাবে কান্না কাটি করলো। অথচ আজও তিনি ফিরিয়ে দিলেন মেয়েকে। নিজের আত্ম অহংকার, রাগ আর কাঠিন্যের দেয়াল ভেঙে মেনে নিতে পারলেন না মেয়ের এমন আহাজারি ভরা আবদারটুকু। জীবন সত্যিই বড্ড বিচিত্র। একজীবনেই কত সময় কত চরিত্রে কত রূপে নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। কত ছোট ছোট চাওয়া আবদারকেও অহং এর তলায় পিষে ফেলতে হয়।এগিয়ে যেতে হয় সময়ের স্রোতের সাথে লড়াই করে।
জীবনের এত রূপ রঙ নিয়ে ভাবতে ভাবতে একসময় হাঁপিয়ে উঠলেন আমদাজ আলী। ক্লান্তি আর বিষাদে ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। হাই ব্লাড প্রেশারের রোগী তিনি। স্ট্রেস একদম নিতে পারেন না। একটু আগের ঘটনায় অতীতের অনেক কথাই ভাবা হয়ে গেছে তার।বড্ড বেশিই ক্লান্ত লাগছে এখন। আস্তে করে বিছানা থেকে নেমলেন তিনি। খাতা বন্ধ করে চশমাটা খুললেন চোখ থেকে। ওগুলো সাইড টেবিলের উপর রেখে ঘরের আলোটাও নিভিয়ে দিলেন। দরজার কাছে গিয়ে একবার বোঝার চেষ্টা করলেন ওদিককার অবস্থাটা। পলকের ঘরটা তার ঘর থেকে বেশ কিছুটা দূরেই। তবুও চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু পলকের কান্না বা কারও কোন কথার আওয়াজ..কিছুই শুনতে পেলেননা। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলেন বিছানার দিকে। সোজা হয়ে শুয়ে কপালে হাত রেখে চোখ বুঝলেন।কিন্তু, সে চোখে আদৌও ঘুম নামলো কিনা বোঝা গেল না।
চলবে…