#ভালোবাসাটা_আমার
#রোকসানা_আক্তার
#পর্ব_০৪
৫.
আজ চারদিন পার হলো নিতু ভার্সিটিতে গেলো না।সারাক্ষণ নিজের পশ্চিমের কোণায় পাতানো বিছানায় নিরিবিলি একা বসে থাকে!আবার বারান্দায় যেয়েও বসে থাকে।প্রিয়া রুমে এলে যদি তাকে জিজ্ঞেস করে,
“ভার্সিটিতে যাবে না?”
নিতুর ঠান্ডা-শীতল উত্তর দেয়,
“নাহ।”
প্রিয়াও আর কিছু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে না।নিজ মগ্নতায় ব্যস্ততায় হয়ে আবার চলে যায়।কিন্তু নিতু এই ক’দিন যে ভার্সিটিতে যায়নি তার খুব লস হয়েছে।স্যাররা মিড টার্ম এক্সামের অনেক টপিকের উপর লেকচার দিয়েছে হয়তো।আবার কিছু কঠিন জিনিসের হিংসও দিয়েছে!এই বিষয়গুলো একজন শিক্ষার্থীর জন্যে কতটা যে গুরুত্বপূর্ণ তা নিতু বুঝে!তারপরও তার ভার্সিটিতে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।মন চায় এই ভার্সিটি,এই কোলাহল শহর ছেড়ে নিজের সেই সরলা-নির্মল, যেখানে প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নেওয়া যায় সেই ছোট্ট গ্রামটায় ফিরে যেতে!নিতুর কল বেজে উঠে।মন না চাইলেও নিতু এবার ফোনের দিকে তাকায়।স্ক্রিনের উপর ভেসে উঠে-“বাবা!”
গ্রাম থেকে তার বাবা কল করেছেন।কেনজানি এবার হঠাৎ নিতুর ভেতরটা হু হু করে উঠে বাবার সাথে কথা বলতে।এই কয়দিন পরিবারের কারো সাথেই কথা বলা হয়ে ওঠে নি তার তেমন!সে অচাঞ্চল্যকর হাতে ফোন তুলে নেয় নিতু।রিসিভ করে বলে,
“বাবা!”
“কেমন আছিস,মা?দুইদিন পর তোর নাকি পরিক্ষা?”
নিতু নিচের দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা শ্বাস ছাড়ে।তারপর কন্ঠে জোর এনে বলে,
“হ্যাঁ,বাবা।”
“পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত খুব,না মা?এই তোর মা আছে না খালি বলে তোকে কল করতে,কল করতে!কিন্তু আমি বলি মেয়ের সামনে পরিক্ষা!এখন আমরা কল করলে মেয়ের পড়াশুনায় ক্ষতি হবে।তা তোর মা বুঝতেই চায়না।এখন আমাকে জোর করে তোর কাছে কল করতে হয়েছে।”
নিতু হাসলো।নির্ভঙ্গিতে হাসলো।হাসি থামিয়ে বললো,
“মা কেমন আছে,বাবা?”
“ভালো আছে।
“মা ঠিকমতো প্রেশারের ওষুধ খায়?”
“খায়।”
“মার প্রেশার এখন কেমন?”
“আহা,আমাদের নিয়ে আর ভাবিস না তো?নিজের পড়াশুনায় মন দে।আর টাকাপয়সা লাগবে?যদি লাগে আমারে এখন বল।আমি করিমকে দিয়ে তোর বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“নাহ বাবা।লাগবে না।”
“লাগবে না বললে তো হবে না।সামনে পরিক্ষা!ভালোমন্দ নিজে কিনে কিছু খাইস!হলের খাবারে পুষ্টি নাই।ডিম,দুধ কিনে খাইস।আমি ১ হাজার টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি একটু পরই।”
“ব-বাবা…লাগব…!”
কলমটা কেঁটে গেলো।নিতু বুঝলো তার বাবা কলটা কেঁটে দিয়েই করিমদের বাড়ি ছুটছে তার বিকাশে টাকা পাঠানোর জন্যে।নিতুর বাবা এটা প্রায়ই করে।নিতু ঢাকায় আসার পর থেকে সে টাকার কথা না বললে তার বাবা তাকে প্রতি মাসে চার হাজার করেপাঠিয়ে দেয়।খুব কষ্ট করেই পাঠায়।বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা মুদি দোকান তাদের।তা থেকেই যা আয় হয় সব ওকে দিয়ে দেয়।মেয়ে ঢাকার শহরে একা।আত্মীয়-স্বজন তাদের কেউ নেই।আল্লাহ না করুক বিপদআপদ আছে।অনেক সময় বিপদে পড়লে দেখা যায় টাকাই শেষ ভরসা!তাছাড়া,মেয়ের সাজপোষাকের খরচ,ফোন খরচ, আরো কত হাত খরচা লাগে।
৬.
নিতু বেলকনি থেকে এসে ফোনটা টেবিলের উপর রাখলো।প্রিয়া তখন ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্যে বইপত্র গোছাচ্ছিল। নিতুকে দেখে বললো,
“মা-বাবাকে বলেছো যে ভার্সিটিতে যাও না?”
নিতু চুপ করে রইলো।প্রিয়া আবার বললো,
“বলে দিও!আরো বলে দিও,বাবা একজনের প্রেমে পড়ছি। তারজন্যে ভার্সিটতে যাওয়া ছেড়ে দিছি! ”
বলে প্রিয়া হাসলো।তারপর আবার তার বইপত্র গুলো এক সপাটে ব্যাগে ঢুকিয়ে ভার্সিটিতে যেতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।নিতু ওইভাবে খানিকক্ষণ দাঁরিয়ে থাকলো।দাঁড়িয়ে থাকার মাঝে নিতুর ফোনে এসে.এম.এসের শব্দ বেজে উঠলো।নিতু দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়ই ফোনের দিকে তাকালো।তার বাবা বিকাশে টাকা পাঠিয়েছেন ১ হাজারের মতন।নিতু এবার মনকে শক্ত করলো!চোখের কোণের পানির মুছলো।বাবার কত কষ্টের টাকা!এত কষ্টের টাকায় সে এখানে এভাবে চলছে…!ভার্সিটিতে যাচ্ছে না!নাহ,আজ ভার্সিটিতে যাবে।যে যেরকম ইচ্ছে ভঙ্গিমা করুক।যা ইচ্ছে বলুক….!
৭.
ক্যাম্পাসে এসে বুঝতে পারে নিতু তাকে নিয়ে পুরো ক্যাম্পাস হাসিঠাট্টা করছে…!পুরো ক্যাম্পাস বললে ভুল হবে আবার।বিশেষ করে তার ক্লাসমেটগুলা।বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের মেয়েগুল যারা রিহান ভাইয়ার ক্রাশ খেয়ে আছে।আর রিহান ভাইয়ার ডিপার্টমেন্টের ওরা!নিতু চোখবুঁজে, ব্যাগ শক্ত করে খাঁমচে ধরে ওর ডিপার্টমেন্টের দিকে এগুলো।এমন সময় পেছন থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো,
“ওরেহ,ভাবী যায়,ভাবী যায়!..”
নিতু বুঝলো না কোন ছেলে তাকে “ভাবী” বলে সম্বোধন করলো।তারপরও নিতু পেছনে তাকালো না।সে তার নাক বরাবর সোঁজাই হেঁটে গেলো তার ক্লাসরুমের দিকে।তার ক্লাসরুমে ঢুকলো।ঢুকা মাত্রই ক্লাসের সবাই ওকে দিয়ে চিৎকার মেরে উঠলো।একজন বলেই উঠলো,
“রিহান ভাইয়া তোমাকে কত্ত মিস করেছে!আর তুমি ভার্সিটিতে আসলে না?”
আরেকটা মেয়ে,
“ভাইয়ার সাথে ফোনালাপ হয়েছে তাই না?রাত জেগে কথা বলতে।দিন শুধু ঘুমতে।ভার্সিটিতে আর কীভাবে আসতে!হাহা হাহাহা….!”
আবার আরেকটা মেয়ে,
“রাতে কী ওসব কথাও বলো..?”
নিতু এবার ঝাঁঝ গলায় চিৎকার দিয়ে উঠলো।কান চেপে ধরে বলে উঠলো,
“দয়া করে চুপ করো,সবাই!দয়া করে..!আমি আর নিতে পারতেছি না..!”
এমন সময় আরিফুল স্যার ক্লাসে ঢুকেন।সবাই ওমনি চুপ হয়ে যায়।তারপর সবাই যে যার সিটে বসে যায়।নিতুও তার সিটে বসে।আরিফুল স্যার ক্লাস শুরু করেন তার।ক্লাস শেষ হলে কোথায় থেকে একজন সিনিয়র ভাই ক্লাসে ঢুকেন।সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠেন,
“তোমাদের মাঝে নিতু কে?”
সবাই ওমনি ড্যাবাড্যাবা চোখে নিতুর দিকে তাকায়।মনে ভয় আর সংকোচ নিয়ে নিতু উঠে দাঁড়ায়।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে,
“জ্বী,আ-মি!”
সিনিয়র ভাইটি বলেন,
“ক্যাফেটেরিয়ায় আসতে পারবে?তোমার সাথে রিহান তোমাকে করতে ডেকেছে!”
এ’কথাটা বলা মাত্রই পাশের একটা ছেলে শিষ বাঁজিয়ে উঠলো।ভ্রু নাঁচিয়ে অন্য ছেলে মেয়েদের বলে উঠলো,
“ওরেহ,এবার জমবে খেলা!”
নিতুর ভেতরের ভয়টা এবার দ্বিগুণ হলো।সে প্রায় অসংযত।রিহান ভাই তাকে ডাকছে কেনো?কিন্তু কারণে ডাকছে?কোনো ভুল আবার করেছে সে?ভাবনার মাঝে সিনিয়র ভাইটি বলেন,
“তোমার এখন আর কোনো ক্লাস আছে?”
নিতুর অন্য একটা ক্লাসমেট জবাব দিয়ে উঠলো,
“এখন ব্রেক সবার।টিফিন টাইম।”
“ওহ।তাহলে নিতু তোমার এখন আসতে তো আর সমস্যা হবে না আই থিংক!”
নিতু মাথা নাড়লো।মানে -“যেতে পারবে।”
৮.
শক্ত কাঠের চেয়ারে বসে আছে নিতু।আর তার সামনে রিহান ভাই!রিহান নিচের দিকে তাকিয়ে টেবিলের উপর তার হাতের পেন টা বারবার ঘুরচ্ছে!দুই মিনিটস হলো এরকম যে ঘুরচ্ছেন না।নিতু এসে বসেছে তিন মিনিট।তিনি এখনো নিতুকে কিছু বলছেন না।কী কারণে ডেকেছেন তার কারণও বলছেন না।নিতু নিচের দিকে তাকিয়ে আছে!রিহান এবার পেন ফুরানোর মাঝেই বলে উঠলো,
“সেদিন খুব ভালো করেই বুঝিয়ে বললাম।চিঠি টার উত্তরও দিয়ে দিলাম।তারপরও ক্যাম্পাসে ট্রল শুরু হলো কেন!”
নিতু রিহানের এ’কথাগুলোর ঠিক মানে বুঝলো না!সে চোখমুখ কুঁচকে এনে বললো এবার রিহানকে,
“ম-মানে?”
রিহান এবার পেন সম্মেত টেবিলের উপর খুব জোরে একটা বারি মেরে উচ্চ আওয়াজে বলে উঠলো,
“ছোট্ট খুকি তুমি?পিডার খাও?মানে বুঝো না!?ক্যাম্পাসে এসব কি শুরু করেছো তুমি?কি শুরু করেছো?আমাকে নিয়ে এসব কি শুরু করেছো?!সেদিন এত সুন্দর করে বুঝিয়ে দিলাম।সুন্দর করে বললাম!তারপরও এসব কী?” কী এসব!”
“ভাইয়া,আমি সত্যিই আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না!আসলে আপনি কী বলতে চাচ্ছেন?!”
“এই মেয়ে?সাহস তো কম না!আবার নাটক শুরু করেছো!সারা ক্যাম্পাসে আমার মান-ইজ্জত রাখলে তুমি?রাখলে?এসব কি বলতেছে সবাই?কি বলতেছে?তোমাকে আমি ভালোবাসি?তোমার সাথে আমার রিলেশন চলে?কত মেয়েই তো এই পর্যন্ত আমাকে প্রপোজাল দিলো।রিজেক্ট করলাম।কই তাদের ক্ষেত্রে তো পুরো ক্যাম্পাস এভাবে বাজে নি।আর তোমার একটা মেয়ে আমাকে জাস্ট প্রপোজাল দিয়েছে এটা সারা ক্যাম্পাস….!ভাবতেও অবাক লাগে!ভীষণ অবাক লাগে!..
চলবে…..