#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব -১৬]
#আফরোজা_আনজুম
হসপিটালের শুভ্র বেডে নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছি। পরিচিত কাউকেই দেখলাম না। একটু নড়তে শরীরে অসহ্য রকমের ব্যাথা অনুভব করলাম। হাত, পা, মুখ সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। দু চোখ নিঠুল ভাইকে খুঁজছে। তখন আমার ট্রিটমেন্টের সময় কোনোমতেই সামনে থেকে সরাতে পারলো না কেউ। আমি ঝাপসা চোখে দেখেছিলাম সে ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না। আমার থেকে দূরে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমার ট্রিটমেন্ট শেষে নার্স তাকে নিয়ে যেতে সক্ষম হলো। এরপর আর দেখি নি। একটু পর দেখলাম আন্টি আর রিনি আপু হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে। আমাকে এই অবস্থায় দেখে আন্টি কাঁদতে শুরু করলো। কীভাবে হয়েছে, কেমন লাগছে একের পর এক জিজ্ঞেস করছে। আমি কিছুই বলতে পারলাম না। দেখলাম একটা লোক নিঠুল ভাইকে ধরে দরজা পর্যন্ত নিয়ে এলো। আন্টি তাকে দেখেই তেড়ে গিয়ে দুই গালে চড় লাগিয়ে দিলো কিছু বুঝে উঠার আগে। নিঠুল ভাই পিছিয়ে পড়লো৷ রিনি আপু গিয়ে ধরলো নিঠুল ভাইকে। আন্টি উঁচু গলায় বললো, ” এবার পেয়েছিস শান্তি! ওর কী অবস্থা করেছিস দেখ! এতো বার বারণ করার পরও শোনার প্রয়োজন মনে করিস নি আমার কথা৷ ভাই-ভাবীকে কী জবাব দিব আমি এখন! বল!”
” আম্মা, থামো একটু। বিপদ এসেছে বলে এমন হলো। ওর নিজের অবস্থাটাও দেখো।” রিনি আপু বললো।
” বিপদ কেন এসেছে! মায়ের কথা শুনে নি বলেই তো!”
সে কিছু বললো না। একটা নার্স এসে বললো আর একটা এক্স-রে বাকি আছে তার। রিনি আপুকে আমার কাছে রেখে আন্টি গেল নিঠুল ভাইয়ের সাথে। অনেকক্ষণ পর ফিরে আসলো তারা। নিঠুল ভাই একবার আমার দিকে তাকিয়ে রিনি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” ওকে কিছু খাওয়াতে হবে, ভাবী।”
” হ্যা। নিচে ক্যান্টিন আছে। যাচ্ছি আমি। ” কথাটা বলে রিনি আপু নিচে গেল।
আন্টি তাকে সিটে বসিয়ে দিল। চোখে মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে কেঁদে বললো, ” আজ কত বড় বিপদ হতে পারতো ভেবে দেখিছিস! এজন্যই আমি তোকে বাইক চালাতে বারণ করি৷ তুই তো আমার কথা শুনিস না। ”
” ঐ লোকটার দোষ, আম্মা। সে-ই স্পিডে গাড়ী চালিয়ে আমার দিকে চলে এসেছে। ”
কথাটা শোনা মাত্র তখনের দৃশ্যটা ভেসে উঠলো আমার চোখে। ঐ লোকটা বেঁচে আছে তো! ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, ” ঐ লোকটার কী অবস্থা! কোথায় তিনি?”
” তার বাড়ির লোকেরা এসে চিটাগাং মেডিকেলে নিয়ে গেছে।”
” বাঁচবে না?” কান্না আঁটকে জিজ্ঞেস করলাম।
” আরে এতটা আঘাত পায় নি। সুস্থ হয়ে যাবে।”
আন্টি আহা রে বলে দুঃখ প্রকাশ করলো। নিঠুল ভাইকে বললো, ” রিনি আসছে না কেন দেখে আসি আমি।”
আন্টি চলে গেলে নিঠুল ভাই আমার মাথার কাছে এসে বসে। আমার মুখে আলতো হাত বুলিয়ে কপালের ব্যান্ডেজের ওপর অনেকক্ষণ সময় নিয়ে চুমু খায়। তার চোখের পানিতে ব্যান্ডেজ ভিজে যাচ্ছে। মাথা উঠিয়ে ভেজা কণ্ঠে বলে, ” আমার জন্য হয়েছে সব, না! এমন হবে জানলে আমি কোনদিন তোকে বাইকে করে আনতাম না। আমার জন্য তোর এতো কষ্ট পেতে হচ্ছে। ”
” নিজেকে দোষ দিচ্ছো কেন? বিপদে কারো হাত নেই। তোমাকে কী বললো ডাক্তার? ”
” আমার তেমন কিছু হয় নি। ”
” তাহলে এক্স-রে করতে বললো কেন? তুমি ভালো করে হাঁটতে পারছো না।”
” পায়ে একটু ব্যাথা পেয়েছে। অতোটাও না।” আমার হাতটা তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো।
ব্যাথায় ‘আহ্’ করে উঠলাম আমি। সে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিল। অস্থির গলায় বললো, ” একদমই খেয়াল করি নি আমি। বেশি ব্যাথা পেয়েছিস?”
আমি মাথা নাড়িয়ে না বললাম। এর মাঝে আব্বু-আম্মুও এলো। তাদের দেখে নিঠুল ভাই সরে গিয়ে অপরাধীর মতো বসে রইল। আম্মু ইতোমধ্যে কান্না শুরু করে দিয়েছে।
.
.
.
এগারো দিন। এগারোটা দিন বিছানায় শুয়ে বসে কাটাতে কাটাতে বিরক্তি এসে গেছে। সারাদিন একজায়গায় বসে, শুয়ে কাটানো যায়! প্রথম দুইদিন নিঠুল ভাই তার বাসায় ছিল। আন্টি আসতে দেয় নি। এরপর প্রতিদিনই সে এখানে চলে এসেছে। মাঝে মাঝে থেকে গেছে। এই কয়দিনে তার কর্মকাণ্ডে বেশ ভালোভাবে বুঝে গেছি সে আমায় কতটা ভালোবাসে। প্রতিদিনই আমার পছন্দের খাবার নিয়ে আসে, ফোন করে অষুধ খেতে বলে। এসব কেয়ারের পাশাপাশি ধমকা ধমকিও ছিল। তার এসবে কেউ তেমন সন্দেহ করে নি। ভেবেছে তার জন্য এমন হয়েছে বলে সে এমন করছে। সকাল থেকে আম্মুকে অনেকবার বলেছি আমার সারাদিন বিছানায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। ছাদে যাবো। আম্মু শুনলোই না উলটো একগাদা কথা শুনিয়ে দিল। তাই বসে বসে ফেসবুক স্ক্রল করছিলাম। তখনই নিঠুল ভাইয়ের কণ্ঠ শুনলাম। মোবাইল পাশে রেখে দিয়ে অসহায়ের মতো চুপচাপ বসে রইলাম। সে এসে অষুধের প্যাকেটটা রাখলো টেবিলে। তারপর বিছানায় বসে জিজ্ঞেস করলো, ” অষুধ খেয়েছিস?” মলম লাগিয়েছিস?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যা বললাম। সে বললো, ” নিয়মিত মলম লাগালে দাগগুলো চলে যাবে। হেলা করবি না বুঝেছিস?”
” কেন দাগগুলোতে কী আমাকে বিশ্রী দেখায়?”
আমার প্রশ্নে সে আমার দিকে রাগী চোখে তাকল। কারণ এর আগেও একবার জিজ্ঞেস করেছি আর উত্তরে সে ভাষণ শুনিয়ে দিল। উত্তর না পেয়ে আমি অসহায় মুখ করে বললাম, ” আমার আর ভালো লাগছে না। আমাকে ছাদে নিয়ে যাবে? আম্মুকে অনেকবার বলেছি। আম্মু বকা দিয়েছে। হাঁটতে তো পারছি। তুমি বললে আম্মু কিছু বলবে না।”
” এখন না। আমার এখন একটা কাজে যেতে হবে। এলে আমি নিয়ে যাবো।”
” তোমার যেতে হবে না। আমিই যেতে পারবো। তুমি শুধু আম্মুকে বললে হবে। ”
” বললাম না এখন যেতে হবে না! ছাদে রোদ এখন। বিকালে যাস।”
হতাশ হয়ে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলাম। তখন বেরিয়ে শেষ বিকেলে সে ঘরে ফিরলো। তাকে দেখেও না দেখার ভান করে রইলাম। সে এগিয়ে এসে হঠাৎ আমাকে কোলে তুলে নিল। বিস্ময়ে আমি চোখ বড় করে তাকিয়ে বললাম, ” আরে কোলে নিয়েছো কেন? নামাও, নামাও। আম্মুরা দেখলে কী বলবে?”
ততক্ষণে সে বেরিয়ে গেছে। ভয়ে আমার মুখটা অন্ধকার হয়ে গেছে। চাইলেও নামতে পারছি না। আম্মুরা দেখলে ভালো হবে না। আমার কথাকে সে উপেক্ষা করে ছাদে নিয়ে এলো। ভাগ্যিস কেউ দেখে নি। আমাকে নামিয়ে দিয়ে সে কোমরে হাত দিয়ে বললো, ” এই কয়দিন শুয়ে বসে থেকে মোটু হয়ে গেছিস তুই।”
” কেউ দেখলে কী হতো! কোলে নিয়েছো কেন তুমি? এখন আবার বলছে মোটু হয়ে গেছি।” ফুঁসে উঠলাম আমি।
সে রেলিঙে ঘেঁষে দাঁড়ালো। হেসে বললো, “সত্যিটাই বললাম। আর দেখলে কী হতো! খারাপ কিছু করেছি না নাকি! বরং দেখলে তোর আব্বু আম্মু বলতো কত কেয়ারিং ছেলেটা! এমন ছেলের সাথে যদি আমার গাধী মেয়েটার বিয়ে দিতে পারতাম!”
গাধী ডাকায় ভীষণ রাগ হলো আমার। এই শব্দটা কেউ আমার জন্য ব্যবহার করলে খুব গায়ে লাগে। তাও কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে সুবিশাল আকাশের দিকে দৃষ্টি রাখলাম। শেষ বিকেলের সূর্যটা পশ্চিমে হেলে পড়েছে। চারপাশটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করে এক মোহনীয় মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে। পাখির দল নীড়ে ফিরছে ব্যস্ত হয়ে। নিঠুল ভাইয়ের দিকে তাকালাম। সে ফোনে কথা বলছে। ফোন রাখতেই আমি বলে উঠলাম, ” গত পরশু তুমি ফোনে বলেছিলে আমার সেদিনের ব্যবহারের জন্য রেগে আছো আমার উপর। এখনো ক্ষমা করো নি? ”
” না। আমার ভালোবাসাকে মিথ্যে বলেছিস তুই, সুযোগসন্ধানী বলেছিস আমাকে। ক্ষমা করবো না এর জন্য। ”
” বললাম তো আমার ভুল হয়েছে! তাদের কথা বিশ্বাস করে এসব ভাবা উচিত হয় নি। কিন্তু কী করবো! আমার চাইতেও রূপবতী, গুণবতী মেয়েরা তোমার আশেপাশে ঘুরঘুর করে। তাদের রেখে আমার মতো একটা গাধী মেয়েকে তুমি ভালোবাসো এটা তো ভাববার বিষয়। তোমার প্রতি দূর্বল থাকলেও তোমাকে পাওয়ার আশা তেমন একটা করতাম না আমি। তোমার সাথে তো আমাকে মানায় না। তাই তুমি না বললে আমার কখনো সাহস হতো না বলার। আমার ভালোবাসা মনে মনেই থাকতো। যখন বললো সুইটির সাথে তোমার রিলেশনের কথা তখন ভাবলাম এটা তো অবিশ্বাসের কিছু নয়। তার মতো মেয়েকেই তো মানায় তোমার জীবনসঙ্গী হিসেবে। তাদের রেখে আমাকে কেন..”
কথার মাঝে সে তেড়ে এলো আমার দিকে। আগুন চোখে তাকিয়ে বললো, ” এতো ছোট ভাবিস কেন নিজেকে? নিজেই যদি নিজেকে ছোট করে দেখিস তাহলে অন্যরা তো বলবেই। জন্মের পর থেকে দেখে আসছিস আমাকে। তোর বুঝা উচিত ছিল মেয়েদের ঠকানোর মতো, সুযোগে তাদের ব্যবহার করার মতো ছেলে আমি নয়। তোর সাথে তো নয়-ই।”
” তাহলে আমাকে ভালোবাসো কেন বল তো! আমি তো গাধী, আমার চোখ হাঁসের আন্ডার মতো, এখন আবার মোটু হয়ে গেছি, হাতে মুখে দাগ।”
” গাধী বলেই বোধহয় ভালোবাসাটা আগে হয়েছে। গাধীর মতো কাজ করা, ঝগড়া করা, লজ্জা পাওয়া। এসবে তোর ভালোবাসাটা প্রকাশ পেয়েছে। তুই না বললেও আআমি বুঝে গিয়েছি। আর চোখ! তুই জানিস আমার সবচেয়ে পছন্দ হচ্ছে তোর বড় বড় চোখ দুটো। চোখ দুটো আসলেই ভয়ঙ্কর। ভয়ংকর সুন্দর। ঐ চোখের দিকে তাকালেই যে কেউ প্রেমে পড়তে বাধ্য। তোর সবকিছুর প্রতি আমি প্রেমে পড়েছি, প্রতিনিয়ত প্রেমে পড়ি। অন্য কোনো মেয়ে আমার ভাবনাতেই আসে না। আমার হৃদয়ের সাথে একেবারে মিশে গিয়েছিস তুই।”
তার কথাগুলো শুনে লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিলাম আমি। মনে প্রচণ্ড সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। সব লজ্জা কাটিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছে করছে আমিও তোমাকে ভালোবাসি। আমার ভাবনাতেও সবসময় তুমিই থাকো। তুমিই আমার প্রথম প্রেম; শেষ প্রেমও তুমিই থাকবে।
আমার পেছনে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সে। আমাকে তার দিকে ফিরিয়ে নিল। বাম গালের ক্ষত জায়গাটায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে, ” এই দাগগুলোতে তোকে আরও বেশি আদুরে লাগে। চুমু খেতে ইচ্ছে করে বারবার।”
লাজুক হাসলাম তার কথায়। এ পর্যন্ত সে অনেকবার চুমু খেয়েছে ওখানে। মুখটা এগিয়ে আনতেই ধাক্কা দিলাম তাকে। সে আমাকে চেপে ধরে জোর করে চুমু খেয়ে নেয়। আমি কপট রাগ দেখালে ঠোঁট প্রসারিত করে হাসে সে। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি সেই হাসি। এত সুন্দর কেন সবকিছু!
# চলবে…
( আমাদের এদিকে প্রায় সবার ঘরে ঘরে জ্বরে আক্রান্ত সবাই। করোনায়ও আক্রান্ত অনেকে। আমিও অসুস্থ। তাই গল্প দিতে দেরি হলো। আর এক পর্ব আছে। তাড়াতাড়ি পোস্ট করবো তা। পাঠকরা আমার জন্য দোয়া করবেন এবং নিজেরাও সাবধানে থাকবেন।)