#ভালবাসা_রং_পাল্টায়_না(অন্তিম পর্ব)
সেই আকুতি ভরা চোখ জোড়া রুমকিকে এতগুলো বছর তাড়া করে বেড়ালেও ভালোবাসা নামক জিনিসটার সাথে পরিচয় হয়নি তার। আজ বুঝতে পারছে এই মানুষটাকে সে প্রচণ্ড রকমের ভালোবাসে। এবং সেই ভালোবাসা আজ থেকে নয় ছোটবেলা থেকেই।
ঠিক সেই মুহূর্ত থেকেই রুমকিকে যেন বোবায় ধরল। কোন কথা না বলে কেবল তানজীদের কথাগুলো মন দিয়ে শুনল আর সেই সাথে অপলক দৃষ্টিতে তানজীদকে দেখতে লাগল। রোদে একেবারে লাল হয়ে আছে। ছেলে হিসেবে অনেক ফর্সা তানজীদ। কিন্তু এই ছেলেকে বাজে লাগে না বরং ভীষণ রকমের সুদর্শন লাগে কেবল এই ফর্সা রঙের জন্য।
কি যেন জাদু আছে এই ছেলের মাঝে। মুহূর্তেই যে কারো সাথে মিশে যেতে পারে, পলকেই যেন আপন করে নেয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে এই ছেলের মাঝে। অনেক ঘুরল, আড্ডা দিল। এরপর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে রুমকিকে বাসায় নামিয়ে দিতে এলে রুমকি বেশ করে বলল বাসায় আসার জন্য। কিন্তু তানজীদ এলো না, কাজ আছে বলে চলে গেল।
রুমকি যখন বারেবারে বাসায় যাবার জন্য অনুরোধ করছিল তানজীদের আর কেন যেন ভীষণ সংকোচ বোধ হচ্ছিল অথচ কালও সে একটা ডাকের অপেক্ষায় ছিল। মানুষ মনে হয় পলকেই অনেক খানি পরিণত হয়ে যায়!
এরপর দুজনের যোগাযোগ হয়ে গেল মুঠোফোনের হাতে বন্ধী। বেশীরভাগ সময় তানজীদ নেটওয়ার্কের বাইরে থাকত। আট বছর চোখের পলকে কেটে গেলেও এখন এই এক বছর সময় যেন কাটতেই চায় না। সব মিলিয়ে দুজনের কারো সময় ভালো যাচ্ছিল না। এর মাঝে তানজীদ জানাল পরের মাসেই তাদের শীপ বাংলাদেশ আসছে। তখন সে কিছুদিন ছুটি পাবে।
দুজন মিলে কত প্ল্যান। রুমকির বাবা ইদানিং কেন যেন ওর বিয়ে নিয়ে উঠে পরে লেগেছেন। তানজীদ এই ব্যাপারটা নিয়ে ভীষণ অস্থিরতায় আছে। প্রথমত তার এখনো ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে জয়েন করার অনেক বাকি। কি বলে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে রুমকির বাসায়? অবশ্য ওর বাবা মা শুরুতে আপত্তি জানালেও ওর পছন্দের কথা জেনে না করবেন না। কিন্তু রুমকির বাসায় কি করে কি হবে? রুমকি ওর বাবা মা কে কিছু জানানোর সাহস পাচ্ছে না এই ব্যাপারে। বয়সে ছোট ছেলে শুনে ওর বাবা মা শুরুতেই বেঁকে বসবেন।
তানজীদের সাথে কথা হয়েছে প্রায় সপ্তাহ খানেক। ও বারবার বলছিল সামনে কিছুদিন নেটওয়ার্কের বাইরে থাকবে। প্রায় এমন হয়। কিন্তু কখনো রুমকির এমন লাগে না। দুইতিনদিন ধরে কেমন যেন অস্থির লাগছে রুমকির। ঘুমুতে পারছে না ঠিক মতো, খাওয়ার রুচি নেই, রাতে কেবল তানজীদকে স্বপ্ন দেখে। সারাদিন মোবাইল নিয়ে বসে থাকে, পাছে তানজীদ কল বা মেসেজ দেয়।
এমনি এক সময় হঠাৎ তানজীদের কল পেল। খুশীতে আত্মহারা মন ময়ূরের মতো পেখম মেলে নাচতে শুরু করল। রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে তানজীদের উৎকণ্ঠিত কন্ঠ শুনতে পেল।
রুমকি কিছু বলতে যাবে কিন্তু তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে লাগল
-শোন ভালো করে। আমরা ঝড়ের কবলে পড়েছি। একটু আগে নেটওয়ার্ক পেয়েছি। পেয়েই প্রথমে আব্বু আম্মুকে কল দিয়েছি এখন তোমাকে। বেঁচে থাকলে দেখা হবে। আর না থাকলে ভুলে যেও। সব কিছু ভুলে নতুন জীবন শুরু করো।
এই কথাটুকুই কেবল শুনতে পেল রুমকি। এরপর তানজীদ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল এমন সময় লাইন কেটে গেল। রুমকি যেন নির্বাক হয়ে গেল। এ কি শুনল সে? কেবল সবে স্বপ্ন বোনা শুরু করেছে, এরমাঝে এসব কি বলল তানজীদ। ভুলে যাবে মানে? সব কিছু কি এতো সহজ?
সারারাত মোবাইল হাতে নিয়ে ঠাই বসে ছিল আর একটু পরপর তানজীদের নাম্বারে কল করছিল। কিন্তু লাইন পাচ্ছে না।
তানজীদের কোন খবর পাওয়া যায়নি। ডুবন্ত শীপ উদ্ধার করা হয়েছে। অনেকের মৃতদেহ মিলেছে, সৌভাগ্যবান দুই একজনকে অবশ্য মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। আর তানজীদের মতো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে।
পুরো পরিবারে যেন শোকের ছায়া নেমে এসেছে। রুমকির অস্বাভাবিকতা দেখে যখন ওর বাবা মা কিছু বুঝতে পারছিল না তখন রুবানা সব জানায়। এতে করে একটা উপকার হয় রুমকির বাবা ওর বিয়ের বিষয়টা আপাতত বন্ধ রাখেন। রুমকিকে স্বাভাবিক হতে সময় দেন।
কিন্তু রুমকি কেন যেন স্বাভাবিক হতে পারে না। মাঝ রাতে প্রায় তার ঘুম ভেঙ্গে যেন তানজীদের কণ্ঠ শুনতে পায়। সেই নার্সারির সামনে দিয়ে যাবার সময় গাছগুলো দেখে। ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে গাছগুলো। এটাই তো হওয়া উচিৎ। সময়ে্র সাথে সাথে সবকিছু পরিবর্তন হবে। গাছগুলোতে একসময় ফুল আসবে। কি করবে রুমকি তখন?
বাবা মায়ের অনেক অনুরোধ, বকাঝকা সব কিছু উপেক্ষা করে যাচ্ছে। সে কিছুতেই তানজীদকে তার মন থেকে সরাতে পারছে না। বলতে গেলে সেই একদিনের দেখা, আর কয়মাস ফোনে টুকটাক কথা। এতেই এতো মায়া জন্মায় কি করে? আসলেই কি মায়া? না ভালোবাসা?
আত্মীয়স্বজন সবাই অনেক করে বুঝিয়েছে কিন্তু কোন লাভ হয়নি। রুমকির সেই এক কথা তানজীদের লাশ তো পাওয়া যায়নি। এমনও হতে পারে সে বেঁচে আছে। কোন একদিন ফিরে আসবে। তখন? তখন রুমকি কি জবাব দিবে ওকে?
সবাই অনেক করে বুঝাল, পুকুরে ডুবে গেলেও একটা সময় পর আর আশা করা যায় না, আর তানজীদ ছিল মাঝ সমুদ্রে তাও আবার ঝড়ের মাঝে। কিন্তু রুমকি কোন কিছু মানতে নারাজ। সে কোন যুক্তির ধার ধারে না। ওর বাবাও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। মেয়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কেন যেন যেতে ইচ্ছে হয়নি উনার আর। ছোট মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করতে লাগলেন।
আর রুমকি? সে ঝুম বৃষ্টিতে সেই কদম গাছের নীচে বসে অপেক্ষায় থাকে হয়তো তানজীদ আসবে এই ঝড় মাথায় করে। এসেই তার সাথে ভীষণ রাগ দেখাবে এমন ঝড়ের মাঝে বসে থাকার জন্য। অপেক্ষায় থাকে রুমকি অন্তত রাগ দেখানোর জন্য হলেও মানুষটা আসুক। একবার হলেও আসুক।