#ভালোবাসার_রোজ[পর্ব-১৪]
#আফরোজা_আনজুম
ক্লাস শেষে বেরিয়ে মিষ্টি আপুর চোখাচোখি হলাম। সে যেন আমারই অপেক্ষায় ছিল। পাশে তার ফ্রেন্ড ইমা আপুও আছে। মিষ্টি আপু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো, ” ক্লাস শেষ?”
আমি স্বভাবসুলভ হেসে হ্যা বললাম। সে বললো, ” তাহলে চলো ওদিকে যাই।”
আমিও তাদের সাথে চললাম। তার কথায় মনে হচ্ছে সে কিছু বলতে চায় আমাকে। হাঁটার মাঝে ফোন দিলাম নিঠুল ভাইকে। রিসিভ করে নি সে। মিষ্টি আপু বললো, ” কাকে ফোন করছো? গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে নাকি!”
” আজ ঐ গাড়িতে যাবো না। নিঠুল ভাইকে ফোন করছি। আমাদের বাড়ি যাবে বলেছে। তার সাথেই যেতে বলেছে।” স্বাভাবিকভাবে বললাম আমি।
” নিঠুলকে তুমি ভালোবাসো, তাই না?”
মিষ্টি আপুর কথা শুনে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। অসহায় দেখালো তাকে। আমি কী বলবো বুঝতে পারলাম না। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে সে আবারও বললো, ” নিঠুলের সাথে তোমাকে যায়! গ্রামের ভুলা ভালা সাধারণ মেয়ে তুমি। স্ট্যাটাস, রূপ, গুণ, শিক্ষা কোনোদিক থেকেই তো ওর সাথে ম্যাচ হয় না তোমার। এই ভার্সিটিতে পড়ো। দেখোই তো তোমার চেয়েও পারফেক্ট কতশত মেয়ে আছে এখানে। অনেকেরই ক্রাশ সে। এমন একটা ছেলে তোমাকে ভালোবাসে! শুনো, একটা উপদেশ দিই তোমাকে। নিজের স্ট্যাটাসের সাথে মিলে এমন কাউকে বেছে নাও। তাহলেই ভালো তোমার জন্য। উপরের লেভেলের কারো সাথে জড়িও না। নিজের লেভেল দেখো আগে।”
তার হাসিমুখে বলা কথাগুলো শুনে ভাষা হারিয়ে গেলো আমার। কী সুন্দর ঠান্ডা মাথায় হাসিমুখে অপমান করলো আমায়। তার চোখের দিকে তাকিয়ে সরাসরি জবাব দিলাম,
“আমি আগেই বুঝেছি আপনি তাকে পছন্দ করেন। তাই আমাকে এসব বলছেন তাই না! আমার লেভেল, স্ট্যটাস সম্পর্কে জানা আছে। নিঠুল ভাইও জানে সব। তার তো কোনো সমস্যা নেই!”
মিষ্টি আপু তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে বললো, ” তুমি বড্ড বোকা। ”
পাশ থেকে ইমা নামের মেয়েটা বলে উঠলো, ” বোকা বলছিস একে! বোকা হলে নিঠুলের মতো ছেলেকে ফাঁসালো কীভাবে!”
তারপর আমাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” শুনো মেয়ে, মিষ্টির সাথে নিঠুলের রিলেশন ছিল। ভার্সিটির প্রথম দিক থেকেই শুরু হয়েছিল। দুজন দুজনকে ভীষণ ভালোবাসে। এইতো কিছুদিন আগে একটা ঝামেলা হলো। আর এরই সুযোগ নিলে তুমি। নিঠুল তোমাকে ভালোবাসে না, বুঝেছো! সে তোমার সাথে কিছু সময় কাটিয়েছে মাত্র। মিষ্টি আর নিঠুল এখনো দুজন দুজনকে ভালোবাসে৷ তাদের সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে। অনেক দূর বলতে কতটুকু তা আশা করি তোমাকে ভেঙ্গে বুঝাতে হবে না। যাই হোক, এখন আবার রিলেশন কন্টিনিউ করতে চায়। এদের মাঝে শুধু শুধু এলে তুমি। তাই বলছি নিজ থেকে সরে যাও। এতে তোমারই ভালো হবে।”
স্তব্ধ হয়ে গেলাম কথাগুলো শুনে। নিঠুল ভাইয়ের রিলেশন ছিল মিষ্টি আপুর সাথে! কিন্তু সে আমাকে বলে নি। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো আমার৷ তাদের কথাগুলো বিশ্বাস হচ্ছে না। বিশ্বাস না হলেও কী। অসম্ভব কিছু তো নয়। প্রথমে তো আমারও তাই মনে হয়েছে। তার সাথে আমার মিলে না। তাইতো তার প্রতি আমার আবেগ-অনুভূতিগুলো চেপে রেখেছিলাম। সে-ই তো এলো নিজ থেকে। মিষ্টি আপুর সাথে দূরত্ব সৃষ্টির পর-ই কী সে আমাকে বেছে নিয়েছে ক্ষণিকের জন্য! কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। বুক ফেটে কান্না আসছে। মিষ্টি আপু এগিয়ে এসে বললো, ” ভালোভাবে বুঝিয়েছি। আশা করি কোনো প্রবলেম ক্রিয়েট করবে না।”
কথাটা বলেই চলে গেলো তারা। নিঠুল ভাই ফোন করছে বারবার। কল কেটে বসে পড়লাম বেঞ্চে। তার কাছ থেকে এমনটা আশা করি নি। অনুভূতিগুলো আমার মনেই থাকতো না হয়! সে কেন ক্ষণিকের জন্য নিজের শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে এলো আমার কাছে! এমন ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না।
এর দুইদিন পর নতুন ভাবি সহ পুরো পরিবারকে দাওয়াত করলো রেবা আন্টি। ঐদিনের পর থেকে নিঠুল ভাইকে ইগনোর করা শুরু করলাম। শতবার কল এসেছে বোধহয় তার। ম্যাসেজগুলোও সিন করি নি। দাওয়াতে সবাই যেহেতু যাবে তাই অগত্যা আমাকেও যেতে হলো। ঘরে একা রেখে যাওয়ার মতো কাজটা কখনো করে না আম্মুরা। তাদের বাসায় গিয়ে একবার চোখাচোখি হলো মাত্র। সে একবারও আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলো না। তখন নিশ্চিত হলাম মিষ্টি আপুর কথা ঠিক তাহলে। মিষ্টি আপু যে আমায় সব বলেছে এটা নিশ্চয়ই নিঠুল ভাইকে জানিয়েছে। আমার ধারণা ভুল হলো। বিকেলের দিকে সবাই ছাদে গেলো। খারাপ লাগছে বলে আমি গেলাম না। রিনি আপুর রুমে শুয়ে ছিলাম। একটু পর দেখলাম নিঠুল ভাই এসেছে ধুপধাপ পা ফেলে। চমকে উঠে বসে পড়লাম আমি। সে এগিয়ে এসে হিসহিসিয়ে বললো, ” এই কী সমস্যা তোর? কয়দিন পর পর কী হয়! এড়িয়ে চলছিস কেন আমাকে! সেদিন ক্যাম্পাসে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম ধারণা আছে তোর!”
হাতের কাছে আমার মোবাইল দেখে সেটা নিয়ে বিছানায় ছুড়ে মেরে বললো, ” এটা কেন রেখেছিস? আমার কল, ম্যাসেজ দেখিস নি! ভালোবাসি বলে মাথায় উঠে গেছিস! নাকি গোপনে নতুন কাউকে জোগাড় করেছিস!”
তার চোখেমুখে চরম রাগ ফুটে উঠেছে। এই চেহারা দেখে ভয় পেলাম আমি। তাও বিছানা থেকে নেমে বললাম, ” গোপনে কেন প্রকাশ্যে কাউকে জোগাড় করলেও তোমার কী? আর তোমার ফোন, ম্যাসেজের রিপ্লাই কেন করবো? আমাকে বোকা পেয়ে ব্যবহার করেছো তুমি। যেই না বুঝেছো তোমার প্রতি দূর্বল আমি অমনি তার সুযোগ নিলে। তোমার সুইটির সাথে ঝামেলা হওয়ার পর আমার কাছে এসেছো। একদম মিথ্যে অভিনয় করবে না আমাকে সাথে। সুইটির কাছে যাও না! আমি তো সরে গিয়েছি। মিথ্যে অভিনয় করতে হবে না আমার সাথে।”
বলতে বলতে কেঁদে দিলাম আমি। আমার কথা শুনে সে শান্ত হলো। এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললো, ” তোকে কে কী বলেছে বল তো! এখানে সুইটির কথা কেন আসছে?”
আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে কাঁদছি। উত্তর না পেয়ে সে আমার হাত চেপে ধরে শক্ত হাতে। পুনরায় জিজ্ঞেস করে কথাটা। তাও উত্তর না পেয়ে রেগে যায়। বলে, ” আমার রাগ উঠাচ্ছিস তুই। একটু আগের কথাগুলো বুঝিয়ে বল আমাকে। আমাকে ইগনোর করার কারণটা কী?”
” না বোঝার ভান করছো? তোমার সুইটি সব বলেছে আমায়। তাকেই তো ভালোবাসো। এর মাঝে আমার অনুভূতি নিয়েও খেললে। এখন আবার তার কাছেই ফিরে গিয়েছো।”
সে আমার হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে কঠিন চোখে তাকায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে সুইটি লেখা নামটায় কল করে লাউড স্পিকারে দেয়। ওপাশ থেকে কিছু বলার আগেই নিঠুল ভাই গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে, ” রোজকে কী বলেছো তুমি? তোমার সাথে আমার রিলেশন ছিল?”
সুইটি ওপাশ থেকে আমতা আমতা করে বললো, ” না মানে আমি তো…”
” সরাসরি জবাব দাও। তোমার সাথে আমার রিলেশন ছিল! তোমাকে কখনো এমন কিছু বলেছি বা এমন আচরণ করেছি যাতে তুমি বুঝতে পারো আমি তোমাকে ভালোবাসি?”
” তোমাকে আমি ভালোবাসি নিঠুল। সেই প্রথম থেকে। তুমি আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।”
” সেটা বুঝতে পেরে আমি তোমাকে প্রথমেই বলে দিয়েছি যে আমার মনে অন্য কেউ আছে এবং শেষ পর্যন্ত সে-ই থাকবে। আমার প্রথম ভালোবাসা সে। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে আমি ভাবতে পারি না। বলেছি?”
ওপাশ থেকে কিছু বললো না সে। নিঠুল ভাই আবার বললো, ” তাহলে তুমি কেন শুধু শুধু আমাদের মাঝে আসছো? তোমার কাছ থেকে এমনটা আশা করি নি আমি। ভালো বন্ধু ভেবেই পাশে ছিলাম। আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক ছিল তা এখানেই শেষ।”
সুইটি ওপাশ থেকে উঁচু গলায় বললো, ” তুমি যাকে ভালোবাসো সে তো তোমাকে বিশ্বাসই করে না। এমন লো ক্লাসের মেয়েকে তুমি ভালোবাসো!”
নিঠুল ভাই উত্তর না দিয়ে কল কেটে দিলো। ফোন রাখলে তার দিকে তাকাই আমি। সে আমার হাত ছেড়ে বলে, ” ছোট থেকেই সবকিছু থেকে আগলে রেখেছি তোকে, শাসন করেছি, পাশে থেকেছি। তুইও আমাকে ছোট থেকে দেখে আসছিস। একসময় ভালোবাসাটা প্রকাশও করলাম। তাও তোর এমন মনে হলো! আমার চরিত্র নিয়ে কথা বললি, সুযোগসন্ধানী ভেবেছিস আমাকে। ওকে। তোর ভাবনা আর অন্যের কথা নিয়েই থাক। আর কখনো আসবি না আমার সামনে।”
কথাগুলো বলে সে চলে গেলো। আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলো না। অবশ্য আমার কিছু বলার মুখ থাকলে তো! কিন্তু সুইটি দের কথাগুলো কীভাবে অবিশ্বাস করি! তার সাথে তো আমার যায় না। এতো এতো মেয়ে থাকতে সে আমায় ভালোবাসে কেন এই প্রশ্নটাই তো মনের ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে তারা। তাদের কথাগুলো বিশ্বাস করে নিচু মনের পরিচয় দিয়েছি নিজেকে। নিঠুল ভাই প্রচন্ড রেগেছে। তাও শান্তি লাগছে সুইটি নামের দুষ্টু মহিলাটির কথাগুলো মিথ্যে হওয়ায়।
মন মেজাজ হালকা হওয়ায় ছাদের দিকে গেলাম। ভাবী আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, ” মাথা ব্যাথা কমেছে? ”
আমি হেসে মাথা নাড়ালাম। আরমান ভাইয়াকে ডেকে বললাম, ” ভাবীর পাশে দাঁড়াও তো! তোমাদের খুব সুন্দর লাগছে। কয়েকটা ছবি তুলি।”
” নিঠুলকে দেখেছিস নিচে? আমাদের ছবি তুলবে বলে ক্যামেরা আনতে গিয়ে গায়েব হয়ে গেছে সে,” আরামান ভাইয়া বললো।
” আমি তো সোজা চলে এসেছি। দেখি নি। ”
আরমান ভাইয়া ভাবীকে টেনে পাশে দাঁড় করিয়ে বললো, ” আচ্ছা। তোর মোবাইলে তোল।”
ভাবী লাজুক হাসলো। কয়েকটা ছবি তোলার মাঝে নিঠুল ভাইকে দেখলাম ক্যামেরা নিয়ে এসেছে। সে নিজেই তুললো তাদের ছবি। পিচ্চিরা ক্যামেরা দেখেই ছবি তুলতে দৌঁড় লাগালো। দুই পরিবারের সকলের একসাথে তুললো অনেকগুলো। সবশেষে ভাইয়া ভাবীর ক্লোজ ছবিও তুললো। এর মাঝে ভুলেও আমার দিকে তাকালো না নিঠুল ভাই। মন খারাপ হলো ভীষণ। নিজে সবকিছু না জেনে অন্যের কথা শুনে সব বিশ্বাস করে নেওয়া একদম ঠিক হয় নি। এভাবেই তো সম্পর্কে ভাঙন ধরে।
#চলবে…