#ভালোবাসাটা_আমার
#রোকসানা_আক্তার
পর্ব_০৬
১৩.
নিতুকে দেখে নিতুর মা বড্ড খুশি হয়ে যান!রান্না ঘর থেকে ধূলোবালি,ময়লা,ঘামে ভরা কাপড়ে দৌড়ে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন।নিতুও মাকে জড়িয়ে ধরে।তবে খুব জোরে না।আলতোভাবে।লুৎফর আলী মেয়েকে বাসস্ট্যান্ড থেকে এগিয়ে আনেন।তিনি নিতুর ব্যাগপ্যাক গুলো নিয়ে ঘরে ঢুকেন।নিতুর মার উচ্ছাসিত গলার আওয়াজে অন্য ঘরে থেকে নিতুর ভাবী,ভাই বেরিয়ে আসে।নিতুর ভাই বলে,
“কেমন আছিস?”
নিতু পেছনে তাকায়।ভাই-ভাবীকে সালাম করে।তারপর বলে,
“ভালো।তোমরা?”
“ভালো।” (ভাই)
ভাবী পাশ থেকে আরেক প্রসঙ্গ টেনে আনে,
“তা তোমার পরিক্ষা কেমন হয়েছে?”
নিতু খানিকটা থমকে যাওয়ার মতন হয়ে গেলো!নিতুর মা নিতুর দিকে ক্ষীণ চোখে তাকিয়ে দেখেন মেয়েটা খুব ক্লান্ত।কথা বলার পরিস্থিতি নেই।বউকে বলে,
“বউ মা? ফলাফলের কথা পরে জিজ্ঞেস করো।মেয়েটা এত দূরের পথ থেকে আসছে আগে একটু বিশ্রাম নিক।”
“আসলে বাবা সব টাকা তো নিতুর জন্যে ঢালে তাই মেয়েটা কেমন রেজাল্ট করে তা আমাদের জানা কর্তব্য না?আর আমরা তো জানি নিতু পড়াশুনায় ভালো। রেজাল্ট খারাপ করবে না।”
বলে নিতুর ভাবী বিচিত্র্য হাসে।
ফারুক বলেন,
“নিতু যা ঘরে যা।আগে যেয়ে ফ্রেশ হ।পরে কথা হবে।”
নিতু মাথা নেড়ে পর ঘরের দিকে পা বাড়াতেই সামনে পড়ে তার ছোট্ট বোন মিতা।সে নিতুকে ওমনি জড়িয়ে ধরে,
“ওহ আপু,তুমি আসছো?আমার জন্যে পুতুল এনেছো?মাটির পুতুল?”
নিতু ওর ব্যাগের দিকে তাকায়।আগের বার বাড়িতে এসেছে আর মিতা বায়না তুলেছে ওর কোন বান্ধবীর বাবা বান্ধবীর জন্যে নাকি একটা মাটির পুতুল এনেছে।তাই সেরকম একটা মাটির পুতুল ওকেও এনে দিতে।বোনের আবদার রাখতে নিতু আজ আসার সময়ই শাহবাগ থেকে মিতার জন্যে একটা মাটির পুতুল কিনে নিয়ে আসে।জানে আসলেই মিতা তাকে পুতুলের কথা জিজ্ঞেস করবে প্রথমে।নিতু মিতাকে ছাড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা লাল রঙ্গের মাটির পুতুল বের করে তা মিতার হাতে তুলে দেয়।তা দেখে মিতা সে কি খুশি হয়ে যায়!আর ওমনি নিতুর গাল জুড়ে তিন চারটা চুমু বসিয়ে দেয়!
“ধন্যবাদ,আপু।ধন্যবাদ।”
বলে পুতুলটা নিয়ে ওমনি বান্ধবীদের বাড়ি দৌড় মারে !হয়তো পুতুল টা ওকে দেখাতে।নিতু ওর ঘরে আসে।এসে দরজা চাপিয়ে বিছানায় আলতো বসে।জানলা দিয়ে বাইরে চোখ পড়ে।বাবা মাকে কাজের তাগাদা দিচ্ছেন শুধু।তাগাদার কিছু কথার আওয়াজ নিতুর ঘরেও ছিটকে আসছে,
“তাড়াতাড়ি করো না?মেয়েটা আমার খিদে লেগেছে!কিচ্ছু খায়নি আজ সারাটা রাস্তায়।তাড়াতাড়ি করো!”
নিতুকে সেদিকে তাকিয়ে থাকার মাঝেই ওর দুই চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রু বেরিয়ে পড়ে।বুকটা ভারী হয়ে আসে।পরক্ষণে আবার নিজেকে ধাতস্থতা করে।
১৪.
চোখের উপর সূর্যের কচকচা আলো পড়তেই নিতুর ঘুম ভেঙ্গে যায়।তাকিয়ে দেখে তোহা জানলাটা খুলে দিয়েছে।নিতু ড্যাবড্যাবা চোখে তোহার দিকে তাকিয়ে থাকে।তোহা হেসে উঠে বলে,
“কিছুদিন আগেই তো বেড়িয়ে গেলি।এখন আবার হঠাৎ করে কি মনে করে এসেছিস?দুলাভাই বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসবে নাকি?”
বলে তোহা চোখ টিপ মারে।”দুলাভাই ” শব্দটা তোহা রিহানকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তা নিতু বুঝলো।নিতু ওমনি ঝাঁজিয়ে উঠলো,
“তোহা?এসব আর কখনো আমার বলবি না!”
বলে পাতলা কম্বল গাঁ থেকে সরিয়ে খাট থেকে নেমে বেরিয়ে আসে।তোহাও নিতুর পেছন পেছন বেরিয়ে আসে।তোহা বলে,
“আহা,রাগ করছিস কেনো?ভুল বললাম নাকি?”
নিতু পুকুরপাড়ে চলে এসেছে।কাঠ দিয়ে পাতানো ঘাটে নেমে পড়ে।হাত দিয়ে দাঁত কচলে দাঁত পরিষ্কার করে।মুখে পানির ঝাপসা মারে। নিতুকে তোহা ওই প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে না দেখে আবার বলে উঠে,
“কিরে?রাগ করলি নাকি আবার আমার কথায়?”
নিতু এবারো জবাব দেয়নি।মুখ ধোঁয়া শেষ হলে ঘাটলা থেকে আবার উপরে উঠে আসে।তোহা আবার বলে,
“এই মেয়ে তো দেখি সত্যি সত্যি রাগ করে বসেছে আমার উপর!এই কথা বলছিস না কেনো?”
নিতু ঝাঁকি মেরে তোহার হাত সরিয়ে দেয়,
“ধরবি না আমাকে!”
“আমি কি মন্দ বলেছি রে?তোর রাজকুমার যদি সত্যি একদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে তখন?”
নিতু তোহার দিকে সরু চোখে তাকায় এবার।উদাস গলায় বলে,
“ভালোবাসা বলতে পৃথিবীতে কিছু নেই!”
বলে পাশ কেঁটে চলে আসে।তোহা ওর স্থির হয়ে থাকে।তোহার কেনজানি এখন মনে হচ্ছে নিতু ভালো নেই।নিতুর মন ভীষণ খারাপ!তবে,কী কারণ!
১৫.
দুই বান্ধবী একটা টঙ্গয়ের উপর পাশাপাশি বসে আছে।নিতুর দৃষ্টি শূন্য।আর তোহার দৃষ্টি নিতুর দিকে স্থির।তোহা এবার হঠাৎ করে বলে উঠে,
“নিতু?কোনো কারণে কি তোর মন খারাপ ?রিহান নামের ওই ছেলেটা তোকে কিছু বলেছে?”
নিতু তোহার দিকে তাকায় একপলক।পরক্ষণে দৃষ্টিটা আবার শূন্যে তুলে নেয়।ওমন দৃষ্টির মাঝে ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে নিতু।বলে,
“আমার না পড়াশুনা করতে আর ভাল্লাগে না!ওই শহর, ভার্সিটি কেমন বিরক্তিকর বিরক্তিকর লাগে!বাবাকে বলতে ইচ্ছে করে জেলার কলেজে ভর্তি করিয়ে দিতে।”
“কেন রে,নিতু?কিছু হয়েছে?”
বলে তোহা এবার নিতুর খুব কাছে এসে বসে।নিতু চুপ করে থাকে।তোহা আবার বলে,
“নিশ্চয়ই রিহান ছেলেটাকে নিয়ে কিছু হয়েছে, না?”
নিতু তোহার চোখের দিকে তাকায়।বলে,
“কাউকে কখনো মন থেকে ভালোবাসিস না।ভালোবাসলে নিজের জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে।এই যে দ্যাখ,আজ পরিক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে বাসায় ফিরে এসেছি।অথচ,মা-বাবা কতটাই না স্বপ্ন বুনে রেখেছে মনে!উনাদের স্বপ্ন আর মনে হয় না পূরণ করতে পারবো!নিজের উপর নিজেরই ঘৃণা লাগছে এখন!”
তোহা এবার নিতুর অবস্থা বুঝে ফেলে!নিতু কাঁদছে।অঝোর ধারাতে অশ্রু ফেলছে।তোহা নিতুর কাঁধে হাত রাখে।ধাতস্থতা করতে করতে বলে,
“লাইফ কারো জন্যে থেমে থাকে না।তুই জানিস এটা, নিতু?আরেহ,কীসব নিয়ে নিজের ক্যারিয়ার শেষ করতেছিস!মা-বাবা কত কষ্ট করে পড়াশুনা করাচ্ছে।বাবা দিনের পর দিন গাধার মতন দোকান নিয়ে খাটছে।মা কাঁথা,পাঁটি বানিয়ে আশপাশের লোকদের কাছে বেচে টাকা নিচ্ছে। নিজেদের সব কষ্ট,রত তোর উপর ঢালছে।স্বপ্ন তোকে মানুষের মতন মানুষ করতে।তুই অনেক বড় হতে!আর সামান্য একটা ছেলের জন্যে বলছিস ওই শহর ভাল্লাগে না।ও-ই ভার্সিটি ভাল্লাগে না!ওরকম ভার্সিটি ক’জনের কপালে হয় রে নিতু?কষ্ট করে চান্স পেয়েছিস। তার মূল্য তো বোঝ!কত ছেলেমেয়ে ওই ভার্সিটিটাকে পেতে কত নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি,মোনাজাতে হাত ধরেছে।তাদের হয়তো অনেকেরই হয়নি!আর তোরইল?আমি পৃথিবীর নিকৃষ্ট বোকা তোকে বলবো যদি আরেকবার বলিস ওই ভার্সিটি ভাল্লাগে না।এখানে ভর্তি হবি!”
নিতু এবার জেনো আরো ফুঁপরে কেঁদে উঠলো।বললো,
“আমার ভার্সিটির ফ্রেন্ড গুলো ভালো না।আমাকে খুবই করুণ চোখে দেখে।কথায় কথায় তামাসা করে।
আমি ওই ভাইয়াকে প্রপোজাল দিয়েছি বলে!আমি ব্যাসিকেলি ওদের সবার জন্যে পরিক্ষায় খারাপ করেছি।পড়ালেখায় মন বসাতে পারি নি।নিজের আজ খুব অনুতপ্ত হচ্ছে!কেনো সেদিন ভাইয়াকে প্রপোজাল দিলাম।আর কেনই বা আজ মা-বাবার স্বপ্নকে ভেঙ্গে চুরমার করেছি!”
“স্বপ্ন তোর শেষ হয়নি,নিতু!স্বপ্ন দেখা সবে শুরু!একটা কথা জানিস কি?মানুষ ভুল থেকে শিখে!হ্যাঁ, আমি বলছি এই তোর বান্ধবী বলছে তুই সবকিছু উপেক্ষা করে আবার নিজেকে নতুন করে গড়ে তুলতে পারবি।ভুলে যা সব।কি হয়েছে,কি ঘটেছে সব ভুলে যা।শুধু বলদের মতন সারাদিন খাটুনি দেওয়া মা-বাবা দুজনের দিকে তাকা!
চলবে….
(কি মনে হয় আপনাদের?নিতু কি পরিবর্তন হবে?)